আমার রেজাল্ট

২০০৩ সালের কথা। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল দেবার দিন। বগুড়াতে বাসায় ছিলাম। তখনও ইন্টারনেটে ফল দেয়ার চল শুরু হয়নি। মোবাইল নেটওয়ার্কের প্রসারও তেমন হয়নি। সবাই নিজেদের রেজাল্ট জানতে তখন মাঞ্জা মেরে স্কুলের নোটিশ বোর্ডের সামনে ভিড় জমাত। আমার কলেজ রংপুরে হওয়ায় আমার সে সুযোগটা ছিল না। সবেধন নীলমণি টিএন্ডটি ফোনই ছিল যা ভরসা। কিন্তু সে সময় বাসায় ফোনটা নষ্ট। রেজাল্ট জানার একমাত্র উপায় বাবার অফিস থেকে ফোন করা। দুপুর থেকে টেনশন, আমার মত মানুষেরও সেদিন ঠিকমত খাওয়াটা হয়নি। কিছুক্ষণ পর বাবার আর্দালি এলেন, বাবার খাবার অফিসে নিয়ে যাবেন। আমি তাকে বললাম, আমার রেজাল্ট জানেন? তিনি আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন, “পাশ করছ, মিষ্টি খিলাও”। আরে বাবা, আমি এতটা খারাপ ছাত্র ছিলাম না যে, পাশ করব না। বললাম, রেজাল্ট জানেন? তিনি মুখে হাসি ধরে রেখেই বললেন পাশ করছ তো। পেটের ভাত যেন টেনশনে গুলিয়ে উঠল। মাথা চুলকিয়ে, উতিউতি তাকিয়ে কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সাহেবও মিষ্টির আশায় বসে আছেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝলেন, মিষ্টি তার ভাগ্যে নেই। তিনি বোধহয় ভাবছিলেন, এ কেমন ছেলেরে বাবা পাশ করেও খুশি না! ভগ্নমনোরথে তিনি খাবার নিয়ে বিদায় নিলেন।
পাশের এক বাসায় ফোন আছে, ভাবলাম গিয়ে নিজেই কলেজে ফোন দেই। আঙ্কেল তখন বাসায় নেই। ফোন লক করে চলে গেছেন। এনডব্লিউডি কল করা সম্ভব না। লোকাল কলই ভরসা। বাবার অফিসে ফোন দিলাম। ধরলেন না। বাসায় ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পর গিয়ে আবার চেষ্টা করলাম। এবার বাবার এক কলিগ ধরলেন। বললেন ডেস্কে নেই। আমি তাকে বললাম, বাবা ডেস্কে ফিরলে পাশের বাসায় যেন একটু কল করে। কাহাতক প্রতিবেশীকে বিরক্ত করা যায়! বাসায় কেউ নেই। বাবার অফিসে যে যাব, সে সুযোগটাও নেই। বাসার উঠানে পা ছড়িয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ঘণ্টা দুয়েক পর, পাশের বাসার আন্টি এলেন। হাতে এক টুকরা কাগজ। উনি হাসি মুখে বললেন, এই নাও রেজাল্ট। ওনার হাসি দেখে প্রাণে যেন একটু পানি পেলাম। কাগজ হাতে নিয়ে দেখি ৪.৫৩! আমার তো আক্কেল গুড়ুম। এত খারাপ তো হওয়ার কথা না। উনি আরেকটা কাগজ দিয়ে বললেন, এইটা তোমার বন্ধুর। সেটা নিয়ে দেখি আমারটার চেয়ে বেশি, কিন্তু ৫ না। আমাদের আগের ব্যাচে ৩ জন ৫ পেয়েছিল। তাই জিপিএ ৫ আমার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু তাই বলে ৪.৫৩! তখনই ছোট খালার আগমন। হাসিমুখে রেজাল্ট জিজ্ঞেস করলেন। পাংশু মুখে বললাম ৪.৫৩। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল, সারাদিন পড়াশুনার নামগন্ধ নাই, হেনতেন, হাবিজাবি আরও কত গালাগালি। আন্টি বুঝলেন অবস্থা বেগতিক। মিষ্টির আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে উনি চম্পট দিলেন। একটু পর আরেক খালা ঢুকল। ছোট খালার কাছ থেকে অবস্থা বুঝে দিয়ে উনিও ধোয়ার কাজ শুরু করলেন। আমি ভ্যাবলার মত তাকিয়ে শুধু গালি শুনে যেতে লাগলাম। একটু পর আম্মু স্কুল থেকে ফিরে এল। আম্মুর মুখেও হাসি। বাসায় ঢুকে ঘটনা কী জানতে চাইলেন। আমি বললাম, জানার দরকার নাই, তুমিও গালাগালি শুরু কর। ঘটনা শুনে আম্মুও মন খারাপ করে আমার পাশে বসে পড়লেন। খালা দুজন আম্মুর অবস্থা দেখে একটু ক্ষান্ত হলেন।
