সোশ্যাল মিডিয়া কতখানি সোশ্যাল

“পুরানা যদিও কেচ্ছা তবু বর্বকত / সমঝাইয়া দিবে নয়া হাল হকিকত”
— সৈয়দ মুজতবা আলী, “গুরবে কুশতন শব ই আওয়াল” (মার্জার নিধন কাব্য), পঞ্চতন্ত্র

[ডিসক্লেইমারঃ এটা কোন গবেষণালব্ধ লেখা নয়; ব্যাপক পড়াশুনা করে ডেভলাপ করা কোন ড্রাফটও নয়। নিজের দেখা এবং অনুভব করা কিছু অভিজ্ঞতাকেই এখানে সাজানোর চেষ্টা করেছি মাত্র। আসলে দুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় পারিবারিকভাবে বেশ ঘনিষ্ট এবং যথেষ্ট স্নেহভাজন একজনের ক্রমাগত “মন খারাপ করা” ফেসবুক স্ট্যাটাসের কমেণ্টের ঘরে কিছু কথা লিখতে গিয়ে তার সাথে ভার্চুয়াল কমিউনিকেশনেই কিছুটা বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে এও অভিযোগ আসে যে, আমি নাকি নিজে ভাল আছি বলেই অন্যের কষ্টগুলো আমার কাছে সহজে বোধগম্য নয়। আমার এই লেখার মূল অংশটা সেই বাদানুবাদকেই পরিমার্জন করে তুলে ধরা, কিংবা বলা চলে সেই বাদানুবাদেরই ফসল। লেখাটা সামনে নিয়ে আসার তাগিদ অনুভব করছি মূলত একারনে, আমার পরিচিতজনের অনেককেই দেখছি ইদানিং ফেসবুক-ডিপেনডেণ্ট হয়ে কিভাবে নিজের লাইফ-স্টাইল-কে জটিল করে ফেলছেন। ফেসবুকের মত একটা পাব্লিক প্লাটফর্ম যে একান্ত ব্যাক্তিগত কোন ডায়রির পাতা নয়, এটা যেন আমরা অনেকেই ভুলতে বসেছি।]

অনেক পুরোনো এবং বহুল প্রচলিত একটা কথা দিয়েই শুরু করি, “ডোণ্ট জাজ এ বুক বাই ইটস কাভার”। এমন কোন মানুষ নেই, যার সমস্যা নেই। চেহারায় হাসি তো সার্কাসের জোকারেরও থাকে, কিন্তু তাদের জীবনের দুঃখগুলো আমরা কি কখনো চোখে বা ভেবে দেখেছি? “ছোটদের ছবি” নামের একটা মুভি দেখেছিলাম এই পেশার মানুষগুলোর জীবন নিয়ে; অসাধারণ একটা আর্ট ফিল্ম। যাহোক, এই মুভির প্রসঙ্গটা জাস্ট একটা কথার কথা; প্রাসঙ্গিকভাবে মনে হলো, তাই উল্লেখ করলাম।

প্রায় প্রতিটি মানুষ কোন না কোন সমস্যায় আবর্তীত। সম্ভবত প্রত্যেকের কাছেই তার নিজের সমস্যাটিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের সমস্যা বলে বেড়ান না বলে তার জীবনে কোন সমস্যা নেই, তা কিন্তু নয়। যারা সবসময়ই হাসিমুখে থাকেন, তাদের হাসির পেছনের চেহারাটাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমদের দেখা হয়ে ওঠে না। আমাদের প্রত্যেকেরই সমস্যা আছে এবং থাকবে। তবে সেগুলোকে এ্যাড্রেস করাই ভাল। সমস্যা থেকে পালিয়ে বেড়ালে সেটা কমে যায় বলে আমার কখনোই মনে হয় না। আর যে সমস্যাটা সেরে যাবার নয়, সেটাকে ঝেড়ে ফেলে দিলেই মনে হয় ভাল হয়; আসলে আমি এটাই বোঝাতে চাচ্ছি, এধরণের সমস্যা যাতে জীবনে বারবার ফিরে না আসে, তার জন্য সচেষ্ট থাকাটাই উত্তম বলে আমি মনে করি।

আর যদি সমস্যাকে ফেইস না করে “দূনিয়ার সবাই ঠিক হয়ে যাবে এবং আমি যেভাবে ভাবছি সেভাবেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে” এমন চিন্তা কাউকে পেয়ে বসে, তাহলে আমার হিসেবে বিরাট ঝামেলায় তারা নিজেরাই জড়িয়ে যায়। এর বাহিরে আমরা কেউই নই, এমনকি আমিও না। কারনটা সম্ভবত এটাই যে, এভাবে সমাধান হয় না এবং যে এভাবে সমাধান এক্সপেক্ট করে কেউ যখন দেখে যে তার মনের মতন করে সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না, তখন এর ধারাবাহিকতায় শুরু হয় মন খারাপ, টেনশন, এ্যাংজাইটি, এমনকি মেজাজ খারাপও। এগুলোর প্রতিটাই বড় সাংঘাতিক; আমি অনেক ভয় পাই; কারন আমার জানামতে এগুলোর যে কোন একটা দীর্ঘমেয়াদি হলে আরো অনেক সমস্যাকে ইনভাইট করে নিয়ে আসে। সেক্ষেত্রে মূল সমস্যাকে এ্যাড্রেস করা এবং মন খুলে কারো সাথে কথা বা বলা মন প্রফুল্য করার পজেটিভ রাস্তাগুলোতে বিচরণ করাই আমার কাছে বেশি গ্রহনযোগ্য মনে হয়। বই পড়া, গান শোনা, মুভি দেখা এসব যেন আজকাল অনেকেই ভুলতে বসেছেন। কিছুই যদি না হয়, অন্তত একান্ত ডায়রির পাতায় কিছু একটা লেখা যায়; অন্তত প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকেও তো নিজের মতন করে সেখানে মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা যায়।

এবারে আমার সমবয়সীদের গণ্ডিতে আসা যাক। আমার দেখা মতে মধ্যবয়স্কদের অনেকেই যারা ফেসবুকের মত সোশ্যাল মিডিয়ায় এ্যাক্টিভ, অথচ ভার্চুয়াল জগতের বাহিরে বাস্তব জীবনে মিনিংফুল ক্রিয়েটিভ এ্যাক্টিভিটিজ-এ বা সেল্ফ-রিক্রিয়েশন-এ ইনভলভমেণ্ট কম, তারা অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরণের সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের লাইফ স্টাইলের সাথে নিজেরটা কম্পেয়ার করা শুরু করেন। সেক্ষেত্রে যে ভুলটা তারা করে বসেন তা হলো, নিজের কি-কি আছে, সেটা ভুলে যান, এবং অপরপক্ষে অন্যরা ফেসবুকের মত সোশ্যাল মিডিয়াতে কিভাবে নিজেকে প্রকাশ করছেন তাতেই তাদের নজর বেশি পড়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার এই উপস্থাপন থেকে এটা মোটেও প্রমানিত হয় না যে তারা (ফেসবুকের মত ভার্চুয়াল জগতের সেই মানুষগুলো) আসলেই ঠিক তেমনটাই ভাল আছেন, যতটা তাদের ফেসবুকের পাতা থেকে মনে হচ্ছে। আর এরও ধারাবাহিক ফল হিসেবে আমি তো “ক্রমাগত মন খারাপের প্রবনতা” এবং আরও কিছু ধাপ এগিয়ে গেলে ক্ষেত্রবিশেষে “ফ্যামিলি ক্রাইসিস”-কেই অনেকের মাঝে ইদানিং বেশ দেখছি।

শুধু তাই নয়, এক পর্যায়ে এমনও মনে হতে পারে, “কেউই আমার সমস্যা বোঝে না”। আমার তো মনে হয়, “আমার সমস্যা কেউ বোঝে না কেন?” এই সমস্যাটা (চিন্তাটা) আবালবৃদ্ধবণিতা সকলের জীবনেই কখনো না কখনো আসে। এটা অবশ্যই একটা স্ট্রেস বা স্ট্রেসের ফল। এটাকে ম্যানেজ করে চলার নামই তো জীবন! স্ট্রেস-ম্যানেজমেণ্ট আমাদের জীবনে ভাল থাকার জন্য খুবই দরকার বলেই আমি মনে করি। তবে কে কোন পরিবেশে কিভাবে তার জীবনের স্ট্রেস সামলাবে, সেটা তাকেই পজেটিভলি ঠিক করে নিতে হবে। … … … কাউকে তো আবার দেখি একটা স্ট্রেস সামলাতে গিয়ে আরো কিছু অন্য স্ট্রেসে জড়িয়ে পড়ছেন, তা সে সোশ্যাল মিডিয়াতেই হোক, আর রিয়েল লাইফেই হোক। কিন্তু নিজের মন খারাপের বিষয়গুলোকে সোশ্যাল মিডিয়ায় পাব্লিক করে ফেলার মধ্য দিয়ে আদৌ কোন সমস্যার সমাধান হয় কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার।

