10th Down মারকুটে ব্যাটসম্যান

বাংগালি জাতি ক্রিকেট পাগল জাতি।আমি বাংগালি, জাতেও পাগল; কিন্তু ক্রিকেট পাগল না। কোনো খেলাধুলাই আমি পারিনা, ক্রিকেট তো আরো না।হাল ছেড়ে দেবার লোক আমি না। সূতরাং ক্রিকেটার হিসাবে প্রতিষ্ঠা সাময়িকভাবে আমার জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হলো।

আমি তখন ৯ম শ্রেণীতে পরি; মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। সামনে আন্ত: হাউজ ক্রিকেট কম্পিটিশন।জুনিয়র গ্রুপে আমরাই সবচে সিনিয়র।সূতরাং দলে আমাদের সংখ্যাই বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু দলীয়করন এবং স্বজনপ্রীতি এমন একটা ব্যপার যা সর্বত্র বিদ্যমান। যেগুলা ভালো পারে, সেগুলা আবার রুমমেটকে দলে টানতে চায়।এমনতেই খেলা পারিনা , এর মধ্যে আবার পলিটক্স।টিমের অধিনায়ক(আব্দুর রহিম) আবার আমাকে দেখতে পারেনা ; কারণ আমি নাকি সবসময় নানা গ্যান্জাম পাকাই এবং নিকট অতীতে তাকে নাকি অশোভনীয় ভাষায় গালাগালি করছিলাম। সূতরাং ১১ তম সদস্য হিসাবে অধিনায়কের নমিনেশন, শামীম।

আমার ১১ সদস্যের টিমে চান্স পাওয়াই মুশকিল হয়ে গেলো।

সৌভাগ্যের ব্যাপার, সহ-অধিনায়ক জুয়েলের সাথে আমার কিছুটা ভালো টার্মস ছিলো। সূতরাং টিমে থাকার একমাত্র উপায়, জুয়েলকে ম্যানেজ করা।

জুয়েলকে ধরলাম। বলে, “তোরে তো কেউ টিমে নিতে চায়না।”
আমি বললাম, “ব্যাটা তুই তো সহ-অধিনায়ক, তোর কথার একটা দাম আছেনা? আর যদি দামই না থাকে, তাইলে এই পুতুল সরকারের দরকার কি? ছাইরা দে ভাইস-ক্যাপটেন্সি “।

পলিটিক্সটা কাজে লাগলো। ১ম ম্যাচে আমার প্রথম একাদশে জা্যগা হলো।
২০ ওভারের ম্যাচ। টসে জিতে ১ম এ ব্যাটিং। ১৯ ওভার তিন বলে ৬ষ্ঠ উইকেটের পতন হলো। আমি দেখলাম, আমার ক্রিকেটার হিসাবে এ যাত্রা ডেব্যু হবার সম্ভবনা বানচাল হয়ে যাচ্ছে। আমি মরিয়া হয়ে ডিক্লেয়ার করলাম আমি নামব। অধিনায়ক রহিম কিছুতেই রাজি না। আমি ব্যাপক কলহ শুরু করে দিলাম। এদিকে প্যাডগুলা আবার আমার জিম্মাধীন।উপায়ন্তর না দেখে আমাকেই পাঠাইলো।

১ম বল অফ স্ট্যাম্পের ২ ইন্চি পাশ দিয়া গেলো। আমি অবশ্য সজোরে চোখ বন্ধ করে হাকিয়ে ছিলাম। নন-স্ট্রাইকিং এ আদনান তখন ৫০ এর বেশি করছে। আমারে উপদেশ দিলো, এই বলে যেনো অবশ্যই ১ রান নিয়া তাকে স্ট্রাইক দেই। কিন্তু আমি আমল দিলাম না। মারকুটে ক্রিকেটার হিসাবে আমাকে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। ছক্কা একটা মারতেই হবে।

