এটা কোন প্রকারের একাডেমিক, বা মনের দায়বদ্ধতার, বা ব্যাক্তিপর্যায়ের কাউকে ফোকাসের উদ্দেশ্যে লেখা নয়। লেখার প্রসঙ্গ ও চরিত্রগুলো আমার ব্যাক্তিজীবন, বেড়ে ওঠা, একাডেমিক ডিসিপ্লিন, প্রফেশনাল স্টাডিজ, পরিচিত মহল, এ-সবকিছুর সংমিশ্রণের প্রতিফলন হলে হতেও পারে। আপাতত শুধু এটুকু জানি, মাথায় কিছু চিন্তা কাজ করছে; কাজেই, লেখাটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এই মুহূর্তে বলা মুস্কিল। মনের মাঝে উঁকি দেয়া চিন্তাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই লিখতে বসলে ডায়রির পাতার মত এদিক-ওদিক চলে যায়। আসলে লিখতে ইচ্ছে হলো, তাই লিখছি।
আমি কবি-সাহিত্যিক কিছুই নই। বাংলায় লিখি মনের ভাব প্রকাশের সুবিধার জন্য, আর ইংরেজিতে মূলত একাডেমিক এবং প্রফেশনাল তাগিদে। খুব যে পড়াশুনা করি, তাও না। নিজের পড়াশুনা ভাষা-সাহিত্যে, আর পেশায় যেহেতু শিক্ষক, কাজেই ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক, কিছু তো পড়তেই হয়। আর পড়তে গিয়ে বা বিভিন্ন সেমিস্টারে একই বিষয় বা টেক্সট রিপিটেডলি পড়াতে গিয়ে কিছু গল্প-কবিতা-রচনা এবং সেগুলোর ইম্প্যাক্ট হয়তো মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে। আবার অনেক সময় নিজের জীবনের বা আসেপাশের জগতের কারো সাথে সেগুলো মিলেও যায়।
তবে ইদানিং ফেসবুক আর ব্লগ-সাইটগুলো কিন্তু বেশ মজার। অনেকেই লিখছেন। হয়তো বা অনেকে আবার আমারই মতন, এমনি-এমনিই লিখছেন। অনেকের লেখাই দেখি বেশ মজার, কারোটা চিন্তাপ্রসূত, কারোটা অটোবায়োগ্রাফিক, কারোটা আবার জীবনের অভিজ্ঞতার খণ্ডচিত্রমালা; পড়তে বেশ লাগে। লেখা পড়ে অনেক লেখকের সাথেই যুক্তি-তর্কে জড়িয়েছি, কারো লেখার ব্যাবচ্ছেদ করেছি প্রফেশনাল অভ্যাসকে সামলাতে না পেরে, আবার অনেককে আনফলো করেছি তাদের লেখার কণ্টেণ্ট, ফরম্যাট, অভিব্যাক্তি এবং ধাঁচ একপেশে হবার কারনে, কিংবা আমার ফিল্ড অফ ইন্টারেস্ট, প্রেফারেন্স এবং প্রায়োরিটি-র সাথে অতিরিক্ত গ্যাপ থাকার কারনে।
আমি ছোটবেলায় মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলাম। এখন অবশ্য আমার সাব্জেক্টেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটা ছোট বোন আছে; আমার একমাত্র বোন, আমার হাফ-সিস্টার। মা মারা যাবার পরে বাবাকে আবার বিয়ে দেয়া হয়; এরপরে আমার সেকেণ্ড মাদারের গর্ভে জন্মানো আমার এই বোন। অর্থাৎ, একই বাবা তবে দু-মায়ের গর্ভে জন্মানো আমরা দুই ভাই-বোন। দুজন মা, কাজেই নানুবাড়িও দুটো, খালাও অনেকগুলো। আমার ফুপুও আবার সাতজন; এর মধ্যে দুজন গত হয়েছেন। কাজিনদের মধ্যে বোনদের সংখ্যার হিসেবে আর নাই-ই বা গেলাম। বৌ আছে, একটা মেয়েও আছে আমার। আর বিয়ের পরে শাশুড়ী নামক আরেকজন মা আমার জীবনে যোগ হয়েছেন। কোন শ্যালিকা নেই; কাজেই এই না থাকাটা সৌভাগ্য নাকি দূর্ভাগ্য, সেটা বলতে পারছি না। এখন নিজ-বাড়িতে বাবা আর আমিই কেবল পুরুষ-দলে, বাকি সব নারী। ডিপার্টমেন্টে নারী কলিগ আছেন বেশ কজন। আর ছাত্রীর তো অভাব নেই। একেবারে নারীবেষ্ঠিত জীবন আমার। … … … এই মুহূর্তে একটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। অনার্স লেভেলের স্টুডেণ্ট থাকাকালীণ সময়ে লিসেনিং এণ্ড স্পিকিং কোর্সে একজনকে এক্সটেম্পোর স্পীচ হিসেবে ড্রীম অফ লাইফ নিয়ে বলতে বলা হলো। ছেলেটা বেশ দুষ্টু ছিল, বলে কিনা তার স্বপ্ন হলো তাকে ঘিরে যেন অনেক মেয়ে থাকে। স্পীচ শেষে রিভিউ সেশনে শিক্ষক স্মিত হেসে উইশ করলেন, সেই ছেলে যেন ভবিষ্যতে অনেকগুলো কন্যার বাবা হয়। তখন বেশ মজা পেয়েছিলাম; তবে এখন বুঝি স্যার কেন সেই কথাটা বলেছিলেন; ক্লাসের সেই শিক্ষক নিজেও কন্যার বাবা।
