আমি কি? শিক্ষক? – ১ম পর্ব
আমি কি? শিক্ষক? – ২য় পর্ব
শিক্ষকতার পেশায় এক যুগেরও বেশি সময় পার করে আজ আমি ভাবতে বসেছি, আমি কি? আমি কি পড়াচ্ছি? আসলেই কি পড়াতে পারছি? আমি জানি যে, আমি নিজেও অনেক কম জানি। যত দিন যাচ্ছে, নিত্যনতুন বিষয় জানছি। নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও টের পাচ্ছি। আসেপাশের কারো কাছে যেকোন ধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় যখনই পাচ্ছি, লুফে নেবার চেষ্টা করছি; আর টেরও পাচ্ছি, আমি কত কম জ্ঞান রাখি। কিন্তু সজ্ঞানে কখনো “কুশিক্ষক” হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছি, তা মনে পড়ে না। অন্তত গত এক যুগেরও বেশি সময়ে আমার হাতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থিদের কাউকে সজ্ঞানে অবহেলা করিনি। ক্লাসে তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে, আর যাই হোক গোজামিল দেইনি। সরাসরি প্রকাশ্যে বলেছি, “আজ আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না; আমি নিজে জেনে তারপরে জানাব।” এবং সেটাই করার চেষ্টা করেছি। এতে করে আমি কখনো ছোট হয়েছি বলে মনে হয়নি।
ছাত্ররা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকের আচরনের সমালোচনা করে থাকে, আমার ক্ষেত্রেও তা হয়। কিন্তু অকপটে নিজের দূর্বলতা স্বীকার করে এখন পর্যন্ত সমালোচিত হয়েছি বলে শুনিনি। ব্যক্তিজীবনে খুব ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে নিয়ম এবং অনুশাসনে থেকে তারপরে ক্যাডেট কলেজের জীবন পার করে সামনে এগিয়েছি। কাজেই আমার আচরনে অবশ্যই এর প্রভাব আছে। বিষয়টা ভাল কি খারাপ, জানিনা; তবে আমার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। যতটুকু জানি, তা ছাত্রদের সামনে উজাড় করে দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে আমি ছাত্রদের পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে। সিলেট ক্যাণ্টনমেণ্টের পাহাড়ের গায়ে বড় হরফে লেখা “ঘাম রক্ত বাচায়” কথার সাথে আমি সম্পূর্ণ সহমত।
ছাত্ররা জিপিএ-৫ পাচ্ছে, ভাল কথা। সবাই পাক, আমি খুশিই হব। কিন্তু তার যথাযথতা থাকা দরকার। এই জিপিএ প্রাপ্তির কতটুকু যথার্থ আর কতটুকু তোতা পাখির বুলি, তা নিয়ে আমরা এখন মনে হয় প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সবাই সন্দিহান। ছাত্রের রেজাল্ট যদি প্রকৃত পরিশ্রমের ফসল হয়, তাহলে তো এমনটা হবার কথা না যে নিতান্তই প্রথম পাতার একটা প্রশ্নের উত্তর ছাত্র দিতে পারবে না। আমি এটা পড়ি, ওটা পড়ি, এই আমার রেজাল্ট। কিন্তু তাহলে কি পড়লাম, তা জানি না কেন? মনে নাও থাকতে পারে, ভুলে যেতেই পারি; কিন্তু জানিই না কি পড়লাম, এ কেমন কথা! আজকের ছাত্র, যে কিনা আগামির কর্নধার, সে কেন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আর কিছুই জানবে না? ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, তথ্য প্রযুক্তি, এসবে ছাত্রের আজ এত অবহেলা কেন। আমি অবাক হই যখন দেখি আসেপাশের অধিকাংশের কাছেই, কিংবা ছাত্রসমাজের বড় একটা অংশের কাছে তথ্যপ্রযুক্তির মানে যখন কেবল ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ। এখানে মা-বাবা-রা কি সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্ত? দায়ভার কিন্তু আমারো। আমি যে শিক্ষক!
আমি কখনোই সিষ্টেমের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে নির্দোষ বলার পক্ষে না। আমরা সবাই মিলেই সিষ্টেম। সিষ্টেমকে সবাই মিলেই সচল রাখতে হয়। কাজেই সিষ্টেম ঠিকমত না চললে আমিও দোষী। ক্লাসে পড়ানোর ফাকে আমার ছেলেমেয়েদের মাথায় আমি এই কথাটা জোরালোভাবে ঢোকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু, আদৌ কি পারছি?