পরের বলে আবারও একই অবস্থা। ব্যাটে বলে একসাথে হলোনা। ছক্কার আশায় গুড়ে বালি। সিদ্ধান্ত নিলাম শেষ বলে বাউন্ডারি মারবো। ব্যাটের কোনায় লেগে বল থার্ডম্যানে গেলো।১ রান এবং খেলা শেষ।

এরপর ফিল্ডিং এ নামলাম।অভিঞ্জ অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নিলো আমারে সবচে সহজ পজিশনে ফিল্ডিং এ নামাবে, যেখানে বল সবচে কম যায়।
বেকুবটা আমারে ফাইন লেগে পাঠাইলো, অথচ পরে জানতে পারছি ঐটা নাকি সবচে’ কঠিন পজিশন।

নতুন বল। উইকেট কিপার হইলো ১ নম্বরের ফাউল। তারে টিমে সিলেকশনের কারন ছিলো, সে নাকি ফুটবলের খুব ভালো গোলকিপার।
কিপার ব্যাটা শুরু থেকেই মিস করা শুরু করলো। সব বল তার পায়ের নিচ দিয়া যায়। সূতরাং বল আসে আমার কাছে ফাইন লেগে। নতুন বল চরকির মত স্পিন করে আমারে পাশ কাটায়ে মাঠের বাইরে। এভাবেই চলতে থাকলো এবং হারলাম। বিপক্ষদলের সর্বোচ্চ রান এসেছে এক্সট্রা থেকে।

গুমোট পরিবেশ।আমার সাথে সবাই কথা বন্ধ করে দিলো। পরের ম্যাচে ১ম একাদশে আমার আর জায়গা হচ্ছেনা নিশ্চিত হয়ে গেলাম।

২য় ম্যাচ। ১ম এ ব্যাটিং। আমার বদলে শামীম টিমে। আমি দ্বাদশ খেলোয়ার। অফ সাইডে স্ক্যয়ার বরাবর বাউন্ড্রি লাইনে স্কোর বোর্ড। তার নিচে আমি বসে আছি চুপচাপ করে। দলে না নেয়ার শাস্তিস্বরূপ বিপক্ষ দলের সাপোর্টার।

আদনান আবারও তুমুল খেলছে।কিন্তু অন্য পাশের ব্যাটসম্যান গুলা একটার পর একটা আউট হইতেছে। শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে শামীম নামবে। আগের মতই ২০ ওভারের খেলা। ১৯ ওভার ৫ম বলে ৯ম উইকেটের পতন হইলো।
শেষ বল খেলতে শেষ ব্যাটসম্যান নামবে। শামীমকে দেখলাম প্যাভিলিয়নে প্যাড আপ করতেছে।

কিন্তু আউট হওয়া ব্যাটসম্যানকে দেখলাম প্যাভিলিয়নে না গিয়া স্কোর বোর্ড বরাবর আসতেছে। অর্থাৎ আমার বরাবর। আমিও বুঝলাম এই চান্স।জীবনে এই রকম চান্স আর পামু না। স্কোরার ছিলো জুনিয়ার ক্লাসের, সূতরাং কিছু বলার সাহস পাইলো না। ওরে ধইরা শামীমের নাম কাটাইয়া আমার নাম লেখাইলাম।

আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের একটা প্যাড কোনোমতে পায়ে দিয়া, আর হাত থাইকা ব্যাট নিয়া সোজা ক্রিজের দিকে দৌড়। শামীম রেডি হওয়ার আগেই আমি 10th Down মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসাবে গার্ড নিয়া নিলাম। আম্পায়ার খেলা শুরু সিগন্যাল দিয়া দিলো।

শামীম বাউন্ড্রি লাইনে বেকুবের মত হা করে দাড়ায়ে দাড়ায়ে আমার শেষ বলের খেলা দেখতে থাকলো।

খেলা শেষে সবাই আমারে ঘিরা ধরলো;”এইটা তুই কি করলি?”
আমি বললাম,”আদনান আমারে প্যাড দিলো, ব্যাট দিলো, তো আমি আর কি করমু, নাইমা গেলাম”।

