যুদ্ধাপরাধারের বিচার বানচাল করার বহু কৌশল জামায়াতে ইসলাম ২০১০ সাল থেকে ব্যবহার করে আসছে। প্রথম দিকে আর্ন্তজাতিক লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ, আর্ন্তজাতিক আইনি পরামর্শক নিয়োগ, মূলধারা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা চালানো, দেশে এবং আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে কনফারেন্স আয়োজন, রাজনৈতিক এ্যাডভোকেসি এবং পাশাপাশি আইনি লড়াই। সাথে ছিল সাক্ষীদের ভীতি প্রদর্শন করা। সবকিছুর সাথে আইসিটিকে কিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে বাঞ্চাল করা যায় সে সুযোগ খোঁজা ছিল বিশেষ কৌশলের অংশ। তবে এসব সফট ট্যাকটিকস ব্যবহার করে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। পরিস্থিতি নানা কারণে প্রতিকূলেই ছিল জামায়াতের জন্য।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় প্রদানকে কেন্দ্র করে এবং শাহবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কোনঠাসা অবস্থা থেকে জামাতের কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। সফট থেকে এখন জামাত হার্ড ট্যাকটিকস ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক সহিংসতায় ফ্রন্টলাইনে বহু স্থানেই শিশু এবং কিশোরদের ব্যবহার করছে জামায়াত ঢাল হিসেবে তান্ডব চালানোর সময়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ধরণের সহিসংতা, ত্রাস, এবং ভীতি প্রদর্শন করেছিল সেটারই পূনরাবৃত্তি শুরু করেছে। সাথে সুনিদ্রিষ্ট আক্রমন এবং টার্গেটেড কিলিং। এই কৌশলগুলোকে জিহাদ হিসেবে প্রচার করে সহজ সমর্থন আদায় করে নিচ্ছে ঢাকার বাইরের লোকালয়গুলোতে। পাশাপাশি কৌশলে আরেকটা কাজ করছে সেটা হলো বাঙালি হিন্দু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সহিংস আক্রমন, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, লুট করা, উপাসনালয় পোড়ানো। গত বছর কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের বৌদ্ধ উপাসনালয় এবং ঘরবাড়ি আক্রমন এবং সহিসংতার পর জামাতি তান্ডবের প্রেক্ষাপটেবৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষজন শঙ্কাগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন বলে সংবাদপত্রে উঠে এসেছে।
৪৭’এর দেশ ভাগকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রাজনীতিতে যে কৌশলটা অভেদ্য সেটা হলো সর্বপ্রথমে বাঙালি হিন্দুকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মুখোমুখি করা। এই কৌশলের সুবিধা হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্রান্ত করলে থেকে প্রতিরোধের মাত্রাটা হয় দূর্বল। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক সংহিসতার ব্যাপারটা তুলনামূলক কম স্পর্শ করে। তাই তারা থাকে নিস্পৃহ। কিন্তু ত্রাস সৃষ্টিটা সাংঘাতিক মাত্রার আতঙ্কের হয়। তাছাড়া সংখ্যালঘুদের সাথে ভারতকে এক করে সহিংসতাকে মোটাদাগে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ময়দানে জায়েজ করে ফেলাও সহজ। এছাড়া বাঙালি হিন্দু বা সংখ্যালঘু পরিবারকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে পারলে বাড়ীঘর, জমিজমা, সম্পদ থেকে ভবিষ্যত লাভের এবং লোভের হিসেব থাকে। তাই এতে স্থানীয় স্বার্থান্বেসী সমর্থন পাওয়াটাও সহজ। মূলত এই কৌশল প্রয়োগে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যোগ হয় প্রাপ্তি, লোকসানের তেমন কিছু থাকে না। জামাত এটা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি যে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাথেও করে থাকে। আহমাদিয়া সম্প্রদায়ও জামায়াতের এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আসছে।
জামায়াত এবারো ঠিক এই একই কাজটি করছে। সাম্প্রদায়িক সহিসংতা থেকে বড় প্রাপ্তি হলো সাধারণের মনযোগ ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। এবং বলতে দ্বিধা নেই যে স্থানীয় জনসমর্থনও ক্ষেত্রবিশেষে বাড়ে। জামায়াত সবসময়ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তার প্রতিপক্ষ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গন্য করে। এটাই হয়ে আসছে। ১৯৬৪ সালে যখন ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধ হয় সেসময় এটা হয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়তো বাংলার মাটিতে হিন্দুত্ব সাফ করার জন্য পাকিস্থানের সেনাদের মোটিভেট করে আনা হয়েছিল। সাথে ছিল জামায়াতের গনহত্যা, ধর্মান্তরিতকরণ সহ যুদ্ধাপরাধ। ২০০১ সালে নির্বাচনের পরও আবার যে হিংসাত্মক সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলা হয় তার নির্মম শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রান্তিক মানুষজন। খালেদা জিয়া তথা বিএনপির জামাত বিষয়ক নীতিতে রাজনৈতিক সমর্থন, জামাত-রক্ষা নীতি এবং শাহবাগ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিরোধী অবস্থান সাম্প্রতিক সহিংসতায় জামাতকে আরো রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে। আবার আওয়ামীলীগ দল হিসেবে এখনো রাজনৈতিক সহিংসতা এবং জামাত মোকাবিলা করার মতো কোন জোরদার এবং সুনিদ্রিষ্ট উদ্যোগ এবং অবস্থান নিতে পারেনি। যথেষ্ট সক্ষমতার পরিচয় দিতে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। এমন অভয় দিতে পারেনি যা আশ্বস্ত করতে পারে সাধারণ মানুষকে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। নিজের স্বার্থের প্রয়োজন এবং ভোটের রাজনীতির হিসেব ছাড়া কিছু করবে সেটা নাও হতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে জামায়াতকে সামাল দিতে এবং নিজেদের রক্ষা করতে। বড় সহিংসতা ঠেকানোর সামর্থ্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর যথেষ্ঠ সীমিত। তাই জনসমর্থন এবং জনপ্রতিরোধের কোন বিকল্প নেই।
যুদ্ধাপরাধ রায় প্রদানের পর থেকে জামাত যে সহিংস নীতি ও জঘন্য সব কৌশল গ্রহন করেছে, রাজাকার সাইদীর রায়ের পর থেকে তা ভিন্ন ধ্বংসাত্মক মাত্রা পেয়েছে। বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদাযের মানুষ জামাতের সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা এবং সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। জামায়াত এটা জেনে-বুঝেই করছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সবারই কিছু করণীয় আছে। সেটা হলো প্রথমত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন। আপনার বা আমার বন্ধু, সহকর্মী বা প্রতিবেশী সংখ্যালঘু মানুষটি সরাসরি সহিংসতার শিকার নাও হতে পারে। কিন্তু কেউ সংখ্যালঘু হলে তার সহিংসতার সরাসরি বা পরোক্ষ প্রভাব অনেক বেশি হয়। একবার তার অবস্থায় যদি নিজেকে বসাতে চেষ্টা অনুমান করাটা খুব কঠিন না যে তার মনে কি অস্থিরতা, অবিশ্বাস এবং শংকা মনের গহীনে কাজ করতে পারে। একবার ভাবতে চেষ্টা করি তো আমার বাড়িটা জামায়াত-শিবিড় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল মূহুর্তে – অবাস্তব মনে হলেও এটাই তো হচ্ছে চারিদিকে, এই স্বাধীন বাংলাদেশে। দেশের সব সাধারণ মানুষই এখন সহিংসতায় ভীত এবং শঙ্কিত। সেজন্যই যারা ভিন্ন ধর্মের অনুসারী এবং ভিন্ন জাতির মানুষ প্রয়োজনে তাদের পাশে সাহস এবং সহমর্মীতার হাতটা বাড়ানো প্রয়োজন। আশ্বস্ত করা প্রয়োজন যে ভয় নেই, পাশে আছি। একটু সহমর্মীতার হাত বাড়িয়ে দিলেই মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সাহস সঞ্চার হয় মনে।
সংখ্যালঘুদের প্রতি জামায়াতের সহিংসতাকে উপেক্ষা করতে পারি আমি আর দশটা সাধারণ মামুলি সহিংসতা মনে করে। কিন্তু, কেন করবো? মনে হতে পারে, আমার কি করার আছে এতে? একজন নাগরিক হিসেবে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাড়ানোটা জরুরী এবং কর্তব্য। সেটা সরাসরি বা পরোক্ষ যেকোনভাবে হতে পারে। আমাদের জেগে ওঠা উচিত এখনই, বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই। আমরা নিশ্চয়ই চাই, আমাদের সংস্কৃতিতে যে বহু মত, বহু বিশ্বাস এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার উপাদানগুলো আছে সেগুলো জামায়াতের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্পে বার বার সংক্রামিত না হোক। যদি বিশ্বাস এবং জাতিগত বৈচিত্র এবং স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং দেশটিকে বসবাসের যোগ্য দেখতে চাই, বিশ্বমনস্ক মানুষ মনে করি নিজেকে, তাহলে জামায়াতি সহিংসতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন এবং প্রতিরোধ করাটা সত্যিকার অর্থে এখন সময়ের প্রয়োজন। সামাজিক মিডিয়ার প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত না হয়ে, প্রতিরোধের কাজটা যার যার অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব করা প্রয়োজন সকলের। প্রতিটি মানুষের সচেতনতাই মিলিত হয়ে ধর্মীয় এবং সংখ্যালঘু সহিংসতা রুখতে জনমত গঠনে সাহায্য করবে। তাই আর দেরি নয়, প্রতিরোধে রুখে দিতে হবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জামায়াতি কৌশল এবং অপতৎপরতা।
চলুন, এখনি অবিলম্বে আমরা সংখ্যালঘু ভিকটিমদের সঙ্গে আমাদের সংহতি দেখিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাড়াই এবং ওদের পাশে গিয়ে বলি 'সবার উপরে মনুষত্ব'; আমরা তোমাদের দুঃখে, তোমাদের কষ্টে সমভাবে ব্যথিত। পারেন কি? চলুন, এখনই সংগঠিত হয়ে আমরা আমাদের 'যার যা কিছু আছে' তাই নিয়ে আমাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে আমাদের মানবতার পতাকা উড়াই, সহজভাবে বলি ভালো সিসি ব্লগ ব্যানারএর অধীনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তহবিল বা ফান্ড রেইজ করতে পারি ? আমি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নৈতিক ও আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার করছি। আসুন, বসে থাকার মানে হয়না .. .......এখনই আমরা মানবতার পাশে গিয়ে দাড়াই।
দেশ যদি মা হতে পারে ওরা যে আমার একই মায়ের সন্তান;
আর মায়ের কাছে সব সন্তানই যে তাঁর চোখের মনি ...
আমার মায়ের নিস্বার্থ ভালোবাসা সব মত ও পথের উর্ধ্বে, সব সন্তানের জন্যই তাঁর সমান ভালোবাসা .....সেখানে কোনো রং নেই, নেই কোনো বর্ণ, নেই কোনো ধর্ম। আসুন আমরা আমাদের পরিবারের পাশে গিয়ে দাড়াই---বলি তোমাদের দুঃখে, তোমাদের কষ্টে আমরাও সমভাবে ব্যথিত।
:boss: :boss:
:thumbup:
এটাই আসল কথা। নীরব থাকলে ক্ষতি যা হবার আরো বেশি হবে। তাই প্রতিরোধ করা এবং হাতে হাত রেখে একে অন্যের পাশে দাড়ানোটা জরুরী। মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
'দাঙ্গা' শব্দটিতে আমার আপত্তি।দাঙ্গায় অংশ নেবার মতো শক্তি বা বাস্তবতা কি বাংলাদেশের হিন্দুদের আছে? একটা হুমকি দিলেই তো তারা তলপি-তলপা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দিকে হাঁটা দ্যায়।সেখানে ঘরবাড়ি পোড়ানোর কি প্রয়োজন বুঝলামনা। ভোটের রাজনীতিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্ধ আওয়ামী-মুখিতা, সুনির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের অভাব, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতায় পলায়নপর মনোভাব, দেশের রাজনীতিকে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য দিতে পারার ব্যর্থতা (মানব-বন্ধন টাইপ ব্যাপারগুলো বাদ দিলে) এই জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।সংখ্যাগুরু মুসলমানের সীমাহীন নিস্পৃহতার কথা না-ই বা বললাম।
কজেই আজ জামাত যা করছে, নানাবিধ ব্যানারে বা অব্যানারে তা ঘটতেই থাকবে। রাষ্ট্র রাজনীতি চলে সংখ্যাগুরুর মেজাজে, ম্যান্ডেটে - ghettoপুত্রদের ঠাঁই তার মনন থেকে ক্রমশঃ বিলীয়মান। অবাক হবার কিছু নেই।
যা হচ্ছে সেটা যে অন্যায়, অপরাধ এবং অস্বাভাবিক সেই বোধদয় হবে কিনা জানি না। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে কথা বলার দরকার। সচেতনতার প্রয়োজন আছে। যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়েও অনেক নিস্পৃহ সময় চলে গিয়েছে - তার ক্ষতিটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। তাই নীরবতা ভাঙ্গা প্রয়োজন সবার আগে।
'দাঙ্গা' শব্দটা বর্তমান সহিংসতায় বাস্তবতা না। প্রশ্নটা রেখে ভাল করেছেন। এক জায়গায় অসাবধানতাবশত লিখেছিলাম। ঠিক করে দিলাম।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
'নীরবতা'-র মাধ্যমে এড়িয়ে যাবার প্রবণতা হচ্ছে সবথেকে বড় ইন্ধনদাতা; এটাই সবথেকে বড় অপরাধ বলে আমার মনে হয়।
:thumbup:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
সহমত
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