হাতেতে যদিও না মারিত তারে, শত যে মারিত ঠোঁটে

“হাতেতে যদিও না মারিত তারে, শত যে মারিত ঠোঁটে”
… পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের “কবর” কবিতা থেকে নেয়া।

সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই ইদানিং “থাপ্পড়” মুভিটার রিভিউ লিখছেন। যে কটা পেয়েছি, সব কটাই মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। এখন পর্যন্ত আমার পঠিত প্রতিটা রিভিউ সবাই খুবই সুন্দর লিখেছেন।

তবে দুয়েকজনের কিছু জায়গায় খানিকটা দ্বিমত পোষণ করি। “৯৫% পুরুষ এই মুভিটা দেখে হিহি করে হেসেছেন”, কোন একটা রিভিউ-এ কেবল এই লাইনটা মেনে নিতে পারিনি, অন্ততঃ যতক্ষণ না স্ট্যাটিস্টাল সার্ভের দ্বারা এটা গবেষণায় প্রমানিত হয়। এই কথাটা নিউট্রাল রিভিউয়ের তুলনায় আবেগ-প্রসূতই বেশি বলে আমি মনে করি।

আমি মুভিটা দেখেছি, এবং আমার কাছে মনে হয়েছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটা প্রকৃত দর্শকের মনে ঝড় তুলে দেবার মতন একটা মুভি এটা। আমার পরিচিত মহলের বেশ কজন এই মুভিটার রিভিউ লিখেছেন, এবং সেই রিভিউয়ারদের লিস্টে নারী-পুরুষ উভয়েই আছেন। এবং সেই প্রতিটি রিভিউয়ে আমি উৎসাহ দিয়েছি।

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হয়তোবা এমন ক্ষুদ্র(??) আকারের “থাপ্পড়” থেকেই বৃহৎ আকারে রূপ নেয়। তবে আমার অভিমত হলো, থাপ্পড় জিনিসটা কখনোই গালে পড়ে না, পড়ে অন্য কোথাও।

এবারে আসি পুরুষ এবং পৌরুষ, এদুটো বিষয়ের বিবাহিত জীবনে প্রভাব এবং অবদান(??) নিয়ে। দাম্পত্যে জোর খাটানো বা আধিপত্য দেখানোর নাম যে পৌরুষ নয়, সেটা একজন পুরুষ শিশুকে শৈশব থেকেই শেখানো প্রয়োজন। মা-বাবার মাঝে সম্মানজনক সম্পর্ক দেখে বড় হওয়া একটা পুরুষ শিশু তার পরিণত বয়সে এবং বিবাহিত জীবনে তথাকথিত পৌরুষ দেখানোর কথা নয়।

এমনই আরেকটা সামাজিক চিন্তা উদ্রেককারী শর্ট ফিল্ম আমি এর আগেও দেখেছিলাম, এবং সেটা বেশ কয়েকবার দেখেছি, “আই ম্যারিড আ স্ট্রেইঞ্জার”। “থাপ্পড়”-এর মতন এটাও সব দর্শকের জন্য প্রযোজ্য নয়। যারা সাব্জেটের চেয়ে অব্জেক্টে ফোকাস করার অভ্যাসে রয়েছেন, তাদের জন্য এই মুভিগুলো নয়।

আমি বিশ্বাস করি, চ্যারিটি বিগিনস এ্যাট হোম। নারী-পুরুষ উভয়কেই সামাজিক রূপে (বায়োলজিক্যাল ফরম্যাটে নয়) কেবলমাত্র মানুষ নামক সামাজিক পরিচয়ে মেনে নিতে ঘাটতি হচ্ছে, এবং এমন একটা অসুস্থ চিন্তার শুরু হচ্ছে সেই শৈশবেই। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বায়োলজিকালি বিচার করার প্রবণতার বাইরে আসার ক্ষেত্রে আমরা ব্যার্থ হচ্ছি, তা সে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য যেখানেই হোক, ক্ষেত্রটাই শুধু আলাদা, মূল বিষয়টা সেইম না হলেও সিমিলার তো বটেই।

কেউ আবার অন্যান্য পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় এটাকে জাস্টিফাই করারও চেষ্টা করেন, এটাও আমার কাছে সঠিক মনে হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে (এটা সামাজিক ধারণা এবং ব্যাক্তিগত অব্জার্ভেশন থেকে লিখছি, কোন পরিসংখ্যান থেকে নয়) বিবাহিত ইয়াং কাপলের মধ্যে পুরুষের দ্বারা শুরু হওয়া ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে একজন বিবাহিতা নারীর বিপক্ষে সেই নারীর শশুরকুলের নারীরাই বেশি জাস্টিফাই করার রাস্তা খোঁজেন। এটা কোনভাবেই আমার কাছে বায়োলজিকাল রিজনিং মনে হয় না, এটা আমার একান্ত বিচারে সামাজিক বা সমাজের প্রচলিত(??) তথাকথিত পারিবারিক চর্চার একটা রিফ্লেকশন৷ আমার কাছে এটাকে সোশ্যাল শেইপিং মনে হয়।

একজন রিভিউয়ারের লেখায় পড়লাম, “থাপ্পড় মুভিটা দেখেছে কিনা” এমন প্রশ্নের জবাবে তার পরিচিত কোন এক পুরুষ নাকি নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেছেন, “আমি থাপ্পড় দেখিনি, তবে দিয়েছি”। রিভিউয়ারের কথার সত্যতা সম্পর্কে আমার তো জানার কথা নয়। তবে সেই পুরুষটিকে যদি শুধু এটুকু বলা হয়, “তাহলে আপনার বাবাও নিশ্চয়ই এটা দেখেননি বরং দিয়েছেন”, আমি নিশ্চিত পুরুষটি রেগে যাবেন, এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাগের মধ্য দিয়ে সেই পুরুষ তার কৃতকর্ম এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করবেন।

আমার অব্জার্ভেশন বলে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সাব্জেক্টের তুলনায় অব্জেক্টের দিকে বেশি ফোকাস করা হয়। আর এক্ষেত্রে বহুযুগের লালিত অভ্যাস বা চর্চা হিসেবে নারীই মুলতঃ অব্জেটিফাইড হন।

পেশায় আমি ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের শিক্ষক। সাহিত্যের কোন ক্লাসে এমন কোন আলোচনার টপিক চলে এলে, আমি সেটার গভীরে যাবার চেষ্টা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সাথে যখন ওপেনলি এই টপিকে আলোচনা হয়, খুব স্বাভাবিকভাবেই বয়সের এবং অভিজ্ঞতা ঘাটতির ফলে এবং সোশ্যালি শেইপড দৃষ্টিভঙ্গির কারনে প্রথমে এটা নিয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনার হিসেব-নিকেষ তারা করতে পারে না। আর করবেই বা কিভাবে? এমন আলোচনাকে তো আমরা প্রায় সোশ্যাল টাবু-র পর্যায়েই ভেবে নেই। তারপরে যখন জীবনের চলতে-ফিরতে ছোটখাটো হিসেবগুলো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সামনে আনতে থাকি, এবং সেইসাথে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোকে নিয়ে তাদের ভাবতে বলি, আমি অনেক ক্ষেত্রেই অবাক হয়ে দেখি, ক্লাসের মেয়েরা এই টপিকে আলোচনায় অংশ নেয়, আর ছেলেদের অনেকের চেহারায় কিছুটা নিশ্চুপ কষ্টের কিংবা চিন্তার ছাপ চলে আসে। আমি নিশ্চিত, তারা সেই মুহূর্তে তাদের মায়েদের বা বোনদের জীবনের হিসেব কষতে থাকে। আমি মোটামুটি এবিষয়েও নিশ্চিত যে, আমার এই ছেলেগুলো অন্ততঃ কিছুটা হলেও তাদের ভবিষ্যত বিবাহিত জীবনে একটা সমতার জীবন যাপন করার চেষ্টা করবে, কিছুটা হলেও নিজেকে তথাকথিত পৌরুষ (সো কল্ড ম্যাস্কুলিন) ইগোর বাইরে রেখে একজন মানুষ হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ লাইফ পার্টনারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হবে। আমার কাছে মনে হয়, যে কোন ক্লাসরুম বা একটা ক্লাস-ও একটা পরিবারের মতই; এখান থেকেও তো চ্যারিটির একটা সূত্রপাত করা যায়।

অনেক লিখে ফেললাম। পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে হয়তো অনেক কথা হবে। কেউ কেউ আবার হয়তোবা রাগও ঝাড়বেন। তবে, সবাইকে শুধু জসীম উদ্দিনের একটা লাইন স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, “হাতেতে যদিও না মারিত তারে, শত যে মারিত ঠোঁটে।”

১টি মন্তব্য “হাতেতে যদিও না মারিত তারে, শত যে মারিত ঠোঁটে”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "চ্যারিটি বিগিনস এ্যাট হোম" - এটাই মূল কথা, এই হোমের পাঠশালাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় পাঠশালা।
    হাতে ছোঁড়া তির অনেক সময় লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে, ঠোঁটে ছোঁড়া তির অব্যর্থ, সবসময় লক্ষ্যভেদী হয় এবং হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।