কুড়ি বছর পর

এক.
দিনটার কথা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে পাবনা সার্কিট হাউসে পৌছলাম। লাঞ্চ সেরে, পোশাক পাল্টে সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট এবং কালো অক্সফোর্ড সু পরে রেডি হলাম কলেজে যাবার জন্য। একুশে মে, ১৯৯২ সাল। সাথে আব্বা এবং বড় ভাই। দুপুর দুইটার দিকে কলেজে পৌছলাম। পথে ক্যালিকো কটন মিলস পড়লো, আব্বা মোটামুটি সেটার নাতিদীর্ঘ ইতিহাস বললেন। পাবনা পৌছাবার পর থেকে পাবনা জেলার ইতিহাসও বলে যাচ্ছিলেন বড় ভাইকে। আমার মনে পড়লো, কলেজ থেকে সব চিঠিতে প্রেরক ঠিকানায় পোষ্ট অফিসের নাম ছিল ক্যালিকো কটন মিলস। আমরা যখন কলেজে যাই, তখনো সম্ভবত মিলটি চালু ছিল। ভোর বেলায় মিলের সাইরেন বেজে উঠতো।

একুশে মে ভরদুপুরে হাউসে নিয়ে যাওয়া হলো। ব্যাগের চেকিং সেরে নিয়ে যাওয়া হলো হাউস রিসেপশনে। ভাসানী হাউস। সব সিনিয়ররা টেবিলে টাই, নেমপ্লেট এবং হাউস ব্যাজ সাজিয়ে বসে আছে। যাবার সাথে সাথেই নামধাম জিজ্ঞেস করে টাই, নেমপ্লেট এবং হাউজ ব্যাজ পরিযে, কি পারফর্ম করতে পারি তা জানতে চাওয়া হলো। আমি আসলে কিছুই পারতাম না। কিন্তু এরকম পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য মায়ের কলিগ সায়রা খালা দিনরাত কসরত করে একটি কবিতা আবৃত্তি করা শেখালেন। বললাম, কবিতা আবৃত্তি করতে পারি। অগত্যা সেটাই শুরু করতে হলো। শুধু কবিতা দিয়ে সেযাত্রা উতরে যাওয়া গেলো না। সবাই জিজ্ঞেস করলো গান পারি কিনা। প্রথমে বললাম, পারি না। যখন বললো, গান গাইতে না পারলে ছাড়া হবে না। বললাম যে চেষ্টা করে দেখতে পারি। সম্ভবত ডিফেরেন্ট টাচের শ্রাবণের মেঘগুলি জড়ো হলো আকাশে … গেয়েছিলাম বেসুরো গলায়। মূর্হমুর্হ হাততালি পড়লো। সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম।

রুম নম্বর ১০২। সাথে আরো তিনজন রুমমেট। হাউসে আমরা ১৮ জন এবং তিন হাউস মিলে আমাদের ব্যাচে মোট ৫৫ জন। অভিভাবকরা সূর্যাস্তের সাথে সাথে চলে গেল। রাতে লাইটস অফের পর আমার রুমে এক কোনার বিছানা থেকে কান্নার আওয়াজ সাথে “আম্মু, আম্মু” … বাকিরা মিলে তাকে সান্তনা দিয়ে থামানো হলো। কলেজে অনেকেই লম্বা চুল নিয়ে এসেছিলাম। পরদিন নাপিতশালায় সেসব চুলের অন্তীমযাত্রা সাধিত হলো। কলেজে যাবার পরদিন আমাদের চুলের উপর বাবলু বাহিনী হামলে পড়লো। আমাদের কলেজের প্রধান নাপিতের নাম ছিল বাবলু। যার হাত থেকে রেহাই পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। বাবলু ভাই সাধারনত জুনিয়রদের চুল কাটতেন না, কাটতেন সিনিয়রদের। তার সাগরেদরাই জুনিয়রদের চুল কেটে হাত পাকাতো। চুল কাটার লাইনে একজন স্থান নিয়ে ঠেলাঠেলির একপর্যায়ে সেটি কিঞ্চিৎ ধাক্কাধাক্কিতে রুপ নিলে এক সিনিয়র যখন জনৈক বন্ধুকে বললো, “ওই মিয়া কলেজে আইসাই পাকনামি শুরু করছো?” বন্ধু তখন শুধু বিগলিত হেসে এটুকুই বলেছিল “ভাই, আর হবিনানে” … সিনিয়র প্রতিউত্তরে বললো, “হবিনানে টবিনানে, এখানে কিন্তু চলবিনানে”। সেই বন্ধু কি ঘুনাক্ষরেও জানতো সেদিন এই কথাটুকু পরের ছয়বছর তার জীবনে কাল হয়ে দাড়াবে প্রতি পদেপদে।

দুই.
ব্যাচে একটি শিশি ছিল। নাম শিশি হলেও আকার আকৃতিতে বেশ বড় ছিল। কলেজ জীবনে তার অনেক চড়াই-উতরাই ছিল। তার হাউসে সে এস্পিওনেজ জাতীয় কাজের জন্য সন্দেহের তালিকায় থাকতো সিনিয়র, জুনিয়র এবং ক্লাসমেটদের মধ্যে। একটু বড় হবার পর, ব্লেজার-স্যুট এসব শিশির প্রিয় পোশাক তালিকায় ছিল। তার এই স্যুট-টাইয়ের কারণে এক্সকারশনে গিয়ে ফৌজদারহাটের উপাধ্যক্ষ মনে করলো সে শিক্ষক। শিশিও উপাধ্যক্ষের সাথে নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে একসাথে চা খেয়ে এলো। পরে সেটা নিয়ে এক মজার কান্ড। শিশি এমনিতে রসিক মানুষ। শিশি ভালবাসতো ক্ষমতা এবং এ্র্যাটেনশন পেতে। ব্যাপার হচ্ছে, শিশি এখন বেসামরিকভাবে ক্ষমতা বলয়ের একদম একশো মিটার রেডিয়াসের ভিতরে থাকে। সেদিনের সেই শিশি আজ পরিপূর্ন একটি বোতল।

একজন এমপি/মন্ত্রীপুত্র ছিল। যার দাদা ছিল পচাত্তরের জেলহত্যার চার জাতীয় নেতার একজন। ক্যাডেট কলেজে একজন ক্যাডেটের ভেতরে যেসব গুনাগুন আশাকরা হয় যেমন নেতৃত্ব, খেলাধূলা এবং পড়ালেখায় ভাল হওয়া, সেসব দিক দিয়ে ছেলেটি ক্লাস সেভেনেই তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিল। ছেলেটি একসময় হটাৎই কলেজ থেকে চলে যায়। পরে তার সাথে আর খুব বেশি যোগাযোগ থাকেনি। উচ্চমাধ্যমিকের পর সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। তারপর সে রাজনীতির কদর্য দিকগুলোর দিকে জড়িয়ে যায়, যার পরিনতি ভাল হয়নি এমনটাই শুনেছিলাম।

একজন প্রধানতম রাজাকার এমপির পুত্রও ছিল। যার পিতার মন এবং হাত একাত্তরে অগনিত নিরপরাধ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত। আর্ন্তজাতিক মানবতাবিরোধী ট্রাইবুনালে সেই রাজাকারের অপরাধের বিচার হচ্ছে। উইকি অনুসারে, ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১এ বুদ্ধিজীবি হত্যার পিছনে মূল ভূমিকা পালন রাখে। অবশ্য পুত্র কলেজে থাকতে দাবি করতো, তার পিতা একাত্তরে ভারত চলে গিয়েছিল! কলেজ থেকে বের হয়ে রেটিনাতে কোচিং করে রাজাকার পুত্র তার চাঁদতারার দেশ থেকে পড়ালেখার পর্ব চুকে এসে দেশের একটি বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সময় প্রতিকূলে তাই এখন শিক্ষাকালীন ছুটিতে পশ্চিমের একটি দেশে। হায় সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ।

একজন উচ্চ-পদস্থ সামরিক আমলার পুত্র ছিল। কলেজে ক্লাস সেভেনে যখন সবার সিনিয়রদের এবং পারিপার্শিক নিয়মকানুনের চাপে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তখন তাকে দেখে মনে হতো সে বেশ একটা রুপকথার জগতে বাস করতো। সিনিয়ররা, শিক্ষকরা অনেকেই তাকে তোয়াজ করে চলতো। তারপর একদিন তার পিতার বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হলে খেয়াল করলাম একটি নক্ষত্র যেন ভূপাতিত হলো। সেও একদিন সাধারণের দলে ভিড়ে গেলো।

একজন বেসামরিক উচ্চ-পদস্থ আমলার পুত্রও ছিল। সে অবশ্য নিজেকে অতো গুরুত্বপূর্ন মনে করতো না। সাধারণদের মতোই ছিল। কলেজ জীবন সম্পূর্ন শেষ না করলেও সে সেই ১৯৯২ সাল থেকে সবার সাথে যোগাযোগটা একদম অটুট রেখে চলেছে। এখন অবস্থা এমন যে আমাদের ব্যাচের যেকোন কাজের জন্য যোগাযোগের মূল ফোকাল পয়েন্ট সে।

হাতে গোনা দু’চারজন্ বাদ দিলে আমাদের ব্যাচটি মূলতঃ মধ্যবিত্ত এবং নিন্ম মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবি বা ব্যবসা পেশার পরিবারের ছেলেরাই প্রতিনিধিত্ব করতো। কয়েকজন গ্রামের কৃষি পরিবারের ছেলেও ছিল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে, তারা প্রত্যেকেই প্রতিভাবান ছিল। পাবনা শহরের বেশ ক’জন ছিল আমাদের ব্যাচে। তাদের পাবনা নিয়ে উচ্চকিত অহংবোধ ছিল। আমাদেরকে নানাভাবে প্রমাণ দেবার চেষ্টা ছিল যে পাবনা মহাবিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ আধুনিক নগরী। পাবনার মেয়েরা পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। ইত্যাদি, ইত্যাদি। তবে এটা ঠিক পাবনা মিষ্টি অদ্বিতীয়। প্যারাডাইস এবং লক্ষ্মী সুইটসের রাজভোগ কিংবা কাটারিভোগ মিষ্টির সাথে তুলনা খুব কম চলে।

আমাদের ব্যাচে একজন চাচা চৌধুরী ছিল। যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়ে চাচার অগাধ পান্ডিত্য ছিল। চাচা চৌধুরী আমাদের মতো আবাল-বালেগদের বয়োঃসন্ধিকালের পরিবর্তন সম্মন্ধে সম্যক ধারণা না থাকায় মাঝে মাঝে প্রেপ-টাইমে বিনামূল্যে প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞান বিতরণ করে দুই জাহানের অশেষ নেকি হাসিল করতেন। সেই বয়সেই চাচা ছেলেমেয়ের অবাধ এবং উদার মেলামেশায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং সবাইকে সেসবে উৎসাহিত করতেন। চাচা এরশাদ’দাদু থেকে কোনঅংশে কম ছিলেন না। এমন কথা চালূ ছিল যে চাচার কলেজ জীবন নাকি শুরুই হয়েছিল ত্রিশ বছর বয়সে। চাচাকে দুষ্টু সহপাঠীরা উপহাস করে বলতো, ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা …

তিন.
ব্যাচে বাঘা প্রথম কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়। ভাল ছবি আঁকতো বাঘা। ছবি-আঁকা নিয়ে নিমগ্ন থাকতো এবং ছবিতে তার প্রিয় বিষয় ছিল নগ্ন নারী অবয়ব। দুপুরবেলা বিশ্রামের সময় আমরা বাঘার রুমে ঢু মারতাম সেসব পেন্সিল স্কেচ কিংবা জলরঙ ছবি দেখতে। বাঘার কলেজের বাইরে চারপাশের গ্রামের নেটওয়ার্ক ছিল দুর্দান্ত। এত দ্রুতগতি সম্পন্ন নেটওয়ার্ক আমাদের ব্যাচের কারো ছিল না। সিগারেটের স্টক শেষ হলে বাঘার শরনাপন্ন হলে সে “এবারই শেষ” বলে যোগাড়যন্ত্র করে ফেলতো দ্রুততার সাথে। বাঘা হাউসে ১৮ জনের মধ্যে খুব সতন্ত্র জীবনযাপন করতো। সে দেয়াল ভেদ করা আমাদের কারো পক্ষে সম্ভব হতো না। বাঘা ইসলাম শিক্ষা টার্মএন্ড পরীক্ষায় সম্ভবত ফেল করলো একবার। তারপর সে ঠিক করে স্টাফ লাউঞ্জে ঢুকে খাতার নম্বর পরিবর্তন করবে। পরিকল্পনা মোতাবেক সে লাউঞ্জের চাবির একটা ডুপলিকেট ম্যানেজ করে ফেলে। পরিকল্পনা মোতাবেক অভিজানে নামলে গার্ডের কাছে ধরা পড়ে। তখন মনে হয়েছিল না-জানি কতবড় অপরাধ করেছে! এতদিন পর মনে হয়, সে বয়সে মানুষ না বুঝে কতকিছু করতেই পারে। এগুলো খুব সামান্য ব্যাপার। কতৃপক্ষ বহিষ্কার না করে সংশোধনী উদ্যোগ নিলেই পারতো। যাইহোক, বাঘাকে কেউ রুখতে পারেনি। বাঘা ক্যাডেট কলেজকে মধ্যমা দেখিয়ে বহাল তবিয়তে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চাকরি করছে।

আমাদের ব্যাচ থেকে পরে আরো কয়েকজন বহিষ্কার হয়। যারা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়, তারা সবাই যার যার জায়গায় ঠিক আছে। তারমধ্যে দুজন সামরিক চাকরিতে যায়। এর ভেতর একজন বেশ ভাল করে পরবর্তীতে। বাকিরা ডাক্তার, ব্যাংকার এবং অন্যান্য পেশায় ঠিকই আছে। শুধু একজন আপাত দৃষ্টিতে অসফল। সে সাধারণ কলেজ থেকে উচ্চতর পড়াশুনা শেষ করে একটি স্কুলের শিক্ষক। কিছুদিন হোমিওপ্যাথির চিকিৎসার উপর শিক্ষা নিয়ে সেটাও চালিয়েছিল। আমরা অনেকদিন বলাবলি করতাম যে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও খামখেয়ালিপনায় ছেলেটা ভবিষ্যত নষ্ট করলো। কিন্তু যদি অন্যভাবে দেখি একমাত্র এই ছেলেটি যা করছে তাতে সাধারণ মানুষের কিছু উপকার হচ্ছে এবং মানুষের কাছাকাছি আছে। বাদবাকি আমরা সবাই মোটামুটি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। অনেক বেশি আত্মপর। শিকড় থেকে দূরে। এবং এভাবেই থাকতে ভালবাসি। দেশে থাকলে আমি হয়তো স্থায়ীভাবে ঢাকার বাইরে থাকতাম না এটুকু কল্পনা করতে খুব একটা অসুবিধা হয় না।

চার.
আমাদের ব্যাচের বেশ কয়েকজনের লেখালেখিতে দারুণ হাত ছিল। তাদের লেখা আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তামও। কিন্তু খুব দুঃখজনকভাবে, তারা লেখালেখি থেকে সবাই এমন বিপরীতমেরুর পেশায় এবং জীবনযাপনে অভ্যস্ত এখন, আর কোনদিন লেখালেখিতে ফিরবে বলে সন্দেহ হয়। তাদের একজন ছিল যাকে আমার সবসময় মনে হতো যে সে সাহিত্যিক হলে চমৎকার হতে পারতো। তার পরীক্ষার খাতার বাংলা বা ইংরেজি রচনা আমি আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। কারণ সে মুখস্থ লিখতো না, লিখতো মন থেকে এবং তাৎক্ষনিক কল্পনা থেকে। সেই রচনায় সে এমন এক গল্প লিখে ফেলতো যে আমি তা মুগ্ধ হয়ে সেই গল্পের শব্দের যাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম। তার তীক্ষ কল্পনাশক্তি এবং দুর্দান্ত সব শব্দের ব্যবহার তার কবিতা এবং গল্পগুলোকে অসাধারণ করে তুলতো। সেই বন্ধু তার মেধাটি চরমভাবে অপাত্রে অপচয় করে যাচ্ছে।

কলেজ থেকে বের হবার পর ব্যাচের একজন দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুন্য প্রদর্শন করে বাঙালি জীবনে যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন তার সবকটিতে প্রথম সে হয়েছে। ব্যাচের প্রথম বিয়ে তার যখন আমাদের কারো আন্ডারগ্রাডে হয়তো দ্বিতীয় বর্ষও শেষ হয়নি। সেই সূত্রে তার প্রথম ভিনদেশী স্ত্রী। ব্যাচের প্রথম পিতৃত্বের অভিজ্ঞতাও তার। প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের মুখোমুখি তার হতে হয়। ক্রমানুসারে ব্যাচের প্রথম দ্বিতীয়-বিয়ের জয়মাল্যও তার গলে। এমনকি তার দ্বিতীয় বিয়েতে যারা উপস্থিত হতে পারেনি তাদের তেমন আফসোস ছিল না, কারণ তাদের আশা এর পরের বিয়েতে তারা উপস্থিত হবার সুযোগ পাবে। আমরা হলফ করে বলতে পারিনা, তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়ের কৃতিত্ত্বের দাবিদার সে হবে না। এসব ঘটনার পর একদিন সে নির্বিকারভাবে এক গেটটুগেদারে বললো, তার ধারণা ব্যাচের প্রথম মৃত্যুর অভিজ্ঞতাও হিসেব মতো তার হবার কথা।

পাঁচ.
কলেজে প্রথম সিগারেট খেয়েছিলাম ক্লাস এইটের শেষ দিকে নিছক কৌতুহলবশত। কারপেন্টার ১০৭ নম্বর রুমের দরজার কড়ায় তার শার্ট ঝুলিয়ে কোথায় যেন কাজ করছিল। আমাদের কেউ তার শার্টের বুক পকেট থেকে বিড়ি এবং লাইটার হাপিস করে দিয়েছিল। পরে সেটা প্রথম দফায় আমাদের রুমে রাতে লাইটস অফের পর একদল টানলো। আরেক দল চিলেকোঠায় টানতে গেল পরের বৃহস্পতিবার। এবং যথারীতি ধরা পড়লো সিরাজী হাউসের প্রিফেকটদের কাছে। উপর্যুপরি উত্তম-মধ্যম, স্টেটমেন্ট লেখা সব মিলে দ্বিতীয় দলকে সামান্য দুই টাকার বিড়ির যে উচ্চ মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছিল, তাতে সেদিন থেকে অন্তত দুজন সারাজীবনের মতো বিড়ি-সিগেরেট থেকে ১০০ হাত দূরে থাকুন সাইনবোর্ড গর্বের সাথে বুকে ঝুলিয়ে এখনো ঘোরে। ভাগ্যিস দ্বিতীয় দলে ছিলাম না! তবে এরপর সেদিনের ঘটনা আর বেশি দূর এগোয়নি।

এক্সকারশনে আমরা গিয়েছিলাম কক্সবাজার। ছিলাম যুবপান্থ নিবাসে। সেখানেই জীবনের প্রথম মদ্যপানের অভিজ্ঞতা হয়। বার্মিজ হুইক্সি। এক বোতল হুইক্সি অনেকে মিলে শেয়ার করেছিলাম। মূল পরিকল্পনায় ছিল দু’তিনজন। পরে যখন মদ কেনা হলো তখন বেশ কিছু ভূঁইফোড় ভাগ বসালো। যুবপান্থ নিবাসে সেসময় দুটি সুইডিস মেয়ে ছিল। আমাদের মাঝে যে সবচেয়ে বেশি ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিল সে মেয়ে দুটির সাথে বেশ খাতির পাতালো। সে এক সাংঘাতিক উত্তেজনাকর অবস্থা। অন্যরা ইংরেজী পারদর্শীর প্রতিভার প্রতি ব্যাপক হিংসুক হয়ে পড়লো। কয়েকজন তো সেই হিংসা উত্তেজনার বশে মদ খেতে চলে এলো। কারণ সবাইকেই কিছু একটা করতে হবে! রাত আটটার দিকে সব উত্তেজনায় পানি ঢেলে মেয়ে দুটি দরজা লাগিয়ে ঘুম।

ছয়.
আমার সাবেক রুমমেটদের মাঝে সবচেয়ে দীর্ঘসময় যে রুমমেট ছিল। সে ভালবাসতো তার মফস্বল শহরের একটি মেয়েকে। মেয়েটির চিঠি এসেছিল কয়েকবার। যথাযোগ্য গোপনীয়তায় সে এক মহা উত্তেজনার সময় আমাদের রুমে। চিঠিগুলো খুব নিরুত্তাপ ছিল যদিও। বন্ধু মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়তো কোন আশা নেই ভেবে। কিংবা যখন দীর্ঘ বিরতিতে কোন চিঠি আসতো না। তারপর এসএসসির ছুটিতে মেয়েটির সাথে বন্ধুর প্রেম হলো। একটি পারিবারিক কারণে ক্লাস টুয়েলভে আচমকা সম্পর্কটি শেষ হয়। বন্ধু বেশ বিপর্যস্ত ছিল। মেয়েটি হটাৎই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এইচএসসির পর মেয়েটি ঢাকায় কোচিং করতে আসে না। বন্ধু এবং আমি মেয়েটির শহরে মেয়েটিকে খুঁজতে যাই। সম্ভাব্য সব কোচিং এবং ঠিকানায় ব্যর্থ হয়ে আমরা ঢাকা ফিরে আসি। এর বছরখানেক পর একদিন মেয়েটি মেয়েটি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তখন বন্ধুর চট্টগ্রামের প্রাক-চাকরি শিক্ষা একাডেমিতে গিয়ে হাজির হয় একদিন। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সম্পর্কটি পূর্নস্থাপিত হয়। এখন রুমমেটের টলটলে স্থিত জীবনের বিপরীতে সেসময়ের তার অস্থিরতা এবং মানুষিক অবস্থায় মনে হয় এই তো সেদিনও সব কত অনিশ্চিত ছিল।

আরেকজনের কথা। কলেজের অন্যতম একজন বন্ধু। যার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপূর্নতা আমাকে বেশ আকর্ষন করতো। তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল প্রখর এবং স্পষ্ট। তার সাথে বন্ধুত্বটা এখনো উষ্ণ। কলেজ থেকে বের হবার পর আমি তখনো ক্যাডেট কলেজ নিয়ে হৈ-হৈ করি। এই বন্ধু এক অলস সন্ধায় হটাৎই যেন চোখ খুলে দিলো – ক্যাডেট কলেজকে আমরা যতো বড় মনে করি জায়গাটি খুব ছোট। এবং এটা একটা মানুষিকতা। এখন সবাই যেহেতু বৃহত্তর পরিসরে তাই ক্যাডেট কলেজ মানুষিকতা থেকে বের হতে না পারলে দৃষ্টিভঙ্গি খুব বড় হবে না, সীমিত থেকে যাবে। সেদিনই বুঝলাম এই অদৃশ্য ৪০ একর সীমানার বাইরে নিজেকে বের করতে হবে। এই বন্ধুর সাথে কতদিন মনস্তত্ত্ব, গল্প-উপন্যাস, সিনেমা, ধর্ম, বিজ্ঞান, গবেষণা, ছাইভষ্ম কতকিছু নিয়ে দিনের পর দিন কথা বলেছি। বন্ধু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চ্যালেঞ্জ করতো দেখে মন থেকে অনেক ভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি কিংবা সেগুলো নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে শিখেছি।

সাত.
আমি অনেকদিন ভেবেছি কলেজের বন্ধুত্ব আসলে অকৃত্তিম কিনা। বহুদিন ভেবেও কোন কূলকিনারা পাইনি। উত্তর কখনো মনে হয়েছে হ্যাঁ, আবার কখনো না। তবে সে সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ন ছিল। কারণ বয়সন্ধি একটি বড় পরিবর্তনের সময়, তার প্রভাব জীবনে অপরিসীম। কলেজে ছয় বছর থাকার কারণে কিনা জানিনা, আমার পরিবারের অন্যদের সাথে কোথায় যেন একটি সুতা-কাঁটা অনুভূতি হয়। হতে পারে কলেজের রেজিমেন্টেশন সেটির একটি কারণ, আবার হয়তো এটা শুধু আমিই নিছক মনে করি। শুধু তাই না, কুড়ি বছর পর মনে হয় প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা আসলে খুব ছোট হয়। পঞ্চাশ বা পঞ্চান্নজন কারো বন্ধু হয় না। এটা ঠিক রেজিমেন্টেশনের কারনে যে যোগসূত্র থাকে তা অনেক শক্ত হয়। কিন্তু তার অর্থ অব্যর্থ বন্ধুত্ব কিনা তা বলা যাবে না। তবে সেই সময়টা নিয়ে সাংঘাতিক ইল্যুউশন কাজ করে। আমি নিজেই উপলব্ধি করি একসময় যাদের সাথে তিনবেলা খাওয়া, ওঠা-বসা, দুষ্টুমি এবং বড় হবার পাঠ নিয়েছি তাদের অনেকের থেকেই মানুষিকভাবে আমি যোজন যোজন দূরে আজ। অন্য অনেকেও তাই। তবে কোথায় একটি লেভেলে বেশিরভাগের সাথেই একটি সংযোগও কাজ করে। সময় সবাইকে হয়তো পাল্টে দেয়। কুড়ি বছর পর হয়তো এসবে আর কিছুই এসে যায় না। আবার মনে হয়, এখনও সবকিছু এসে যায়। কোনকিছুই অনর্থক ছিল না।

৫,৭৬০ বার দেখা হয়েছে

৭২ টি মন্তব্য : “কুড়ি বছর পর”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এরকম বিশ্লেষন করা স্মৃতিচারন আগে পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। দারুন হয়েছে :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    পড়লাম এবং বুঝলাম মাঝখানে ডুব দেয়ার পর লাভবী ভাই আবার আগের ফর্মে সিসিবিতে প্রত্যাবর্তণ করেছে। স্মৃতিচারণের এমন ব্যতিক্রমী ভঙ্গী সিসিবি আগে পড়িনি নিশ্চিত ভাবেই।

    এইতো পরশুদিনও আপনাকে ইয়াদ করতেসিলাম, অনেক দিন আপনার দেখা পাইনা দেখে।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
    • জিহাদ (৯৯-০৫)

      একটা প্রশ্ন: স্যুট টাই এর কথা লিখেছেন সেটা কি আপনারা ইলেভেনেই পেয়ে যেতেন? আমাদের সময় টুয়েলভে ফেয়ারওয়েলের আগে দেয়া হতো সবাইকে।


      সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

      জবাব দিন
      • রাব্বী (৯২-৯৮)

        পড়লাম এবং বুঝলাম জিহাদ আমারে মনে করছিলো 🙂

        নিজের স্যুট-টাই এক্সকারশনে নিয়ে গেছিল। এক্সকারশনে কিছু ব্যক্তিগত কাপড় নেবার অনুমতি ছিলো। আমাদেরও কলেজ ব্লেজার দিতো টুয়েলভে ফেয়ারওয়েলের আগে। তবে আমরা এডজুটেন্টের কারণে সম্ভবত টুয়েলভে থাকতে শীতে ব্লেজার পরেছিলাম।


        আমার বন্ধুয়া বিহনে

        জবাব দিন
  3. আমিন (১৯৯৬-২০০২)
    পাবনার মেয়েরা পৃথিবীর সেরা সুন্দরী।

    এইটুকুর লাইগাই পাঁচ তারা 🙂

    শেষের প্যারাটার অনুভূতিগুলো পুরাই মিলে গেল।

    আমি নিজেই উপলব্ধি করি একসময় যাদের সাথে তিনবেলা খাওয়া, ওঠা-বসা, দুষ্টুমি এবং বড় হবার পাঠ নিয়েছি তাদের অনেকের থেকেই মানুষিকভাবে আমি যোজন যোজন দূরে আজ। অন্য অনেকেও তাই। তবে কোথায় একটি লেভেলে বেশিরভাগের সাথেই একটি সংযোগও কাজ করে। সময় সবাইকে হয়তো পাল্টে দেয়। কুড়ি বছর পর হয়তো এসবে আর কিছুই এসে যায় না। আবার মনে হয়, এখনও সবকিছু এসে যায়। কোনকিছুই অনর্থক ছিল না।

    বড় কইরা ঐ। (খালি কুড়ির জায়গায় ষোল হইবো)

    আপনের লেখা পইড়া উদাস হয়ে গেছি। এমন লিখতে পারলে জীবনটা স্বার্থক হইতো (সার্থক ভানাম ভুল হইছে মনে হয়)।

    সিসিবিতে আমার পড়া সেরা স্মৃতিচারণ ।

    ভালো থাইকেন রাব্বী ভাই।

    জবাব দিন
  4. শরিফ (০৩-০৯)

    ভাই আপনার এই সৃতি চারণ পড়ে আমি আমার কলেজের সেই দিনগুলোতে আবার ফিরে যাচ্ছিলাম । আমি সিরাজী হাউসের ভাই । ক্যাফটেরিয়ার পিছনে সেই সেলুন , চুল কাটানোর জন্য লাইন দিয়ে দাড়িয়ে থাকা জুনিয়র থাকাকালীন, চুল কাটানো শেষ মানে বিশ্বযুদ্ধ জয় করা সব সৃতি মনে পড়ছিল । যা হোক কেমন আছেন ? গত APEC এর রিউনিওনে আসছিলেন ?

    লেখা অসাধারণ :hatsoff: :thumbup:

    জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    মন্ত্রীপুত্র, রাজাকার পুত্র, কোটালপুত্র, এক্স এম্পি, কারেন্ট এম্পি, ওরে বাপ্স, তোমাদের দেখি রমরমা অবস্থা ছিল।

    আমরা তো তো সেই তুলনায় মনে হয় অনেক সাদাসিদাই ছিলাম। সাদাসিদার সুবিধা অনেক, কম্পলিসিটি নাই তেমন। সবাই পাংগা খাই, স্টাফ কাউরেই পাত্তা দেয় না


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  6. হায়দার (৯২-৯৮)

    Happy birthday to us, দোস্ত।
    তোর লেখা পড়ে মনে পড়ল, গতকালকে ২১শে মে ছিল।
    লেখা পড়ে যতটা না ভাল লেগেছে, তারচেয়ে বেশী খারাপ লেগেছে।
    নিজেদের ব্যাচের অনেক কিছু মনে পড়ে গেল।

    জবাব দিন
  7. সামিয়া (৯৯-০৫)

    পড়লাম এবং বুঝলাম মাঝখানে ডুব দেয়ার পর লাভবী ভাই আবার আগের ফর্মে সিসিবিতে প্রত্যাবর্তণ করেছে। স্মৃতিচারণের এমন ব্যতিক্রমী ভঙ্গী সিসিবি আগে পড়িনি নিশ্চিত ভাবেই।

    নাজমুল হয়ে গেছি 🙁

    জবাব দিন
  8. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    তোমার লেখা পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি। আজকাল কম লিখছো। ব্যস্ত বুঝি খুব?
    এ লেখা পড়ে নিজের সময়ের কথা মনে পড়ে গেলো --
    আমাদর সময়ে হেড নাপিত ছিলেন সুনীল দা। সিনিয়র জুনিয়র তোয়াক্কা করতেন না বলে বরাবর ক্লাস সেভেন এইটের ভাগ্যে উনিই বরাদ্দ ছিলেন। একটু ঘাড় নাড়লেই একেকটা শক্ত রদ্দা পড়তো ধাঁই করে, আর চিবিয়ে চিবিয়ে ''এন্নে না এন্নে'' বলতে বলতে ঘাড়টাকে টেনে পজিশনে নিয়ে যেতেন।সেখান থেকে উদ্ধার পাবার পর আধাছোলা মাথা নিয়ে তেমন একটা চিন্তা থাকতোনা, ঘাড়টা যে মটকে যায়নি এই আনন্দেই হাউসের দিকে দৌড় -- বাথরুম বুক করতে হবে না গোসল করার জন্য! আহ্‌, সেসব দিন আজ গত।
    ফৌজদারহাটেও মন্ত্রীপুত্র কোটালপুত্রের সমাগম কম ছিলোনা। বেশির ভাগেরই স্বাস্থ্য ছিলো গায়গতরে বেশি, মার্কশীটে কম।তাদের ঘিরে প্রশাসনের একটা সদা তেলতেলে ভাব। রাজ্যের ডিসিপ্লিন শুধু আমক্যাডেটদের জন্য। তবে এখন বুঝি, আমক্যাডেট হয়েই বেশ হয়েছে, তা নয়তো আমড়াকাঠের ঢেঁকি হতে হতো।

    আমরা গিয়েছিলাম ১৮ই মে। কলেজে তখন শুধুমাত্র এইচএসসি ক্যান্ডিডেটরা ছিলেন। মহা এক গন্ডগোল লেগে কলেজ তখন ছুটি -- তখন যিনি প্রিন্সিপাল ছিলেন তাঁর অলরেডি অবসরের নির্দেশ চলে এসেছে। শুনছিলাম তাঁর দুর্নীতির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে ক্যান্ডিডেটদের একাংশ পালিয়ে ঢাকা হেডকোয়ার্টারে রওয়ানা দিয়েছিলো, সেই ব্যাচের প্রায় ১৫-১৬ জন আউটও হয়ে গেছে। ওই অবস্থায় আমাদের সেখানে পৌঁছানো। কি মজা। ক্লাস ১২ আলাদা ডাইনিং এ যায়, আমরা আলাদা। দিনরাত খালি হৈচৈ আর আড্ডাবাজি, মাঝেমধ্যে ১২-এর ভাইরা এসে রিকোয়েস্ট করতো, 'আস্তে, আমাদের পরীক্ষা'।
    সেসব দিন টিকে ছিলো ১৪ দিন। তারপর ভ্যাকেশন শেষে ফিরে এলাম রেগুলার ক্যাডেট কলেজে। ওই দু'সপ্তাহের মজা কড়ায় গন্ডায় শোধ দিতে হয়েছিলো ক্লাস এইটকে।

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      ব্যস্ততা বেড়েছে। সময় পাই না, তাই লেখাও কম। আপনার কলেজের স্মৃতিকথা পড়ে ভাল লাগলো। কেমন লাগে চিন্তা করলে আগে ওরকম একটা জীবন কাটাতাম। স্যারদের কাছে সবসময় গল্প শুনতাম যে ফৌজদারহাটের ছেলেরা কত বর্নাঢ্য পরিবারের আর আমরা সে তুলনায় কত ফকিন্নি পরিবারের। যাইহোক, আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
      • নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

        আর বলোনা, ব্যস্ততার জীবন একটুও ভাল্লাগেনা। একটু আয়েশ করে যে ব্লগ লিখবো সে উপায় নেই।
        স্যারদের ছিলো এই এক চাপাবাজি -- যেখান থেকে বদলি হয়ে আসতেন সেখানকার ক্যাডেটদের গুণগান করেই যেতেন ক্লান্তিহীন।আমরা ভাবতাম মির্জাপুর, ঝিনাইদহের পোলাগুলা কি মানুষ না অন্যকিছু। বাস্কেটবলে একটা থ্রো-ও নাকি মিস হয়না।

        আমাদের সময়ে ফেয়ারওয়েল ডিনারের পর একটা ট্র‍্যাডিশন ছিলো বিদায়ী স্যারকে ক্লাস টুয়েলভ বেশ চ্যাংদোলা মতন করে ধরে 'হি ওয়াজ এ জলি গুড ফেলো... হি ওয়াজ এ জলি গুড..." গাইতে গাইতে ওপর দিকে ছুঁড়ে ফেলে ফের লুফে নেয়া। (আমরা তখন এইট কি নাইন এ)। জনৈক স্যারের ক্লাস ১২ এ শত্রুসংখ্যা যথেষ্ট থাকায় বেশ ভুগতে হয়েছিলো বিদায়ের সময় কে বা কারা আকাশে ছুঁড়ে দেবার আগ মুহুর্তে জায়গামতন চেপে ধরলে বেচারা চেঁচিয়ে উঠেছিলেন,'' এ্যাঁই এ্যাঁই করস কি, *চি ছারি দে, *চি ছারি দে''। অথচ এই স্যারই দেখো অন্য কলেজে গিয়ে বলেছেন, তোমরা তো এফসিসির ক্যাডেটদের নখেরো যোগ্য না, ওরা কোনদিন আমার সাথে বেয়াদবি করেনাই। 😀 ।

        জবাব দিন
    • অরূপ (৮১-৮৭)

      হা হা হা ... কি মনে করায় দিলা নুপুর। কি দিন গেছে ...
      (যদিও তুমি লিখছো ২০১২ তে )
      আজকে পড়তে গিয়েও মনে হোল, এই তো সেদিনের কথা।
      কিছু ঘটনা কখনো পুরানো হয় না। (সম্পাদিত)


      নিজে কানা পথ চেনে না
      পরকে ডাকে বার বার

      জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      "বেশির ভাগেরই স্বাস্থ্য ছিলো গায়গতরে বেশি, মার্কশীটে কম" - 😀
      "তবে এখন বুঝি, আমক্যাডেট হয়েই বেশ হয়েছে, তা নয়তো আমড়াকাঠের ঢেঁকি হতে হতো" - :thumbup: আমের মূল্যই আলাদা!

      জবাব দিন
  9. রায়েদ (২০০২-২০০৮)

    উপরের সবগুলা কমেন্ট জোড়া লাগিয়ে যদি মনের ভাব ব্যক্ত করা যায়, এছাড়া মনে হচ্ছে সম্ভব না।

    কমেন্ট পড়ে পড়ে ভাবছিলাম কোনটাকে কপি পেস্ট করব।

    নাহ নাজমুল হওয়া আসলেই কঠিন।

    জবাব দিন
  10. নাজমুল
    শুধু একজন আপাত দৃষ্টিতে অসফল। সে সাধারণ কলেজ থেকে উচ্চতর পড়াশুনা শেষ করে একটি স্কুলের শিক্ষক। কিছুদিন হোমিওপ্যাথির চিকিৎসার উপর শিক্ষা নিয়ে সেটাও চালিয়েছিল। আমরা অনেকদিন বলাবলি করতাম যে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও খামখেয়ালিপনায় ছেলেটা ভবিষ্যত নষ্ট করলো। কিন্তু যদি অন্যভাবে দেখি একমাত্র এই ছেলেটি যা করছে তাতে সাধারণ মানুষের কিছু উপকার হচ্ছে এবং মানুষের কাছাকাছি আছে। বাদবাকি আমরা সবাই মোটামুটি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। অনেক বেশি আত্মপর। শিকড় থেকে দূরে। এবং এভাবেই থাকতে ভালবাসি। দেশে থাকলে আমি হয়তো স্থায়ীভাবে ঢাকার বাইরে থাকতাম না এটুকু কল্পনা করতে খুব একটা অসুবিধা হয় না।

    :thumbup: :thumbup: :thumbup:

    জবাব দিন
  11. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "ব্লেজার-স্যুট এসব শিশির প্রিয় পোশাক তালিকায় ছিল। তার এই স্যুট-টাইয়ের কারণে এক্সকারশনে গিয়ে ফৌজদারহাটের উপাধ্যক্ষ মনে করলো সে শিক্ষক। শিশিও উপাধ্যক্ষের সাথে নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে একসাথে চা খেয়ে এলো। পরে সেটা নিয়ে এক মজার কান্ড। শিশি এমনিতে রসিক মানুষ। শিশি ভালবাসতো ক্ষমতা এবং এ্র্যাটেনশন পেতে। ব্যাপার হচ্ছে, শিশি এখন বেসামরিকভাবে ক্ষমতা বলয়ের একদম একশো মিটার রেডিয়াসের ভিতরে থাকে। সেদিনের সেই শিশি আজ পরিপূর্ন একটি বোতল।" - হা হা হা 😀 😀 😀
    "আমাদের ব্যাচে একজন চাচা চৌধুরী ছিল। যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়ে চাচার অগাধ পান্ডিত্য ছিল" - আমাদের ব্যাচেও এমন একজন ছিলো, তার নাম মোমেন চাচা। বয়সে সে আমাদের চেয়ে বেশ বড় ছিলো মনে হয়। সেই তখন থেকেই সে সব সময় সুন্দর ক্লীন শেভড থাকতো।
    "পঞ্চাশ বা পঞ্চান্নজন কারো বন্ধু হয় না" - একথাটা তো ঠিকই, তবুও কলেজ থেকে বের হয়ে আসার প্রায় ৪২ বছর পরেও মনে হচ্ছে কারো কারো সাথে বন্ধুত্বটা অকৃত্রিমই রয়ে গেছে সেই তখন থেকে ("আমি অনেকদিন ভেবেছি কলেজের বন্ধুত্ব আসলে অকৃত্তিম কিনা" প্রসঙ্গে বললাম কথাটা)!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।