আত্মার ডায়রি থেকে: শুধু একটু আদর

১.

“” আমার ভালবাসা, আমার প্রাণপ্রিয়,

এত আনন্দ আমি কীভাবে যে তোমাকে বোঝাব! কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলছি, তোমার একটা মেয়ে হয়েছে, একেবারে চাঁদের মত সুন্দর। তুমি বাবা হয়েছ, আর আমি – মা। জানো লক্ষ্মীটি, তোমার মেয়ে একেবারে তোমার মত হয়েছে, তোমার মত ওর কপালের ডানপাশেও একটা তিল আছে। কিন্তু মেয়েটা সারাক্ষণ শুধু কাঁদে, মনে হয় বাবার আদর পেতে চায়। please লক্ষ্মীটি, জলদি চলে আস। জলদি ,জলদি………..।

ইতি

তোমার ভালবাসা, তোমার প্রিয়া “”

ঢাকা থেকে স্ত্রীর পাঠানো এই চিঠিটা লাহোর ক্যান্টনমেন্টে বসে আমি ক্যাপ্টেন সুমন যেদিন receive করেছিলাম তখন ‘৭১এর ফেব্রুয়ারি। প্রিয়ার ইচ্ছে ছিল, ছেলে হলে পাইলট বানাবে, মেয়ে হলে ডাক্তার। তাই মেয়ের কথা ভাবতেই আমার চোখের সামনে একটা স্বপ্ন ভেসে এল। আমার মেয়ে নামকরা ডাক্তার হবে।মেয়েকে এক নজর দেখার জন্যে ছুটি manage করতে সচেষ্ট হলাম। কিন্তু পারলাম না, শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। বন্ধ করে দেয়া হল বাঙালিদের পূর্বপাকিস্তানে ফিরে আসা। দেশের টানে পাকিস্তান ছেড়ে পালালাম আমরা সেনাবাহিনীর কয়েকজন। বাড়িতে একবার মেয়েটাকে দেখেই যোগ দেব যুদ্ধে- এটাই ছিল ইচ্ছা। কিন্তু ঢাকার খুব কাছাকাছি এসেও বাড়িতে যাবার ইচ্ছেটা ত্যাগ করতে হল দেশের টানে – ‘এদিকটা তখন হানাদারদের দখলে; মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ নয়।’ ফুটফুটে মেয়েটাকে একটু আদর দেয়ার ইচ্ছা সুপ্ত রেখেই যোগ দিলাম মুক্তিফৌজে। এরপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা। প্রিয়ার ঐ চিঠিটা বুকে নিয়ে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ালাম দেশের এপাড় থেকে ওপাড়। চোখে বাংলামায়ের স্বাধীনতার নেশা; মনে ছোট্ট মেয়েকে আদর দেবার প্রত্যাশা। যুদ্ধের মাঝে প্রায় রাতেই আকাশের চাঁদ দেখে ভাবতাম, ‘ঐ তো আমার মেয়ে।’

যুদ্ধের শেষদিকে অক্টোবরে ৯নং সেক্টরে যুদ্ধরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আমি পঙ্গু হয়ে গেলাম। কোনমতে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও এই ব্যথাটাই একদিন আমাকে মরণের ডাক দিয়েছিল। যুদ্ধের বাকিটা সময় সেনাবাহিনীর অধীনে চিকিৎসারত ছিলাম। যুদ্ধ শেষে ডিসেম্বরে ফিরে চললাম নিজের বাড়ির দিকে। চোখে রঙিন স্বপ্ন; একটা নতুন দেশ, নতুন পতাকা আর প্রিয়ার কোলে একটা নতুন মানুষ। এত নতুনের আনন্দে পঙ্গুত্বের কষ্টটা আর আমার মনে স্থান পায়নি।   কিন্তু হায় ! এ কি ! কোথায় বাড়ি, এ যে ধ্বংসস্তুপ। প্রিয়ার বদলে শোক সংবাদ; “আমার প্রিয়ার ক্ষতবিক্ষত লাশটা নাকি বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল রাজাকারদের ঘাটির পিছনে।”  আর আমার মেয়ে ? ? যুদ্ধ তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। কী দোষ ছিল আমার ছোট্ট মেয়েটার ? কী অপরাধ ছিল আমার প্রিয়তমার ?

২.

কেটে গেছে প্রায় ২৫টি বছর। এই বুড়ো পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ক্ষতস্থানটায় পচন ধরেছে। আমি ঢাকার P.G.  হাসপাতালে  চিকিৎসাধীন। বুঝতে পারছিলাম জীবনের শেষ দিন আসন্ন। জীবনের সব হারিয়ে এখন নিজেকে হারাতে পারলেই আমি বেঁচে যাই। কিন্তু হায় ! জীবনের শেষ দিনগুলিতে জীবনের প্রতি একটা মায়া পড়ে গেল। কারণ – আমার চিকিৎসায় কর্তব্যরত ডাক্তার মেয়েটা, তাজনিন। ওর পরম সেবা শুশ্রূষা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে লাগল প্রিয়ার সেই কথাগুলো – ” মেয়ে হলে ডাক্তার বানাবো ।” অবশেষে একদিন মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বললাম,  তুমি কে মা ?কেন মিছিমিছি এই বুড়োর জন্য এত কিছু করছ ?

: ছোটবেলায় যুদ্ধে বাবাকে হারিয়েছি, তাই আপনার মত বাবার বয়েসি কারও কষ্ট দেখলে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনা।

চোখের জল লুকিয়ে বড় আবদার নিয়ে বলেছিলাম, ‘ একটু কাছে আসবে মা, তোমার কপালে একটা আদর দিব।’ কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, আজরাইল আমার প্রাণপাখিটা টানাহেচড়া শুরু করেছে। আমি উঠে বসতে চেষ্টা করলাম, ওর কপালটা আমার মুখের কাছে আসতেই আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, ” হে আল্লাহ, আমি বাঁচব , আমাকে আর একটিবার শক্তি দাও।” কারণ, ওর কপালের ডানপাশে একটা তিল ছিল। কিন্তু আমার ওষ্ঠাধর ওর কপাল স্পর্শ করার আগেই আমি প্রচন্ড ব্যথায় বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। আমার প্রাণপাখি উড়ে চলল পরপারের উদ্দেশ্যে। আর উঠে বসা হল না, শত স্বপ্নের মেয়েকে এত কাছে পেয়েও দেয়া হল না কাঙ্ক্ষিত সুপ্ত আদরটা।

পরিশিষ্ট:

এখনও ডা. তাজনিন তার বাবার কোন সঠিক পরিচয় জানেন না, শুধু এতেটুকুই জানেন যে তার বাবা তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন এবং যুদ্ধের পরে তার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবুও বাবার কথা মনে হলেই তার বুকটা হাহাকার করে ওঠে, চোখের সামনে কেবলই ভেসে ওঠে, একজন বৃদ্ধ তার কপালে আদর দিতে গিয়েই চমকে উঠেছিলেন,  মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।

আচ্ছা, মৃত্যু পথযাত্রী ঐ বুড়ো কী করে sure  হয়েছিলেন যে এই তাজনিনই তার মেয়ে ?

একটা তিলই কি সব পরিচয় নিশ্চিত করে ? হয়ত করে না।

তবুও একটা অচেনা মেয়েকে নিজের মেয়ে ভেবে মনে শান্তি পেতে ক্ষতি কী………….

তবুও একটা অচেনা বুড়োকে নিজের  বাবা ভাবতে ক্ষতি কী………….

২,০২৭ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “আত্মার ডায়রি থেকে: শুধু একটু আদর”

  1. চোখে রঙিন স্বপ্ন; একটা নতুন দেশ, নতুন পতাকা আর প্রিয়ার কোলে একটা নতুন মানুষ। এত নতুনের আনন্দে পঙ্গুত্বের কষ্টটা আর আমার মনে স্থান পায়নি.......

    সুন্দর লিখসো। কিছু বানানের ভুল পীড়াদায়ক।
    Well done, brother.

    জবাব দিন
  2. তারিক, এই ব্লগের অন্যতম সেরা লেখা এটি...নি:সন্দেহে...
    গল্পের প্লট অতি সুন্দর...
    তোমার এই লেখাটি সবাইকে ক্যাডেট কলেজ বাদেও কিছু লিখার অনুপ্রেরণা জাগাবে...এগিয়ে চলো...

    জবাব দিন
  3. ভাল্লাগছে...

    ভাইয়া,বানানটা আরেকটু খেয়াল করে লিখ।বানানের জন্যও অনেক সময় সুন্দর লেখার সৌন্দর্য কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়।সেকেন্ড প্যারার প্রথম লাইনটা কেমন একটু খটোমটো লাগলো।ওই লাইনটা কি ঠিক আছে?

    আরো লিখতে থাকো... অপেক্ষায় রইলাম...

    জবাব দিন
  4. ভাই, আমি বাংলায় নতুনতো, বাংলা লিখতে অনেক অনেক সময় লাগে, এইটা পোস্ট করতেই প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে গেছে। তাই বানানের দিকে ততটা খেয়াল রাখতে পারি না, একটু expert হয়ে গেলে ইনশাল্লাহ আর এমন ভুল হবে না। এবারের মত কান ধরলাম............

    জবাব দিন
  5. চরম লাগলো। গল্পের নামটা চমৎকার, মাঝখানের লেখাগুলো চমৎকার, শেষটা চমৎকার আর পরিশিষ্টটাও চমৎকার।
    সবকিছুই চমৎকার। গল্প লেখা চালিয়ে যান। এভাবেই বিকশিত হবে ক্যাডেট কলেজ ব্লগ।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।