৩০ মার্চ সকাল আটটার আগে সিও’র অফিসের বারান্দায় অবিশ্রান্ত গোলাগুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে লেফটেন্যনাট হাফিজ উদ্দিন আহমেদের মনে হল তিনি এক অসম যুদ্ধের নাগালে চলে এসেছেন । আগের দিন জগদীশপুর ক্যাম্পে, ব্রিগেড কমান্ড ভয়েসের প্রায় অসঙ্গত যে সমস্ত কথপকথন আচমকা তাঁর কানে এসে গিয়েছিল, হঠাত করে সেগুলি তাঁর কাছে পরিস্ফুট হতে শুরু করল। রাত বারোটার দিকে ইউনিটে ফিরে আসতে আসতে ইউনিটের চারিপাশে তিনি যে পরিখা কাটা দেখেছিলেন, বাস্তবতার নিরিখে এখন সেগুলি আঁকার পেতে শুরু করল। একটু পর পোড় খাওয়া সৈনিক, সুবেদার মজিদ যখন তাঁকে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করলেন, প্রথাগত নেতৃত্বের প্রতি সাহজাত আনুগত্য, বিদ্রোহ আর তাঁর মাঝে এক অদৃশ্য পর্দারর মত তখনও ঝুলে রয়েছে। সিদ্ধান্ত এবং নির্দেশের আশায় তিনি দ্রুত পায়ে অধিনায়ক লেফটেন্যন্ট কর্নেল রেজাউল জলিলের অফিসের দিকে রওনা দিলেন। তাঁকে আসতে দেখে রেজাউল জলিল বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই, পাঞ্জাবি অফিসার ক্যাপ্টেন ইকরাম পাশে এসে পড়লেন। হাফিজকে দ্বিতীয় বারের মত ফিরে আসতে হল।
কোত সিলগালা করার কথা শুনে তিনি প্রথমবারের মত সিও’র অফিসে গিয়েছিলেন সকালে। সেই যাওয়াটা হয়েছিল খুবই আকস্মিক। তিনি সাধারণত এত ইনফরমালি সিওর অফিসে যান না। তবে সেদিনের কথা আলাদা।
১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুররানি ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্যে সকালে কোত সিলগালা করে চাবি নিয়ে গিয়েছেন শুনে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যনাট আনোয়ার হোসেনকে সাথে নিয়ে সাড়ে সাতটার আগেই ইউনিটে চলে এসেছিলেন। খবর পেয়ে তিনজন পাঞ্জাবি অফিসারও তাঁদের সাথে হাজির হয়েছেন। বয়সে তাদের দু’য়েক জন হাফিজের চেয়ে তরুন হলেও চাকরিতে প্রায় সমসাময়িক। সম্ভবত তখন পর্যন্ত এই কমবয়সী পাঞ্জাবি অফিসাররা ঘটনা কতদূর গড়াবে আঁচ করতে পারেননি।ইউনিটকে নিরস্ত্র করার লজ্জা তাদেরকেও বিহবল করে ফেলেছিল।
হাফিজ দেখলেন সিও অফিসে উদ্ভ্রান্তের মত পায়চারি করছেন। টুআইসি মেজর ইকবাল কোরেশি পাঞ্জাবি অফিসার। তিনিও সিওর অফিসে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে দেখে উৎকণ্ঠিত মনে হচ্ছে। হাফিজের জিগ্যাসার উত্তরে, “সিও বললেন উই হ্যাভ বিন ডিসার্মড। মনে হল ক্ষোভ, অপমান আর ভয় একই সাথে তার কন্ঠে ভর করেছে”। হাফিজের পরবর্তী প্রশ্ন, “আমরা এখন কী করবো?” ঠিকমত উচ্চারিত হবার আগেই গুলির শব্দে চারিপাশ উচ্চকিত হয়ে উঠল। ঝড়ের মত রুমে ঢুকে ইউনিটের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সৈনিক সুবেদার মেজর আজিম খান বললেন, “স্যার, সিপাইওনে কোত লুট লিয়া, বাঘাওয়াত হোগিয়া আল্লাহকে ওয়াস্তে কুছ কিজিয়ে”। অধিনায়কের উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে, কি হচ্ছে বোঝার জন্যে হাফিজ বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিলেন।
এখানেই সুবেদার আব্দুল মজিদের সাথে তাঁর দেখা। তিনি বললেন স্যার, “কান্ড ঘটায় ফেলসি। অহন আর মাথায় কাম করতাসে না। অফিসার সাহেবানদের মধ্যে আপনি ছাড়া কমান্ড নেবার মত কেউ নাই। আপনে কমান্ড নেন”। হাফিজ এতক্ষণে আজিম খানের বলা বাঘাওয়াত হয়ে যাবার মানে ধরতে পারলেন। সৈনিকরা বিদ্রোহ করেছে। তাঁকে দ্বিতীয়বার সিও’র কাছে যেতে হল। এবারও কোন সিদ্ধান্ত না পেয়ে মাত্র সোয়া দুই বছরের চাকরির মাথায় জীবনের সবচে বড় সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেললেন।
সুবেদার মজিদ আর সুবেদার চাঁদ বকসের মাধ্যমে হাফিজের নেতৃত্বে গ্রহণের খবর সৈনিকদের মধ্যে পৌছে গেল মুহুর্তেই। সৈনিকরা এই খবরে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেও হাফিজ গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। সব আক্রমণের একটা লক্ষ্য থাকে, তাঁদের বিদ্রোহের চুড়ান্ত লক্ষ্য হয়তো স্বাধীনতা, তবে ইউনিটের ক্ষুদ্র সামর্থ তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা ভেবে দেখবার বিষয়। এই মুহুর্তে প্রধান কাজ হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নাগাল থেকে বেরিয়ে নিরাপদ কোথাও যাওয়া।
তাদের নিরস্ত্র করার পর প্রথম সুযোগেই সৈনিকরা কোত ভেঙ্গে অস্ত্রপাতি বের করে পাশের ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাঞ্জাবি সৈনিকদের আক্রমণ করেছে। চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মমণবাড়িয়া আর জয়দেবপুরের বিদ্রোহের খবর পেয়ে পাঞ্জাবি ইউনিটগুলি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। প্রায় সাথে সাথে তিন দিক থেকে প্রতি আক্রমন শুরু করেছে ২২ এফ এফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) আর ২৫ বালুচ। দক্ষিণ আর দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে ২২ এফ এফ, আর যশোর – কুষ্টিয়া মহাসড়ক অবরোধ করে উত্তর পূর্ব দিক থেকে আক্রমন করছে ২৫ বালুচ। সকাল নয়টা থেকে আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে গিয়েছে।
হাফিজ জানেন শত্রুর তুলনায় তাদের অস্ত্র, জনবল সবই অপ্রতুল। ইউনিটে উপস্থিত জনবল ৪০০ জনেরও কম। অফিসারদের মধ্যে সিওসহ সাকুল্যে চারজন বাঙালি অফিসার। এর মধ্যে বোঝাই যাচ্ছে সিও বিদ্রোহীদের সাথে থাকতে পারছেন না। ইউনিটের কনিষ্ঠতম অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শফি ওয়াসীউদ্দিনের বাবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাস্টার জেনারেল অব অর্ডন্যন্স লেফটেন্যান্ট জেনারেল খাঁজা ওয়াসিউদ্দিন, বিদ্রোহে শফি থাকবে বলে মনে হয়না। তার মানে আনোয়ার ছাড়া আর কোন অফিসারকে তিনি সঙ্গে পাবেন না। তিনি সৈনিকদের অযথা গুলি খরচ করতে নিষেধ করেছেন। পাঞ্জাবি ইউনিট গুলির গড় দূরত্ব ৭০০ গজেরও কম। তাদের মুহুর্মুহ গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে গোটা অঞ্চল। বাঙালি সৈনিকরা ইউনিটের চারিপাশে কেটে রাখা মরিচায় অবস্থান নিয়ে আক্রমন প্রতিহত করে চলেছে। বেশ বড় একটা দল অবস্থান নিয়েছে ইউনিটের পুকুরের পাড়ে।
