নেশা – শেষ পর্ব

নেশা ২

সকালে টুকটাক কিছু জিনিষ পত্তর নিয়ে কাউকে কিছু না বলেই কমল অফিসে চলে গেলো । কান্ট্রি ম্যানেজারের সাথে দেখা হল লাঞ্চের আগে। তিনি বললেন, ভাবীর সাথে কথা হয়েছে?

– হ্যা, ওর দিক থেকে কোন সমস্যা নেই, আমি রেডি হয়েই এসেছি। আপনি বললে লাস্ট ফ্লাইটেই চলে যেতে পারি।

হক সাহেবকে খুব আন্তরিক মনে হল। ‘বড় একটা দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচালেন। ভাবীকে বলবেন যে কোন প্রয়োজনে কোন সংকোচ না করে যেন আমাকে ফোন করেন।নেদারল্যান্ডের টিমটার সাথে আমিও চলে আসবো, পরের সপ্তায়’।

সিলেট এয়ারপোর্টে নেমে মন ভালো হয়ে গেলো কমলের। তখনও সন্ধ্যা নামেনি। ভিড়ভাট্টা কম। সিগারেটের দোকান সামনে পড়তেই এক প্যাকেট গোল্ডলিফ কিনে ফেললো সে। এত দিন একটা দুইটা করে সিগারেট কিনতে কিনতে মনটাই ছোট হয়ে যাচ্ছিল । আজ থেকে তার স্বাধীনতা শুরু। কোম্পানীর রেস্ট হাউসটা লাক্কাতুরা টি এস্টেটের পাশে ছোট্ট একটা টিলার উপর। ব্যল্কনিতে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল কমল। চা বাগানের উপর শেষ বিকেলের রোদ অদ্ভুত একরকম আলো বিছিয়ে দিয়েছে। কচি চায়ের পাতায় মাঝে মধ্যে ঝিকমিকিয়ে উঠছে আলো।
পারুলের কথা মনে পড়ে গেল। বউটা তার বেড়াতে পছন্দ করে। এই বিশ বছরে পারুলকে নিজের সাধ্যমত ঘুরিয়েছেও কমল। চা বাগানে রাত কাটানোর অনেক দিনের ইচ্ছে পারুলের। হঠাত করেই মন খারাপ হয়ে গেলো কমলের। ব্যালকনিতে বসে বসেই সন্ধ্যা নামিয়ে ফেললো। কেয়ারটেকার একবার চা দিয়ে গিয়েছে। রাতে কী খাবে জানার জন্যে এসে দেখলো চায়ের কাপটা সেরকমই পড়ে আছে। বলল, স্যার চা তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর এক কাপ বানিয়ে দেই? কমল বলল, টেবিলের উপর সিগারেটের প্যাকেটটা আছে দিয়ে যেও তো।

সিগারেটের চকচকে প্যাকেটটা হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, ‘এখানে কফি হবে না? কফি খাওয়াতে পারবা?’
প্যাকেটটা খুলতে খুলতে ফোন বেজে উঠলো।

