বিবর্তনবাদ ও তার শত্রুরা
নৃবিজ্ঞানের অনেক কিছুর মত আদিম মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারানুষ্ঠানের অধ্যয়নও বিবর্তন তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয়েছিল। উনবিংশ শতকে কোন কিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে চিন্তা করা বলতে ঐতিহাসিকভাবে চিন্তা করাকে বোঝাত। প্রাচীন কালের সবচেয়ে মৌলিক গঠনটিকে খুঁজে বের করা এবং যে ধাপগুলোর মাধ্যমে তার ধীর উন্নয়ন ঘটেছে সেগুলোর সন্ধান করাই এক্ষেত্রে মুখ্য। টাইলর, মরগ্যান, ফ্রেজারসহ অনেকেই ডারউইনের বিশ্লেষণমূলক দৈব-প্রকরণ ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের তুলনায় Comte এবং হেগেলের মত ব্যক্তিদের সংশ্লেষণমূলক সামাজিক-ধাপ তত্ত্বগুলোর উপর বেশী কাজ করেছেন। কিন্তু এই উভয় ধারার গবেষকরাই বিবর্তনের মহান মৌলিক ধারণাটিকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ তারা সবাই মানতেন যে, জটিল ও অসমসত্ত্ব বর্তমান অপেক্ষাকৃত সরল ও সমসত্ত্ব একটি অতীত থেকে ক্রমান্বয়ে উদ্ভূত হয়েছে। এই অতীতের নিদর্শনগুলো গালাপাগোসের কচ্ছপের মতই আমাদের চারপাশের দুর্গম প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। টাইলর ছিলেন আর্মচেয়ার পণ্ডিত, “বিগ্ল জাহাজের” অভিযানের মত কোন অভিযানে তিনি অংশ নেননি। কিন্তু বিভিন্ন মিশনারি, সৈনিক ও অভিযাত্রী দলের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিবেদনগুলোকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাজানোর পর তিনিও বিবর্তনমূলক ধারণার সাথে একমত হন। ডারউইনসহ তখনকার বিখ্যাত সব পণ্ডিতের মত তিনিও এই তত্ত্বকে সত্য ধরে নিয়ে এগোতে শুরু করেন। তারা সবাই মনে করতেন, একটি ঘটনার আদিম থেকে অত্যাধুনিক রূপগুলোর সুসংবদ্ধ ও ঐতিহাসিক দিক দিয়ে সুসজ্জিত তুলনার মাধ্যমেই সেটি বোঝার রাজকীয় পথের সন্ধান পাওয়া যায়।
টাইলরের মতে মৌলিক রূপ যা থেকে পরবর্তী সবকিছুর উন্নয়ন ঘটেছে তা হল সর্বপ্রাণবাদ তথা এনিমিজ্ম। ধর্মের সবচেয়ে সরল সংজ্ঞা ছিল, “কোন আধ্যাত্মিক সত্ত্বায় বিশ্বাস”। তাই বলা যায়, সেই আদিম যুগে যে ভিত্তির উপর বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে সবকিছুর সূত্রপাত ঘটেছিল তা বুঝলেই ধর্ম বোঝা যাবে। এ প্রেক্ষিতে টাইলরের তত্ত্ব ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক। তিনি বলেন, মৃত্যু, স্বপ্ন এবং আছর পড়ার মত ধাঁধাময় ও অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনাগুলোকে বর্ণনা করার সমালোচনাহীন কিন্তু যুক্তিবাদী প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আত্মার উপর বিশ্বাসের সূচনা ঘটেছিল। আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করা যায় এমন ধারণার মাধ্যমে তখন এগুলোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। এগুলোর ব্যাখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যথাক্রমে আত্মার চিরতরে চলে যাওয়া, আত্মার ঘুরতে বেরোনো এবং আত্মার আগ্রাসন। টাইলরের মতে প্রকৃতির আরও দূরবর্তী ও ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মার ধারণাটি ব্যবহৃত হতে থাকে, যতদিন পর্যন্ত না পৃথিবীর সবগুলো গাছ ও প্রস্তর মানব সৃষ্ট কোন না কোন মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ প্রতিটি প্রাকৃতিক জিনিসের ব্যাখ্যাই আত্মার মাধ্যমে দেয়া হতে থাকে। আধ্যাত্মিক সত্ত্বায় বিশ্বাসের উচ্চতর এবং আরও উন্নত ধরণগুলো যেমন, বহু-ঈশ্বরবাদ এবং তারও পরে একেশ্বরবাদ এই সর্বপ্রাণবাদের ভিত্তির উপরই গড়ে উঠেছে। তাই সর্বপ্রাণবাদ হল মানবতার সাধারণ দর্শন। এ থেকে উচ্চতর বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে যেগুলো বিভিন্ন চিন্তাবিদদের সমালোচনামূলক প্রশ্নের প্রক্রিয়ায় দিন দিন পরিশিলিত ও বিশোধিত হয়েছে। তাই বলা যায়, বিশ্বের ধর্মীয় ইতিহাস ছিল প্রগতি এবং আলোকসম্পাতের ইতিহাস।
অন্ধকার থেকে আলোতে আসার প্রক্রিয়ার কথা ধর্মের অধিকাংশ বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যাতেই বলা হয়েছে। ফ্রেজার (সেই উনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানী যিনি বিংশ শতকে ৪০ বছর বেঁচে থেকেও তার চিন্তাধারায় কোন পরিবর্তন আনার প্রয়োজন বোধ করেননি) বলেন, মানুষের মানসিক প্রগতি হয়েছে জাদু থেকে ধর্ম এবং ধর্ম থেকে বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে। জাদু ছিল মানুষের আদিমতম চিন্তা। প্রকৃত বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ সম্বন্ধকে “স্পেশিওটেম্পোরাল সংযোগ” (“সংবেদনশীল জাদু”, যেমন ষাঁড়ের রক্ত খেলে ষাঁড়ের সব শক্তি যে খেয়েছে তার মধ্যে এসে পড়ে) বা “ঘটনাগত সাদৃশ্য” (“অনুকরণমূলক জাদু”, যেমন ড্রামের শব্দের কারণে বজ্রপাত সৃষ্টিকারী মেঘের উদ্ভব ঘটে) ভেবে ভুল করা থেকেই এই জাদুর উদ্ভব। Durkheim এর মতানুসারে, পরিব্যাপ্ত, ভৌগলিক ও পবিত্র ছবিগুলো থেকে পাওয়া “কারণ”, “শ্রেণী” বা “সম্পর্ক” বিষয়ে সুনির্দিষ্ট, বিশ্লেষণমূলক ও ইহজাগতিক ধারণার উদ্ভব ঘটার প্রক্রিয়াতেই বিবর্তনমূলক উন্নয়ন সংঘটিত হয়েছে। তিনি এগুলোকে সামাজিক আচরণবিধির “সামষ্টিক রূপায়ণ” নামে আখ্যায়িত করেছেন। এই রূপায়ণ এবং তার নৈতিক কার্যকারিতার মধ্যে “মানা”, “টোটেম” এবং “ঈশ্বর” এর মত সংস্কারগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। অন্যদিকে ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, বিবর্তনমূলক উন্নয়নের এই প্রক্রিয়া এক ধরণের যুক্তিসহকরণের (rationalization) মাধ্যমে ঘটেছে। এই যুক্তিসহকরণ বলতে আরও সূক্ষ্ণভাবে সংজ্ঞায়িত, আরও নির্দিষ্টভাবে আলোচিত এবং আরও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধারণাকৃত কিছু সামাজিক গড়নের মধ্যে ধর্মের প্রগতিমূলক সংগঠনকে বোঝায়। এ ধরণের তত্ত্বগুলোর সূক্ষ্ণতার পরিমাণ এবং বর্তমান কালে সেগুলোর প্রাসঙ্গিকতা কখনও কম আবার কখনও বেশি। কিন্তু টাইলরের মত এই তত্ত্বগুলোও ধর্মের বিবর্তনকে সামাজিক পার্থক্যকরণের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে মেনে নিয়েছিল। অর্থাৎ সকল তত্ত্বেই মেনে নেয়া হয়েছে যে, আদিম মানুষের অনেক বিস্তৃত, সর্বগ্রাহী, কিন্তু তুলনামূলকভাবে অপ্রতিসম ও সমালোচনাহীন ধর্মীয় অনুশীলন আধুনিক সভ্যতাসমূহের অধিক সুনির্দিষ্ট, নিয়মতান্ত্রিক এবং অপেক্ষাকৃত কম কর্তৃপক্ষীয় অনুশীলনে রূপান্তরিত হয়েছে। ওয়েবার, যিনি তীব্র উৎকণ্ঠার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিবাদ এবং আশাবাদ উভয়টিকেই সমভাবে গ্রহণ করেছিলেন, তিনি এই রূপান্তরকে বলেছেন “বিশ্বের মোহমুক্তি” (Entzauberung)।
বিবর্তনবাদের পিছু পিছু এসে গিয়েছিল বিবর্তনবাদ-বিরোধিতা। এই বিরোধিতা এসেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি পক্ষ থেকে। একদিকে রোমান ক্যাথলিক পণ্ডিতেরা “অধঃপতন তত্ত্ব” প্রচারের মাধ্যমে বিবর্তনবাদকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এই তত্ত্ব অনুসারে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কাছে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে যে বাণী এসেছিল মূর্তিপূজা সহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে এই মানুষেরাই সেটিকে কলুষিত করে ফেলে। অন্য দিকে Boas দার্শনিক ধারার মার্কিন পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদদের “আর্মচেয়ার অনুমিতির” (armchair speculation) বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। তারা গোষ্ঠীয় প্রথাগুলোর আরও রূপতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে করা গবেষণা দিয়ে এই মতবাদকে প্রতিস্থাপন করার দাবী জানিয়েছিলেন।
এ ধরণের প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে প্রথমটি এক যৌক্তিক অনুসন্ধানের জন্ম দিয়েছিল। এটা ছিল বর্তমানে অস্তিত্বশীল আদিম গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পরম সত্ত্বায় বিশ্বাসের অনুসন্ধান। এই বিতর্কিত অনুসন্ধান প্রক্রিয়া “আদিম একত্ববাদ” এর সন্ধান করতে গিয়ে অনেকাংশেই দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। সংস্কৃতির নায়কোচিত চরিত্র নিয়ে ল্যাং (১৮৯৮) এর কিছু ভাষ্য এবং আকাশ দেবতা নিয়ে এলিয়াডের (১৯৪৯) কিছু ভাষ্য বাদ দিলে প্রায় সবগুলো প্রচেষ্টাই অনুৎপাদনমূলক বলে সাব্যস্ত হয়েছে। যে তত্ত্ব এরকম অনুসন্ধানের জন্ম দিয়েছিল এবং এর ফলে যে পরিস্থিতির সূচনা ঘটেছিল তার সবই বর্তমানে পণ্ডিতদের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। এ নিয়ে এখন আর কেউ উচ্চবাচ্য করে না। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটির স্থায়িত্ব ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি এবং এটি মানবজাতির বৈজ্ঞানিক বিবরণের (এথনোগ্রাফি) পদ্ধতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। অবশ্য এটিও এখন গুরুত্ব হারাতে বসেছে। বিবর্তনমূলক সাধারণীকরণের কিছু প্রায়োগিক বিনাশ সাধন করেছিল এটি। এটা বাদ দিলে এই প্রতিক্রিয়ার প্রধান অবদান ছিল সাংস্কৃতিক ব্যাপনের ক্ষেত্রে। এই ব্যাপন সংক্রান্ত গবেষণার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ গ্রেট প্লেইন্স জুড়ে রৌদ্র নৃত্যের বিস্তার নিয়ে “লেজলি স্পায়ারের” গবেষণা (১৯২১) এবং ক্যালিফোর্নিয়ার আদিবাসী ধর্মের গবেষণায় “এ এল ক্রোয়েবারের” বয়স-অঞ্চল দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ। সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এমন বণ্টনমূলক গবেষণা ধর্মীয় চিন্তাধারা, গুণাগুণ এবং অনুশীলন বোঝার ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসেনি। খুব কম ছাত্রই বর্তমানে এগুলো নিয়ে গবেষণা করে। এভাবে মাঠ পর্যায়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা এবং নিয়মতান্ত্রিক আরোহী বিশ্লেষণের জন্য Boas চিন্তাধারাকে গ্রহণ করা হয়েছিল খুব সাবধানতার সাথে। এই গবেষণার সুফলও পাওয়া গেছে। কারণ পরবর্তীতে অনেক তত্ত্বই এগুলো থেকে সম্পদ নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। অনেকগুলোই এর উত্তরসূরি হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে।
[চলবে…]
< < গত পর্ব
১ম
অভিনন্দন :party: :party:
পইড়া নাকি না পইড়া?
লেখাটা সুখপাঠ্য না। তাই না পইড়াও কমেন্ট দেয়া জায়েজ আছে। 😀
তাই নাকি? আগে বলবা না 😛
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ভালো লাগছে। চালায়া যাও।
তবে এই লেখার মধ্যে কিছু 'red flag' আছে, যা বিজ্ঞানের মূল চেতনার পরিপন্থি। যেমন,
- বোল্ড শব্দগুলো কেমন যেন 'ধর্ম/মতবাদ' এর সাথেই বেশি মানানসই লাগে। তবে এগুলো বিবর্তনবাদীদের কাছে ভালো লাগবে, নিশ্চিত 🙂 ।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আমিও এই লাইনটা খটকা নিয়ে লিখেছিলাম। লেখকের নিজস্ব চিন্তা যে লেখাটাতেও কিছুটা ঢুকে গেছে সেটার পরিচয় পাওয়া যায় এখানে। সে সময়ের প্রায় সব নৃবিজ্ঞানীর এগুনোর পদ্ধতি বিবর্তন হয়ে পড়ার কারণেই, বোধহয় তিনি এটা লেখার সাহস করেছিলেন। ঠিক করেননি।
পরের লাইনটাও আরেকটু সায়েন্টিফিক উপায়ে লিখতে পারতেন।
আমি আপনার সাথে একমত।
Ive just sent you a small article (only 6 pages), a critical appraisal of this article by Geertz. It will take no more than 30 min to read. Hope this would help you.
অনেক ধন্যবাদ মাহমুদ ভাই। এখনই পড়ছি।
আমার চিন্তা কেমন যেন লেখার সাথে এগুতে পারছেনা। ইংলিশ টার্ম হতে বাংলা টার্ম গুলো বেশি খটমটে। কপি করে নিলাম। দেখি নিযেই একটু পরে। তারপর নিশ্চয় তোমার ৩য় পর্ব পরে বুঝতে পারব।
লেখাটাকে বেশ খানিকটা জটিল করে ফেলেছি। আগের করা অনুবাদে কোন পরিবর্তন না করার কারণে এমন হয়েছে। আগের অনুবাদ যতটুকু আছে তা দিয়ে আরেকটা কিস্তি হবে। এরপর পরীক্ষা শেষ হলে বাকিগুলো দেব।
মাহমুদ ভাই এই প্রবন্ধের একটা critical appraisal পাঠিয়েছেন। সেটা পড়ার পর এবং প্রবন্ধটা আবার বোঝার পর যখন চতুর্থ পর্ব শুরু করব, তখন আশাকরি অনেক সহজ হয়ে যাবে।