প্রজন্ম শাহবাগ পূর্বাপর

আমরা যারা শৈশব এবং কৈশোরের সন্ধিকালে স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান দেখেছি তাদের অনেক আশার সঞ্চার হয়েছিল নব্বই-উত্তর নতুন দিন নিয়ে অগ্রজদের উচ্ছ্বাস দেখে। আমরা একাত্তর দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। শুধু গল্প শুনেছি। বইয়ে পড়েছি। কখনো সিনেমায় দেখেছি। আর বিশেষ দিনে টেলিভিশনে যুদ্ধের ফুটেজ দেখেছি। পরিবার এবং পড়শির কাল নিরবধির স্বপ্নে আচ্ছন্ন থেকেছি। ভীষণভাবে মগ্ন হয়েছিলাম নব্বইয়ের নতুন অজানা দিনের শিহরণে। তখন আর কিছু বুঝি বা না-বুঝি সেটা যে বাংলাদেশের রাজনীতি ইতিহাসে একটা মাইলফলক সেটা বুঝতাম। আশা ছিল দেশে সত্যিকার গণতন্ত্রায়ণ হলে অগ্রজদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নগুলো হয়তো বাস্তবে রূপ নিবে। কিন্তু অগোচরে কেমন করে যেন সেই অর্জন, সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা চুরি হয়ে গিয়েছিল।

সত্তরের দশকের শেষে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইসলামীকিকরণের সুযোগে যে জামাতে ইসলাম নামের বিষধর কালসাপের পুনর্জন্ম হলো, সে দুই কিস্তি সরাসরি এবং ছায়া সামরিক শাসনের আদরযত্নে রুষ্ট-পুষ্ট হয়ে নব্বই-উত্তর গণতান্ত্রয়নের ফসল খেতে শুরু করলো নিয়ন্ত্রনহীন ইঁদুর বন্যা হয়ে। রীতিমতো সদর্পে। অপ্রতিরোধ্য ভাবে। রাষ্ট্রের উদারীকরণ নীতির সুযোগে যখন আশি এবং নব্বই দশকে উৎপাদন এবং সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণের শুরুতে সবাই ব্যক্তিগত ধান্ধায় মত্ত, জামাত তখন খুবই পরিকল্পিতভাবে সেই সুযোগ দলীয় সাংগঠনিক এবং ব্যবসায়িক বিনিয়োগে কাজে লাগায়। সেই সাথে ছিল মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশের অনুদান। পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হতে পারতো। নিশ্চিতভাবে আমরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের একজন শহীদজননী জাহানারা ইমাম ছিলেন। বিরানব্বইয়ের যুদ্ধাপরাধ গণআদালত স্থাপন এবং যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিকে সবার মাঝে অদম্য সাহসীকতা এবং কর্কট রোগের সাথে জীবনপণ লড়াই করে যে অকাট্য সত্যকে সবার মাঝে প্রতিষ্ঠিত করেন তাহলো রাষ্ট্রের শুভ এবং অশুভ, ন্যয় এবং অন্যায়ের বোধ। সময় শেষ এখনো শেষ হয়নি – যুদ্ধাপরাধারের বিচার সবসময় প্রাসঙ্গিক এবং অতি আবশ্যকীয়। আমরা হয়তো সেবার প্রথমবারের মতো জানলাম এবং বুঝলাম বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের মূল নৈতিক শক্তির উৎস মুক্তিযুদ্ধ। যা আমরা হারাতে বসেছিলাম। বিস্মৃত হয়ে পড়ছিলাম।