১ ঘণ্টার মত দুজনে বসে থাকার পর আম্মু জিজ্ঞেস করল, তোর কোন পরীক্ষা খারাপ হয়েছিল? মাথা চুলকিয়ে বললাম, কোনটাই তো খারাপ হয়নি। হলে সামাজিক বিজ্ঞানে এ প্লাস মিস হতে পারে। আর কোনটায় না। দুজনে হিসেব করতে লাগলাম। ভাবলাম, সামাজিক বিজ্ঞানে এ মাইনাস, বাংলায় এ মাইনাস, অঙ্কে এ, ইংরেজিতে এ। কিন্তু তাতেও ৪.৫৩ মেলানো সম্ভব হচ্ছিল না। যা হওয়ার হয়েছে ভেবে শেষে দুজনই হিসেব করা বাদ দিলাম। আশেপাশে প্রতিবেশীদের মিষ্টি দিতে হবে। তাই মিষ্টি বন্দোবস্তে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আম্মুর কাছে বেশি টাকা ছিল না। আর রেজাল্টও আহামরি কিছু না। তাই বাজারে গিয়ে সবচেয়ে নিম্নমানের আর কমদামি মিষ্টিটা কেন হল। দামও কম পড়ল। ততক্ষণে রাত দশটা বেজে গেছে। বাবাও বাড়ি ফিরলেন। সাধারণত এত দেরীতে উনি বাড়ি ফেরেন না। রেজাল্ট খারাপ বলেই উনি মন খারাপ করে দেরী করেছেন। কিছুক্ষণ পর ভাত খাওয়া শেষে মিষ্টি দেখে বললেন, এই মিষ্টি কেন? আমি বললাম, রেজাল্ট খারাপ তাই মিষ্টিও খারাপ। বাবা বললেন, হ্যাঁ রেজাল্ট একটু খারাপই হয়ে গেছে। আমি বলি, একটু খারাপ! এর চেয়ে বাজে আর কিছু হতে পারে! বাবা একটু অবাক। বললেন, ২৮ জন এ প্লাস পেয়েছে দেখে মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে নাকি? ২৮ জন! ২৮ জন এ প্লাস পেল আর আমি মোটে ৪.৫৩! আম্মু হঠাৎ বললেন, সৌরভের রেজাল্ট কী? কেন, ৪.৮৮।
৪.৮৮? আমি যেন নরক থেকে মর্ত্যে উঠে এলাম। এ যে আমার স্বপ্নেরও বাইরে। আমার আশা ছিল, খুব বেশি হলে ৪.৭৫ পাব। আমি আর আম্মু দুজনেই খুশি। আমাদের খুশি দেখে বাবা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, এত খুশি হওয়ার কী আছে। ২৮ জন এ প্লাস পেয়েছে আর আমি পাইনি।
বাবাকে কে বোঝাবে, আমার রেজাল্ট এক মুহুর্তে ০.৩৫ বেড়ে গেছে। ২৮ জন গোল্লায় যাক। আমার রেজাল্ট নিয়ে আমি স্বর্গ অভিমুখে যাত্রা করতেই বেশি উদগ্রীব।
প্রতি বছর এসএসসি, এইচএসসির রেজাল্ট দিলে আমার মনে পড়ে সেই দিনটার কথা আর অনিশ্চয়তাময় সেই ৮ ঘণ্টা!

১,২৪৬ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “আমার রেজাল্ট”

  1. ইফতেখার (৯৫-০১)

    আহারে কৈ সেই সব দিন ... দুইটা লেটার পাইসি বৈলা পুরা মান্জা মেরে ঘুরা যাইতো, আর আত্বীয়স্বজন শুনেই খুশি হয়ে পকেটে/পার্সে হাত দিতো সাথে কি আছে খুজতে ...

    স্টার পাইসি কিনা এইটাই ছিলো ম্যাক্সিমাম কোয়েস্চেন, স্টার মার্কস মিস না করলে মুখ উজ্জ্বল হয়ে যাইতো সবার ...

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।