প্রথম আলোতে একটা সিরিজ বিজ্ঞাপন খুব চলছে। দেশপ্রেমকে ব্যাবহার করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষকে উজ্জীবিত করা বিজ্ঞাপন, যার বক্তব্য অনেকটা এরকম-দেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা এর কোন অংশ নই। আমরা আমাদের কাজ করে যাব। ভালো কথা। বিশেষত যখন ওই লাইনটা বলে “আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ” তখন আমারো লোম খাড়া হয়ে যায়। কিন্তু আমি বিজ্ঞাপনের যে মূল বক্তব্য তার আরো একটু ভিতরে ঢুকতে চাই। বিজ্ঞাপনটিতে সমস্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে সমাধান দেখানো হয়েছে তা আমাদের আসলে কোথায় নিয়ে যাবে?
এই যে দেশের তথাকথিত দুই প্রধান ” রাজনৈতিক দল” ক্ষমতা নিয়ে যে কামড়াকামড়ি করছে তার উদ্দেশ্য যে আমাদের মঙ্গল কামনা থেকে নয় তা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়া লাগেনা। কিন্তু সমস্যাটা সেখানে নয়। সমস্যা হল এর ফলে আমরা ম্যাংগো পিপল যে রিএকশন দিচ্ছি বা আমাদের দিতে “অনুপ্রাণিত ” করা হচ্ছে সেখানে।
প্রথমত, এই যে সহিংসতা হচ্ছে, আমরা স্বীকার করি বা না করতে চাই, সেগুলো কিন্তু ঘটাচ্ছে আমার দেশের মানুষ, আমার চেনা পরিচিতদের মাঝেই কেউ না কেউ। তারা আমাদেরই ভাই, বাবা, ছেলে। গত ত্রিশ বছর ধরে তাদের এর জন্য তৈরী করা হয়েছে। তাই “আমরা এর মধ্যে নাই” বলে যেমন দায় এড়ানো যায়না তেমনি বাস্তবতাকে অস্বীকার করাও যায়না যেটা এই বিজ্ঞাপনে করার চেষ্টা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এই বক্তব্যকে ঠিক ধরে নিয়ে আমরা যদি শুধু “কাজ” করে যাই, তাহলে কি ঘটবে? এখন দুনিয়াটা অনেক কঠিন। সেই যুগ আর নাই যে যখনি অরাজকতা অনেক বেড়ে যাবে তখনি গায়েবি সাহায্য এসে সব ঠিক করে দিবে। এখন আমাদের সাহায্য করার জন্য কেউ নাযিল হবেনা, আমাদের নিজেদের সমস্যা আমাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। আর তার জন্য প্রথমে আমাদের এটা তো বুঝতে হবে যে “এইসব বাচ্চাদের খেলা” আসলে আমাদেরই খেলা, আমাদের অধিকার, আমাদের ক্ষমতা “ওদের” হাতে চলে যাওয়াটাই যত সমস্যার কারন। এই দেশেরই কিছু মানুষ ক্ষমতাকে নিজেদের মাঝে রেখে দিতে চেয়েই এই সমস্যা জিইয়ে রাখছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সেই ক্ষমতাকে তাদের হাত থেকে নিয়েই বেরিয়ে আসতে হবে, আমরা এর মাঝে নেই বলে আলাদা হয়ে গেলে আসলে ওদেরকে এইসব নৈরাজ্য চালিয়ে যেতে দেয়াই হবে। এখানে আসলে “নিরপেক্ষ” থাকার কোন উপায় নেই। ব্যাপারটা অনেকটা সেই বিতর্কটার মত- আমার সামনে কোন সবল লোক যদি কোন শুঁটকাকে পেটাতে থাকে, আর আমি যদি “নিরপেক্ষ” থেকে ওদের বিরক্ত না করি তাহলে যতই ভান বা অস্বীকার করি, আমার মৌনতা কিন্তু সবল লোকটার পক্ষেই যায়। একটু উদাহরন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক এই বিজ্ঞাপনের কথামত আমাদের কাজ আমরা করে গেলাম। অর্থাৎ কৃষক শষ্য ফলালো, কারখানায় শ্রমিকরা উৎপাদন করল, আমরা মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা অনেক “মাথা খাটিয়ে” সেগুলো বিক্রির ব্যাবস্থা করে দিলাম, আর এইসব রাজনীতির ব্যাবসায়ীরা বা ব্যাবসায়ী রাজনীতিবিদেরা আমাদের অনাগ্রহের সুযোগ নিয়ে তাদের কামড়াকামড়ি চালিয়ে গেল, তাতে অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে? আমাদের কোন লাভ হবে? আমরা যেই ফুটবল ছিলাম সেই ফুটবলই থেকে যাবো…
তাই সত্যিই যদি সমস্যা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাই তাহলে সমস্যাকে মোকাবিলা করেই আমাদের তার সমাধান করতে হবে, সমস্যা থেকে পালিয়ে গিয়ে নয়। এই পালানো প্রকারান্তরে “দুষ্টু লোকদের” জনগনের পুটু মারাতেই সাহায্য করবে। কাজ তো করতেই হবে, কাজ না করলে খাবোক কি? তার পাশাপাশি কার জন্য কাজ করছি সেটাও বুঝতে হবে, তা না হলে আমাদের ইতিহাসও হবে সেই আরব বসন্তের মত নিজেরা নিজেদের পুটু মারার ইতিহাস…
এই প্রশ্নটাই কালকে আমার মাথায় ঘুরতেছিল...
দেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের কি করণীয়???
মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...
জ্ঞান দিতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। ছোট করে বললে কোন শর্টকাট নাই। খুঁজ, পড়। সত্যিই জানতে চাইলে সমাজটা কিভাবে চলে সেটা বের কর। তখন নিজেই বুঝবে কিভাবে এটা পালটানো যাবে।
না জানাটা দোষের কিছু না, কিন্তু জানতে না চাওয়াটা দোষের। এইগুলানের শাস্তি হওয়া উচিৎ!!