আমি নিজেও অনেক ক্ষেত্রে পাজলড হই। সমস্যায় থাকি। ঠিক সেই সমস্যাগুলোর মুহূর্তে হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারি না, কিন্তু সেটাকে সোশ্যালি পব্লিক করে ফেলা হলো আমার মতে বড় একটা বোকামি। নিজের বল অন্যের কোর্টে দিয়ে দেবার মতই। কারন, একসময় আমার সমস্যাগুলো হয়ত সেরেই যাবে, কিন্তু আমি তো তখন আর অন্যের দুয়ারে-দুয়ারে গিয়ে বলতে পারব না, আমার সমস্যা মিটে গেছে। সেক্ষেত্রে কিন্তু আরেকটা ঝামেলা, সমস্যা মিটালাম, কিন্তু লংটার্ম অস্বস্তি ইনভাইট করে রাখলাম।

আচ্ছা একটু নিজের মত করেই নাহয় ভাবি, আজকে আমার মন খারাপ, আমি ক্রমাগত সোশ্যাল মিডিয়ায় পব্লিকলি এমন কিছু লিখলাম, যাতে সবাই বুঝে গেল যে, আমি সমস্যায় আছি বা আমার মন খারাপ। এখন, আমার প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে তাদের মতন করে বোঝালেন, কিন্তু তাদের বোঝানোর স্টাইলটা আবার হয়তো আমার মনের মত হলো না। … … … ওদিকে আবার আরেকটা গ্রুপ হয়তো সামনা-সামনি আমার সাথে সহানুভুতির “উহ-আহ” করে যাচ্ছেন, “একদম মনের কথা বলেছেন! আসলে আমাদের সমস্যা কেউই বুঝবে না!” এসব হয়তো বলবেন ঠিকই, কিন্তু আমার সমস্যা যাদের জানার দরকার নেই, তাদের কাছেও যথেষ্ট নির্ভরযোগ্যতার সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই গ্রুপ্টাই পৌঁছে দেন/দেবেন।

… … … আপাতত, মূল প্রসঙ্গে আমার কথা শেষ। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, কারা আমার সাথে আমার মনের মতন করে না হলেও অন্তত রেগুলার আমার পেছনে লেগে থাকেন কেবলমাত্র আমাকে মনের দিক থেকে চাঙ্গা করার জন্য? যারা আমার মঙ্গল কামনা করেন? নাকি উল্টোটা?

… … … লেখাটা শুরু করেছিলাম “সমস্যা” নিয়ে। এখানে আমার একটা উপলব্ধি শেয়ার না করলেই নয়। ক্যাডেট কলেজের আমার দুই বছরের জুনিয়র একজন বর্তমানে কোন একটা প্রথম শ্রেনির গ্রুপ অফ কোম্পানিজের একটা উইং-এর প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। তিনি তার বয়সের তুলনায় অনেক উঁচু পদ সামলাচ্ছেন, এবং অবশ্যই সেটা নিজ যোগ্যতাতেই। একবার তার একটা কথা আমার বেশ মনে ধরেছিল, যা ছিল অনেকটা এরকমঃ “সবাই যেখানে প্রব্লেম দেখে, আমি সেখানে খুঁজি প্রোস্পেক্ট”!! … … … সমস্যা ছিল, আছে, থাকবে, কিন্তু এসবের মাঝে আমি নিজেকে দুঃখ বিলাসী করে সবার সামনে নিয়ে আসব, নাকি প্রকৃত সমস্যাকে এ্যাড্রেস করে একটা আরামের পথ খুঁজে নেব, তা আমাকেই বেছে নিতে হবে।

… … … আরেকটা কথা, যদিও হাস্যকর তবুও লেখার শেষে এসে কেন যেন হঠাত মনে হলো, তাই লিখছি, নাথিং সিরিয়াস, আবার হতেও পারে সিরিয়াস। … … … সোশ্যাল মিডিয়ায় মনের ভেণ্টিলেশনের এধণের প্রবনতা যদি কেবল অন্যের সিম্প্যাথি নেবার জন্যই হয়ে থাকে, তাহলেও সাবধান!! কখন না তা আবার অভ্যাসে পরিনত হয়!! আবার এতে ধরা খেলেও বিপদ!! রাখাল বালক ও নেকড়ে বাঘের গল্প তো সবারই জানা!!

৫,৬৬০ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।