আলাপন ১

আশিস‘দা,

কেমন আছো?

মনে আছে, সেবার মেলায় যাবো বলে কী বায়নাটাই না ধরেছিলাম! মেলা বসে সকালে, বিকেলের মধ্যেই গুটিয়ে যায়। সেই সময়টায় আব্বা থাকেন অফিস নিয়ে। উপায়? … আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদন ছিল মেলার শেষ দিন। অগত্যা তোমার সাথে পাঠালেন আমাকে আম্মা। ভয়ে তোমার চেহারা হয়েছিলো দেখবার মত, যদি আমার কিছু হয়?… বিশ টাকা দিয়েছিলেন আম্মা; হাঁড়িপাতিল আর পুতুল কিনেই যখন টাকা শেষ, তখন চোখ পড়েছিলো এক গোছা লাল চুড়ির উপর – টকটকে লাল, যেন এক জোড়া লাল জবা ফুটে ছিল চুড়ির ডালিতে। কিছুই বলিনি তোমাকে, এমনকি তোমার  দিকে তাকাইনি পর্যন্ত, – অথচ কেমন করে যেন বুঝে ফেললে তুমি! বাঁশি কিনবে বলে তিনদিন ধরে অনেক চাওয়ার পর খালাম্মার দেয়া দশ টাকা বিসর্জন দিলে আমার চুড়ি পাওয়ার আনন্দে!… দুহাত ভরা চুড়ির দিকে তাকিয়ে খুশিতে আমার চোখ ভিজে উঠছিল বারবার, বিশ্বাস হচ্ছিলো না অভাবনীয় সেই পাওয়াটুকু। দুহাতের তালুতে চোখ মুছতে গিয়ে টুংটাং টুংটাং শব্দ করছিলো চুড়িগুলো, একমনে গাইছিলে তুমি – চুড়ির টুংটাং আর তোমার গান কখন যে একসাথে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো – বুঝতে পারিনি। তাই আজও যতবার চুড়ির টুংটাং কানে আসে, তোমার গান ভেবে ভুল করে বসি।

সে যাক গে, এরপর কী হয়েছিলো তোমার মনে আছে? চোখ মুছতে গিয়ে খেয়াল করিনি কিছুক্ষণ, ব্যাস, হারিয়ে ফেললাম তোমাকে! কান্না ভুলে হাজার মানুষের ভিরের মাঝে তখন আমি তোমাকে ডাকছি আর দৌড়াচ্ছি – কিভাবে তোমাকে খুঁজে পাবো জানিনা, খুঁজে পেতে হবে শুধু সেটুকুই জানতাম। হঠাৎ পাশ থেকে হাত চেপে ধরলে তুমি – আমার বা হাতের কবজিতে তোমার আঙুলের প্রচণ্ড চাপে চুড়ি ভেঙে হাত কেটে সে কী কাণ্ড! রাতে আম্মার কাছে যখন ধরা পড়লাম, আমার চুড়ি পরার উপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন তিনি। ( পরিওনি অনেকদিন, বহুবছর পর এক চুড়িওয়ালার সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত – সে আরেক গল্প, পরে না হয় বলব তোমাকে।) সে রাতে বাসায় ফিরে তুমিও মার খেয়েছিলে অনেক – বাঁশি কেনার টাকা মেলায় হারিয়ে ফেলেছো বলায়।

পরদিন স্কুলে তোমার সাথে যখন দেখা , তোমার ঠোঁটের একপাশে রক্ত শুকিয়ে তখনও জমাট বেঁধেছিল। কী গেছে আগের রাতে তোমার উপর দিয়ে – বুঝতে একটুও বাকি ছিলোনা আমার। কিন্তু তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম আমি । কষ্ট সেখানে ছিলোনা এতটুকুও – কী ছিল বুঝতে পারিনি সেদিন। আর আমি স্কুল থেকে ফিরে চুড়িগুলো আম্মাকে দিয়ে দিয়েছিলাম – আলমারিতে তুলে রেখেছিলেন তিনি। খুব কাঁদছিলাম আমি – আম্মা ভাবছিলেন চুড়ি হারানোর কষ্টে, আমারও মনে হচ্ছিলো ওরকমই কোন কারণ হবে। কিন্তু, … তোমার চোখে সেই অদ্ভুত আনন্দ আর আমার আমার অশ্রুবিন্দুতে জড়ো হওয়া সেই কষ্ট – এই সবকিছুর উত্তর পেয়েছিলাম অনেকগুলো বছর গড়িয়ে যাওয়ার পর, যখন দুজন বাস করি দুই পৃথিবীতে।…

সেই বাঁশি কিনেছিলে তুমি পরের বছর মেলায়, সারাক্ষণ বাজাতে। মনে আছে, কতদিন আমার ঘুম ভেঙেছে তোমার বাঁশির সুরে! আর আজ, ব্যাস্ত শহরের অস্থির গাড়ির হর্ন ছাড়া আর কিছুই কানে পড়েনা। শহুরে জীবনের নেশা তোমাকেও পেয়ে বসেছিল এক সময়, আর তাই হয়ত আমার বিয়েতেও এলেনা তুমি। কনেবিদায়ের মুহূর্তে বারবার তাকাচ্ছিলাম আমি চারপাশে, যদি একটিবার তোমায় দেখতে পাই ভিরের মাঝে! তোমার পুরনো সেই প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়ছিল ভীষণভাবে – আমার কানের পাশে মুখ নামিয়ে বলেছিলে, “ বুড়ি, বিয়ে হয়ে যেদিন চলে যাবি তুই, সেদিন পাশে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাবো আমি, তোর বিয়েতে সে-ই হবে আমার উপহার” … পাওনাটুকু আজও বাকি আছে, কী বলো?

আচ্ছা, তুমি আসলেই কেমন আছো? কী করছো? কোথায় আছো? বিয়ে করেছো? … পুতুল খেলায় যখন আমি তোমার মিথ্যা মিথ্যা বউ সাজতাম, তখন তুমি আমায় ডাকতে ‘বউমণি’ বলে, তোমার সত্যি সত্যি বউকে কি ‘বউমণি’ বলে ডাকো? …

এখনো ভাবছো, কেন হঠাৎ এই চিঠি? আমি নিজেও ঠিক জানিনা। শুধু এটুকুই জানি, তোমার কাছে কখনোই পৌঁছাবেনা আমার এই কথাগুলো। ভুলে যখন গেছই, মনে করিয়ে কী লাভ, বলো?

আমার পাগলামির কারণে অনেক বকতে তুমি, কিন্তু শুধরাতে পারনি। আজ আরেকটা পাগলামি করলাম – হয়ত এ-ই শেষ। তোমার কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে যে শহরে, সেই শহরে যাচ্ছি আমি। ওখানেই থেকে যাবো ভাবছি। হয়ত, কোথাও না কোথাও তোমার রেখে যাওয়া কোন চিহ্ন খুঁজে পাবো একদিন, ভেবে নিবো – খুব কাছেই কোথাও আছো তুমি…! একই শহরে একসাথে থাকা হয়ত হয়নি আমাদের, তবুও, এ-ও তো একভাবে থাকা, একসাথে!

তোমার শহর থেকে আবার তোমাকে লিখবো, কেমন?

-ইতি

তোমার ‘মনে না পড়া’ এক গল্প

১,৮৫৫ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “আলাপন ১”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    বাহ!
    বেশ লাগল! :clap:

    একটি পরামর্শঃ
    লেখার পর অভ্র স্পেল চেকার দিয়ে চেক করলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত টাইপো থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

    পরের আলাপনের অপেক্ষায় থাকলাম!


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    হৃদয় ছোঁয়া গল্প, অসাধারণ হয়েছে তানজিনা।
    সে রাতে বাসায় ফিরে তুমিও মার খেয়েছিলে অনেক – বাঁশি কেনার টাকা মেলায় হারিয়ে ফেলেছো বলায়।
    তোমার সত্যি সত্যি বউকে কি ‘বউমণি’ বলে ডাকো?

    অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যায় এসব কথা।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।