(এই গল্পের সবক’টি চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কারুর সাথে এদের কোন মিল পরিলক্ষিত হলে তা নিতান্তই কাকতালীয়।)
– বাবা, তুমি কি ‘দি কাইট রানার’ পড়েছ?
– না, মা, পড়িনি। তবে বইটার নাম শুনেছি, খুব সম্ভবত: একজন আফগান লেখকের লেখা উপন্যাস।
– তুমি ‘দি কাইট রানার’ পড় নি?
রোদেলা আশ্চর্য হয়। এই উত্তর তার কাছে অপ্রত্যাশিত। চোখে-মুখে তার ঝুলে থাকে একরাশ অবিশ্বাস।
– না, মা। ইংরেজি সাহিত্য আমি তেমন একটা পড়িনি। বাংলা সাহিত্যই বা পড়েছি কতটুকু? মাই লাইফ ইজ ফুল অব ওয়েষ্টফুল মোমেন্টস। টেস্টের প্রিপারেশান কেমন?
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে রোদেলার আসন্ন টেস্টের কথা তুলি। উচ্ছলতা নিভে যায়। রোদেলা মলিন বদনে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। চোখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বলে, “ভালো”।
– এইচএসসির ফাইনাল পরীক্ষা কঠিন কিছু নয়। টেস্টই হচ্ছে আসল পরীক্ষা। সে হিসেবে এই পরীক্ষার নাম দেয়া উচিত ছিল ‘এসিড টেস্ট’। এই পরীক্ষায় তোমার পজিশন দেখে বুঝব, ফাইনালে কেমন করবে। ভাল রেজাল্ট করতে হবে, মা! আমাদের এছাড়া আর উপায় কিছু নাই। আমি চাই তুমি তোমার বেষ্টটুকু দাও।
এ পর্যন্ত বলে আমি বিরতি দিই। জানি, রোদেলা অক্ষরে অক্ষরে আমার কথা মেনে চলবে। তবু ওর মলিন মুখ দেখে খারাপই লাগে। মনে হয়, মেয়েটাকে এমন করে না বললেও পারতাম।
শীতের দিনে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। একটি একটি করে টেস্ট পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ঘরে ফিরে এসে ওকে জিজ্ঞেস করছি, “মা’মণি, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?” বিকেলের নরম আলোর মত খুব নিচু গলায় রোদেলা তার জবাব দিচ্ছে। একেকদিন একেক রকম জবাব। “ভাল”, “মোটামুটি”, ইত্যাদি। ওর কি এখনও মন খারাপ হয়ে আছে? ও কি অন্যকিছু প্রত্যাশা করছে আমার কাছ থেকে? আমার মেয়েটার মন খুব নরম। এই বয়সেই সে তার নরম মন আমাদের প্রত্যাশার চ্যারিয়টের চাকার তলায় অকাতরে বিছিয়ে দিতে শিখেছে।
সন্ধ্যেয় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আয়েশ করে সোফার বসেছি। হাতে মুরাকামির ‘কাফকা অন দ্য সোর’। আসাদ স্যারের দেখাদেখি ‘নরওয়েজিয়ান উড’ পড়বার পর থেকে এই লেখককে মনে ধরেছে। আর ‘কাফকা অন দ্য সোর’ হাতে নিয়েছি জাহিদ স্যারের কথায়। সেদিন ফেসবুকে তাঁর বাৎচিত হচ্ছিল আসাদ স্যারের সাথে। আমি চুপিসারে ফলো করছিলাম তাঁদের বার্তা বিনিময়। জাহিদ স্যার বলছিলেন মুরাকামি ‘কাফকা অন দ্য সোর’-এ অনেক বেশী ফিলজফিক্যাল। তখনই মনে হয়েছিল, পড়তে হবে। কিনেও রেখেছিলাম। এই সেমেষ্টারের ক্লাস শেষ হয়েছে। আপাতত পড়ানোর কাজে ক্ষণিক বিরতি। তাই রাতে প্রিপারেশন নেবার ঝক্কি-ঝামেলা নেই। অন্যসময় তো এমন সুযোগ মেলে না। এই সুযোগে খানিকটা মুরাকামির ফিলোজফি চেখে দেখি।
এখন যে ঘরে এসে সোফায় বসেছি, সেটি ছিল একচিলতে একটা লিভিং রুম। ‘লিভিং রুম’ শব্দটার সাথে ছেলেবেলায় আমার পরিচিতি ছিল না। আমরা বলতাম ‘ড্রয়িং রুম’। আমাদের ছেলেবেলার সেই ড্রইং রুমে থাকতো, একসেট সোফা, থ্রি সিটারের সামনে একটি সেন্টার টেবিল, সিঙ্গেল সিটারের পাশে একটি করে সাইড টেবিল। একদিকে একটি শো-কেস, অথবা একটি আলমারি; বই, কাচের তৈজসপত্র, একটি কি দু’টি শো-পিস দিয়ে সাজানো। একপাশে জানালার ধারে একটা পড়ার টেবিল, অন্যপাশে রাতে ঘুমুবার স্থান সংকুলানের জন্য একটি সিঙ্গেল খাটও পাতা থাকত। দু’বছরের কিছু আগ দিয়ে রোদেলার যখন এসএস সি পরীক্ষা আসন্ন, নিরিবিলি পড়াশুনা করবার জন্য তার প্রয়োজন একটা একান্ত কোণ, তখন আমাদের এই রুম লিভিং রুমের স্ট্যাটাস হারিয়েছে। তার বর্তমান রূপ আমার ছেলেবেলার সেই ড্রয়িং রুমের মতো। একপাশে সোফা, একপাশে পড়ার টেবিল, একপাশে খাট। তখন থেকেই আমার কাছে বড় প্রিয় হয়ে ওঠে এই রুমটি। কখনও কখনও আভিজাত্য হারিয়ে গেলে মানুষ সাধারণ্যের নৈকট্যলাভে ধন্য হয়। এই প্রিয়তা হয়ত তেমনই, আবার হয়ত তেমন নয়। তুমি তাকে ঠিক ভালবাসো না, তার অবয়বে খুঁজে ফেরো বিস্মৃত অতীত।
পড়ার টেবিলে রোদেলা পড়তে বসেছে। আগামীকাল জীববিজ্ঞান পরীক্ষা। জীববিজ্ঞান রোদেলার পছন্দের বিষয় নয়। প্রথিতযশা চিকিৎসক মায়ের একান্ত ইচ্ছায় ও আমার প্রচ্ছন্ন সমর্থনে নিতান্ত অনিচ্ছায় সে এই বিষয় অধ্যয়নের তালিকায় রেখেছে। জীবনে আমাকেও একাধিক বার এমনটা করতে হয়েছিল, হয়ত রোদেলার মা’কেও।
সবেমাত্র ‘কাফকা অন দ্য সোর’ খুলে বসেছি। উপন্যাসের মূল চরিত্রটিকে প্রস্ফুটিত করবার পাশাপাশি লেখক ইউ এস আর্মি ইন্টেলিজেন্স সেকশনের ১৯৪৪ সালের একটি টপ সিক্রেট রিপোর্ট ধীরে ধীরে উন্মোচন করছেন। রিপোর্টকে তথ্য-প্রাপ্তি অধিকারের আওতায় ১৯৮৬ সালে সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। ৭ নভেম্বর ১৯৪৪ সালে আনুমানিক সকাল ১০ ঘটিকায় জাপানের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা সম্পর্কে কতগুলো মানুষকে করা ইন্টারভিউ। আজ ইউনিভার্সিটিতে বেশ খানিকটা সময় পাওয়ায় একটানে ৬৩ পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করা গেছে। উত্তেজক এবং আধপড়া। বুকমার্ক করা ছিল যাতে চটজলদি খুঁজে পাওয়া যায়। খুলেই অষ্টম অনুচ্ছেদ, সেখানে ইন্টারভিউ করা হচ্ছে বায়ান্ন বছর বয়সের ডাক্তার সিগেনরি সুকামায়াকে। ৬৪ পৃষ্ঠা পড়ে ৬৫ পৃষ্ঠায় চোখ রেখেছি,
“We were ordered by the military to immediately undertake an examination of the children in question. It was the middle of November 1944. It was quite unusual for us to receive requests or orders from the military. The military, of course, had its own extensive medical branch, and being a self-contained entity that put a high priority on secrecy, they usually preferred to handle matters internally. Apart from the rare times when they needed the special knowledge and techniques that only outside researchers or physicians had, they seldom appealed to civilian doctors or researchers.
Thus when they broached this we immediately surmised that something extraordinary had occurred. Frankly, I didn’t like to work under military directions. In most cases their goals were strictly utilitarian, with no interest in pursuing truth in an academic sense, only arriving at conclusions that accorded with their preconceptions.”
অংশটুকু পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে ! এমন সময় শোনা গেল রোদেলার কণ্ঠস্বর,
– বাবা…
– হু…
বইয়ের পাতা থেকে চোখ না তুলেই বলি। তারপর হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পাই। ও যেন বিশেষ কিছু বলতে চাইছে। কাছে ডাকি। যত্ন করে টু-সিটারে পাশে বসাই। ডান হাতে জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে মাথা রাখবার স্থান করে দিই। আলগোছে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকি। পিতার বুকের গভীর কোন উৎস থেকে নিঃসরিত স্নেহ-ধারা অবারিত অকুণ্ঠিত হাত বেয়ে আত্মজার মাথা অব্ধি নেমে আসে।
– বাবা, তুমি ইংরেজি উপন্যাস পড়ছ?
– হ্যাঁ, ইংরেজি অনুবাদে ‘কাফকা অন দ্য সোর’। ‘নরওয়েজিয়ান উড’ খ্যাত হারুকি মুরাকামির লেখা।
– আচ্ছা…
তারপর একটু বিরতি দিয়ে বলে, “বাবা, তুমি ‘দি কাইট রানার’ পড়বে?
এই দুর্বলতম মুহূর্তে মেয়ের কথা ফেলবে সে কোন পাষাণ? “পড়ব, মা”।
রোদেলার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাতের কাছেই শেলফে রাখা ছিল, ‘দি কাইট রানার’। এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে রোদেলা ঝট করে উঠে গিয়ে এক লহমায় হাত বাড়িয়ে শেলফ থেকে পেড়ে আনে সেটি। আনন্দের রঙিন ঘুড়ি হয়ে উড়ে আসে সে আমার কাছে। তখন আমার এক হাতে মুরাকামি, অন্য হাতে খালেদ হোসাইনি।
হঠাৎ সেলফোনে নোটিফিকেশন আসে। ভাইবার নোটিফিকেশন। ভাইবার ব্যবহার করতাম না আমি, ইদানীং চাপে পড়ে কোন এক বিশেষ গোত্রভুক্ত হতে হয়েছে। সেখানে শুধু গোত্রভুক্ত থাকলেই চলে না, গোত্রাধিপতি ও বশংবদ সহচরদের সম্মান রক্ষার্থে তাঁদের দেয়া পোস্টগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হয়, লাইক দিতে হয়, মাঝে-মধ্যে কমেন্ট না করলে ‘মল পার্টি’-তে নাম ওঠে।
শেষ কথাগুলো ভালই বলেছেন ভাই
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল