সফট স্কিলস বিষয়ে আমার ভাবনা

প্রায় ২৫ বছরের কর্মজীবন আমার, যার প্রায় পুরোটাই বলা চলে শিক্ষাজগতে “শিক্ষা-গবেষণা-প্রশাসন” এই তিন-এ আবর্তিত হয়েছে। এর মাঝে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় কাটিয়েছি ২১ বছরের বেশি সময় জুড়ে। দায়িত্ব এবং পড়ানোর নেশায় ছিল ভাষা, ভাষাতত্ত্ব, এবং সাহিত্য। তবে নিজের পূর্ণকালীন কর্মক্ষেত্রে এবং নানান জায়গায় আমন্ত্রিত হয়ে যে বিষয়গুলো পড়িয়ে বা আলোচনা করে অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছি, এবং বলা চলে যেগুলোতে সত্যিকারভাবে কারো কাজে আসতে পেরেছি, সেই কোর্স বা বিষয়গুলো ছিল সফট স্কিলস রিলেটেড। এমনকি পূর্ণকালীন কর্মক্ষেত্রের ভাষা, সাহিত্য, এবং ভাষাতত্ত্বের ক্লাসেও কর্ম-পরিবেশের অভ্যাস এবং শৃঙ্খলা বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের ধারণা দেবার চেষ্টা করেছি। আপাতত, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্র থেকে অবসরে থাকলেও কর্ম থেকে অবসরে থাকার মানসিকতার আমি নই। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যে কোন অবস্থাতেই কাজের মাঝে থাকার চেষ্টা করতে পারে; যে কাজে তার পারদর্শিতা তৈরি হয়, সেটাই সে চর্চায় রাখতে পারে; যেমন, আমার ক্ষেত্রে “শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা” – এই জগতেই আমার বিচরণ।

আমার মতে, সফট স্কিলস ইন্সট্রাক্টর হিসেবে ভাললাগা-ভালবাসা তখনই একজনের মধ্যে তৈরি হয়, যার মাঝে নিজ বিষয়ের/ডিসিপ্লিনের একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি আরো কয়েকটি চর্চিত এবং উপলব্ধ বিষয়/গুণ থাকে; আমাদের প্রেক্ষাপটেঃ ১। যার বাংলা ও ইংরেজির জ্ঞান (গাঠনিক, উচ্চারণ, এবং উপস্থাপন) গ্রহণযোগ্য মানের, ২। যিনি নিজে তার কর্ম, কর্মক্ষেত্রের শৃঙ্খলা, এবং কর্ম-পরিবেশন বিষয়ে সচেতন (মোটামুটি সিরিয়াস), এবং ৩। যিনি আই.টি. সহ অন্যান্য নিত্য নতুন চলমান টেকনোলজির বিষয়ে আগ্রহ ধারণ করেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই তিনটা তো প্রায় তিন রকমের প্রসঙ্গ, আবার আমার ডিসিপ্লিনের/সাব্জেক্টের সাথে এগুলো তো যায় না। তাহলে এবারে আবার উপরের তিনটা পয়েন্ট ঘুরে আসুন, আস্তে-ধীরে ভাবুন, মিলিয়ে নিন – আপনি কর্মক্ষেত্রে আপনার সহকর্মী, আপনার অধস্তন, এবং আপনার টিম লিডার (আগের দিনের “বস” টার্মটা রয়ে গেলেও কন্সেপ্টটা পুরোনো হয়ে গেছে) – এই তিনের কাছে আপনি আসলে কি এক্সপেক্ট করেন। এমনকি চাকরিদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছেই বা আপনার চাওয়াতে (এক্সপেক্টেশনে) সবচেয়ে কম লেভেলেও কী কী থাকে বা থাকতে পারে (ইদানিং কর্ম-পরিবেশের “টিক্সিসিটি” নিয়ে সচেতন মহলে বেশ আলোচনা হচ্ছে। কেনই বা হচ্ছে? এক্সপেক্টেশন্স এবং রিয়ালিটির বড় ফারাকের জন্যই তো, নাকি?)

বিষয়গুলো অতি সাধারণ। তবে মানিয়ে গুছিয়ে চর্চায় রাখাটাই মুখ্য। আর সেজন্য দরকার কিছুটা গোছানো আলোচনা, চর্চা, এবং তদারকি; এগুলো হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে, হতে পারে কর্মক্ষেত্রে ট্রেনিং-এর মাধ্যমে। তবে মনে রাখতে হবে, পরিবর্তন একদিনে বা এক মুহূর্তে হবে না বা আসে না। এর জন্য উদার ইচ্ছাশক্তি একটা কালেক্টিভ প্র্যাক্টিসের প্রয়োজন। ছোট থেকে বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে কাজের যে অভ্যাসগুলো আমাদের তৈরি হয়ে যায়, তা থেকে সহজে বেরুনো কষ্টসাধ্য তো বটেই, তবে অসম্ভব কিছুই নয়; প্রয়োজন শুধু নিজেকে শুধরানোর বা গোছানোর ইচ্ছা এবং নতুন কিছু জানার মানসিকতা বা প্রবণতা। আমার তো মনে হয়, এই বিষয়টাকে কিছুটা গুরুত্বের সাথে চর্চায় (প্র্যাক্টিসে) আনতে পারলেই বাকিটা আস্তে-ধীরে হয়েও যায়।

প্রসঙ্গতঃ আমার পুরোনো কিছু ছাত্রছাত্রীর অনুপ্রেরণায় আমি ইদানিং লিঙ্কডইন প্লাটফর্মে আগ্রহী হয়ে উঠেছি। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকি, তেমন একটা এ্যাক্টিভ না হলেও আমার আসলে ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করতে ভালই লাগে, অনেক কিছু জানার এবং বোঝার চেষ্টা করা যায় (অবশ্য এর জন্য আন-বায়াসড এবং নন-জাজমেন্টাল থাকাটা জরুরি)। ফেসবুক-কে আমি একান্তই ব্যক্তিগত প্লাটফর্ম হিসেবে বেছে নেই, আমার কারো কিছু পছন্দ না হলে, আমি তার সাথে থাকি না বা থাকতে অনাগ্রহী হই, আবার কেউ আমার সাথে এই ভার্চুয়াল জগত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেও আমি কিছুই মনে করি না। ইউটিউব আমি পছন্দ করি, কারণ অডিও-ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশনে জানার বা শেখার বিষয়কে দ্রুত আয়ত্তে নেয়া যায়। আর লিঙ্কডইন-কে আমি ওপেন রাখি, কারন এটা প্রফেশনাল জগতের সোসালাইজেশন প্লাটফর্ম; আমার মতে, প্রফেশনালি শেখার/শেখানোর বিষয়গুলো ওপেননেস/উন্মুক্তভাবেই বেশি ইফেক্টিভ। আমি নতুন নতুন কিছু বিষয় দেখে-শিখে বেশ অবাক হচ্ছি এটাতে যে, আমরা সামাজিকভাবে আসলেই বেশ ইমব্যালান্সড। ফেসবুকে যেখানে মতপার্থক্য আর বাদানুবাদের আধিক্য চোখে পড়ে, সেখানে লিঙ্কডইন আবার আমাদেরকে যেন ঠিক ততটাই নিজেকে গুছিয়ে উপস্থাপন করা শেখায়। যেমন, নতুন কোন জায়গায় গেলে সামাজিক বিবেচনা বোধসম্পন্ন একজন মানুষ আগে সেই জায়গা, সেই অঞ্চলের কালচার, এক্সপ্রেশনাল টিউনিং (আচারাদি) এসব বিষয়ে নিজেই ধারণা নিয়ে তারপরে সক্রিয় হন; লিঙ্কডইন যেন ঠিক তেমনই একটা মাধ্যম; এখানে যে যা খুশি বলছেন না, কারণ অন্যরা এখানে প্রফেশনাল এপ্রোচ নিয়ে আসছেন। অন্যের ব্যক্তি-ইস্যুতে এখানে আমি কারোরই কোন আগ বাড়ানো আগ্রহ বা অনধিকার চর্চা এখন পর্যন্ত দেখিনি। সবাই যেন এখানে প্রফেশনাল সভ্যতার চর্চাই করছেন – অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, শিখছেন, শেখাচ্ছেন।

আবারো মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই মুহূর্তে কর্মক্ষেত্র থেকে অবসরে আছি; মনে হচ্ছে কিছু একটা করি। তাই সফট স্কিলস নিয়ে আমার সামান্য জ্ঞানের অবস্থান থেকেই কিছু একটা করার ইচ্ছা হলো। আমি সফট স্কিলস নিয়ে এযাবৎ যা কিছু পড়িয়েছি, আলোচনা করেছি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সামান্য যা কিছু জেনেছি-শিখেছি, সেগুলোকে খুব সংক্ষেপে গুছিয়ে ভাব প্রকাশের চেষ্টা করছি। নানান জায়গায় যে লেকচার দিয়েছি বা আলোচনা করেছি, আর তখন যে টপিক এবং স্লাইডস সামনে এনেছি, সেগুলোকেই খণ্ডে খণ্ডে গুছিয়ে আলোচনার মতন করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। তবে এগুলোই তো শেষ নয়। আমার জানার সীমাবদ্ধতা নিশ্চয়ই আছে। আবার আমার আলোচনায় কেউ না কেউ আরো কিছু কন্ট্রিবিউট করতেই পারেন। আবার হয়তো কারো মনে জিজ্ঞাস্য কিছু উঁকি দিতে পারে, আর তাতে আলোচনা আরো নতুন ডাইমেনশন উন্মুক্ত করতে পারে। আরেকটা কথা না বললেই নয়, আমি যা কিছু সিরিজ আকারে লিখছি, সেগুলো যে আমারই আবিষ্কার, তা কিন্তু মোটেও নয়। আমি নিজে জেনেছি, পড়েছি, দেখেছি, শিখেছি, সহকর্মীদের সহায়তা নিয়েছি, তারপরে হয়তো কোন একটা টপিকের লেকচারের জন্য কম্পাইল করেছি, এবং সেইসাথে যোগ করেছি নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা। – এসব নিয়েই সেই ধারাবাহিক সিরিজ। প্রথম প্রথম প্রতিদিন লিখতে মজা লাগলেও, এখন আবার মাঝে মাঝে সেটা দায়িত্বের মতন চাপানোও মনে হচ্ছে, তারপরেও এক নেশার ঘোরে প্রায় প্রতিদিনই একটা করে নিজের বানানো পোস্টারের মতন ড্রাফট-ম্যাটেরিয়াল শেয়ার করে যাচ্ছি। – দেখা যাক কতদিন চালাতে পারি। কেউ সেগুলো পড়লে, চিন্তা করলে, বা সেগুলো কারো উপকারে আসলে সেটা আমাকে আনন্দ দেবে। লিঙ্কডইনে আমার প্রোফাইলে পোস্টগুলো ওপেন করা আছে।

©সহযোগি অধ্যাপক আহমদ মাহবুব-উল-আলম (অবঃ), পি.এইচ.ডি. রিসার্চ ফেলো (বি.ইউ.পি.)
লিঙ্কডইন প্রোফাইলঃ https://www.linkedin.com/in/ahmad-mahbub-ul-alam-ab9390135/

১১১ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।