পারুলের ফোন। অভ্যস বসত সিগারেটের প্যাকেটটা নামিয়ে রেখে ফোন ধরল কমল। সিগারেট খেতে খেতে কখনও পারুলের ফোন ধরেনা সে। অদ্ভুত মহিলা। মোবাইলের ওপার থেকে নিশ্বাসের নামা ওঠা থেকেই পারুল বুঝে ফেলে। পারুল নয় তার ফোন থেকে ডায়াল করেছে রুপা।‘বাবা তুমি কোথায়?
– সিলেটে
– সত্যিই তুমি সিলেটে?
– হ্যা, কালকে বললাম না!
– তুমি পচা
– কেন বাবা?
– – আমার এমসিকিঊ কে ধরে দেবে?
– কেন মামমামকে বল
– মামমাম কী ধরে! তুমি জানোনা আমি সিক্সে ওঠার পর থেকে মামমাম আমাকে পড়ায় না?
– না জানিনা তো
– জানবে কেন তুমি পচা বাবা, আমার পরীক্ষা কবে তুমি জানো? সত্যিই একটু চিন্তায় পড়ে গেল কমল। কত তারিখ থেকে মনে করতে পারলো না। এসব খবর তো পারুলই রাখে।
– বাবা, তুমি আসবা না? এবার রুপার গলাটা একতু ধরে এলো। কমলের বুকের মধ্যে হু হু করে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোর মা কোথায়?’
– মামমাম শুয়ে আছে। আজ মামমাম তোমার জন্যে রোজা রেখেছিলো জানো?
– ফোনটা তোর মাকে দে।
– মামমাম কথা বলবে না। ডাকতে মানা করেছে।জারাহ কথা বলবে।
এরপর রুপার ফুঁপানোর শব্দ শুনতে পেল কমল। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল তার।
জারাহ ফোন ধরেই বলল, ‘হ্যালো বাবা ! তুমি খেয়েছো? জারাহ’র এই প্রশ্নটা তার জানা। সব সময়ই সে ফোন ধরে প্রথমে এই কথাটা বলে। এর পরে বলে, কী করছো ? আজ সে প্রশ্ন না করে জারাহ বলল, ‘বাবা তুমি একটু ধর আমি বারান্দায় গিয়ে কথা বলব।
– বাবা তুমি শুনতে পাচ্ছো?
– হ্যা
– কবে আসবা।
– এই তো, কাজ শেষ হলে।
এবার ফিসফিসিয়ে উঠলো জারাহ’র গলা। বলল, ‘তুমি এলে সিগারেট খেতে দেবো, প্রতিদিন একটা কিন্তু। আচ্ছা আপ্পি চলে এসেছে রাখি?’
হঠাত করেই ফোনটা কেটে গেলো।

কমলের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেলো। এতদিন পারুলের অত বারণেও কমল সিগারেটকে পুরোপুরি ছেড়ে দেবার কথা ভাবেনি।পারুলের সামনে যা ই বলুক, একেবারে গোল্ডলিফ শূণ্য জীবনের কথা একবারও মনে হয়নি । ঝগড়াঝাটি বেশি হলে দু’একবার ছেড়েদেবার কথা ভেবেছে মাত্র। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই ভাবনা চিন্তাকে জলাঞ্জলি দেবার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অথবা সে নিজেই নতুন একটি সিগারেট জ্বালানোর ছুঁতো খুঁজে বের করেছে । জারাহ’র টেলিফোনটা কেটে যাবার পর, আজ সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ‘তুমি এলে সিগারেট খেতে দেবো’, কথাটা ঠিক কোথায় বিধলো, কমল বলতে পারেনা। তবে এই একটি বাক্য তার দিনকাল বদলে দিল।মনের অজান্তেই কান্না চলে এলো কমলের।

কেয়ারটেকার কফি নিয়ে এসে দেখলো, মন খারাপ করে বসে আছে প্রোজেক্ট স্যার। তার চোখের কোনা চিকচিক করছে পানিতে।‘স্যার কফি’। কেয়ারটেকারকে দেখে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো কমল। বলল লাইট টা নিবিয়ে দাও

লাইট নিবিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছিল সে। কমলের প্রশ্ন শুনে থামল।
– তোমার নাম কী?
– আব্দুল বারেক সার।
– তুমি সিগারেট খাও?
উত্তর দিলোনা বারেক। কমল বলল, ‘বুঝেছি, পরিবার কিছু বলে না?’
– স্যার এখনও বিয়া করি নাই।
– আচ্ছা এই সিগারেটের প্যাকেট টা নিয়ে যাও।
– স্যার আমি সিগারেট খাই না।
– ঠিকাছে, কাউকে দিয়ে দিও। আর আমার রুমে কোন এস্ট্রে যেন না থাকে বুঝেছো?
কফির কাপ রেখে চলে গেলো বারেক।
কমল তাতে ঠোঁটও ছোঁয়ালোনা । রাতে খেতেও ইচ্ছে করলো না। বিছানায় গিয়ে ঘুমোতে পারলো না সে।
ফিরে যাবার জন্যে কান্ট্রি ম্যানেজারকে কী বলা যায় ভাবতে লাগলো।

১৬ টি মন্তব্য : “নেশা – শেষ পর্ব”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    পরাজয়টা নেশার কাছে হয় নাই, সেইটাই সুখের কথা।
    তবে সিগারেটে আকর্ষনটাকে নেশা বা আসক্তি বললে অন্য সব নেশা বা আসক্তিকে হালকা করা হয় বলেই আমার মত।
    সিগারেটের ক্ষেত্রে কিন্তু ডিটক্স-এর দরকার পড়ে না যেটা অন্যগুলোতে নিশ্চিত ভাবে প্রয়োজনিয়।
    তাছাড়া এটা যে ডিপেন্ডেন্স তৈরী করে সেটা অনেক বেশী নিয়ন্ত্রনাধীন।

    বকাঝকার জন্য নেশা বলাটা ঠিক আছে কিন্তু আসলে ব্যাপারটা অত খারাপ না, অন্যগুলা যতটা খারাপ.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    রুথ গ্লিক নামের একজন বেস্ট সেলার কুকবুক লেখক আছেন এদেশে। তিনি রান্নাবান্নার পাশাপাশি রোমান্টিক ধাঁচের বইও লিখে থাকেন অবসরে। একবার এক সাক্ষাৎকারে মিজ রুথ বললেন যে তাঁর হামেশাই মনেহয় জগতের সেরা কাজটি তিনি পেয়েছেন। তিনি দিনভর কলমের টানে মানুষের সুখ দুঃখ, হাসি আনন্দের কথা লিখে চলেন এবং তার কলমের টানেই কত সংসার ভেঙ্গে যায় আবার কত না নতুন জীবনের গান রচনা করতে পারেন তিনি। রুথ বলছেন, then I give them a happy ending!

    :clap: :clap:

    জবাব দিন
  3. সাইদুল (৭৬-৮২)

    আমার কাছে মনে হয় ভাঙার চেয়ে গড়াটা বেশি জরুরী। যদিও আমি এমন কোন তালেবর আদমী নই যে কিছু বললেই হয়ে যাবে, তারপরও আমি চেষ্টা করি আশাবাদী থাকতে, পাঠককে আশাবাদী রাখতে।

    ধন্যবাদ সাবিনা


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    সব ক'টি পর্ব মিলিয়ে ছোট্ট ছিম-ছাম দারুণ একটি ছোট গল্প হয়ে গেল।
    এরকম আরও চাই, ভাই! 😀 (সম্পাদিত)


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  5. সাইদুল (৭৬-৮২)

    শেষ পর্যন্ত গল্পটা ভালোবাসার কথা ভেবেই লেখা. পারুল চরিত্রটির প্রতি একটু সুবিচার করতে চেষ্টা করেছি শেষের দিকে, তাও এত আলগোছে যে অনেকের চোখেও, পড়বেনা


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  6. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "অভ্যস বসত সিগারেটের প্যাকেটটা নামিয়ে রেখে ফোন ধরল কমল" - এই একটা ছোট্ট ব্যাপার, স্ত্রীর ফোন পেয়ে "অভ্যাস বশতঃ" প্যাকেটটা নামিয়ে রাখা, কি চমৎকারভাবেই না তুলে ধরলে!
    "‘তুমি এলে সিগারেট খেতে দেবো’, কথাটা ঠিক কোথায় বিধলো, কমল বলতে পারেনা। তবে এই একটি বাক্য তার দিনকাল বদলে দিল।মনের অজান্তেই কান্না চলে এলো কমলের।" - মানুষের মনের এসব চোরাগলির খবর ক'জনাই বা রাখে, আর ক'জনাই বা এত সুন্দর করে তা ব্যক্ত করতে পারে!
    চমৎকার হয়েছে এ "নেশা"র গল্প। খুব ভালো লেগেছে তিনটি পর্বই।

    জবাব দিন
  7. সাইদুল (৭৬-৮২)

    কয়েকদিন সিসিবি থেকে দূরে ছিলাম, ইন্টারনেটের অভাবে। এসেই তোমার মন্তব্য। আহা চমতকার


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।