আদনান তুমুল আপত্তি জানাইলো।সবাই গালাগালি শুরু করল। আমি নির্বিকার।

শামীমরে আংগুল দিয়া দেখাইয়া বললাম, “ঠিক আছে। আমারে যখন খেলতে দিবিনা তোরা, যা খেলুম না। ওরে 12th man হিসাবে ফিল্ডিং এ নামা।”

২,৫০৯ বার দেখা হয়েছে

৪৭ টি মন্তব্য : “10th Down মারকুটে ব্যাটসম্যান”

  1. তৌফিক

    ক্যাডেট জীবন শুরু হইছিল আপনারে দিয়া ব্যাগ টানাইয়া। এর প্রতিদান হিসাবে সিসিবি জীবনের শুরুতে ব্লগ প্রিন্সিপাল যখন ফ্রন্টরোল করতে বলবে তখন আপনার বদলি হিসাবে আমি ওইগুলা কইরা দিমুনে। O:-) ;;) O:-)

    জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    ব্যাপক মজা পাইলাম =)) =)) =)) =))
    দারুন, দুর্দান্ত!!! :)) :))

    10th Down না, সিসিবিতে ওপেনিং টাই মারকুটে হইছে রেদোয়ান (বাংলায় বানানটা কি ঠিকাছে? ) :thumbup: :thumbup:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    রেদওয়ান ভাই পোস্টে মির্জাপুর ট্যাগ করেন। আর রিকোয়েস্ট এইখানে নিয়মিত থাইকেন। আপ্নের লেখার আমি বিরাট ফ্যান।
    @ সবাই, রেদওয়ান ভাই আমার দেখা সবচেয়ে প্রণোচ্ছল ক্যাডেটদের মাঝে একজন। একটা আড্ডা জমানোর জন্য ইনি একাই যথেষ্ট।

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    দোস্ত ব্যাপক শুরু করছিস... :thumbup:
    নিয়মিত থাকিস, লিখিস...

    অ.টঃ প্রিন্সু আইসা কিছু কইলে 'না বোঝার ভান' করে থাকবি...(সাম্প্রদায়িকতা!! 😀 )
    '৯৫ আপ আপ... :awesome:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  5. হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    ব্লগে স্বাগতম ভাই। পাঁচতারা দাগায়ে দিলাম লেখায় 🙂 এই পোস্টটাকে একটা সিরিজের প্রথম কিস্তি ধরে নেয়া যায় না? তাইলে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়েন তাড়াতাড়ি 😀

    জবাব দিন
  6. জিহাদ (৯৯-০৫)

    আরে রেদওয়ান ভাই!
    আপনারে দেইখা খুব ভাল্লাগতেসে, বস 😀
    আমারে চিনার কথা না। চেনার দরকারও নাই। আমি FH এ ছিলাম। হাসনাইনদের ব্যাচ।

    তবে দুইদিন আফটার লাঞ্চ ডাইকাও পাঙ্গাননাই। এইজন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ! 😀

    সিসিবিতে নিয়মিত থাকেন। স্বাগতম।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  7. আন্দালিব (৯৬-০২)

    নতুন নতুন সিনিয়র আইসা ফাটাফাটি ডেব্যু পোস্ট দিয়া আমাদের ভাত মেরে দিচ্ছে। 🙁

    রেদওয়ান ভাই, লেখা খুব খুব ভালো হয়েছে। হাত-পা-প্যাড-গার্ড খুলে লিখতে থাকেন! :grr:

    সিসিবি'তে আপনার লেখা চলুক আরো আরও!

    জবাব দিন
  8. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    বস দেখি অন্য লেভেলের খাইশটা ছিলেন!!!মাইন্ড খায়েন না,সেইরাম মজা পাইছি ঘটনা পইড়া...আমার মজা লাগতেছে আপনের ক্যাপ্টেনের খোমার কথা চিন্তা কইরা =)) =))

    জবাব দিন
  9. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আমি আসার আগেই :frontroll: কোর্স কমপ্লিট!! গুড..... গুড বয়। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই কাফি! লেখাটায় ৫ তারা দাগাইছি আগেই :thumbup:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।