তবে আমার অতীত এমনটা ছিল না। ছোটবেলায় বাসার একমাত্র সন্তান হিসেবে একক পরিবারে বড় হওয়াতে নারী বা মেয়ে হিসেবে বলা চলে আমি কেবল মা-কেই চিনতাম। খেলার সঙ্গী ছিল ছেলেরাই। পড়েছি জিলা স্কুলে, ছেলেদের সাথে; এরপরে ক্যাডেট কলেজে, বলা চলে একেবারে মরুদ্যানবিহীন মরুভূমিতে। নারীসঙ্গবিহীনভাবে বড় হচ্ছিলাম বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথম-প্রথম মেয়েদের সাথে মিশতে স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। পরে জেনেছি, আমি নাকি অনেকেরই, বিশেষ করে ক্লাসের মেয়েদের, হাসাহাসি আর টিপ্পনি-উপমার বিষয় ছিলাম। বাসায় অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিতা কোন মেয়ে বা মহিলা এলে নিজের ঘরেই কিছু একটা নিয়ে ব্যাস্ততার ভান ধরে থাকতাম, নয়তো যে কোন একটা কাজের অজুহাতে বাসার বাইরে চলে যেতাম।
পরিবারে দুজন মা-কে দেখেই শিখেছি-জেনেছি, নারীর জীবন কেমন। ছোটবেলায় সেভাবে না বুঝলেও, এখন একাডেমিক এবং প্রফেশনাল পড়াশুনাতে মা-দের জীবনের প্রতিদিনের ছোট-ছোট জিনিসগুলো নিয়ে মনের মাঝেই রিভিউ করি। ছোট বোনটার সাথে আমার বয়সের বিস্তর ফারাক, তবে তার আগমনে শিখেছি পরিবারে শেয়ারিং কি জিনিস। বিয়ের পর থেকে নারী ও তার নানান রস এবং রূপ চিনছি, চিনেই চলেছি; তবে পুরোপুরি চিনেছি, তা বলা যাচ্ছে না, ব্যার্থতা আমারই। নট ব্যাড এট অল; অতীতের নারীসঙ্গবিহীন এ-জীবন সমৃদ্ধ হচ্ছে। কন্যা এসে শেখালো ভালবাসা কাকে বলে। বৌকে তো ভালবাসা যায়-ই, কিন্তু কন্যাকে ভালবাসা বা কন্যার ভালবাসা, সে বড় অদ্ভূত – আবদার, গাল ফোলানো, বাবাকে জড়িয়ে চুমু দেয়া, প্রতিটা যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা।
যাহোক, ইচ্ছে ছিল হায়ার স্টাডিজে গেলে লিটারেচার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এ্যাপ্লাইড লিঙ্গুইস্টিক্সের দিকেই যাব। কিন্তু, আয়রনি অফ লাইফ ইজ, আমি লিটারেচার নিয়েই কাজ শুরু করলাম। তাও আবার ফেমিনিজমের ধার ঘেঁসে। প্রথম সেমিনার দেবার সময় যে ড্রাফট জমা দিয়েছিলাম সেখান থেকে থিয়রিটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্কের কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম। … … … The foremost consideration for a better understanding of the term ‘feminism’ is possibly the verity that the creeds and values, altered with time, and forming isolate ‘waves’. Sheber (2017) mentioned that every wave has not the distinct time framework; rather each wave is better defined by its objectives and mechanisms than an interlude in time. She (Sheber, 2017) further coined the conventionally standard waves of feminism centered on ‘politics, culture and academia’. However, the promising fourth wave has not yet been unanimously accepted which is centered on technology. Historically, the first wave of feminism, which was centered for voting right of women, took place from 1900 to 1959, while the second wave occurring in the 1960s to 1980s was to focus on gender equality in family and work, including official and unofficial matters as well (Sheber, 2017). The third wave emerging from 1990 to 2008 prioritized women’s individual freedom over their own lives (Henry, 2004). And the fourth wave, which started in around 2012, has still been continuing to the present, emphasizing on the perception and individuality of both male and female citizens, along with fighting against women’s physical harassment and discrimination, strongly establishing women’s rights (Cochrane, 2013). … … … আমার চলমান গবেষণা মূলত জেন অস্টিন এবং শরৎ চন্দ্রের উপন্যাসে নারীর উপস্থাপনের তুলনা নিয়ে। তবে এমন বিষয় নিয়ে কাজে জড়িয়ে আছি, তা সত্বেও কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি ফেমিনিস্ট ভাবতে পারছি না। কারন নিজেও তো অনেক সময় হয়তো বৌয়ের সাথে প্যারালাল না থেকে ম্যাস্কুলিন হয়েছি, তা সে মনের অজান্তে হলেও। “বিইং এ ম্যান” আর “শোইং ম্যাস্কুলিনিটি” যে এক জিনিস নয়, তা মনে হয় আমরা অনেক পুরুষই ধরতে পারি না। আসলে ধরতে পারি না , তা নয়, বরং সেভাবে কিছু আমরা আসলে শিখিই-নি। এই পুরুষতান্ত্রিকতায় আমাদের নারীরাও যেন অনেকেই কোন না কোন ক্ষেত্রে আবার নিজেই নিজের মনের দিক থেকে পারিপার্শিক ম্যাস্কুলিনিটি-তেই শেইপড বা কণ্ডিশণ্ড।
কিছু টেক্সট বারবার পড়াতে গিয়ে ক্লাসের আলোচনার রেশ ধরেই সেগুলোর সাব্জেক্ট, থিম, ক্যারেক্টার্স, এসব যেন মাথায় ঘুরতেই থাকে, বিশেষ করে নারী চরিত্রগুলো এবং তাদের এক্সপেরিয়েন্স-গুলো। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছোট গল্প “ক্যাট ইন দ্যা রেইন”, এড্রিন রিচের কবিতা “আণ্ট জেনিফার্স টাইগার্স” এবং “লিভিং ইন সিন”-এর মত আরো বেশ কিছু টেক্সট যেন মাথার ভেতরে ইদানিং ঘুরপাক খেতেই থাকে। এই লেখাগুলোতে যে ফিমেল এক্সপেরিয়েন্স এবং মেলাঙ্কলি প্রজেক্টেড হয়েছে বা যেভাবে হয়েছে, তা আমার কাছে বেশ নিখুঁত মনে হয়েছে; এগুলো যেন আমাদেরই কন্যা-জায়া-জননীর গল্প। আজ বিকেলে বা সন্ধ্যায় ফেসবুকে গার্লস ক্যাডেট কলেজের আমার চেয়ে বছর তিনেকের জুনিওর একজনের লেখা পড়ছিলাম । পেশায় সে ডাক্তার অথচ চমৎকার লেখে; তার লেখা পড়ে মনে হয়ছে যেন এড্রিন রিচের কবিতার বাংলা গদ্য-ভার্শন, কিংবা হেমিংওয়ের ছোট গল্পের সেই মেয়েটারই কথা এটা। এই চরিত্রগুলো আসলে কারা? কাদের জীবন নিয়ে এসব গল্প? আসলে এরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদেরই পরিবারের নারী। আমাদেরই কন্যা-জায়া-জননী। আমার একান্ত হিসেবে এরা সবাই মিলেই “আমার জীবনে নারী”।
