২/৩ বছর আগে কলেজ বার্ষিকীর জন্য লেখা একটা গল্প শেয়ার করলাম -কাউকে ছোট করা এই গল্পের উদ্দেশ্য নয় –
আমাদের গল্পের প্রধান চরিত্র ,ধরা যাক তার নাম শ্যামলী ।উত্তরায় একটা গার্মেন্টসে চাকরি করতো ।হঠাৎ দেখলে চট করে কারো পক্ষে আলাদা করে চেনা মুশকিল -খানিকটা ময়লা রং ,কাঁধে নেমে আসা চুল ,কটা চোখ -একটু ছোটখাটো গড়নের ।
সেদিন ডিউটি শেষে একটু আগেভাগেই বের হল শ্যামলী । বেতন হয়েছে সেদিন ।কাল ভাইটার জন্মদিন ।একটা থ্রি-কোয়ার্টারের জন্য বায়না ধরেছে -অনেকগুলো করে নাকি পকেট থাকে ।গত ঈদে ভাইটাকে কিছুই দিতে পারেনি -পরশু নাহয় একটু শিশুপার্কে নিয়ে যাওয়া যাবে ।
বিকেলের হলদে রং যখন লালচে হতে শুরু করেছে ,আর সব ক্লান্ত পাখিদের মত শ্যামলীও উঠে এলো ঘরের পথে ।কানে একজোড়া সস্তা ধরণের দুল -একটা ফুটপাতের দোকান থেকে কিনে পরেই ফেলেছে -ভাইয়ের জন্মদিন ছাড়া এসব পরবার সুযোগ আর কটাই বা আসে ।সাভার বাসা শ্যামলীদের -জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির ঠিক আগে ।আজ হয়তো পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে ।ব্যস্ততার ক্লান্ত পায়ে সাভারের বাসে উঠলো ও ।
বাস থেকে নেমে শ্যামলী দেখলো ,তাহের দাঁড়িয়ে আছে ।ওকে দেখে এগিয়ে এলো -এমনভাবে ,যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলো ।একটু অবাক হলো ও ।তাহের আগে ওর গার্মেন্টসেই গার্ডের চাকরি করতো -মাস দুয়েক হলো ছেড়ে দিয়েছে ।এখন নবীনগরের রাস্তায় মটর সাইকেল হাঁকিয়ে বেড়ায় ।টাকা পায় কোত্থেকে ব্যাটা ওড়ানোর -ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে গেলো শ্যামলী ।
-কিরে তাহের ,কি খবর ?এখানে কি করোস ?
-আরে ম্যাডাম ,ওয়েলকাম ,ওয়েলকাম ।আইজক্যা কপালডাও ভালো ,তোমারে সময় মত পাইয়া গেলাম ।
-ক্যান ,কি দরকার ?
-ক্যান ,দরকার ছাড়া পাড়ার মাইনশের খবর নেওয়া যায়না ?
-তাও ,দরকার ছাড়া খোঁজ খবর কইরা বেড়ানোর টাইম আমগো মত গরীবগো কই ?
-যাক গিয়া ,রাবেয়া তোমারে খুঁজে -কিয়ের নাকি টাকা পাও তুমি ।অয় তো কালকে মুন্সীগঞ্জ যাইবোগা ।
-ইয়ে …আইজকা তো সন্ধ্যা নাইম্যা গ্যাছে ,ভার্সিটির ভিতরে গেলে ফিরতে আন্ধার জাঁইকা বসবো ।কাইল যাই ?
-কইলাম না অয় কাইলকা যাইবোগা ?আরে চলো চলো ,আমিও ওইদিকেই যামু অখন ,পরে বাসায় পৌঁছায় দিমু নে ।
জাবির হোস্টেলে পেছনটা এক বিশাল এলাকা -জঙ্গলই বলা চলে ।কেউ খুব একটা যায়না ওদিকটায় ।শ্যামলীর একটু কেমন যেন করতে লাগলো ,কি যেন একটা ঠিক নেই ।
-কিরে ,রাস্তা দিয়া হাঁট ।ঐদিক যাস ক্যা ?
জবাবে পেছন থেকে একটা শক্ত হাত ওর গলা চেপে ধরলো ।কোমরে স্পর্শ করলো ধাতব কিছু একটা ।ভার্সিটির নির্জন রাস্তায় ছুটে এসে বাঁচাবার কেউ নেই তখন ।আতঙ্কে পাথর হয়ে গেলো শ্যামলী ।
-চোপ হারামজাদী ,একটা সাউন্ড করবিনা ।আগে হাঁট ।
টানতে টানতে জঙ্গলের গহীনে একটা কাঁটাঝোপের ওপর ওকে ফেললো হাতটা ।জামা ছিঁড়ে গেলো অনেকটা ।এতক্ষণে দেখতে পেলো শ্যামলী ,তাহেরসহ ওরা তিন জন ।
-তাহের…ভাইরে ,ও ভাই…তোর কসম লাগে …
-চোপ হারামজাদী !!চোপ !!
-আম্মা ,আম্মাগো…
একজন ওর পা দুটো চেপে ধরলো -ঠিক যেভাবে কুরবানির সময় গরুকে ধরা হয় ।হাতের ওপর চড়ে বসলো অসহ্য ভারী দুটো পা । তাহের নামের অতিকায় পোকাটা এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে …
আঁধার হয়ে এলো শ্যামলীর চেনা জগতটা ।
*****
তারপর ??
পরের অংশটুকু আমি নিজেই বর্ণনা করি -গল্পের ভাষায় কাহিনীটা ঠিকমত আসবে না ।
গণ ধর্ষণের পর মৃতপ্রায় শ্যামলীকে টেনে জঙ্গলের আরো গভীরে নিয়ে গেলো ওরা ।রক্তাক্ত তলপেটে ,মুখে বারবার পড়লো জুতা আর ডালের আঘাত ।অচেতন শ্যামলীর সারা দেহে কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগ করলো পশুরা ।পুড়তে থাকা শরীরটার ব্যবস্থা পরে করা যাবে ভেবে চলে গেলো ওরা ।
দুদিন পরের এক রাত ।কিছুক্ষণের জন্য চেতনা ফিরে এলো শ্যামলীর ।সারা শরীর ঝলসে গেছে ,নড়বার শক্তিটুকু নেই ।নির্জন জঙ্গলে কেউ শুনলো না ওর নীরব কান্না ।শুনলো শুধু পিঁপড়া সম্প্রদায় ,যারা এসেছিলো “মৃতদেহ” টার সদ্ব্যবহার করতে ।আর একটা শেয়াল ,চারপাশে ঘুরঘুর করছিলো ।অসহ্য যন্ত্রণায় আবার জ্ঞান হারালো মেয়েটা ।
পরদিন সকালে আবারো চেতনা ফিরে এলো শ্যামলীর ।আরো ঘন হয়ে এসেছে পিঁপড়ার স্তর ।কিছু মানুষের কণ্ঠস্বর হঠাৎই শুনতে কানে এলো ওর ।শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে নড়ে উঠতে চাইলো ও সাহায্যের আশায় ।
প্রকৃতি সময়ে সময়ে মানুষকে নিয়ে খানিকটা নির্মম কৌতুক করে ।সেদিন এসেছিলো ওর তিন “সাহায্যকারী” -তাহের ,আর তার দুই বন্ধু ।শরীরের এখনো স্পন্দন আছে দেখে হতবাক হয়ে গেলো তারা ,তবে অবাক ভাবটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নিলোনা ।শ্যামলীকে “সাহায্য” করলো তারা -পুরো শরীরে এসিড ঢালা হলো ,ছুরি চালানো হলো গলার কাছটায় ।
আমার কথা আপনাদের অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে ,কিন্তু সত্যি সত্যি তখনো মারা গেলোনা শ্যামলী ।খোলা চোখ দুটো সোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে ।এসিডের কারণে পিঁপড়াগুলোও তখন চলে গেছে ।একটুখানি বৃষ্টি হলো সেদিন রাতে ।তখন অপেক্ষা শুধু নষ্টপ্রায় দেহ ঘড়িটা বন্ধ হবার ।সময় যাচ্ছে ,আরো ধীর হয়ে আসছে সেটা -টিক…টিক…টিক…
হতভাগ্য শ্যামলীকে পাঁচ দিনের মাথায় উদ্ধার করা হলো জাবির ঘন জঙ্গল থেকে ।ক্যাম্পাসের বৃদ্ধ ঝাড়ুদার জালাল মিয়া জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখতে পান জীবন্মৃত দেহটা ।তারপর শুরু হয় এক অসম লড়াই ।হাসপাতালের বিছানায় একুশ দিন লড়াই চলে মৃত্যু আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের ।জাবির জঙ্গলে জবাই হওয়া ,দগ্ধ ,এসিডে ঝলসানো যে মেয়েটা পাঁচটা দিনের অসম্ভব জীবন যুদ্ধে টিকে ছিলো ,অবশেষে তার ঠাঁই হয় শূন্যতায় ।মৃত্যুর আগে এক এক করে সবার নাম বলে যায় সে ।চারমাস পর এক অলস দুপুরে সাভার থানার এসআই হাই তুলতে তুলতে কেস ফাইলে বড় করে লেখেন -পলাতক ।
****
আমি জানি ,আপনারা অনেকেই কাহিনীটা পড়া শেষ করে “ধ্যাত্তেরী” বলে ব্লগটা বন্ধ করবেন ।হয়তোবা খুব উঁচু দরের হয়নি লেখাটা ।কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় ,আজ যদি আমার (বা আপনার) হাসিখুশি একটা বোন থাকতো ,আর তার ধর্ষিত -দগ্ধ দেহটা পাওয়া যেতো জাবির ঘন জঙ্গলে ,তবে সেটা কেমন হতো !প্লিজ ,আমরা কেউ যেন পাথর হয়ে না যাই -আমরা যেন অমানুষ হয়ে না যাই !!
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে ।)
দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই ঘটনার (রাহেলার) খুনীদের বিচার হয়েছে পলাতক দেখিয়ে। বাস্তবতা এতটাই নিষ্ঠুর। সেটা আবরও মনে করিয়ে দিলো।
অসাধারণ লেখা। পাঁচ তারা।
আমি কখনোই ভুলতে পারি না ঘটনাটা...
এরা কি মানুষ ???
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
:clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: ::salute:: অসাধারণ................
ধন্যবাদ...।
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
নাফিজ তোরে কালকে কি কইছিলাম?? মনে আছে??
ব্লগে স্বাগতম।
অনেক কথাই তো হইলো...মনে আছে রে ভাই...
আপনারও মনে আছে তো আমার প্রস্তাবটা?? 🙂 🙂
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
লেখা পড়ার পর অনুভূতি................তাহেরের মত মানুষ সামনে পেলে মানুষ খুন করার আপরাধবোধ থাকত না.........
আমরা কেউ যেন পাথর হয়ে না যাই -আমরা যেন অমানুষ হয়ে না যাই ।
এটাই বলার ছিলো
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
ভয়ঙ্কর একটা লিখা...
বাস্তব কখনো কখনো গল্পের চেয়েও সুন্দর, কখনো কল্পনার চেয়েও কুৎসিত...
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
🙁
নাফিজ,
নানান ব্যস্ততায় গল্পটা পড়া হয়নি আগে।
লেখাটা নিয়ে দু'ভাগে আলোচনা করা যেতে পারে।১: তোমার লেখাটার স্টাইল নিয়ে;
২: শ্যামলী বা অজস্র শ্যামলী বা তাহেরদের নিয়ে।
কিছুই বলতে ইচ্ছে করছেনা শেষমেশ।স্তব্ধতা নিয়ে বসে আছি।
কি বা কে যে আসলে 'পলাতক' আমাদের বোধ থেকে তা অনুধাবন করতে চেষ্টা করছি।
"পলাতক" আসলে আমাদের বিবেক, আর "বন্দী" আমাদের মেরুদন্ড, আমাদের শেকল ভাঙ্গার সাহস ।
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
লেখাটা যে সুন্দর হইছে তা তো ৩-৪ বছর আগেই বলছি।
কিন্তু শ্যামলী নামটার যে প্রিলিমিনারি চেঞ্জ আমরা করছিলাম তা মনে আছে???
😀 😀 😀