পার্শববর্তী ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের বাঙালি সৈনিকরাও এসে ফার্স্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ২৫ তারিখ রাতে ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের বাঙালি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হাইকে গুলি করে হত্যা করার পর থেকেই এই ইউনিটের সৈন্যরা লড়াই করার সুযোগ খুঁজজিল। ফার্স্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহ তাদেরকে লড়াইয়ের পথ করে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর সেকেন্ড লেফতেন্যান্ট আনোয়ারকে অফিস থেকে বাগানে নেমে সৈনিকদের মরিচার কাছাকাছি আসতে দেখে হাফিজ তাঁকে বিদ্রোহের প্রস্তাব দিলেন। কোন দ্বিধা না করেই হাফিজের প্রস্তাবে সাঁড়া দিয়েছেন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ২৩ ওয়ার কোর্সে কমিশন পাওয়া এই অফিসার। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগে তিনি ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা এ্যাথলেট। সম্ভবত খেলার মাঠেই তৈরি হয়েছে তাঁর লড়াকু মানসিকতা।
শত্রুপক্ষের লাগাতার আক্রমণে ততক্ষণে কুড়ি জনের মত বাঙালি সৈনিক আহত হয়েছে।। তাদের মধ্যে হাবিলদার আমিনের অবস্থা সংকটাপন্ন হলেও ফার্স্ট এইডের বেশি কোন চিকিৎসা তাঁকে দেওয়া যাচ্ছেনা। যুদ্ধ থামানোর জন্যে মেগাফোনে মাইকিং শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, যুদ্ধ বন্ধ করে আত্মসমর্পণ করলে কমান্ডার সবাইকে ক্ষমা করবেন। হাফিজের কাছে প্রস্তাবটা গ্রহণযোগ্য মনে হল না। তিনি সৈনিকদেরকে লড়াই চালিয়ে যেতে বলে, অফিসের দিকে রওনা হলেন ঘোষোণা বন্ধ করানোর জন্যে।
অফিস তখন ফাঁকা হয়ে পড়েছে। গুলির হাত থেকে বাঁচার জন্যে সিও সহ অন্যান্য অফিসার পুকুরের অন্য ঢালের দিকে বসেছেন। তাঁকে দেখে ইকবাল বললেন, হাফিজ অনেক হয়েছে, ওয়ার ইজ নট এ গেইম অব সকার, তুমি মেগাফোন হাতে নিয়ে সবাইকে থামতে বল।
হাফিজ এই কয় ঘন্টায় বুঝে গিয়েছেন যুদ্ধ ফুটবল খেলা নয়।
কয়েক বছর যাবত তিনি পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড়। তিনি জানেন বাঁশি বাজা মাত্রই তার লক্ষ হয়ে পড়ে বিপক্ষ দলের গোল বার। ১৯৭০ সালে ইরান সফরে অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে তাঁকে যেমন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড তুলে নিতে হয়েছিল, আজও তেমন ক্রান্তিকালে তাঁকে বিদ্রোহের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়ছে , এখনও তিনি এই যুদ্ধের লক্ষ্য পুরোপুরি স্থির করতে পারেন নি। দেশের অন্য কোথাও যুদ্ধ শুরু হয়েছে তিনি জানেন না। তাঁর সৈনিকদের তিনি কোথায় নিয়ে যাবেন এখনও ঠিক হয়নি। শত্রুর গুলিতে ইতমধ্যেই ম্যাগাজিন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। প্রাণ থাকতে আত্মসমর্পণ করার প্রশ্নই আসেনা।
তিনি শান্ত গলায় মেজর ইকবাল কোরেশিকে বললেন, “২৫ বালুচ ফায়ারিং বন্ধ করছে না কেন? আমার পক্ষে যুদ্ধ থামানো সম্ভব নয়”।
ইকবাল কোরেশির সাথে কথা বার্তা শেষ করে ফিরে আশার পর হাফিজ দেখলেন পুকুরের কাছে ইউনিটের এডজুট্যান্ট পাঞ্জাবি অফিসার ক্যাপ্টেন নিসারের মাথায় এলএমজি ঠেকিয়ে গুলি করতে যাচ্ছে হাবিলদার সাহেব মিয়া। দুই পাশ থেকে জাপটে ধরে থাকা সৈনিকদের সাথে ধ্বস্তাধস্তি করতে করতে তিনি বলছেন, “কিয়া কার রাহাহো তুম?”
