[সরকারি কর্তব্যে আমি দেশ হতে হাজার মাইল দূরে। এক যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত। দেশ হতে একটা ফোন আমার সব চিন্তা-ভাবনাকে এলোমেলো করে দিল। এক সপ্তাহ আগে দেশ হতে ঘুরে এসেছি। তারিখটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর ২০০৯। যেতে চাইলেও যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। একটু পর পর ফোনে কথা বলে মনকে ঠাণ্ডা রাখা। শেষবারের মত বাবার মুখটা দেখতে বড় ইচ্ছা জাগে কিন্তু নিয়তির হাতে তখন আমি বন্ধী। বুকের ভিতর পাথর-সম চাপা ব্যথা। অনবরত চোখ দিয়ে ঝরছে পানি। বুকের ব্যথাটা কমানোর জন্য কাগজ কলম নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। যদি কিছুটা কষ্ট কমে। মরুভূমির মাঝে একটা তাঁবুর মধ্যে আমি একা বড় একা হয়ে লিখেছিলাম। আমার সহধর্মিণী লেখাটা উঠিয়ে রেখেছিল। ইতোমধ্যে চার বছর পার হয়ে গিয়েছে।]
শ্রদ্ধেয় বাবা,
প্রথমে আমার সালাম ও কদমবুসি নিবেন। আশাকরি আল্লাহ্র রহমতে বাসার সকলকে নিয়ে ভালো আছেন। আমি আপনাদের দোয়ায় ও আল্লাহ্র রহমতে ভালো আছি।
পর-সংবাদ এই যে, আমি দেশ হতে হাজার মাইল দূরে মরুভূমির এক দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি। নিশ্চয়ই শুনে আপনি খুশি হয়েছেন। আচ্ছা বাবা, আপনার কি মনে পড়ে আমার ছোটবেলার কিংবা কৈশোরের দিনগুলার কথা।
সালটা হবে ১৯৮১ বা ৮২ হতে ৮৫ সাল। সঠিক সালটা মনে করতে পারছি না। তবে ঐ সময় আমি প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র। প্রাইমারী স্কুলের সব সময় আপনার “ শিক্ষকতার” কল্যাণে বরাবর প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছি। স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার সময় দুটা পুরস্কার আমার সব সময় থাকত। এক- পরীক্ষার ফলাফলের, ২য়- স্কুলের দৈনন্দিন হাজিরা।
ঐ সময়ে কোন এক বছরে আপনি জাহাজে চড়ে হজ্বে গিয়েছিলেন। হজ্ব শেষে আমার জন্য সৌদি-আরবের লোকেরা যে কাপড় পড়ে তাই নিয়ে আসলেন। আমি প্রায় সময় বিশেষ করে জুম্মার দিন ঐ সৌদি ড্রেস আর মাথায় পাগড়ি বেঁধে আপনার সাথে মসজিদে যেতাম। পাড়ার ছোট বড় সবাই মজা করে ছোট হাজি বলে ডাকত। আমি এখনও চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট ঐ ড্রেস পড়া ছবিটা দেখতে পাই।
সব বাবা মার স্বপ্ন থাকে তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। পাঁচ ভাই আর চার বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। মা এবং বড় ভাই বোনদের কাছে শুনেছি আমাকে নিয়ে আপনাদের ইচ্ছার বা আশার কথা। আমাকে মাদ্রাসাতে পড়াশুনা করাবেন। খুবই স্বাভাবিক এত ছেলে-মেয়ের মধ্যে একজন অন্তত ইসলামিক পথে আলেম হোক। কিন্তু আপনি আমাকে তা না করিয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের একটিতে পড়ার সুযোগ করে দিলেন।
আচ্ছা বাবা, আপনার কি মনে পড়ে?
যখন আমি ছোট আমাকে নিয়ে বাহিরে কিছু কেনাকাটা করতে নিয়ে যেতেন। আমাকে হাফ প্যান্ট বা শাট কিনে দেওয়ার পর যে কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে জিলাপি বা মিষ্টি খাওয়াতেন। যতদূর মনে পড়ে বেশিভাগ সময় খুলনার বড়বাজারে নিয়ে যেতেন। কিন্তু যে ঘটনা আমাকে আলোড়িত করে তা হোল- কেনাকাটার আর খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর আপনার ব্যস্ততার জন্য হয়ত আমাকে রিক্সাতে একা বাসায় পাঠাতেন। যতবারই আমি আপনার সাথে গিয়েছি ততবারই শেষ পর্বটা একই। প্রতি বারই ভীরু চোখে পিছু ফিরে দেখতে পেতাম আপনি রিক্সার নাম্বারটা টুকে রাখতেন। ছেলে হারিয়ে যেতে পারে এই ভয়ে বারবার টুকে রাখতেন রিকশার নাম্বার অথচ আপনি নিজেই হারিয়ে গেলেন।
বাবা আপনার কি মনে পড়ে??
আমি যখন ক্যাডেট কলেজ হতে আপনাকে চিঠি লিখতাম। আপনার কাছ হতে বা মায়ের কাছ হতে চিঠি পেতাম। প্রতিটা বাবা,মা ছেলেকে বিভিন্ন উপদেশ দিয়েই চিঠি দিত। বিশেষ করে আপনার চিঠি কলেজে বসে যখন খুলতাম তখন আশ্চর্য হতাম “আমার চিঠিটা আমাকে কেন পাঠানো হয়েছে?“আমার পাঠানো চিঠিটা পড়ার সময় লাল কালি দিয়ে আমার চিঠির বিভিন্ন ভুলগুলো মার্ক করা। আর আমাকে শুধরানোর জন্য সঠিক শব্দ বা বাক্য কি হবে তা লিখে দিতেন।আমার নিজের কাছে তখন লজ্জা লাগত এবং আমার ভুলে ভরা চিঠি কমে আসত। আজ বড় ইচ্ছা জাগে যদি চিঠিগুলো জমিয়ে রাখতাম। সময়-তো কখনই আপন হয় না।
বাবা আপনার কি মনে পড়ে??-
কলেজ হতে যখন ছুটিতে আসতাম। দুরুস্ত দুষ্ট বালক আমি তখন চুরি করে সময় পেলে মার্বেল খেলা, ডাংগুলি কিংবা বিভিন্ন ব্রান্ডের সিগারেটের খালি প্যাকেট দিয়ে “চারা” খেলতাম। আর আপনি হাতে লাঠি নিয়ে পাড়ার সম্ভাব্য জায়গাতে আমাকে খুঁজে বেড়াতেন।মাঝে মাঝে ধরা পড়ে দিতেন আমাকে উত্তম মধ্যম।
বাবা আপনার কি মনে পড়ে?-
শীতের সকালে বাড়ীর ছাদে রোদের মধ্যে খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি খাওয়া আর সেই সাথে ক্লাসের বিভিন্ন পড়ার জবাবদিহিতা।এমন কি লোডশেডিং হলে বাসার বড়রা খুশি হতো কিন্তু আমাকে হ্যারিকেন না আসা পর্যন্ত টেবিলে বসে থেকে আপনি তখন জিজ্ঞাসা করতেন সন্ধি-বিচ্ছেদ, বাগধারা, কবিতা বা বাংলা বাক্য কে ইংরেজিতে বলা। সকালে কিংবা রাতে যখনই পড়া বলতে বা লিখতে ভুল করতাম আর তখনই আপনার হাতের মুষ্টি-বন্ধ হত আমার চুলের উপর। অনেকবারই আপনার সেই অতি-পরিচিত আমার মাথার চুলের উঁচু ঝাঁকুনিতে কাপড় নষ্ট হয়েছে। এই কষ্ট হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে আপনার সাথে চুল কাটার জন্য যেতাম বাজারে।আপনি আমাকে নাপিতের দোকানে চেয়ারের উপর একটা আলাদা পাটাতনের উপর বসিয়ে দিয়ে চলে যেতেন সংসারের বাজার করতে। আমি নাপিতকে বলতাম চুলটা হবে “কদম-ছাট”। এই “কদম-ছাট” চুলে এক গাদা তেল মেখে আপনার সামনে পড়ার টেবিলে বসতাম। বাবা সেই হতে এখনও পর্যন্ত চুলটাকে বড় করতে পারলাম না।
বাবা আপনার কি মনে পড়ে?
ছোট বেলা হতে সব সময় আপনার মুখটা থাকত কঠিন। পিটাপিটিই নয় ভাই-বোনের এত বড় সংসার সামলানো।১৯৯১ সালের কিছুটা সময় কাটিয়েছি আপনার খুব কাছের সান্নিধ্য। এখনও সেই হাসি সেই ভালোবাসা আমাকে অনুরণিত,আন্দোলিত করে। সালটা মনে আছে কিন্তু মাসটা স্পষ্ট মনে নেই। সেপ্টেম্বর/ অক্টোবর ক্যাডেট কলেজের ছয় বছর শেষ করে এইচ এস সি ফল প্রার্থী। নতুন জীবনের শুরুর পদযাত্রা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন্ড রাংককের জন্য নির্বাচিত হয়েছি। আপনাকে ফোনে খবরটা জানালাম কিন্তু মেডিক্যালের জন্য আমাকে ঢাকাতে থাকতে হল। সব ফরমালিটিস শেষ করে অবশেষে বাড়ীতে ফিরলাম। তার কয়েকদিন পর আমার এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হোল। চারটা লেটার সহ স্টার মার্ক পেয়েছি। ঐ সময় যশোর বোর্ডের পাশের ফলাফল ছিল ৪০%-৪৫% একদিকে ছেলের ফলাফল আর অন্যদিকে আপনার আশা ছেলে সেনাবাহিনীর অফিসার হবে সেই কাঙ্ক্ষিত চাকুরী।বাবা তার কয়েকদিন পরে আপনি আপনার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী মহলে নিয়ে গিয়েছিলেন। মসজিদে আমার জন্য মিলাদ দিয়েছিলেন। আপনার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিল। আপনি গর্বে বুক ফুলিয়ে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পাচ্ছিলেন। আপনার মুখে অক্লান্ত ঝলমল হাসি আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কৈউ জিজ্ঞাসা বা লিখতে বললে আমি এই কথা বা ঘটনা বলি।আজ আমার বয়স ছত্রিশ(৩৬) জীবনের অর্ধেকের কিছু বেশি সময় হয়তো পার করেছি। এখনও বা আজ-অবধি ঐ রকম শান্তি আমি আর আপনাকে দিতে পারি নাই। আর এখন শত চেষ্টা করলেও আমি তা পারব না।
বাবা আমাকে তুমি ক্ষমা কর।
বাবা আমাকে তুমি মাফ করে দিও ……
বাবা আমাকে তোমার মত হওয়ার শক্তি দাও।
বাবা……… বাবা……বাবা……… তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বাবা…
গ্রেডা,দারফুর,সুদান–২০০৯
[ বাবার মৃত্যুর পর তাঁবুর মধ্যে একা বসে আমি লিখেছিলাম আর কাঁদছিলাম। যে ভাবে লিখেছিলাম ঠিক ঐ ভাবেই লেখাটা রেখে দিয়েছি। হয়ত কিছু বাক্য বা শব্দ গঠনে ভুল থাকতে পারে। আশা করি পাঠক তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে।]
:boss: :boss: :boss:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ভাবছিলাম আপনাকে নক করবো।
সেই কবে লিখেছিলেন আর আজ।
যাই হোক খুব ভালো লাগলো।
কিছু বানান ভুল আছে। আপনি নিজেও হয়তো খেয়াল করেছেন।
দেশের বাইরে যারা থাকে তাদের জন্য আসলে মায়া হয়। নিজের জন্যও।
কিছুই করার থাকে না।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
:boss: :boss: :boss:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
😀
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আপনার রেজাল্ট তো খুব ভালো ছিলো।
কেমনে হইলো?
সারাদিন তো আপনারা বাঁদরামি করতেন।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
রাজীব,
😀 😀 ...............
ধন্যবাদ।
অসম্ভব সুন্দর লেখা !
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে
ধন্যবাদ।
চমৎকার লাগলো লেখাটা পড়ে। আপনারা কলেজ থেকে বের হবার এক বছর আগে বাবাকে হারাই। বয়সে তখন অনেক ছোট আমি। তাই মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে গেঁথে যাওয়া টুকরো কিছু স্মৃতি আর কিছু ছবি বাদে আর কোন সম্বল নেই। উনি ভাল থাকুক, শান্তিতে থাকুক এই কামনা করি।
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
মোকাব্বির,
ধন্যবাদ।আমাদের সবারই উচিত আমাদের বাবা,মার জন্য দোয়া করা।
অত্যন্ত চমৎকার একটা লেখা পড়লাম।
বাপ হারানোর কষ্ট খালি সে'ই বোঝে যার বাপ নেই। 🙁 (সম্পাদিত)
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
সামিউল,
তুমি ঠিক কথা বলেছ। It can be only feel by heart but not possible to express. Take care.
মোকাররম :boss: :boss:
পিলখানা লিখে ফেল
শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা..
চিঠিটা কত বার পড়েছি তার হিসাব নেই, যতবার পড়েছি ততবার অশ্রুজলে আমার বক্ষ ভেসে যাচেছ ।আমি ও ১৯৯৩ সালে বাবাকে হারিয়েছি ।মনে রাখার মত অত্যন্ত চমৎকার একটা লেখা পড়লাম ।