অণু ব্লগঃ তিন

আমাদের বাড়ীর কাছেই রুবি ফলস। এর আগেও বার কয়েক গেছি মাটির নিচের এই রূপের জলধারা দেখতে। এবারের জার্নিটা একটু অন্য রকম কারণ কানাডা থেকে ভাই-ভাবী এসেছেন, আর আমি তাদের গাইড হয়ে আমেরিকার রূপ বৈচিত্র্য দেখাতে বেরিয়েছি। হাজার উপায়ে আমাকে তো তাদের কাছে প্রমাণ করতে হবে যে রূপে গুণে কানাডার চাইতে আমার দেশটি উত্তম! আমাদের বাড়ী থেকে মাত্র দুশো কিলোমিটার দূরে এই মেঘ পাহাড়ের দেশ। সবাই মিলে গল্প করতে করতে যখন টেনেসি পৌঁছুলাম আলো ঝলমলে একটি দিনের শুরু হয়েছে সবে। আমাদের দলে ছোট বড় মিলিয়ে ছয়জন, বড় একটা ভ্যানে করে আটলান্টা থেকে এসেছি আমরা একদিনের ট্যুরে। 

শহরে ঢুকেই শক্তপোক্ত একটা ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিলাম এই ভেবে যে কখন আবার না জানি খাবার জোটে। এখন রূবি ফলসের কথা একটু না বললেই নয়। রূবি ফলসের বিশেষত্ব হলো এটী মাটির প্রায় একশো পঞ্চাশ ফুট নিচে অবস্থিত, মাটির গভীরে পাথুরে গুহার মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখা মেলে এই ঝর্ণার। কী যে তার রূপ! মনে হবে মাটি ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এসেছে আলো আর জলের এই অবিরাম ঝর্ণাধারা!

আমেরিকান গাইড তার দায়িত্ব পালন করেছে যথাযথ ভাবেই। পিচ্চিটা হাঁটতে পারছেনা? তাতে কি, আমার কাঁধ তো রয়েছে! কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটলাম সবাইকে দেখিয়ে। চুইংগাম ফুরিয়ে গেছে? অসুবিধা নাই, আমার ব্যাকপ্যাকে পোটলা করে সব এনেছি। গেটোরেইড, চুইংগাম, চিপস, কুকি, টিস্যু পেপার অথবা পানির বোতল… হাজার হোক প্রমাণ তো করতেই হবে আমাদের আতিথেয়তাই সেরা! গুহা, গিরিখাদ, পাহাড় অথবা পথঘাট যা বলো, চিজি ঐ ট্যুর গাইডের চাইতে আমি কম জানি নাকি? হাহ! কিন্তু বাবারও যে বাবা রয়েছেন সেটি টের পেলাম ভেতরে যাবার পর। ভাতিজী কানাডিয়ান বিচ্ছু মেয়ে আমার ঝুঁটি চেপে বসে আছে কাঁধে, কখনো কু কু বলে চোখের চশমা খুলে নিচ্ছে তো কখনো আহ্লাদের আতিশয্যে আমার নাকের বাঁশী থেবড়ে দিচ্ছে। সব চলছিল ভালোই কিন্তু হঠাৎ মনে হলো আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। দম আটকে আসছে, চোখে কেবলই শর্ষে ফুল দেখছি। বাচ্চাটিকে বাপের কোলে দিয়ে ট্যুর গাইড কে হড়বড় করে নিজের কথা বলে এক দৌড়ে এলিভেটরে্র কাছে গেলাম। পেছনে পরে রইল আমার একমাত্র কন্যা আর ভিনদেশী অতিথিরা। দুজন গাইড ধরাধরি করে আমাকে খোলা আকাশের নীচে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল। চোখে মুখে পানির ঝাপটা পরতেই আমি যেন নতুন জীবন পেলাম ফিরে!

রুবি ফলসে গিয়ে জানলাম আমি যে ক্লাস্ট্রোফোবিক!!

১,৭৮৪ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “অণু ব্লগঃ তিন”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    যে কোন ফোবিয়ার কথা জানা থাকলে সেটা বড় কোন সমস্যা না।
    অনেকেরই অনেক ধরনের ফোবিয়া থাকে, কৈ, তেমন কিছু তো হতে দেখি না...

    বর্ননাটা চমৎকার লেগেছে...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. মুজিব (১৯৮৬-৯২)

    দারুণ প্রাঞ্জল বর্ণনা, আপু! :clap: :clap: :boss:

    নিজের সেফটির জন্য ফোবিয়ার কথা জানা থাকা ভালো। তবে যতক্ষণ না আপনি সেই ফোবিয়াটির ফোবিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ এগুলো নিয়ে খুব বেশী উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। 😀


    গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

    জবাব দিন
  3. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :hatsoff: :hatsoff:

    অনেক ধন্যবাদ পড়বার জন্য, মুজিব! আমি ভালোই থাকি মোস্ট অব দা টাইম...বিপত্তি ঘটলে পালাবার পথ খুঁজি দ্রুত! গত বছর দেশে গিয়ে বসুন্ধরা সিটি মলের এলেভেটরে এতো ভিড় ছিল যে দেখেই দম বদ্ধ লাগছিল। সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম ওপর থেকে নীচে। আমি সাফোকেটেড ফিল করলে লোকজনের সাথে কথা বলা শুরু করি!

    জবাব দিন
  4. Runa Shabnam (83-89)

    সাসপেন্স বাড়তে বাড়তে কেমন করে যেন ক্লাস্ট্রোফোবিতে গিয়ে আটকে গেলো ..... হিহি :brick:


    মানুষ এমনতয়, একবার পাইবার পর
    নিতান্তই মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর.........

    জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন বর্ণনা আপু, শেষে এসে চিন্তায় পড়লাম। মুক্ত থাকুন 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।