সাহেব মিয়া ইউনিটের নামকরা সাঁতারু। হাফিজকে আসতে দেখে তিনি চীৎকার করে বললেন “স্যার, আইজকা এই হালারে মাইরাই ফালামু। আমগো উপর খবরদারি করতে আইসে”।
হাফিজ দ্রুত কাছে গিয়ে কলার ধরে সরিয়ে নিয়ে এলেন সাহেবকে। “কি করিস তুই? ব্যাটা ওনার সাথে আমাদের যুদ্ধ কিসের? এডজুট্যান্ট সাহেবরে ছাড়”।
সাহেব ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছেন হাফিজের কথায়। হাফিজের অবস্থা দড়ির উপর হাঁটার মত।তিনি বাঙালি সৈনিকদের রক্ষা করতে চান, নিরস্ত্র পাঞ্জাবি অফিসারদেরও কপুরুষের মত মারতে চাননা। তিনি জানেন নিয়ন্ত্রণ আলগা হলেই অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। সাহেব মিয়াকে এলএমজিসহ উওর দিকের ট্রেঞ্চে পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
ছাড়া পেয়ে কৃতজ্ঞ নিসার বললেন, “মুজেভি হাতিয়ার দো, আমিও সিনিয়ার টাইগার, আমি তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করতে চাই”।
হাফিজ বললেন, “তার দরকার হবেনা। প্লিজ গো ইনসাইড দ্য অফিস”।
তিনটার দিকে সুবেদার আব্দুল মজিদ বিমর্ষ মুখে হাজির হলেন।তাঁর সকালের উদ্যমে একটু ভাটা পড়েছে। তিন বললেন স্যার, “গুলি তো প্রায় ফুরায় আসছে, এখনও তো পাঞ্জাবিগো ফায়ারিং কমেনা। মটরও মারতাছে সমানে”।
হাফিজ বললেন, “খাওয়া দাওয়া হইছে? সুবেদার মজিদ হাসতে হাসতে বললেন হ স্যার, প্যাট ভইরা পানি খাইছে কয়জন”। হাফিজও হাসলেন। তিনি জানেন লঙ্গরে চুলা জ্বলেনি, সৈনিকরা সকালের নাস্তা পর্যন্ত পায়নি। পরিবেশ হালকা করার জন্যে তিনি কথাটা বলেছিলেন। এই অনিশ্চিত যুদ্ধের মতি গতি বোঝা যাচ্ছে না। কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।তিনি আনোয়ার কে ডেকে পাঠালেন। আরেক পশলা গুলি এসে পড়লো আশে পাশে। হাফিজ চীতকার করে বললেন, “ঘাবড়াবার কিছু নেই। গুলি হিসাব করে খরচ কর। তার শেষের কথা গুলি মিলিয়ে গেলো আরেক পশলা গুলি বৃষ্টিতে”।
সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার, সুবেদার মজিদ, সুবেদার চাঁদ বখশ আর কয়েকজন অভিজ্ঞ এনসিও জেসিওর সাথে আলাপের পর সকলের মনে হল যে এভাবে যুদ্ধ দীর্ঘক্ষণ চালান চাবেনা।
সারাদিন কারো খাওয়া হয়নি।
আহত সৈনিকদের চিকিতসা দেওয়া যাচ্ছেনা।
তাহলে কি করা?
আত্মসমর্পন?
সকলে একমত হলেন। আত্মসমর্পণের প্রশ্নই আসেনা। তবে যুদ্ধের কৌশল বদলাতে হবে। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোথাও সংঘবদ্ধ হতে হবে।তারপর পালটা আঘাত।
কিন্তু তিনদিকের অবরোধ ছিন্ন করে বের হওয়াতো সহজ কথা নয়। উত্তর পশ্চিম দিকে খোলা জায়গা আছে বটে, তবে সেটি একেবারেই খোলা প্রান্তর। এয়ার ফিল্ডের পাশদিয়ে প্রায় মাইল খানেক লম্বা ধান ক্ষেত। কয়েকদিন আগে ধান কাটা হয়ে গেছে। সারা মাঠে কোন আড় নেই। পাঞ্জাবিরা দুই দিক থেকে মেশিন গান ফায়ারদিয়ে কাভার করে রেখেছে এই মাঠ। হাফিজ বললেন, “আমাদেরকে এই মাঠ দিয়েই বের হতে হব। রেঞ্জের বাইরে যবার আগে মাথা তোলা যাবেনা। এক সঙ্গে যাওয়া যাবেনা। যেতে হবে ছোট ছোট দলে। তার পর খিতিব দিয়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা জড়ো হব চৌগাছায়। চৌগাছার রুট চেনা আছে তো সবার? অস্ত্র ফেলে যাওয়া যাবেনা। এমো নিতে হবে যতগুলি সম্ভব। কেউ যদি না যেতে চায়। এখনই এডজুটেন্টের কাছে গিয়ে রিপোর্ট করতে পারে। আমার কোন আপত্তি নেই”।
কেউ তেমন কোন কথা বললেন না। শুধু একজন এনসিও জানতে চাইলেন, “এইচ আওয়ার কখন?”
হাফিজ বললেন, “কোন এইচ আওয়ার টাওয়ার নেই। যতদ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে”।
আনোয়ার বললেন, “স্যার এই ঝকঝকে আলোর মধ্যে দিয়ে গেলেতো ক্যাজুয়ালটি হবার সম্ভাবনা থাকে, সন্ধার পরে গেলে হয়না?”
হাফিজ রাজী হলেন না। বললেন, “অন্ধকারে কমান্ড কন্ট্রোল ঠিক রাখা যাবেনা। সমস্যা হবে আরও বেশি। ওরা এম্বুশও করতে পারে। আমাদেরকে দিনের বেলাতেই যেতে হবে। ফায়ার এন্ড মুভ করা ছাড়া গতি নেই। যা থাকে কপালে”।
হাফিজের সাহসকে আনয়ারের মনে হচ্ছিল স্পর্ধা। তিনি জানেনে, এই বিদ্রোহে জড়িয়ে না পড়লে আজই হাফিজের ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি হবার কথা ছিল। সব কিছু এপ্রুভড হয়ে গেছে। সকালে সিও’র র্যংেক পরাবার কথা ছিল। জুনিয়ার অফিসারদের সবচেয়ে কাংখিত র্যংড়ক, দু’ কাঁধ ভরা পিপস। হাফিজ সেটা ভ্রুক্ষেপই করছেন না।
সবগুলি মেশিন গান তুলে নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে বসানো হল। হাফিজ বললেন, “ক্রমাগত ফায়ার করে ওদের ব্যস্ত রাখো মাথা তুলে যেন এইমড ফায়ার করতে না পারে”। চাঁদ বখশ চীৎকার করতে থাকলেন , “ছ্যারা ব্যারা কইরা ফালা, শালারা যেন নিশানা লাগাইবার না পারে, মাজা তোলবার না পারে”।
পাঞ্জাবি ইউনিটের ফায়ারের তীব্রতাও বেড়ে গেল। সৈনিকরা ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে দু’জন, তিনজন করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ধান ক্ষেত পার হয়ে খিতিবদিয়া গ্রামের গাছ পালার আড়ালে চলে যেতে থাকল। বেলা চারটার মধ্যে অনেকেই বেরিয়ে যেতে পারলেন। হাফিজ, মজিদ, আনোয়ার তখনও যাননি। হাফিজ বললেন, “কতজন বাকী। আনোয়ার বললেন, আমরা তো মোট ছিলাম সাড়ে তিনশ’। এখন শ’খানেকও বাকী। নেই”।
হাফিজ বললেন, “আনোয়ার টেইক এ চান্স নাও। আমি সিওকে বলে আসি”।
রেজাউল জলিল নিস্প্রাণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাফিজ বললেন স্যার, “আমরা যাচ্ছি”
“কোথায় যাচ্ছো?”
“স্যার এখনও জানিনা”।
“হাফিজ…” সিও কিছু বলতে চাইছিলেন। হঠাত মেজর ইকবাল কোরেশি এসে পড়ায় আর কিছু বললেন না। এই নিয়ে তিনবার। সিও’র কাছ থেকে ফিরে এলেন হাফিজ।
আনোয়ার আর মজিদ তখনও যান নি। হাফিজ বললেন, “মুভ”।
আনোয়ার বললেন, “স্যার আপনি রওনা দেন, আমি বাকীদের নিয়ে আসছি”।
হাফিজ মাঠে নামতেই গুলির মধ্যে পড়লেন। গুলির আঘাতে শুকনো ধুলো উড়ে, ধোয়াশা সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে দিয়ে তিনি ছুটে চলেছেন।সাথে হাবিলদার করিম ইব্রাহিম আর কয়েকজন। একটু পরেই তারা খিতিবদিয়ার সবুজ ঘেরাটোপের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। হাফিজ বিস্মিত হয়ে দেখলেন কয়েকশ’ গ্রামবাসী হাতের কাছে যা পেয়েছে দা, খন্তা, কুড়াল, সড়কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁদের অভ্যর্থণা জানাবার জন্যে।
একটু পর অন্যদের নিয়ে রওনা হলেন আনোয়ার। তিনি কাউকে আটকা পড়তে দেবেন না। বললেন, সবাই আগে বাড়ো, আমি কাভার দিচ্ছি। শত্রুর গুলির তীব্রতা তখনও আরও বেড়েছে, এই অবিশ্রান্ত গুলি বর্ষণের মধ্যে দিয়ে প্রকৌশল বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেট অস্ত্র হাতে ছুটে চলেছেন। সহযোদ্ধাদের কাভার দিতে দিতে। শেষ বিকেলের আলো একেকবার তার শরীর, কখনও তাঁর অস্ত্র ছুঁয়ে যাচ্ছে।
খিতিবদিয়া গ্রামে একটি গাছের নীচে বসে, হাফিজ বারবার আনোয়ার আর মজিদের খবর নিতে চাচ্ছেন। গ্রামবাসী সেসব নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আনোয়ারের খবর তাঁরা না জানলেও আরও অনেক যোদ্ধাকে তাঁরা বরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সুবেদার আব্দুল মজিদ, আবুল খায়ের, আবুল হাশেম তমঘায়ে জুররাতসহ আরও অনেকে। গ্রামের যুবকরা সবাই যুদ্ধে যাবার জন্যে হাফিজের পাশে ভীড় জমাচ্ছে। হাফিজ আরেকটু অপেক্ষা করে মতিয়ার নামে স্থানীয় এক যুবকের সাথে চৌগাছার পথ ধরেছেন।
ততক্ষণে সেনানিবাস থেকে ফার্স্ট বেঙ্গলের সকল বিদ্রোহী নিরাপদে বেরিয়ে এসেছেন। গুলির আঘাতে সৃষ্ট ধুলোর ধোঁয়াশার উপর ডুবন্ত সুর্যের আলো পড়ে ঘোলাটে হয়ে উঠেছে খিতিবদিয়া আর সেনানিবাসের মাঝখানের মাঠ। সেই ঘোলাটে আলোয় আনোয়ারের সহযোদ্ধারা তাকে পড়ে যেতে দেখলেন। শত্রুর মেশিন গানের একটি বার্স্ট বাইশ বছরের জীবনটিকে প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।সহযোদ্ধারা এই বীর যোদ্ধাকে কাঁধে করে হয়বতপুরের দিকে রওনা হয়েছেন।
হাফিজরা সে কথা জানতে পারলেন না।
সূত্রঃ
রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রানের বিনিময়ে
মেজর হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম; রক্তে ভেজা একাত্তর
এ এস এম সামছুল আরেফিন; মুক্তযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান
Siddik Salik; Witness to Surrendar
Major General KM Shafiullah BU; Bangladesh at War
Liutenant General A SM Nasim BB; Bangladesh Fights for Independence
অসাধারন। এমন আরো লেখা চাই। এমন লক্ষ ত্যাগের বিনিময়েই আজকের স্বাধীনতা। স্যালুট।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
ধন্যবাদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
আমরা আজকের এই স্বাধীনতা পেয়েছি এই সাহসীদের জন্য। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের শ্রদ্ধাভরে সরণ করে যাব।
্ধন্যবাদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
ভাল লাগলো এমন লেখা পড়ে
্ধন্যবাদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
অনেক ধন্যবাদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান