ক’দিন আগেও এ ঘরটা বেশ খোলামেলা ছিল। লোকে তেমনটিই বলত । ক’দিন হল এ ঘরটাকে আমার গুমোট ঘুপচি মনে হচ্ছে। যেন চারপাশটা আমাকে ঠেসে ধরবে।শ্বাস রোধ হয়ে যাবে।ঘর নিয়ে গবেষণার পরিবর্তে এখন আমার অফিসের কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। আর কথা ছিল ছ’টায় বাসায় ফেরার।ততক্ষণে বেলী – আমার স্ত্রীও অফিস থেকে ফিরবে ।ছোট মেয়ে ঝিনুক আরও আগেই স্কুল থেকে ফেরে।সারা দিনের খাটা-খাটুনির পর স্ত্রী-কন্যার সাহচর্যে সব ক্লান্তি-শ্রান্তি মুছে যা্বে। আমরা তিনজনে আড্ডায় মাতব । সারাদিন কে কী করলাম সে সবই আড্ডার বিষয়বস্তু।রাতে খেতে বসে খাবারের স্বাদ নিয়ে বেলীকে গালমন্দ করব – তা সে যতই ভাল রাঁধুক।এক ফাঁকে বড় মেয়ের বাঁধাই করা ছবিটা চোখে পড়বে। এত কম বয়সে ওকে কেন হোস্টেলে পাঠালাম তা নিয়ে আফসোস করব । রাতে শোয়ার আগে ওকে একটা চিঠি লেখার খসড়া করব । খুব আদরে বড় হওয়া মেয়েটা হোস্টেলে কেমন আছে কে জানে !
হিসাব অনুযায়ী এমনটি হওয়ার কথা । কিন্তু সব হিসাব-নিকাশে তালগোল পাকিয়ে গেছে।আমি হয়ে গেছি বিছানাবন্দী । অসুস্থ হৃতপিণ্ড আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে, পাকাপোক্তভাবে । অন্য পৃথিবীতে যাত্রা করার সব ব্যাবস্থাও করে দিয়েছে। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার নয়।হৃৎপিণ্ডটাকে সুস্থ রাখার জন্য সব নিয়মই মেনেছি। তেল-চর্বি ছুঁয়েও দেখিনি । কম ক্যালোরির খাবার খেয়েছি চিরকাল। ঈদে–পার্বণে কখনো হেরফের হয়নি। যারা হিসেব করে খায়নি তাদের উপদেশ দিয়েছি-‘বুঝলেন ভায়া,জিভটাকে ছোট করুন । মুটিয়ে যাচ্ছেন ।বয়স হলে কত রোগশোক যে হবে !’ অথচ…আমার লালিত বিধি-নিষেধগুলো আমাকেই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কখন যে শরীরটাকে উচ্ছনে ঠেলে দিল…!
স্ত্রী,দু’টো ফুটফুটে মেয়ে – এই নিয়ে সাজানো বাগান।আমি সে বাগানের একনিষ্ঠ মালী হতে চেয়েছি।ওদের একটু সুখে রাখব,সে আশায় এই ছোটখাট বাড়িটা বানিয়েছি – তিল তিল করে টাকা জমিয়ে আর ধারদেনা করে । বাড়ি বানানোর সময় ঠায় দাঁড়িয়ে মিস্ত্রীদের তদারকি করেছি । দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেছে,কিন্তু মুখ থেকে হাসি আর বুক থেকে তৃপ্তিটুকু সরে যায়নি ।বুকে তখন একফালি সুখের জমিতে নিজের বাড়ির স্বপ্ন । বখাটে–চাঁদাবাজেরা স্বপ্নের গায়ে আঁচড় কাটতে এলে ওদেরও সামলেছি । প্রতিটা ইটে আমার ঘাম আর মমতার ছাপ আছে , এ আমি হলফ করে বলতে পারি । এখন আমার অসুস্থতা চলে যাওয়ার নোটিশ এনেছে । নিজের ঘর ছেড়ে কেমন করে অন্যখানে চলে যাব ? আমি দুর্বল হাতে দেয়াল আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি।কিন্তু নিষ্প্রাণ দেয়াল আমাকে ধরে রাখতে চায়না। কাঁড়িকাঁড়ি টাকা ঢালা হচ্ছে আমার পেছনে। একটা আধমরা মানুষের দিন কয়েক আয়ু বাড়ানোর চেষ্টা । হয়ত আমার ব্যয় স্ত্রী-সন্তানদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যটুকু খেয়ে ফেলছে । তবু বাঁচার লোভ হয় । চোখ দু’টো পানি ঝরিয়ে চলে যখন-তখন । পুরুষদের কাঁদতে মানা- এ নিয়ম তারা মানে না ।
বড় মেয়েটা হোস্টেল থেকে বাড়ী ফিরেছে । ওকে একদম অন্যরকম লাগছে । লাগারই কথা ।কৈশোরে পা রেখেছে যে । ও ওর কচি হাতে ভাত মেখে আমাকে খাইয়ে দিয়েছে । দু’এক গ্রাস মুখে দিতেই বুকটা শুন্যতায় ভরে গিয়েছিল । মেয়েটা একদিন বড় হবে । ওর সন্তানকে এমন করেই খাইয়ে দেবে।সে সুন্দর মুহূর্তটিতে আমি থাকব না ।গলা দিয়ে ভাত নামছিল না । বেলীকে ডেকে বলেছি মেয়ে দু’টোর যেন কখনো কষ্ট না হয়।আমি বেঁচে থাকব – এ রকম একটা সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ও বলেছে , ‘তোমার মেয়েদের তুমিই দেখে রেখো,আমি পারব না ।’ আমি জানি আমি দেখে রাখতে পারব না ।বেলীর কাঁধে সব দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেব।এ বোঝাটা ওর জন্য কি খুব ভারী হবে ?
মানুষ মরণশীল ।সবাইকেই মরতে হবে ।সেটা হয় দুই দিন আগে আর না হয় দুই দিন পরে ।
আর রিফাত তোমার লেখা সুন্দর হয়েছে । ছোট একটা কাহিনীকে সাহিত্যের প্রয়োগ এর মাধ্যমে সুন্দর একটা রুপ দিয়েছ । :clap:
ভবিষ্যতে এই রকম আরও লেখা থাকবে আশা করি । 🙂
মন ছুঁয়ে যায়।
কাহিনীর বর্ণনা ভাল্লাগছে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
:thumbup: :boss:
মাশাল্লাহ....পিচ্চিগুলা যে কেমনে এত সুন্দর লিখে...... :clap: :clap:
🙂
ভাল লেগেছে :thumbup:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
:clap: :clap: :clap:
::salute::
ভালো হয়েছে। অনেক দিন পর আমার নিজের বাবার জন্যও খারাপ লাগছে। বাবার এত কাছে থেকেও আমি কেন আমরা ভাই বোন কেউ বুঝতে পারিনি একটু পরে বাবা আর থাকবে না। এইটাই আমদের জীবনের শেষ একসাথে ইফতার ...।