Köy Enstitüsü (Village Institute), যে প্রজেক্টকে আজকের উন্নত তুর্কী শিক্ষা ব্যাবস্থার মেরুদন্ড বলে অভিহিত করেন অনেক শিক্ষাবিদ্গণেরা।
সালটা ১৯২৬, তুর্কী প্রজাতন্ত্র গঠনের কেবল মাত্র তিন বছর হয়েছে, তখনই এক যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করে আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক এর গঠিত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয়। প্রথমে এটি ছিলো কেবলই গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়ার একটি প্রজেক্ট; পরে এটি বৃহদাকার ধারণ করে। এই প্রজেক্টটি মূলত মার্কিন দার্শনিক তথা শিক্ষাবিদ জন ডিউই এর “উপযোগবাদী শিক্ষা দর্শন” এর উপর ভিত্তি করে সাজানো। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এটি köy öğretmen okulu (গ্রাম শিক্ষকের স্কুল) নামে পরিচিত ছিলো। ১৯৩৮ সালে তৎকালীন তুরস্কের শিক্ষামন্ত্রী ‘হাসান আলি ইউজেল’ ব্যাক্তিগতভাবে এই প্রজেক্টটি পরিচালনা করেছিলেন এবং নামকরণ করেন Köy Enstitüsü (Village Institute); তাই ওনাকে এই প্রজেক্টের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, সেই সময় তুরস্কের ৩৫,০০০ গ্রামে একটিও প্রাইমারী স্কুল ছিলোনা! সেজন্য দূরদূরান্ত থেকেও শিক্ষার্থীরা এসব স্কুলে পড়তে আসতো। এ ধরণের ইন্সটিটিউট ছিলো মোট ২১ টি। তন্মাধ্যে সবচেয়ে নামকরা ছিলো Hasanoğlan Köy Enstitüsü (হাসানও’লান ভিলেজ ইন্সটিটিউট)। এই ইন্সটিটিউট টি ১৯৪১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চালু ছিলো। এই ইন্সটিটিউট টি ছিলো তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামে। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে এই ইন্সটিটিউট গুলোর কার্যক্রম Türkiye Cumhuriyeti Millî Eğitim Bakanlığı (তুরস্ক শিক্ষা মন্ত্রনালয়) এর তরফ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তো চলুন, একটু বিস্তারিত জেনে আসা যাক এই সাড়া জাগানো প্রজেক্টটি সম্পর্কে। আগেই বলেছি, এই ইন্সটিটিউট গুলো তৈরীর মতাদর্শ মূলত জন ডিউই’র উপযোগবাদী শিক্ষা দর্শণ থেকে নেওয়া; যেখানে ডিউই বলেছিলেন, গ্রামীণ স্কুলগুলোকে সেখানকার সম্প্রদায়ের জীবনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। তাই এই ইন্সটিটিউট গুলোতে সাধারণ পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি জীবনধর্মী শিক্ষা গ্রহণ ও বাধ্যতামূলক ছিলো। জীবনধর্মী ও ব্যাবহারিক শিক্ষার মধ্যে ছিলো মূলত, দুগ্ধ খামার, পশুপালন, রেশম চাষ, বনায়ন, মধু চাষ এবং উন্নত চাষাবাদ প্রক্রিয়া এবং এর যন্ত্রপাতি পরিচালনা। এধরণের শিক্ষা গুলো আবার সব ইন্সটিটিউটে এক ছিলোনা; যেই গ্রাম যেই ধরনের চাষাবাদের উপযুক্ত সেখানে সেই ধরনের শিক্ষা দেওয়া হতো। আর মেয়েদের জন্য ছিলো কার্পেট তৈরী, সেলাই, দুগ্ধজাত পণ্য তৈরীর মতো শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিদিন ঠিক সকাল ৭ঃ৩০ এ স্কুল শুরু হতো। দুপুর ১২ঃ৩০ পর্যন্ত চলতো পুঁথিগত বিদ্যাশিক্ষা; এরপর দুপুরের খাবার। তারপর শুরু হতো জীবনধর্মী ও ব্যাবহারিক শিক্ষার ক্লাস। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে কোন গতানুগতিক ক্লাস হতো না; এদিন সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা মিলে পুরো সপ্তাহের শিখণগুলো ঝালিয়ে নিতো। স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিলো অনেকটা বন্ধুর মতো; শিক্ষকেরা শিক্ষক নয়, বরং সাহয্যকারী এর ভূমিকায় ই থাকতো বেশিরভাগ সময়। এছাড়াও সাহিত্য, ইতিহাস তথা বিভিন্ন ধরনের কলা ও মানবিক বিষয়ের শিক্ষা গ্রহণও ছিলো বাধ্যতামূলক; কিন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের নিজের ইচ্ছামতো এগুলো পছন্দ করতে পারতো।
তুরস্কের শিক্ষা মন্ত্রনালয় এবং শিক্ষাবিদেরা তখনই উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন, যেহেতু আমাদের জন্যসংখ্যার অধিকাংশই গ্রামে বাস করে, তাই তাদেরকে পিছনে ফেলে আমরা কখনোই জাতী হিসেবে উন্নত হতে পারবো না! আর তুর্কীদের জাতীস্বত্ত্বা নিয়ে যারা জানেন, তারা তো জানেনই নিজেদের দেশ এবং জাতীকে তারা কতটা ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। এই সদ্য ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের কথা যদি ভাবেন, ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার মানুষদের জন্য এরা যে যা পেরেছে করেছে; সরকার না, আমি জনসাধারণের কথাই বলছি। স্কুল, কলেজ, অফিস ফেলে দিয়ে এরা চলে গিয়েছে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সেবা করতে, ঐ সকল এলাকায়।
যাইহোক, আসল কথায় ফিরে আস যাক, তুরস্কের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ভাষ্যমতে বেশ কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মাথায় রেখে এই ইন্সটিটিউট গুলো তৈরী করা হয়। প্রথমত, এই ইন্সটিটিউট গুলোর সাথে অন্যান্য স্কুল গুলোর পার্থক্য খুজে বের করা। দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলের আবাদি জমিগুলো যোগ্য মানুষের হাতে দেখাশোনার ভার দেওয়া। তৃতীয়ত, পুরো দেশ কে একই সাথে উন্নত করা এবং সকল জনগণের জীবনযাত্রার মানে ভারসম্য আনয়ন। চতুর্থত, দেশের পিছিয়ে পড়া গ্রাম্য জনগোষ্ঠীদের শিক্ষার আলো পৌছে দেওয়া। পঞ্চমত, সকলের মধ্যে বন্ধুত্ত্বভাবাপন্ন সম্পর্ক ও একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখার অনুশীলন করা। এটা কে অনেকটা “অপরকে বিশ্বাস করতে না পারলে কেউ নিজেকে বিশ্বাস করতে শেখে না” মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। ষষ্ঠত, সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোপরি নিয়মানুবর্তিতা, আত্মপ্রচেষ্টা ও আত্মবিশ্বাস এর অভ্যাস গড়ে তোলা।
রেফারেন্সঃ Köy Enstitüleri Belgeseli (ভিলেজ ইনস্টিটিউট ডকুমেন্টারি)
ভাষাঃ Türkçe (তার্কীস)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, “আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এমন যুগান্তকারী উদ্যোগ কবে নেবেন?!”
আঙ্কারা, তুরস্ক
৯ মার্চ, ২০২৩