একটি চিঠি…. ত্রিভুজের তিনটি কোণ….. অত:পর…………..

” ELEMENTS ” , জ্যামিতি শাস্ত্রের এক মহা পবিত্র গ্রন্থ । ৩০০ সাল থেকে উনিশ শতকের গোঁড়া পর্যন্ত জ্যামিতি বলতে বোঝাত ইউক্লিডের হাতে গড়া এই এলিমেন্টস্ বইটিকেই। দীর্ঘ দুই হাজার বছর ধরে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি একচেটিয়াভাবে শাসন করেছে জ্যামিতি শাস্ত্রকে । সমগ্র ইউরোপের বাঘা বাঘা সব পণ্ডিতেরা ইউক্লিডীয় জ্যামিতিকে অগ্রাহ্য করার চিন্তা ভুলেও কখনও মাথায় আনতেন না। ভাবা যায়? কতখানি প্রভাব বিস্তার করলে এমনটি হওয়া সম্ভব! সত্যিকার অর্থে , সে সময় সারা পৃথিবীতে যারা জ্ঞান বিজ্ঞানে নেতৃত্ব দিতেন, নেতৃত্ব দিতেন বৈজ্ঞানিক চেতনার,তাদেরও বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, ইউক্লিডীয় জ্যামিতিকে অস্বীকার করে নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করা পাগলামি আর মূঢ়তা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু পাগলামি করার জন্য লোকের কী আর অভাব হয়!

হ্যাঁ, কার্ল ফ্রেডরিক গাউস, সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম গণিতবিদদের একজন,প্রথম বিরোধিতা করলেন ইউক্লিডকে। তাঁর হাতেই সূত্রপাত ঘটে Non-Eucledian Geometry-র। কীভাবে ? আচ্ছা, তার আগে জেনে আসা যাক,গাউস কেন তাঁর অ- ইউক্লিডীয় জ্যামিতি তাঁর সময়ে বিজ্ঞানী মহলে প্রকাশ করেন নি। সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়ে যাব বন্ধু ফ্রিডবিচ বেসেলের কাছে গাউসের লেখা এক চিঠি থেকে। এই বেসেল ছিলেন স্বাধীন ও স্বচ্ছ চিন্তার নায়ক হিসাবে গোটা ইউরোপে প্রসিদ্ধ। গাউসের লেখা চিঠিটি নিচে তুলে দেওয়া হল।

” শ্রদ্ধেয় বন্ধু,
আমি সারা জীবন ধরে চেয়েছি যা সত্য তার নির্বিবাদ প্রকাশ হোক। সত্য ছাড়া বিজ্ঞানে আর আছেটা কী। কিন্তু তুমিতো সমকালের ইতিহাস জানো, সারা ইউরোপের তাবৎ গণিতবিদরা ইউক্লিডে অন্ধ। এদের মতে ইউক্লিডের জ্যামিতিতে হাত দেয়া মানেই এক স্বতঃসিদ্ধ সার্বজনীন সত্যকে নিষিদ্ধ করা। তুমিই বলো, এমন আকাশ বাতাস যেখানে সেখানে আমি কীভাবে ইউক্লিড বিরোধী জ্যামিতির উদঘাটন করি? যদিও জানি অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সত্য। কিন্তু এমন অবস্থায় তা করলে লোকে আমার চৌহুদ্দিতে এসে চিৎকার করবে, গালিগালাজ দিবে , আমার মনের শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাবে, এটা ভাবতেও আমার ভয় হয়। এই হুজুকে পাগলদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।”

গণিত সাম্রাজ্যে ঝড় তোলা এই চিঠিটি প্রকাশিত হয় গাউসের মৃত্যুর অনেক পরে। অ- ইউক্লিডীয় জ্যামিতির ধারণা গাউসের জীবদ্দশায় মানুষ জানতে পারেনি। তাঁর মৃত্যুর পর গোটা ইউরোপ সহ সমগ্র বিশ্ব জানতে পেরেছে, জ্যামিতিতে ইউক্লিডের কথাই শেষ কথা নয়।

গাউসের মতো আরো কয়েকজন গণিতবিদও অ- ইউক্লিডীয় জ্যামিতি আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু গাউসের প্রিয় শিষ্য রেইম্যান ছাড়াও জার্মানির জিরোলামো সাখেরি,হাঙ্গেরির জেনাস বোল্যাইয়া , রাশিয়ার লোবাচেভস্কি প্রমুখের আবিষ্কৃত অ- ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সঙ্গে গাউসের আবিষ্কৃত অ- ইউক্লিডীয় জ্যামিতির পার্থক্য ছিল অনেক ।

এবার দেখা যাক গাউসের প্রমাণের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য । গাউস দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রির চেয়ে কম (!) । এই সত্যতা প্রমাণ করার জন্য তিনি এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটালেন । কী রকম? তিনজন লোককে তিনি তিনটি পাহাড়ের মাথায় উঠালেন । প্রত্যেকে তার নিজের সঙ্গে অন্য দুজনের মধ্যে যে কোণ উৎপন্ন করল তা বের করলেন ।তিনটি কোণের মাপ তিনজনের কাছ থেকে আলাদাভাবে নিলেন গাউস , তারপর কোণ তিনটি যোগ করলেন । দেখা গেল যোগফল ১৮০ ডিগ্রির চেয়ে কম! কিন্তু গাউসের প্রিয় শিষ্য এবং অসামান্য প্রতিভাধর গণিতবিদ রেইম্যান আবার প্রমাণ করে দেখালেন যে, কোন ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রির চেয়ে বেশী ! ! !

মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক । কিন্তু যে ব্যাপারে গাউস,রেইম্যান একমত হলেন তা হলো, কোন একটি ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল যতো ছোট হবে ততোই ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ধীরে ধীরে ১৮০ডিগ্রীর কাছাকাছি আসবে। আবার বিপরীত ভাবে কোন ত্রিভুজের আকৃতি যতো বড় হবে ততোই ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ধীরে ধীরে ১৮০ডিগ্রী থেকে সরে আসবে।

গাউস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন , সীমিত ক্ষেত্রে ইউক্লিডের ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ডিগ্রী-র জ্যামিতিক তত্ত্বটি খাটলেও সীমাহীন ক্ষেত্রে অথবা মহাজাগতিক ক্ষেত্রে অ- ইউক্লিডীয় তত্ত্বকে প্রয়োগ করাই যুক্তিযুক্ত।

অথচ দুই হাজার বছর ধরে ইউক্লিড বলেছেন, কোন ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি কাঁটায় কাঁটায় ১৮০ ডিগ্রী । সারা পৃথিবীর মত আমাদের দেশের মানুষও তাই জানে এবং স্কুল-কলেজে সেটাই পড়ানো হয়। কিন্তু দু:খের বিষয় এই যে, আধুনিক কালের কার্ল ফ্রেডরিক গাউস বা অন্যদের আবিষ্কৃত অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি সম্বন্ধে আমাদের স্কুল-কলেজ গুলোতে কোন ধারণাই দেয়া হয় না, শেখানো তো দূরের কথা। আমাদের দেশ ছাড়া উন্নত-উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশেই অ- ইউক্লিডীয় জ্যামিতিকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। সঙ্গত কারণেই বোধহয় একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমরা আধুনিক গণিত শাস্ত্র থেকে অনেক যোজন দূরে অবস্থান করছি।

৩,১৩৫ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “একটি চিঠি…. ত্রিভুজের তিনটি কোণ….. অত:পর…………..”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    :clap: :clap: :clap:
    চমৎকার লেখা।
    শুধু গণিত নয়, অনেক কিছুতেই আমরা পিছিয়ে।
    কিন্তু ছাত্র থাকা অবস্থায় (এখনো তো তুমি ছাত্র নাকি চাকুরীতে প্রবেশ করেছো?) যখন তুমি এ সম্পর্কে জানো তার মানে বাংলাদেশের গণিতবিদেরা এ সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন; নয়কি?
    পশ্চিমা দেশগুলোতেও গণিতবিদেরা ছাড়া আর কেউ এ বিষয়ে জানেন কিনা তাতে আমার প্রবল সন্দেহ রয়েছে।
    তবে আগেই বলেছি চমৎকার লেখা। নতুন কিছু জানলাম। তোমাকে ধন্যবাদ।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

    সাদিক ভালো লিখেছ। তবে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করতে চাই:
    ১। ইউক্লিডের 'এলিমেন্ট' ইউরোপে রচিত প্রভাববিস্তারকারী প্রথম জ্যামিতির গ্রন্থ। তবে মিশর ও ভারত উপমহাদেশে অনেক আগেই এই সব জ্যামিতি জানা ছিল।
    ২। 'এলিমেন্ট'-এর ১০০% কৃতিত্ব ইউক্লিডের নয়। ইউক্লিডের পূর্বেই এর অনেক কিছুই গ্রীসে জ্ঞাত ছিল। ইউক্লিড সবকিছু সাজিয়ে একটি গ্রন্থে রূপ দেন, প্লাস নিজস্ব কিছু জ্ঞানও (উপপাদ্য, তত্ব, পস্টুলেট, ইত্যাদি) উপস্থাপন করেন।
    ৩। ত্রিভূজের তিন কোনের আগে উল্লেখ করতে হবে পন্চম পস্টুলেটটি, যেটি প্যারালাল পস্টুলেট হিসাবে খ্যাত। If a line segment intersects two straight lines forming two interior angles on the same side that sum to less than two right angles, then the two lines, if extended indefinitely, meet on that side on which the angles sum to less than two right angles.If the sum of the two interior angles equals 180°, the lines are parallel and will never intersect. ঐ দুইটি লাইনকে আমরা সমান্তরাল সরল রেখা বলি।
    ৪। পস্টুলেট হলো যার কোন প্রমাণ নেই অথচ তাকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়। ঐ প্যারালাল পস্টুলেটটির বিষয়ে ইউক্লিডের নিজের মনেও খটকা ছিল।
    ৫। মুসলিম গণিতবিদ আল হাইয়াম (Al Hazen) (৯৬৫-১০৩৯) প্রথম চেস্টা করেছিলেন সেটি প্রমান করার।
    ৬। অপর মুসলিম গণিতবিদ ওমর খৈয়াম (১০৫০-১১২৩) প্যারালাল পস্টুলেটে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং তাকে ভুল প্রমাণ করতে গিয়ে নন-ইউক্লিডিয়ান পস্টুলেট তৈরীর প্রচেস্টা করেন। এবং তিনিই প্রথম এলিপটিকাল ও হাইপারবোলিক জ্যমিতির জন্ম দেন।
    ৭। আরও একজান মুসলিম গণিতবিদ নাসির আল দিন আল তুসিও (১২০১-১২৭৪) এলিপটিকাল ও হাইপারবোলিক জ্যমিতির উপর কাজ করেন।
    ৮। আল তুসির ছেলে সাদর আল দিন পিতার কাজের উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। যা পরবর্তিতে রোম থেকে প্রকাশিত হয়।
    ৯। এই সব কিছুর অনেক পরে গাউস (১৭৭৭-১৮৫৫), রিমান ও লোবাচেভস্কি নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির উপর কাজ করেন।
    ১০। আরেকটা কথা, বাংলাদেশে স্কুলে পড়ার সময় নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি সম্পর্কে আমাকে কোন ধারণা দেয়া হয়নি। আমি এই বিষয়ে প্রথম জানতে পারি বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। তবে আমি কিন্তু আমার ছাত্রদেরকে এই সম্পর্কে বিস্স্তারিত বলি।

    তোমাকে ধন্যবাদ। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।