চমৎকার লেখা ভাইয়া। আপনার বাংলা গদ্য পড়ে আরাম হয়। নাম শুনে মনে হচ্ছিল একটা সিরিজ হতে যাচ্ছে। শিরোনাম পড়ে সমরেশের "মেয়েরা যেমন হয়" এর কথা মনে পড়লো শুরুতেই। সেরকম একটা সিরিজের কথাও ভাবতে পারেন কিন্তু।
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
ধন্যবাদ জিহাদ। সিরিজের চিন্তা যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। তবে তোমার মন্তব্য উৎসাহিত করছে। অবশ্যই মাথায় থাকল।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
খুব সুন্দর
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
খুব সুন্দর
ধন্যবাদ
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
সুন্দর লেখা। সিরিজ হলে বেশ ভাল হয়, অপেক্ষায় থাকলাম।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। মন্তব্যে উতসাহ পেলাম। সময় সুযোগ পেলে সিরিজ লেখার চেষ্টা করা যেতে পারে।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
লেখাটি আরো বেশী প্রত্যাশা নিয়ে পড়েছিলাম । সমালোচনা নয় পাঠকের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে। "আমার জীবনে নারী" লিখতে স্পর্শ করতে হবে মা স্ত্রী কন্যার বাইরের নারীকে ও।সেখানে হয়তো আরো সাহসী হতে হবে লেখককে।
আজকাল লেখায় যার বড় অভাব বোধ করি।বিষয় নির্বাচনের জন্য ধন্যবাদ।
পড়ার জন্য এবং এমন একটা মন্তব্যের জন্য অনেক-অনেক ধন্যবাদ।
তাহলে সাহস করে বলেই ফেলি। জীবনে একবার গভীর প্রেমে পড়েছিলাম। জেন অস্টিনের "প্রাইড এণ্ড প্রেজুডিস" উপন্যাসের নায়িকা এলিজাবেথ বেনেটের প্রেমে পড়েছিলাম। কাউকে মুখ ফুটে সেভাবে আগে এসব বলতাম না। বেশ লজ্জা-লজ্জা লাগত। তবে আমার শিক্ষকরা মনে হয় এটা টের পেয়েছিলেন। তাঁরা আমাকে এই চরিত্র নিয়ে অনার্সের ভাইভায় প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছিলেন। সেই ভাইভা বোর্ডের এক শিক্ষক তো জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, "জীবনে কেমন সঙ্গীনি চাই?" কাঁচুমাঁচু হয়ে বলেছিলাম, "সেটা এখনো ভেবে দেখা হয়নি।"
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
এই চরিত্রগুলো আসলে কারা? কাদের জীবন নিয়ে এসব গল্প? আসলে এরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদেরই পরিবারের নারী। আমাদেরই কন্যা-জায়া-জননী। আমার একান্ত হিসেবে এরা সবাই মিলেই “আমার জীবনে নারী”।
শেষটা একটু বেশিই সুন্দর। লেখার বাঁকে বাঁকে আমাকেও খুঁজে পেলাম যেন। তবে শুরুর দিকটায় কিছুটা বৈচিত্র্য থাকতে পারতো।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
আমাদের মানে পুরুষদের চারপাশে বহু নারী থাকে। কেউ থাকে কেন্দ্রের পাশের কক্ষপথে... কেউ বা একটু দূরে... কেউ বা আরও দূরে। যেমন থাকে পরমাণুর নিউক্লিয়াস এ প্রোটন ও নিউট্রন। আবার এর বাইরে ইলেক্ট্রন। প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের আছে আলাদা মিথষ্ক্রিয়া। কেউ কেউ বিকরষণাত্মক চার্জ নিয়েও এক সাথে থাকে কেন্দ্রে। কেউ ভিন্ন চার্জ নিয়েও থাকে বাইরের কক্ষপথে সতত ঘূর্ণায়মান।
ভালো লেগেছে।
মন্তব্যটাতে ব্যাতিক্রমের ছোঁয়া আছে, বলতেই হচ্ছে।
লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম