ফাউ প্যাঁচাল-০৩

আমি নাকি এর আগের লেখাগুলায় চাপা মারছি আর ছোট ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করছি,এই ধরনের কথা বলায় হপ্তাখানেক আগে আমি বাপ্পী (মাহবুব ০০-০৬, BCC)-রে মাইখানেক দাবড়াইছি আর মিনিটদশেক পিটাইছি। যদিও তারে পিটানো নিয়ে আমার কোনোই আক্ষেপ নাই তারপরও বলতেই হয়, আমরা কমবয়েসী এক্স-ক্যাডেটরা একসাথে হইলে যেসব বিষয় নিয়ে গ্যাঁজাই সেইগুলা একই ভাষায় কখনও পোস্ট করলে বিরাট বিপত্তি আছে;সিসিবি নাস্তানাবুদ হয়া যাবে। তাই কিছু নিরীহ ছোটখাট ঘটনারে এক্টুখানি fabrication সহ লিখি…………….এবং এখন থেকে ফাউ প্যাঁচাল সাধু ভাষায়……

গল্প ৪ঃ
শামছুল আলম স্যার ছিলেন ওই সমস্ত শিক্ষকদের একজন যাঁহাদের গলার আওয়াজে আকাশে মেঘ ডাকিত, জংগলের শের হালুম দিতো এবং সুকুমার রায়ের ভাষায় মালুম হয় “আমাদের হাত পা পেটের ভিতর সেঁধিয়া যাইতো”। তা একদা তিনি আমাদের বি-ফর্মে ক্লাস নিতেছেন, পড়াইতেছেন জীবনবাবুর কবিতা। একে তো আধুনিক কবিতা, তাও আবার শামছুল আলম স্যার! আমরা গালে হাত দিয়া “ “বিপন্ন বিস্ময়” কথাটির মানে বড় হইলে বুঝিব, এখন নয়”-এই কথার মর্ম বুঝিতেছি। বোধ কবিতার সৌন্দর্যে ডুব দিতেছি, ওই সময় আমাদের আরেক কমবখত নাহিদ আসিয়া হাজির, সে এ-ফর্মের। সে মুখ কাঁচুমাচু করিয়া দ্বিধান্বিত স্বরে স্যাররে বলিল,
“ স্যার, আমারে ডেকেছেন?”
স্যার উনার দীঘল গুম্ফরাজির আড়াল থেকে এক অকৃপণ হাসি হাসিয়া বলিলেন, “হ্যা বাবা, ভেতরে এস………… আহা! ভয় কিসের?……… আমি কি বাঘ না ভাল্লুক, যে তোমারে খেয়ে ফেলব? …………কাছে এসে দাঁড়াও।”
সত্য কথা বলিতেছি, স্যারকে আমরা ওই সময় এইসব নিরীহ শ্বদন্তবিশিষ্ট শিকারি প্রাণীদের চাইতেও বেশি ভয় পাইতাম এবং নাহিদের ভীত চেহারা সেই কথা ব্যাপকভাবে প্রকাশ করিতেছিলো। তাও সে অতি সাহসে স্যারের সামনে গেলো। যাইবা মাত্রই স্যার তাহার কান পাকড়াও করিলেন এবং পরমূহুর্তেই তা পাকায়ে রক্তবর্ণ করিয়া দিলেন। অতঃপর আকাশে মেঘ গর্জাইলো, “গতকাল রাতে কি করতেছিলে ডাব গাছে??”

তাহলে আইসেন সেই রাতের ঘটনা বলি,
আমরা সবাই জানি যে ক্যাডেটদের ডাবতৃষ্ণা জ্ঞানতৃষ্ণার চেয়ে প্রবল এবং তারিক হাউসের পিছনের ডাববৃক্ষকূলের আধিক্য সর্বজনবিদিত। তাই ওই রাতে আমাদের ব্যাচের তারিক হাউসের কিছু তৃষিত ক্যাডেট ডাব পাড়িবার প্রকল্প করিল। সবই ঠিক আছে কিন্তু সাধারণত কিছু নিরাপত্তাজনিত কারণে হাউসের এতো কাছে ডাব পাড়া হইয়া থাকে না। তাই সকল সম্ভাব্য বিপদ বিবেচনা করিয়া তাহারা বৃক্ষারোহণ শুরু করিল। আরোহণকারীদের মাঝে ছিলো এই নাহিদ এবং সে অত্যুৎসাহী হওয়ায় কারো অপেক্ষা না করিয়াই তাহার assigned বৃক্ষে উঠা শুরু করিয়া দিলো। কিন্তু সকল সম্ভাবনা চিন্তা করিলেও একটি ব্যাপার কেহই চিন্তা করে নাই। শামছুল আলম স্যার ব্যাচেলর মানুষ বিধায় তারিক হাউসের তিনতলায় গেষ্টরূমে থাকিতেন, ক্যাম্পাসের কোন কোয়ার্টারে নহে। এই কারণে বাকিরা সবাই যখন গাছে উঠা শুরু করিয়াছে এবং নাহিদ একটির মগডালে চড়িয়া বসিয়া ডাব পাড়িবার পাঁয়তারা কষিতেছে, এক ভারি গলার গায়েবী আওয়াজ কোথা থেকে জানি আসিলো……
কে এইটা ডাব গাছে??”
নাহিদ প্রবল আতংকে ঘাড় ঘুরাইতে লাগিলো কিন্তু কাহারেও দেখিতে পায় না! সে কী ভয়ানক ব্যাপার!! অন্যরা তাহার থেকে বুদ্ধিমান ছিলো বিধায় তাহারা এই পরিকল্পনার একমাত্র ভুলটি টের পায়। তাই নাহিদের প্রাণপাখি যখন অদৃশ্য এক ভূতের ভয়ে ডাববৃক্ষের মগডালে ঘুরপাক খাইতেছে, বাকি বুদ্ধিমানেরা তৎক্ষণাৎ যাহার যাহার গাছ থেকে নামিয়া নিরাপদ স্থানে পলাইয়া আসিয়াছে। এই কয় মূহুর্তের বিলম্বই ছিল গায়েবী গলার মালিকের জন্য যথেষ্ট। মগডালে বসা নাহিদ সম্বিৎ ফিরিয়া পাইলে আবার গায়েবী আওয়াজ শুনিল,
“বাবা নাহিদ, নেমে আইস।”
ভূতের ভয়ে ক্ষুণ্নহৃদয়ে ও ব্যথিতচিত্তে নাহিদ নামিতে নামিতে যখন মাঝপথে, তখন আবার গায়েবী গলার আওয়াজ,
“কাল থার্ড পিরিয়ডে B-ফর্মে আমার ক্লাশ আছে, দেখা করবে তখন।”
কি আশ্চর্য! আমরা দেখিলাম নাহিদ ভূতের চাইতেও স্যারকে বেশি ভয় পায়। এইবার সে বাকিটুকু নামিয়া আসিলো।
———————————————————————————————————————–

গল্প ৫ঃ
ইহাও ডাব পাড়া নিয়া এক কাহিনী, তবে গল্প আমার কোনো ব্যাচমেটরে নিয়া নহে, কয়জন বড় ভাইদের নিয়া; এবং পূর্ববর্তী গল্প অপেক্ষা অধিক আনন্দদায়কও বটে। গল্পের খাতিরে ভাইদের নাম ধরি X,Y ও Z। Z ভাই বৃক্ষারোহণে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। X ওY ভাই, উনারা বৃক্ষারোহণ দর্শণেই অধিক আনন্দ পাইতেন।
তাই এক অমাবস্যার রাতে X,Y ও Z ভাইরা তৃষ্ণায় ব্যাকুল হইয়া উঠিলে উনারা ডাব পাড়িবার সংকল্প করেন। যথারীতি Z ভাই গাছে উঠিয়াছেন এবং X ওY সম্ভাব্য বিপদের আশংকায় চারপাশে চোখ রাখিতেছেন। পরিতাপের বিষয়, ওই রাতে ভাগ্যদেবী কিঞ্চিত অপ্রসন্ন ছিলেন বিধায় দুজন গার্ড ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইলো। উপস্থিত ক্যাডেটদের সাথে গার্ডদের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন নিম্নরূপঃ
“হৈ! হৈ!! হৈ!!! ধর, ধর।”
“হায়! হায়!! হায়!! পালা, পালা।”
সোজা কথায় গার্ডরা ভাইদের দেখিবা মাত্রই ধাওয়া শুরু করিলো এবং X ওY ভাইরা পালানো শুরু করিলেন। এবং Z ভাই তখনো গাছে! মিনিট পাঁচেক পরে X ওY ভাই দুজনেই জীবন বাজি রাখিয়া দৌড়াইয়া পালাইয়া আসিলেও Z ভাইয়ের কোন খবর নাই। সবাই চিন্তিত, আধা ঘন্টার পর Z ভাইয়ের চেহারা দেখা গেল। জানা গেলো উনি এতক্ষন গাছের উপরেই ছিলেন। পরিস্থিতির আচমকা পরিবর্তনে তিনি ভ্যাবাচাকা খাইয়া যান এবং গার্ডদের হাতে উনার বন্ধুদের ধাওয়া খাওয়া দেখিতে থাকেন। উনার বক্তব্য অনুযায়ী সে নাকি এক দর্শণীয় ব্যাপার। রাস্তার যে যে অংশ স্ট্রিটলাইটে আলোকিত ছিল শুধু সেই সেই অংশে এই ঐতিহাসিক দাবড়ানি দেখা যাইতেছিলো। পাঁচমিনিটের ধাওয়া পালটা ধাওয়ায় অনেক কিছুই ঘটে যাহা বিভিন্ন সময়ে চারজন ব্যাক্তির অবস্থান প্রকাশে বোঝানো যাইতে পারেঃ
১ম মিনিট- X,Y সামনে, পিছনে দুই গার্ড।
২য় মিনিট- X সামনে , তার পিছনে এক গার্ড, তার পিছনে Y, তার পিছনে ২য় গার্ড।
৩য় মিনিট- ১ম গার্ড, মাঝখানে X ওY, পেছনে ২য় গার্ড।
৪র্থ মিনিট- সামনে দুই গার্ড, পেছনে X ও Y।
৫ম মিনিট- দুই গার্ড দৌড়াইতেছে, X ও Y হাউসে।

এই জগাখিচুড়ির কারণ ছিলো একটাই, অমাবস্যার রাতের ঘুটঘুটে আন্ধকার। অবশেষে পরিস্থিতি ঠান্ডা হইয়াছে ভাবিয়া Z ভাই গাছ থেকে নামিবেন, ওমনি দুই গার্ড গাছতলায় আসিয়া হাজির। তাহারা শ্রান্তচিত্তে X ও Y বংশবদ কুকর্মের তালিকা বানাইতে লাগিলো এবং আজ রাতে Z কেনো আসে নাই বা আসিলেও কোন ঝোপঝাড়ে লুকাইয়া আছে তা গবেষণা করিতে লাগিলো। মিনিট পনেরোতক গালিগালাজ শেষে তাহারা যাইবে কি, তা নয়! উলটো তাহারা কি মনে করিয়া বিড়ি ধরাইয়া তাতে সুখটান দিতে লাগিলো; ইতোমধ্যে Z ভাই মশার কামড়ে হাত মুখ ফুলাইয়া ফেলিয়াছেন, হাত পা অবশ। তাই প্রায় আধাঘন্টার পর গার্ডরা হাল ছাড়িয়া চলিয়া গেলে Z ভাই নামিয়া আসার সুযোগ পান।
দুঃখ! ভাইরা ওই রাতে ট্যাপের পানি খাইয়া তৃষ্ণা মিটায়ে ছিলেন।
(পুনশ্চঃ ডাবগাছের মগডাল নাই জানি, তবুও বলিতে ভালো লাগে।)

—————————————————————————————————————
লেখকের কথাঃ আমার আগের দুইখান প্যাঁচাল পোষ্ট যদি না পড়ে থাকেন ও পড়তে চান-
ফাউ প্যাচাল-০১
ফাউ প্যাচাল-০২

২,৮৮৩ বার দেখা হয়েছে

৩১ টি মন্তব্য : “ফাউ প্যাঁচাল-০৩”

  1. আরাফাত (২০০০-০৬)

    দোস্ত তুই বাংলায় (এইচ এস সি) এ+ পাইলি না কেন 😮 😮 ।
    পুরাই রম্যরচনা 😀

    ১ম মিনিট- X,Y সামনে, পিছনে দুই গার্ড।
    ২য় মিনিট- X সামনে , তার পিছনে এক গার্ড, তার পিছনে Y, তার পিছনে ২য় গার্ড।
    ৩য় মিনিট- ১ম গার্ড, মাঝখানে X ওY, পেছনে ২য় গার্ড।
    ৪র্থ মিনিট- সামনে দুই গার্ড, পেছনে X ও Y।
    ৫ম মিনিট- দুই গার্ড দৌড়াইতেছে, X ও Y হাউসে

    এ থেকে বোঝা যায় ভাইরা পারমুটেশান কম্বিনেশান এর অঙ্ক ভালো পারতো :-B ।

    আমি প্রাকটিস কইরাও ডাব গাছে চড়া শিখতে পারি নাই :(( :(( ।
    রাজু, রিয়াদের কিছু কাহিনী লিইখ্যা ফেলা।

    জবাব দিন
  2. রিজওয়ান, তুই একটা মাল। শ্যাষবার রাজশাহী গিয়া কইছিলাম তোরে দারুণ ভালা পাইতাসি ইদানিং... আইজকা আবার কইলাম 😛

    এত সুন্দর করে লিখছিস কীভাবে? আমাদের X,Y,Z এর কাহিনীটা সেইরকম হইছে!! =)) =))

    ভালো কইরা লিখতে থাক। এইসব ফাউ প্যাচাল আমার খুব পছন্দের... 😀

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।