ভিক্ষা নাই, মাফ করেন

দেশ হিসাবে আমেরিকা খুব একটা খারাপ না। বিদ্যূত এর সমস্যা নেই, যানজট এর বালাই নেই, আবহাওয়াও খুব একটা খারাপ নয়। ছোট থাকতে সাদা-কালোর যেই পার্থক্যের কথা শুনতাম এখানে এসে ওই ভুলও মোটামুটি ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু …………. সব খানেই একটা কিন্তু থেকে যায়। যেমন-

# ঘটনা ১.

আমি একটা সুপার স্টোর এ কাজ করি যেখানে ৭০% ভাগ কর্মচারী বাঙ্গালী সুতরাং বাকিরা বাংলা না বুঝলেও কথা বললে বুঝতে পারে যে এটা বাংলা।
একদিন আনুমানিক ৬০-৬৫ বছরের একজন প্রৌঢ় দোকানে ঢুকে মাতলামি শুরু করার কিছুক্ষন পরে একজন আফ্রিকান কর্মচারী আমাকে এসে বলল লোকটা বাঙ্গালী, আমি যাতে তাকে বাইরে চলে যেতে বলি।
আগেই বলে রাখি বাঙ্গালীদের জন্য দোকানে ঢুকে মাতলামি করা মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার।
তার কাছে গিয়ে ভদ্র ভাবে ইংরেজীতে তাকে দোকান থেকে বের হয়ে যেতে বলার পর সে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপরে বাংলায় জিজ্ঞাসা করল,
– “বাঙ্গালী?”
– “হ্যা”
– “তাইলে বাবা আমার সাথে এইরকম ব্যবহার করছ কেন?”
– “আপনি দয়া করে বের হয়ে যান, দোকানের নাম তো খারাপ করছেনই সাথে বাংলাদেশ এরও নাম ডুবাচ্ছেন।”
তাকে PUSH করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় উনি যা বললেন তার সারমর্ম অনেকটা এরকম,
ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বি.এ পাস করেই এখানে [NY] চলে আসেন। ট্যাক্সি চালিয়েই অনেক পয়সা পেতেন সুতরাং অন্য পেশার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।
এখানে ২-৩টা বাড়ি আছে, ব্যাঙ্ক এ অঢেল টাকাও আছে খালি পরিবার নেই। নেই মানে মারা গেছে বা বিয়ে করেননি তানা, ছেড়ে চলে গেছে।
এখানেই বিয়ে করেছিলেন, আর বাকি ১০টা আমেরিকান মেয়ের মতন তার বউও বিয়ের ৮-১০ বছর পরেই ডিভোর্স দিয়েছে।
ছেলে-মেয়েরাও বড় হওয়ার পরে আর “ট্যাক্সি চালক” এর সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখতে চায়নি।

তার এখন দিন কাটে মাতলামি করে আর কবরে যাওয়ার কাউন্ট ডাউন করে।

# ঘটনা ২.

উপরের ঘটনা থেকেও আরও খারাপ যেটা ঘটে তা হল ইদানিং উল্ল্যেখযোগ্য বাঙ্গালী (!) ছেলে মেয়ে আর বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষন বোধ করছে না।
এটা নিয়ে পত্র-পত্রিকা গুলোও বেশ সরব।
আগে বেপারটা মোটামুটি বিচ্ছিন্ন হিসাবে চালিয়ে দেওয়া গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা বেশ আতঙ্কজনক ভাবে দেখা দিয়েছে।
ছেলে-মেয়েরা ১৫-১৬ বছরেই ফ্যাণ্টাসির শিকার হয়ে একবার এই পথে পা বাড়ায় যা তাদের বাবা-মা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না, সাবধান করা তো অনেক দুরের কথা।

# ঘটনা ৩.

প্রথমটার মতই এটাও আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা।
ব্যাঙ্ক কার্ড এখানে এত বেশী ব্যবহার হয় যে খুব কম সময় এ পকেটে ক্যাশ থাকে। রাত ১১:৩০ এর সময় কাজ থেকে ফেরার পথে দেখি জ্যাকসন হাইটস স্টেশন এ একজন বৃদ্ধ হাতে মগ নিয়ে ভিক্ষা করছেন। পকেট হাতড়ে দেখলাম ১ডলার এর একটাই নোট আছে তাই দিয়ে দিলাম। বৃদ্ধ মুখ উচিয়ে আমাকে দেখলেন আর সাথে সাথে কেদে দিলেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম।

তার কাহিনী আরো করুন।

বাংলাদেশ ডি.ভি পেয়ে এসেছেন। আসার পরে নিজেই পরিবার এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। বাবা-মা মারা গেছেন কবে সেই খবর ও জানেন না। দেশের বাড়িতেও এখন আর কেউ থাকে না। সুতরাং দেশেও যেতে পারছেন না।
ছেলের বিয়ের ১ বছর এর মাথায় ছেলে আর বউ বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। নিজের বাড়িতেই এখন আর ঢুকতে পারেন না। নিজের ছেলের বিরুদ্ধে কোর্ট এও যেতে চান না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
– “তো আমাকে দেখে কাঁদলেন কেন?”
– “বাবারে, ১ডলার তো দুরের কথা, ছেলের বাসায় তার মুখ দেখতে গেলেও এখন আর দরজা খুলে না। দরজার ফুটো দিয়ে আমাকে দেখলেই ভিতর থেকে আওয়াজ আসে …………

ভিক্ষা নাই, মাফ করেন

এর মানে এইনা যে এখানে কেউ ভাল নেই, সুখে নেই।
কিন্তু ……… একটা কিন্তু থেকেই যায়।

২,৯১৬ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “ভিক্ষা নাই, মাফ করেন”

  1. সাইফুল (৯২-৯৮)

    পাবন,

    ভাল লিখেছ। সব জায়গাতেই সমস্যা আছে, শুধু রূপ ভিন্ন। মানুষকে বেঁছে নিতে হয় সে কোন পথ দিয়ে যাবে। অনেক কিছু উপলব্ধির আছে...

    (অফ টপিকঃ কোন হাউসে ছিলে?)

    জবাব দিন
  2. রাফী (০৪-০৮)

    আমি বলবো - পাবন দোস্ত, আল্লাহর রহমত - এই ডালাসে এখন পর্যন্ত হাতে গোনা যে কয়টা ভিক্ষুক পাইসি, সবাই কাউলা; তাও শুধু গ্যাস স্টেশন আর ওয়ালমার্ট-এর বাইরে খারায়া জিগায় - "Buddy, my car is outta gas - got some change, man?"

    দোয়া করি কোন বাঙ্গালীরে যেন এমন না দেখতে হয়, যেমন তোর দেখতে হইল! 😕

    আর পোলা মাইয়া তাড়ায়া দেওয়ার কাহিনী মামা বিভিন্ন 'স্টাইলে' অনেকের কাছ থেকেই শুনসি - এক আঙ্কেলরেও পাইসিলাম এইরকম যে ছেলে খেয়াল রাখে না... তাও ভাল আন্টি এখনও আছে... আল্লাহ্‌ই জানে আমাদের কপালে কি আছে মামা!! 🙁

    লেখাটা অচাম হইচে! :thumbup:

    জবাব দিন
  3. আছিব (২০০০-২০০৬)

    আরো লেখা চাই তোমার কাছ থেকে প্রবাসে অভিজ্ঞতা থেকে। ঘটনা গুলো মর্মস্পর্শী কিন্তু বাস্তব। তবে ঘটনা ২ পুরাই কেয়ামতের আলামত। সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার

    জবাব দিন
  4. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    আমার বর এম এস করেছে নিউইয়ার্কে। ওর কাছ থেকে সেখানকার কিছু কাহিনী শুনেছি তবে এতো খারাপ ছিল না। মোহাম্মদ জাফর ইকবালের একটা বইয়ে পড়েছিলাম যে ছেলেরা বাবার খোঁজ নেয়্না আবার বাবা মারা গেলে ভিডিও করতে আসে যাতে ইন্সুরেন্সের টাকা পায়।

    আমি যে জায়গায় থাকি সেখানে বাংলাদেশের একটা বিশাল সংখ্যক প্রবীণ কমিউনিটি আছে। উনারা অধিকাংশই সচিব, জাতিসংঘ বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। দেশের সবচেয়ে মেধাবী এবং সচ্ছল গ্রুপের একাংশ। এখানে সেটল করেছেন কারণ আবহাওয়া আর সন্তানদের কারণে। তাদের জীবন আবার অন্য্রঅকম। তবে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা তো সবারই আছে। অনেকদিন ধরে মাথায় প্রবাসী প্রবীণ লেখাটা নিয়ে ঘুরছি। প্রায়রিটি আসলে লিখে ফেলবো।

    তোমার মর্মষ্পর্শী লেখার জন্য ধন্যবাদ।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
      • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

        পাবন - এখানকার হোমলেস আর সোশাল ওয়ার্কের সাথে কিছুটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকার কারণে + কাছ থেকে অনেক প্রবীণের জীবন দেখে অর্থাৎ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি যা বুঝেছি তা হলো ভিক্ষা বা যারা হোমলেস হয় তাদের সাধারণত কিছুটা মানসিক সমস্যা থাকে। আমেরিকাতে সিটিজেন কেউ দশ বছর যে কোন কাজ করলে তার বুড়ো বয়সে সে চাইলে রাষ্ট্রএর সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের সুবিধা নিতে পারে। তার এরকম ভিক্ষা করে চলার দরকার হন না। তুমি যেই বাং্গালির কথা বললে তার ব্যাপারে আরেকটু জানার চেষ্টা করে দেখতে পারো। সে কিন্তু সহজেই তার এলাকার সরকারী বৃদ্ধনিবাসে থাকার আবেদন করতে পারে।


        “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
        ― Mahatma Gandhi

        জবাব দিন
        • পাবন (২০০৪-২০১০)

          প্রথমত NY তে এটা বেশী হয় কারন এখানে কেউ Tax দিয়ে কাজ করতে চায় না।
          ।বাঙ্গালী এত বেশী যে খুব সহজেই Minimum Wage এ কাজ পেয়ে যায় কিন্তু Tax দেওয়া লাগে না [The Employer has to pay the exact amount of Tax as the Employee is paying in New York] ।

          কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় কেননা তখন আর Social Security র সুবিধাগুলো পাওয়া যায় না।

          আর এখানে যা লিখলাম সেটা নিছকই এক পশলা বৃষ্টির মতন ঘটে যাওয়া ঘটনা। উনাকে সাহায্য করার কোন উপায় আমার জানা নেই ......... 🙁


          Proud to be a Cadet,
          Proud to be a Faujian.

          জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আমেরিকাকে স্বপ্নের দেশ ভেবে এখানে এলেই স্বপ্নভঙ্গটাও সেরকম মর্মান্তিক হবে বৈকি।
    তবে এখন তো দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে মহাদেশগুলোর মধ্যে।
    দেশ থেকে পালিয়ে অন্য মহাদেশে চলে যাবার প্রবণতা একটু কমে এলে বোধ হয় এমন ঘটনা কম দেখা যাবে। এমনিতে বছর দশেক আমেরিকা বা কোন পাশ্চাত্য দেশে থাকার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে।

    জবাব দিন
    • পাবন (২০০৪-২০১০)

      আমি অনেক কেই জিজ্ঞাসা করসি ভাই,

      সবাই একই কথা বলে ...........
      - "যদি বিয়ের আগে চইলা যাইতে পার তো বাইচা গেলা, কিন্তু ........ একবার বিয়া করসো তো গেস" ............

      এখানের Life Style টাই এইরকম, কষ্ট করলে আরামে থাকা যায় দেখে খুব কম মানুষই এখান থেকে বের হতে পারে ......... যখন ভুলগুলো বুঝতে পারে ততদিনে দেরী হয়ে যায়।


      Proud to be a Cadet,
      Proud to be a Faujian.

      জবাব দিন
  6. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

    আশা করি এই লেখা পরে অন্তত ১% হলেও লোকজনের ইউ এস এ তে স্থায়ি বসবাসের ফ্যান্টাসি দূর হবে :thumbup:

    তবে অসাধারন লিখেছ :clap:


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।