আমরা বাংলাদেশের যে ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে পড়ে বড় হয়েছি সে পাঠ ছিল খণ্ডিত, বিকৃত, ক্ষেত্রবিশেষে বানোয়াট, কিছু অংশ ধোঁয়াশা এবং অনেক গুরুত্বপূর্ন অংশ অনুপস্থিত। প্রপাগান্ডামূলক। এবং তা ছিল পরিকল্পিত। তাই অগ্রজদের মুখে যা শুনতাম তার সাথে পাঠ্যের অনেক গড়মিল মনে হতো সবসময়। দুই দশকের বেশি সময় গণতন্ত্রের ইতিহাস মূলতঃ ক্ষমতার রাজনীতির। স্বার্থের রাজনীতি। অনেক ক্ষেত্রেই নীতিহীন আপোষের রাজনীতি। শুধু ভোটাভুটির অংক। মাঝখানে বছর দুয়েকের ছায়া সামরিক সরকার। নেহায়েত ভাগ্য ভাল বলে গত দশকের এই পর্ব সংক্ষি্প্ত ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য যে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে দুচারজন উচ্চাভিলাসী এবং দুরভিসন্ধিমূলক স্বৈরাচারী নায়কের উত্থান হয়। আমরা তাদের মনে করি ত্রাতা। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, তারা তাদের ক্ষমতার মঁসনদ মজবুত করতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, জনপ্রশাসন, সামরিক প্রতিষ্ঠান কাউকেই কলুষিত করতে বাকি রাখে না। ত্রাতারা সবসময় পাকিস্থানের সামরিক রাস্ট্রীয় মডেলের সাথে আমাদের পূর্নপরিচয় ঘটান। আমাদের অবস্থা হয় সেই মাধ্যমিকের বানর এবং তৈলাক্ত বাঁশের অংকের মতো যে আমরা তিন ফুট উঠি তো আবার পরের বার পাঁচ ফুট পিছলে পিছনে যাই। জাতি হিসেবে, রাষ্ট্র হিসেবে কখনোই কাঙ্খিত লক্ষ্যে আর পৌছানো হয় না। মজার ব্যাপার হলো, স্বৈরাচারী নায়করা সবসময়ই ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি বিশেষভাবে দূর্বল। তারা কখনোই তাদের স্পর্শ করে না। বরং স্বযত্নে লালন পালন করে এসেছেন। কি অদ্ভুত এক আপোসরফা হয়।

বলতেই হবে, আমরা এমন এক প্রজন্ম যারা সাংঘাতিক দ্বিধান্বিত ইতিহাস, নৈতিকতা এবং বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছি। যে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলাদেশ ইতিহাস জ্ঞান নিয়ে বড় হয়েছি তা স্বভাবতই খন্ডিত, সংকীর্ন, প্রপাগান্ডা-নির্ভর এবং বহুমাত্রিক। তাই হয়তো আমরা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিতেও এক্যমত্ স্থাপন করতে পারিনা। আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধকে গর্ব করি। বাংলা ভাষা নিয়ে গর্বিত। শুধু তাই না, আমরা সবসময় আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে গর্বিত হতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিশ্বাস করতে পারিনি, রাজনৈতিক দলগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদেরকে এবং আমাদের স্বপ্ন আশাআকাংক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করেনি, সামরিক প্রতিষ্ঠান অযাচিতভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেছে এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে যার ফলাফল হয়েছে সাধারণ জনগণের সাথে দূরত্বের, দাম্ভিকতার এবং সৎ-সহোদরের সম্পর্কের, বিচার ব্যবস্থা এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আদর্শ অবস্থায় নেই। মূলধারার ছাত্র রাজনীতি যেখান থেকে দেশের নেতা এবং নেতৃত্ত্ব সৃষ্টি হবার কথা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ-সংস্কৃতি তার বর্তমান অবস্থা না বলাই ভাল আজ। লেজুড়ধারী কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, পেশাজীবি, ব্যবসায়ী … এই লিষ্ট শুধু লম্বা থেকে লম্বা হতে থাকবে। অবশ্যই সবক্ষেত্রেই ভাল এবং যোগ্য, এবং দেশের ভাল চায় এমন মানুষ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা সবথেকে বেশি অসহায়।

জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন, জুডিশিয়ারি, দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতো দূর্বল, অদক্ষ এবং প্রায়শই দলীয় করে রাখা হয় যে নির্বাচন নিয়ে দলগুলো একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস করে না। যে অনাস্থা এবং অবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। দু-তিনবার মোটামুটি গ্রহনযোগ্য ঠেকা কাজ চালানোর পর সেটারও অসারতা বেরিয়ে হয়ে পড়ে। এটাও ঠিক আমাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব কিনা সফলভাবে সেটা নিয়ে শুধু রাজনৈতিক দল না সাধারণ মানুষের মাঝেও অনেক সংশয় আছে। অবিশ্বাস আছে। এটা কি আমাদের সবার একটা বড় ব্যর্থতা না? নতুন প্রজন্মের আস্থার জায়গাগুলো তাই খুব সীমিত। দিনের পর দিন তা সংকুচিত হয়েছে, হচ্ছে এবং বড় কোন পরিবর্তন না আসলে হয়তো আরো সীমিত হবে।

অগ্রজদের বহুবার হতাশ করতে দেখেছি ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ বলে। এর গুঢ় অর্থ কি তা বোঝার মতো বোধগম্যতা কৈশোরে ছিল না। দেশের মানুষ সবসময় চাইতো যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক কিন্তু নিত্যদিনের সংগ্রাম সবাইকে এতো ক্লান্ত করে দেয় যে বিচারটার প্রতি সমর্থন থাকলেও সবাই একসাথে সরব হয় না। পর্যাপ্ত আগ্রহ থাকে না। তখন সরকারের শাসন ব্যবস্থার বিপর্যয় বিচারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ন হয়ে যায় বা বিচারটা অর্থহীন মনে হয়। মানুষ তখন যুদ্ধাপরাধ এবং বর্তমানের অপশাসন একই স্কেলে মাপে। চাল, ডাল, বিদ্যুৎ, সন্ত্রাস, ছিনতাই, নিরাপত্তাহীনতা, দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো যে মানুষ প্রতিদিন মুখোমুখি হয়। যুদ্ধাপরাধ যে অতীত। আর আমরা যে ইতিহাসবিমুখ সে তো আর নতুন কিছু না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও বার বার আপোষ করেছে। স্বার্থের কাছে নীতি বিসর্জনের শিক্ষা দিয়েছে। আমরা সেটাই মেনে নিয়েছি, নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে শিখেছি। আবার ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থের খামখেয়ালিপনায় জাতি হিসেবে আমরা আজ যেখানে দাড়িয়ে আমাদের মতামতের এবংa উপলদ্ধির বৈসাদৃশ্যও সাংঘাতিক প্রকট। হয়তো যেকারণে আমরা সাংঘাতিকভাবে বিভাজিত। তীব্রভাবে মেরুকৃত।

এতো হতাশার পর আশার কথা এই, শাহবাগ আবারো প্রমাণ করলো সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে যুদ্ধাপরাধের বিচারটা খুব গুরুত্বপূর্ন। এবং এখনো। প্রতিটি মানুষই ইতিহাসের নানা উপাদান নিয়ে নিজেকে গড়ে তোলে। নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের ইতিহাসের মুক্তিযুদ্ধ উপাদান ভীষণরকম প্রতিনিধিত্বশীল। এবং আত্মপরিচযের মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে অনেক কটাক্ষ শোনা যায়। আমাদের হাজার বছরের দেশজ সংস্কৃতি এবং ইতিবাচক অর্জনগুলো গর্ব করার মতো থাকলেও আমরা আত্মপরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হই জাতিগত এবং ধর্মীয় রাজনীতির চোরাবালিতে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের এই সংশয়কে পুঁজি করে স্বার্থ এবং ক্ষমতার রাজনীতিতে বরাবর প্রতিষ্ঠিত হয়ে এসেছে। এখন একটি গুরুত্বপূর্ন সময়কাল এই প্রশ্ন করার যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সাতচল্লিশের পর আমাদের কি দিয়েছে কিংবা আদেও কিছু দিতে পারে কিনা। সাতচল্লিশ পরবর্তী আড়াই দশক যথেষ্ঠ সময় আমরা অতিক্রম করে এসেছি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক মডেলের পরীক্ষণের জন্য। উত্তরও আমাদের জানা যে ধর্মভিত্তিক মডেল কাজ করে না, তা না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না।

বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মজার ব্যাপার আছে। আমরা প্রতি দুই-দশক প্রান্তে একবার করে প্রচন্ড বিক্ষোভে আমাদের অস্তিত্ত্বের স্বরুপ কি হবে তা নির্ধারণের জন্য যুগপদ আন্দোলন সংগ্রাম করি। হতে পারে দুই দশক একটি কাঁকতাল। বাহান্নতে ভাষা আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ে স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলন। দুইহাজার তেরোতে এসে যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিতে শাহবাগের প্রজন্ম আন্দোলন। প্রতিটি আন্দোলন ছিল গণমানুষের সংগ্রাম। জাতীয় রাজনীতির মৌলিক প্রশ্নের সংগ্রাম। প্রতিটি আন্দোলনের পুরোধা ছিল সেই সময়ের নতুন প্রজন্ম। আরো একটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ন, যারা সেই আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করতে না পেরে বিরোধিতা করেছে ইতিহাস তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। আন্দোলনের সুফল যে আমরা সবটুকু পাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তা নয়। কিন্তু আন্দোলনগুলো প্রতিবারই একটি করে মৌলিক অস্তিত্বের প্রশ্নে জাতির অবস্থান নির্নয় করে – ৫২তে ভাষা, ৭১এ স্বাধীনতা এবং স্বাধীন রাষ্ট্র, ৯০এ গনতন্ত্র, এবং ২০১৩ তে এসে যুদ্ধাপরাধের বিচার।

শাহবাগের প্রজন্ম আন্দোলন নিয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত। গর্বিত। এমন বৈপ্লবিক জাগরণ আশার অতীত ছিল এমন সময়ে। কিন্তু সত্যিই দেয়ালে পিঠ ঠেকা অবস্থায় চলে এসেছিলাম। সম্পূর্ন স্বতঃস্ফুর্তভাবে হাজার হাজার মানুষের গান, কবিতা, কোরাস, স্লোগান, প্লাকার্ড, ব্যানার, ব্লগিং, ফেসবুক এবং টুইটবার্তা – এই আবেগের মূল্য অপরিসীম। যদিও শাহবাগের স্লোগান প্রতিনিধিত্ব করছে ফাঁসির দাবি, তবে শাহবাগ স্ফুলিঙ্গ যে শুধু ফাঁসির দাবিতে সীমাবদ্ধ তা নিশ্চিতভাবেই না। এই আন্দোলন আরো অনেক কিছু। আরো গভীরে প্রথিত। শাহবাগ অতি অবশ্যই একটি শক্তিশালী সংকেত মেরুকৃত দলীয় ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে। ডাক এসেছে জামাত বয়কটের – যে দল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধীতা করেছে সেই দল ধর্ম এবং সততার মোড়কে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূখন্ডে সেই কলুষিত রাজনীতি করতে পারে কিনা সে প্রশ্ন গভীরভাবে আমাদের নিজেদের ভাবার সময় হয়েছে। জামাত তোমার সময় শেষ – বিয়াল্লিশ বছর অনেক বেশি সময় পেয়েছো। বয়কটের ডাক পড়েছে জামাত মালিকানার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। দেশের মানুষ জামাতের অরাজকতা এবং শঠতায় কান্ত, অসহায় এবং অসুস্থ বোধ করেছে দশকের পর দশক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রত্যাখান নাকি নিষিদ্ধ?

অন্য যে কোন আন্দোলনের মতো আমরা জানিনা এই আন্দোলনের ফসল কে কিভাবে ঘরে তুলবে। গণজাগরণ নিশ্চিতভাবেই নতুন আশার সঞ্চার করে। দেশের প্রতি ভালবাসা এবং মমত্ব বাড়ায়। স্বপ্ন দেখায়। একই সাথে আমাদের প্রত্যাশার লাগাম টেনে ধরাটাও জরুরী। কারণ সময়ের সাথে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হয়। এজেন্ডাগুলো মূল লক্ষ্য থেকে বিস্তৃত হতে থাকে। এই আন্দোলনে দুটি বিষয় মূখ্য – যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং জামাতের রাজনীতির ভবিষ্যত। আমরা কেউ জানি না শাহবাগ প্রজন্ম আন্দোলন কোথায় কতদূর আমাদের নিয়ে যাবে এবং ফলাফল আমরা কি পাবো। বাংলাদেশের রাজনীতি ইতিহাসে এবং নতুন প্রজন্মের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ পূর্নস্থাপিত হচ্ছে এবং হবে। রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়বে। কিন্তু মৌলিক গুনগত পরিবর্তন হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। শাহবাগ প্রজন্ম আন্দোলন যে এটা জানে না তা কিন্তু নয়। হয়তো শাহবাগ আন্দোলন দীর্ঘ সময় চলবে। কিন্তু রাজপথ আন্দোলন যখন স্তিমিত হবে তখন সামনে কি? নিশ্চিতভাবেই দেখতে চাইনা, রাজনীতির বাঁকে যুদ্ধাপরাধীরা রাষ্ট্রের পোর্টফোলিও নিয়ে জাতীয় পতাকাবাহী গাড়িতে করে আবারো সদর্পে দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করুক।

শাহবাগের আন্দোলন কোন দলীয় রাজনৈতিক আন্দোলন না নিশ্চিতভাবেই। এটা একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন এবং সেটা জনমানুষের। আমাদের মতো দেশের কোনদিন ভাল পরিবর্তন আসবে না যতক্ষন আমরা সচেতনভাবে রাজনৈতিক প্রকিয়ার অংশ না হই। এই অংশগ্রহণ ক্ষমতার রাজনীতির অংশ হওয়া না। শাহবাগ প্রজন্ম আন্দোলন আন্দোলন আর কিছু হোক বা না হোক নিশ্চিতভাবে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি বার্তা যে তোমার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে কোন ছাড় নেই। একটা কথা মানতেই হবে, শাহবাগের মতো করে সাম্প্রতিককালে যুদ্ধাপরাধের ইস্যুটি নিয়ে কেউ সব শ্রেনী-পেশার মানুষের মাঝে, সাধারণের মাঝে একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেনি। মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, ধনী, শিশু, প্রবীণ, মুক্তিযোদ্ধা, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এই আন্দোলনের অংশ হয়েছে। এমন সন্ধিক্ষন আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুব বেশি আসে না।

শাহবাগ চত্ত্বরের প্রজন্ম আন্দোলন কি মিশরের তাহরীর স্কয়ারের মতো শাহবাগ স্কয়ার হওয়া প্রয়োজন? আমাদের সত্যি কোন আরব বসন্তের দরকার নেই। আমরা নিশ্চয়ই চাই না কোন মুসলিম ব্রাদারহুড ধরনের সাম্প্রদায়িক দল আন্দোলনের সুফল নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসুক। আমরা তার চেয়ে শতগুন ভাল অবস্থায় আছি সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিবেচনায়। আমাদের আন্দোলনের স্বকীয়তা আমাদেরই থাক। অনেকের মাঝেই একটি ব্যাপার খেয়াল করেছি। বিশেষত অনলাইনে। তাহলো শাহবাগ আন্দোলন আর্ন্তজাতিক মিডিয়াতে ঠিকমতো কাভারেজ পাচ্ছে না সেটা নিয়ে চিন্তিত হতে। একটা ব্যাপার খেয়াল করা প্রয়োজন, শাহবাগ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নে জামাতের আর্ন্তজাতিক প্রপাগান্ডাকে প্রতিরোধ করে এগোতে হচ্ছে। অনেক অসত্য বিষয় জামাত-শিবির দিনের পর দিন প্রপাগান্ডার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে এসেছে। তারা বিভিন্ন মানবাধিকার এবং স্পর্শকাতর বিষয়গুলো মিডিয়ায় এবং আর্ন্তজাতিক মহলে সচতুরভাবে উপস্থাপন করে তাদের সহমর্মীতা আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু সবথেকে বড় কথা হলো, আমাদের সত্যি বড়মাপের আর্ন্তজাতিক মিডিয়ার আগ্রহের বস্তু হবার দরকার নেই। আমরা জানি, জাতি হিসেবে আমাদের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন কিভাবে তা মোকাবিলা করতে হয়। আমরা বাহান্ন, একাত্তর এবং নব্বইয়ে তা করেছি। কারো সাহায্য ছাড়াই। আমাদের আর কিছু থাকুক বা নাই থাকুক জাতি হিসেবে এই আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদাটুকু আছে।

অনেকেই এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যত নিয়ে শংকা করছেন। প্রত্যাশা যুদ্ধাপরাধ এবং জামাত রাজনীতি ছাপিয়ে গগণচুম্বী হয়েছে। সেটা পুরোপুরি অবাস্তব না আমাদের অতীত ফিরে দেখলে। আমরা যখন একটু আশার আলো কোথাও দেখতে পাই সেখানে সব সমস্যার সমাধান একবারে করে ফেলতে চাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি আমাদের প্রজন্মকে আরো বেশি সংশয়গ্রস্থ করে তুলবো এসময়ে? নাকি এই জনজাগরণে লড়াই করতে সাহস জোগাবো গঠনমূলকভাবে? সে প্রশ্নের উত্তর কঠিন না হলেও প্রত্যেকের সেটা ভাববার প্রয়োজন রয়েছে। এই আন্দোলন বিচার এবং আইনকে সঠিক বা ভুল প্রকিয়ায় পরিচালিত করার জন্য জনমত, চাপ বা প্রভাব তৈরির বিষয় নয়, শাহবাগ প্রজন্ম যা করছে তা হলো প্রথাগত রাজনীতিকে সতর্ক করে দিচ্ছে এবং নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করছে। স্পষ্টতঃ দেশের রাজনীতি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেক ফাঁকফোঁকড় রয়েছে। কিন্তু কোন দেশটাইবা আদর্শ অবস্থায় রয়েছে? প্রতিটি দেশের অবস্থাই সতন্ত্র। আশার কথা হলো আমরা এটা জানি, আমাদের ফাঁকফোঁকড় রয়েছে এবং সেটাই বলে আসছি যে এটার মেরামত প্রয়োজন। এবং এখনই সেই সময়।

শাহবাগ প্রজন্ম বড় রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি-রাজনীতি ক্ষমতার খেলার অবসান চায় যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে। এজন্যই শাহবাগের এই সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনের ভীষণভাবে দরকার ছিল। আমাদের দেশের বড় আন্দোলনগুলো নারী-পুরুষ, শ্রেনী-পেশা, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে সমগ্র দেশের সমর্থন পেয়ে থাকে। সেই সমর্থন এ আন্দোনে তরুণদের সাথে রয়েছে। বাংলাদেশের সমগ্র মানুষ এবং বাংলাদেশি ডায়াসপোরার সংহতি নিশ্চিতভাবে এই আন্দোলনের গুরুত্ব কতটা বেশি তা নির্নয় করে। তরুণদের সম্মিলিত আন্দোলনের অহিংস চরিত্র গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বড় উপাদান। কিন্তু এই আন্দোলন কিভাবে একটি ক্যাটালিষ্ট হিসেবে কাজ করবে? সরকারে সাথে? নাকি বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রশ্ন তুলে? নাকি শুধু জনমত গঠন করে? কিংবা সচেতনতা বাড়িয়ে? আমাদের জাতীয় জীবনে খুব কালেভদ্রে আশার সঞ্চার হয়, স্বপ্ন এবং আশা যে কোন জাতি এবং সমাজের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ন, হয়তো জাতীয় জীবনের সবথেকে বড় সবথেকে শক্তিশালী আশার আলো। স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পর যদি একত্রিত হয়ে প্রমাণ করি যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করা জাতীয় জীবনের সবথেকে বড় কাজ। তবে তাই হোক। শাহবাগ দিয়েই নতুন দিনের সূচনা হোক।

১০ টি মন্তব্য : “প্রজন্ম শাহবাগ পূর্বাপর”

  1. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    আমরা বড় হয়েছিলাম হানাদার বাহিনী শুনতে শুনতে। মনে আছে তুমি একটা জায়গায় আমাকে ঠিক করে দিয়েছিলে পাকিস্তানী শব্দটি দিয়ে। আমাদের তারুণ্য আর বাংলাদেশের গনতন্ত্রের যাত্রা একই সাথে শুরু হয়েছিলো।। অনেক সময় পেড়িয়ে গেছে। কি ফল হবে তা জানিনা, তবে মনে হয় এই "শাহবাগ" প্রজন্ম চত্বরের বড্ড বেশি দরকার ছিল। জামাতে ইসলামের রাজনীতি ধর্মের নামে ক্ষমতা দখল ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বিশ্বায়নের যুগে রাজনীতি আর ধর্ম যদি আলাদা হতে না পারলো তাহলে আর নিজেদের সভ্য বলে দাবী করা কেন? শব্দটা ঠিক ধর্ম না বলে এথনোসেন্ট্রইজম বললে বেশি উপযুক্ত হয়।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    রাব্বী,
    খুব গোছানো লেখা, যথারীতি পাঁচতারা। অনেক গতানুগতিক লেখার ভিড়ে চিন্তার খোরাক জোগানো একটা লেখা।

    শাহবাগের চলমান আন্দোলনের ফলাফল নিয়ে খুব ষ্পষ্ট ধারণা পেলাম না। এইখানে অবশ্য তুমি আরো অনেককেই পাবে, তারা এই আন্দোলনের ফলাফল নিয়ে খুব একটা সচেতন/আত্মবিশ্বাসী নয়। কিন্তু আমি খুবই আশাবাদী। আমার মতে, এই আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের ইতিহাসে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সার্বিকভাবে যুগান্তকারী ফল নিয়ে আসছে।

    ইসলামের রাজনীতিকরণের বয়ানে দ্বিমত আছে। মন্তব্য আকারে লিখতে গিয়ে দেখি ব্লগের থেকেও বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই, আলাদা ব্লগে জানাবো আমার ভাবনা।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      ফলাফল কি হবে তা বলা যাচ্ছে না। আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে গতিপ্রকৃতি পাল্টায়। তবে আন্দোলনের ফলাফল নির্নয়ের সময় এখনো আসেনি।

      আপনার ইসলামের রাজনীতিকরণ শব্দযুগলের সাথে আমারও দ্বিমত আছে - ৭১' পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে বিষয়টিকে দেখি রাষ্ট্র/রাজনীতির ইসলামীকরণ। ঠিক বিপরীত।

      ধন্যবাদ।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)
    শাহবাগ দিয়েই নতুন দিনের সূচনা হোক।

    আশাবাদ দিয়ে শেষ হয়েছে লেখাটা। আশা বাদ দিয়ে বসেছিলাম --- আশা করতেও ভয় করে আজকাল, তাই খালি সন্দেহ হয় -- সবকিছুতে কিন্তু কিন্তু করি।

    তবে আন্দোলনের একেবারে ভেতরে চলমান প্রক্রিয়া চিন্তাভাবনাগুলো না জানলে মুশকিল - শুধু অন্ধের মতো বসে থাকা।কোন একটা পথে যাচ্ছে কি না আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছেগুলো এটা (আভাসে হলেও) জানা প্রয়োজন। মেসেজ যা দেবার আমরা দিয়ে দিয়েছি -- এখন সেই মেসেজের ভাষা বুঝে রাজনৈতিক দলগুলো, মানুষ কি করছে কতটুকু করার আছে --- যা যা হবে কতদিনে হবে এগুলো জানা বোঝা জরুরী।

    রাজনীতিকরা বাইরে থাকলেও পুরো প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক। কাজেই পোড়খাওয়া ছেলেপেলেরাই শেষমেশ টিকে থাকবে - নেতৃত্বে তারাই চলে আসবে যাদের সততা, সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। সরকার বা কোন মধ্যবর্তী আলোচকের সংগে কি সাংগঠনিক আলোচনা চলছে/চলবে? আমার জানা নেই।

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      আমার মনে হয়, আশাবাদ একটা ভাল প্রত্যয়, সবকিছুর মাঝে সবচেয়ে ভাল। এবং কোন ভাল প্রত্যয়ের কখনো মৃত্যু হয় না।

      আন্দোলন অনেকগুলো মত, স্রোতধারা এবং বিশ্বাসকে একটি লক্ষ্যে একই প্ল্যাটফর্মে ধারণ করছে - দেখা যাক কি হয়।

      ধন্যবাদ।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
      • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
        আন্দোলন অনেকগুলো মত, স্রোতধারা এবং বিশ্বাসকে একটি লক্ষ্যে একই প্ল্যাটফর্মে ধারণ করছে

        লক্ষ্য পরিস্কার- 'রাজাকারের ফাঁসী চাই'। এখন যাদেরকে এই কাজটা করার দায়িত্ব জনগণ দিয়েছে, তাদেরকে বাধ্য করতে হবে সেই দায়িত্ব পালন করতে। আশা করি সেটা এখন সহজ হবে, কারণ সরকার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করেছে।


        There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

        জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।