মানুষ প্রাপ্তিতে খুশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা যেন আকাশ ছাড়িয়ে না যায়, সেটাও তো দেখা দরকার। আমি আমার ক্লাসের ছাত্রদের কাছে আমার সেই বন্ধুটির কথা প্রায়ই বলি, যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২.৭২ সিজিপিএ নিয়ে সামরিক বাহিনীর শিক্ষা কোরে গিয়ে শর্ট কোর্সের মধ্যে প্রথম হয়েছিল। সে কি খারাপ মানের ছাত্র ছিল? সে তো ঠিকই তার যোগ্যতাবলে জীবনে অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তাকে নিয়ে আমরা বন্ধুরা যথেষ্ট গর্ববোধ করি। হলফ করে বলতে পারি, আমার সেই বন্ধুটিকে আমি কোনদিন সিজিপিএ-র পিছনে ছুটতে দেখিনি। মাষ্টার্সে পড়ার সময় দুই সেমিষ্টারেই আমি প্রায় টানা ২০/৩০ দিন ক্লাস করতে পারিনি; এক সেমিষ্টারে ডেঙ্গু আরেকবার চিকেন পক্স। আর এই দুই সেমিষ্টারেই এই গ্যাপের মধ্যে প্রতিটি কোর্সেই অন্তত একটা করে সম্পূর্ণ টেক্সট ক্লাসে পড়ানো হয়ে গিয়েছিল। আমার সেই বন্ধুটিই তখন আমাকে সবচেয়ে বেশি পড়াশুনায় সাহায্য করেছিল। নিজে পড়ে সে আমাকে পড়িয়েছিল। আমি তার কাছে চির ঋণি। কিন্তু নিজের গ্রেড নিয়ে কখনোই তার কোন মাথাব্যাথা আমি দেখিনি। নিজের মাথায় জ্ঞান না রাখলে সে আমাকে পড়ালো কিভাবে?
আমি জীবনে কোন পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি বলে মনে পড়ে না। সারাজীবনই অতি সাধারনভাবে মধ্যমমানের রেজাল্ট করেছি। শিক্ষকদের আমার কাছে প্রাত্যাশা কি ছিল, তা সঠিক বলতে পারব না, তবে আমি যা করেছি, যা পেয়েছি, তাতেই আমার মা-বাবা এবং আমি নিজে অনেক খুশি। কারন পাঠ্য পুস্তকের বাইরেও জীবনকে অনেক উপভোগ করেছি-করছি, শিক্ষকদের স্নেহাশিষে ধণ্য হয়েছি সারাটি জীবন, প্রথম সারির না হওয়া সত্বেও শিক্ষক এবং গুরুজনদের সান্যিধ্যে যা পেয়েছি, তাই ধারন করার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি তা জানিনা, কিন্তু চেষ্টা তো করেছি, আর তাতেই অনেক আনন্দ পেয়েছি, জীবন স্বার্থক মনে হয়েছে; ছিটেফোটা যা কিছুই তলানি হিসেবে অর্জন করেছি, সম্পূর্ণ উজার করে বিলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রায়ই অনেক হতাশ হই, যখন দেখি বিলিয়ে দেয়াতে আমার প্রাপ্তি এ-কালে যে প্রায় শুণ্যের কোঠায়।
[২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।]
ক্লাসে তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে, আর যাই হোক গোজামিল দেইনি। সরাসরি প্রকাশ্যে বলেছি, “আজ আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না; আমি নিজে জেনে তারপরে জানাব।” এবং সেটাই করার চেষ্টা করেছি। এতে করে আমি কখনো ছোট হয়েছি বলে মনে হয়নি। :clap: :clap:
নিজের মনের আনন্দে লিখালিখি করি।
🙂
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
ভালো লেখা।
জিপিএ বা ক্লাসে ১ম/২য় হওয়াই যে সব না এইটা বুঝে ওঠাটাই জরুরী।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
এই জিনিষটা মা-বাবা-দের সবার আগে বোঝা উচিত।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
কেউ বুঝে না রে ভাই।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আমি কিন্তু অনেককেই দেখি, যারা বোঝেন।
যারা বুঝছেন না, তারা হয়ত সংখ্যায় ভারি।
কিন্তু তারপরও, অনেকেই বোঝেন।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
যারা সন্তানদের উপর অযথা চাপ দেন না এদের সংখা নগণ্য।
এদের মধ্যে আবার বাবা বা মা কেউ একজন চাপে রাখে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
কথাটা সত্য!
কিন্তু আমি আশাবাদী!
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
লেখাটা আমার মনের ভাবনাকে কতকাংশে প্রতিফলিত করেছে।
এমন কিছু বিষয় নিয়ে আড্ডা বা আলাপে কথা বলা হচ্ছে আজকাল মাঝে মধ্যেই। এবার জিপিএ-৫ নিয়ে সব নাটকীয়তার মাঝে কথাগুলো গলার কাছে দলা পাকাচ্ছিলো। লিখে ফেলতে হবে খুব শিগগিরই। নিশ্চিত ভাবে সিসিবিতে শেয়ার করবো।
ভালো লাগলো লেখাটা। সাধুবাদ।
লিখে ফেলেন, ভাইয়া।
পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম