শিক্ষকের ডায়রিঃ পর্ব-৭

আমি সচরাচর আমার এক্সিস্টিং কোন ছাত্র/ছাত্রীর কাছ থেকে কোন প্রকারের গিফট/টোকেন রিসিভ করি না। তবে কালেক্টিভলি ছাত্র/ছাত্রীরা যদি ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষকের জন্য (বিশেষ করে তাদের বিদায় অনুষ্ঠানে) স্মৃতিস্মারক হিসেবে কোন কিছু দেয়, তখন তো সেটা নিতেই হয়। অবশ্য এর বাইরেও কখনো কখনো নিতে হয়েছে; যেমন, কেউ হয়তো বিদেশ সফর থেকে ফিরেছে, এবং ডিপার্টমেন্টের সকল শিক্ষকের জন্য কিছু টোকেন নিয়ে এসেছে; আমার কাছে তখন মনে হয়েছে সেটা ফিরিয়ে দেয়া অসামাজিক এবং অসম্মানজনক।

আবার, একবার আমার তত্ত্বাবধানে একটা প্রজেক্টের কাজ করে আমার মাধ্যমে আন্ডারগ্র‍্যাড লেভেলের কয়েকজন সিলেক্টেড ছাত্রছাত্রীর সামান্য কিছু অর্থপ্রাপ্তি হয়েছিল। সেখান থেকে তারা আবার প্রত্যেকে কিছু পরিমানে কন্ট্রিবিউট করে আমার জন্য খুব সুন্দর একটা শার্টপিস এবং একটা চমৎকার টাই কিনে আমাকে গিফট করেছিল। খুব সম্ভবতঃ তাও আবার কোন এক ঈদের ঠিক আগ দিয়ে এবং সঙ্গত কারনেই আমি সেগুলোও ফিরিয়ে দিতে পারিনি। তবে, কোন ছাত্র/ছাত্রী চাকরি পেয়ে দু-চার মাস পরে ডিপার্টমেন্টে বেড়াতে এলে আমিই বরং তাদের কাছে মিষ্টি খেতে চাই; এটা মনে হয় আমি চাইতেই পারি। অবশ্য প্রায় প্রতিবারই আমি কিছু বলার আগেই তারা তাদের শিক্ষকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে যায়; এটা আমার মতন শিক্ষকের জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া; নিজের ছেলেমেয়েদের সফলতা দেখার আনন্দটাই অন্যরকমের।

তবে এমনও বেশ কিছু ঘটনা আছে, যখন ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ তাদের আবেগ বা ভালবাসার জায়গা থেকে আমাকে ব্যাক্তিগত ভাবে গিফট দিতে চেয়েছে কিংবা সাথে করে নিয়েও এসেছে, এবং সেগুলো বেশ সরাসরিই আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে। সেই মুহূর্তগুলো আমার জন্য বেশ অস্বস্তিকর ছিল। এখন অবশ্য বয়সের কারনে আমি আরেকটু স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড হতে শিখেছি। কোন ব্যাচ বা গ্রুপের সাথে প্রথমবার ক্লাস নেবার সময় আমি সরাসরিই কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখার কথাগুলোকে নির্দেশনার মতন করে বলে দেই যাতে করে তাদের অল্প বয়সের কোন অকওয়ার্ড ইমোশনাল বিহেভিয়ার/এক্টিভিটিজে মুখের উপরে “না” করে দেবার মতন সিচুয়েশনকে এ্যাভয়েড করা যায়। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক যথেষ্ট সাবলীল, তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই কিছুটা দূরত্ব সম্পর্কগুলোকে অনেকটাই ভাল রাখে।

আর এধরণের কিছু অতি সঙ্গত কারনেই আন্ডারগ্র‍্যাডের ছেলেমেয়েদের সাথে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় কানেক্টেড থাকি না। কারন মূলত একটাই, তাদের বয়স কম, কাজেই ম্যাচ্যুরিটিও কমই থাকবে এটাই স্বাভাবিক, আবার সেই সাথে ইমোশনাল কাজকর্ম দিয়ে অস্বস্তিও তৈরি করে ফেলবে। তবে মাস্টার্স লেভেল বা প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমার এই নিয়ম অনেকটাই শিথিল, কারন তারা গ্র‍্যাজুয়েট, জীবনের বেশ কিছু অধ্যায়কে উপলব্ধি করে ফেলেছে, কিংবা উপলব্ধি করছে। তাদেরকে এবং তাদের অবস্থান ও অবস্থানগত/অর্জিত ম্যাচ্যুরিটিকে আমি সম্মান করি।

মাত্র কদিন আগে আমার এক প্রাক্তন ছাত্রী আমার অফিসে এসে অনেক সঙ্কোচ প্রকাশ করেই আমাকে উপহার হিসেবে একটা চমৎকার ফটোফ্রেম দিয়ে গেছে। মেয়েটা মাত্র ক’মাস হলো চাকরি পেয়েছে। সে আমাকে বারবার বলছিল, আমার সাথে দেখা করে এই টোকেনটা দেবার জন্য তাকে নাকি অনেক সাহস সঞ্চয় করে তবেই আসতে হয়েছে। আমি ফেরাতে পারিনি, যদিও সেটা নিতে অনেক অস্বস্তি হচ্ছিল, তারপরেও নিলাম। বাসায় এসে আমার পরিবারের সবাইকে দেখালাম, পুরো বিষয়টা জানালাম, সবাই মনে হলো কিছুটা ইমোশোনাল হলো পুরো বিষয়টাতে।

মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে ক্রাফটেড সেই ফ্রেমটাতে আমার স্ত্রী-কন্যা মিলে পছন্দের কিছু ছবি সাজিয়ে নিল, আর আমার উপরে নির্দেশনা হলো আমি যেন অবশ্যই তাদের তরফ থেকে আমার সেই এক্স-স্টুডেন্টের প্রতি অন্ততঃ একবার হলেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, কারন আমার বৌ-বাচ্চা ধরেই নিয়েছে গিফট-টা আমাকে দেবার মুহূর্তে আমার সেই প্রাক্তন ছাত্রী আমার কাছে অনেক বকা খেয়েছে।

পুনশ্চঃ কিছূ প্রাসঙ্গিক কথা যোগ করতেই হচ্ছে। নিজের ডিপার্টমেন্টের প্রায় পনেরো বছর বা তারও বেশি সময়ের একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত জুনিয়রকে চাকরিতে পিক করার জন্য আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রথম দিকের আরেকজন ছাত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা। যেহেতু, এই লেখায় কারোরই অনুমতি নেয়া হয়নি, কাজেই এখানে নামগুলো না হয় অপ্রকাশ্যই থাক।

৩৬০ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “শিক্ষকের ডায়রিঃ পর্ব-৭”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।