বয়স এখন একান্ন – ক’দিন বাদেই বাহান্নতে পা দিব। আর ‘যাহাই বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন’ – তাই বয়সের হিসাব ছেড়ে দিয়ে ইংরেজীতে প্রচলিত ‘গ্রেসফুলি এইজিং’ কথাটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আমাদেরকে ধীরে ধীরে বার্ধক্যকে বরণ করে নিতে হয়। তারপরেও বয়স বাড়ার কিছু উপসর্গ থাকে আর সেই সাথে আসে কিছু উপলব্ধি। সৃষ্টিকর্তাকে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে কিনা সেই উপলব্ধির সূত্র ধরে গত বছর পঞ্চাশ বছর বয়সে পবিত্র হজ্ব পালন করি। আর এই হজ্ব যাত্রার প্রস্তুতি স্বরূপ যখন লিস্ট ধরে ধরে যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের যোগাড় যন্ত্রের আয়োজন চলছিলো – তখন সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে এক জোড়া রিডিং গ্লাসও কিনে ফেললাম। কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই ছোট অক্ষরে লিখা বই পড়ার সময় বইটাকে স্বাভাবিক দূরত্বের চাইতে একটু দূরে ধরে পড়তে হচ্ছিল। এটি একটি বয়স বাড়ার স্বাভাবিক উপসর্গ -বাংলায় ‘চালশে’ বলা হয়ে থাকে। কারণ সাধারণত চল্লিশের পরে এই উপসর্গের দেখা মিলে। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য দেখা দিল পঞ্চাশে। পঞ্চাশ বছর বয়সে এই রকম আরো কিছু উপসর্গ জীবনকে ‘পানশে’ করে দেয়ার পাঁয়তারা কষে – ইংরেজীতে একে বলে ‘মিড লাইফ ক্রাইসিস’। এই ক্রাইসিস একেকজন একেকভাবে মোকাবিলা করেন। তবে আমার ষ্ট্র্যাটেজি হচ্ছে একে নিয়ে মোটেই মাথা না ঘামানো। তাই চোখের এই সামান্য অসুবিধাকে তেমনভাবে আমলে নেইনি। তাছাড়া প্রতি বছর অপটোমেট্রিসের কাছে যখন চোখ পরীক্ষা করাতে যাই, তিনি আমাকে রিডিং গ্লাস না পরলেও কোন ক্ষতি নেই বলে সার্টিফিকেট দিয়ে দেন। ফলে আমিও তেমন গা করি না। কিন্তু তারপরেও কেন জানি হজ্বে যাওয়ার আগে ডলার স্টোর থেকে একজোড়া রিডিং গ্লাস ‘অফ-দ্য-সেলফ’ কিনে ফেললাম। প্ল্যান ছিলো হজ্বের সময় প্রতিদিন কিছু নোট লিখে রাখব যাতে পরবর্তীতে বড় আকারে আমার হজ্ব অভিজ্ঞতার কথা লিখতে পারি। হজ্বের আনুসাঙ্গিক ধর্মীয় আনুষ্ঠিকতা পালনের সময় সেই নোট অবশ্য আর লিখা হয়ে উঠেনি – সব ঘটনাই মনের পাতায় গেঁথে নিতে হয়েছে। তাই সেই রিডিং গ্লাস জোড়া আর বের করতে হয়নি হজ্বের সময়। হজ্ব থেকে ফিরে এসে গ্লাস জোড়ার জায়গা হলো আমার স্টাডি টেবিলের এক কোনায়। বই পড়তে তেমন একটা লাগে না, তবে কাগজে-কলমে কিছু লিখতে গেলে রিডিং গ্লাস জোড়ার শরণাপন্ন হতেই হয় – তাই সেটাকে ‘রাইটিং গ্লাস’ বলাই বোধহয় অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
হজ্বে যাওয়ার ব্যাপারে নিজের পরিবারের বাইরে যার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী উৎসাহ এবং সহযোগিতা পেয়েছি তিনি হচ্ছেন পাবনা ক্যাডেট কলেজের একজন এক্স-ক্যাডেট। বেশ কয়েক বছর আগে টরন্টোর নর্থ-ইয়র্ক রিজিয়নে অবস্থিত ‘আবু হুরাইরা’ মসজিদে তার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। অনেক বছর ধরেই আমাদের অর্থাৎ স্ত্রী-পুত্র সহ আমার এই মসজিদে নিয়মিত যাতায়াত। প্রথম থেকেই দূর থেকে তাকে দেখেছি ইফতারির সময় ঢাউস সাইজের এক ফ্লাস্ক হাতে সবাইকে নিজ হাতে বানানো তেঁতুলের শরবত বিলি করে বেড়াতে। এই শরবতের সুত্র ধরেই তার সাথে আমার প্রথম আলাপ। আমি নিজেও একজন এক্স-ক্যাডেট, তবে রংপুর ক্যাডেটের। ব্যাচের হিসেবে তিনি আমার তিন ব্যাচ জুনিয়র। তার মাধ্যমেই ঝকঝকে এক ঝাঁক উচ্ছল ও প্রাণবন্ত বাংলাদেশীদের সাথে পরিচয় যারা এই মসজিদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সেই বিভিন্ন কর্মকান্ডের ভিতর টেবিল টেনিস খেলা হচ্ছে অন্যতম। তাদের উৎসাহেই আমি টেবিল টেনিস খেলায় যোগ দেই আর এই খেলার মাধ্যমেই তাদের সাথে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশী কিংবা পাকিস্থানীদের দ্বারা পরিচালিত অন্যান্য মসজিদ থেকে ‘আবু হুরাইরা’ মসজিদটি কিছুটা ভিন্ন – জুমার নামাযের খুৎবা, রমযানের তারাবী কিংবা বিতর নামায আমাদের পরিচিত হানাফী মাহযাবের থেকে কিছুটা ভিন্নভাবে পরিচালিত হয় এখানে। ফরয নামায কিংবা খুৎবার শেষে হাত তুলে মোনাজাতের প্রচলন নেই এখানে। প্রথম প্রথম কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও পরে উপলব্ধি করি যে ইসলামে মাহযাব ব্যাপারটি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আবু হুরাইরাতে জুমার খুৎবার বিষয়বস্তু সিলেক্ট করা হয়ে থাকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সাথে মিল রেখে, গুরুত্বের সাথে আলোকপাত করা হয় এখানে বেড়ে উঠা কিশোর আর তরুণদের প্রতিদিন যে সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় সেইসব বিষয়ের প্রতি। আমরা যারা পরিণত বয়সে এই দেশে এসেছি কিংবা এদেশের হাইস্কুল কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়নি, তারা হয়ত সেই সব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিবহাল নই। আবার আমরা যদি এখানে বেড়ে উঠা আমাদের সন্তানদের সাথে সেভাবে না মিশি তবে তারা হয়ত কখনই সেই সব চ্যালেঞ্জের কথা আমাদের সাথে শেয়ার করবে না। ফলে আমরা হয়ত জানতেই পারব না তারা কিভাবে আস্তে আস্তে ধর্ম বিমুখ হয়ে যাচ্ছে, কিভাবে তারা ‘ওরিয়েন্টালিজম’-এর ওয়েস্টার্ন ব্যাখ্যার ফাঁদে পা দিচ্ছে।
সোমালি অধিবাসীদের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদে তাদের পাশাপাশি প্রচুর আরব, পাকিস্থানী, ইন্ডিয়ান, শ্রীলংকান, আফগান, আফ্রিকান এবং বাংলাদেশী মুসলমানদের দেখা পাওয়া যায়। ইদানীং বেশ কিছু উইঘুর, তুর্কেমেনিস্থানী আর হুই চাইনিজ মুসলিমদেরও দেখা যায় এখানে। তবে সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশীদের অবস্থান সোমালীদের পরপরই। আর মসজিদের বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণও অন্যান্যদের তুলনায় বেশ উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি মসজিদ সংলগ্ন চার্চটি প্রায় দশ মিলিয়ন ডলার মূল্যে কেনা হয়েছে। বেশ কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় এই বিপুল অংকের ফান্ড যোগাড় করা হয় যার সিংহভাগই এসেছে মসজিদে আসা মুসল্লীদের ডোনেশন থেকে আর সেই মুসল্লীদের একটা বড় অংশ হচ্ছে বাংলাদেশী।
প্রতি বছর বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে রমযান পালন করা হয়ে থাকে আবু হুরাইরা মসজিদে। তারাবী নামায পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন অন্তত পক্ষে একজন ক্বারী তথা হাফেজকে আনা হয়ে থাকে প্রতি বছর। সাধারণত আল-মাগরিব দেশগুলোর একটি থেকে আগমন হয় এই অতিথি হাফেজের। তার সাথে আবু হুরাইরার নিজস্ব হাফেজরাও সামিল হন তারাবী নামাযের ইমামতিতে। আবু হুরাইরার ‘হেফজ’ প্রোগ্রাম থেকে অসংখ্য তরুণ হাফেজ তৈরী হচ্ছে যার ভেতর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণেরাও আছেন। এরকম একজন বাংলাদেশী হাফেজ তারাবীতে ইমামতি করে থাকেন নিয়মিত। রমযানের প্রতিটি দিনেই আবু হুরাইরা মসজিদে থাকে উন্মুক্ত ইফতারির ব্যবস্থা। ইফতারির এই বিশাল আয়োজনের জন্য তৈরী করা হয় আলাদা ফান্ড। তবে অনেকে আবার একা কিংবা গ্রুপ করে একেক দিনের ইফতারি স্পন্সর করে থাকেন। আর সবাই মিলে এক সাথে উৎসবমুখর পরিবেশে ইফতারি করার টানে আমি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই হাজির হই আবু হুরাইরাতে। মাঝে মাঝে সাথে করে বীন-স্যালাড আর ফ্লাস্ক ভর্তি চা-কফি নিয়ে আসি যা সবাই ভাগাভাগি করে নেই। আমার মতন অন্যান্যরাও বাড়ী থেকে হালিম, পিঁয়াজু ইত্যাদি কিছু বানিয়ে অথবা ‘পিঠাঘর’ থেকে গরম গরম জিলাপি নিয়ে আসেন। আবু হুরাইরা থেকে দেয়া ইফতারির সাথে সেগুলো যোগ হয় তখন। ইফতারির পরে এশার নামাযের জন্য অপেক্ষার সময়টুকু কেটে যায় গরম কফিতে চুমুক দিয়ে আর সবার সাথে খোশগল্পে। সেই খোশগল্প আরও বেশী জমে উঠে যেদিন বয়সে প্রবীন কিন্তু তারুণ্যের প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরা জর্ডানের আবু ইউসুফ যোগ দেন আমাদের সাথে। এক সময়ের আন্তর্জাতিক মানের তুখোড় টেবিল টেনিস খেলোয়াড় আবু ইউসুফ এখনও অনেক বাঘা তরুণদেরকেও ঘামিয়ে ছাড়েন। তার ঝুলিতে জমে আছে অনেক গল্প – সেই গল্পগুলিই আমাদেরকে মোহিত করে রাখে যখন তিনি আমাদের আসরে থাকেন। পাঠকদের জন্য তোলা রইল আবু ইউসুফের সেই গল্পগুলি অন্য আরেকদিনের জন্য।
বিগত কয়েক বছর ধরেই শবে কদর অর্থাৎ সাতাশে রমযানের ইফতারি স্পন্সর করে যাচ্ছে আবু হুরাইরার বাংলাদেশী কমিউনিটি। শুরুতে কমিউনিটির মুষ্টিমেয় সদস্য এই উদ্যোগ নেন। পরবর্তী বছরগুলোতে কমিউনিটির অন্যান্য সদস্যরা এই উদ্যোগে অংশ করা শুরু করেন। বর্তমানে বৃহত্তর বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যরা অর্থাৎ যারা আবু হুরাইরা মসজিদে নিয়মিত নন তারাও এই স্পন্সরশীপে অংশ গ্রহণ করেন এবং শবে কদরের ইফতারিতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেন। ফলে সংগৃহীত ফান্ড দিয়ে এবছর সাতাশে রমযান বাদেও আরও একদিনের ইফতারির ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশী মহিলারা তাদের নিজেদের উদ্যোগে দুইদিন ইফতারির আয়োজন করেন। সেই দুইদিনের ইফতারিতেও উদ্বৃত্ত কিছু ফান্ড যোগ করা হয়। সাতাশে রমযানের জন্য আয়োজন করা হয় প্রায় চৌদ্দশত লোকের ইফতারি যা কিনা অন্যান্য সাধারণ দিনের লোকসংখ্যার দ্বিগুনেরও বেশী। এবছর আবার জুমাতুল বিদা এবং শবে কদর একই দিনে হওয়ায় মসজিদের ভলান্টিয়ারদের কাজের চাপও বেড়ে হয় দ্বিগুণ। ইফতারির জন্য পার্কিং লটের একটা অংশে টেবিল চেয়ার পেতে পুরুষদের বসার ব্যবস্থা করা হয় আর মহিলাদের জন্য বরাদ্দ করা হয় ভেতরের ‘মাল্টি-পারপাস হল’। মসজিদ কমিটি থেকে যদিও বিপুল সংখ্যক তরুণ ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা হয়, তারপরও আমরা কয়েকজন এত বড় কর্মযজ্ঞের সার্বিক দেখাশুনার দায়িত্ব নেই। আমার উপর ভার পড়ে বাংলাদেশী মেহমানদের আপ্যায়ন করে তাদেরকে নির্দিষ্ট কয়েকটি টেবিলে বসার ব্যবস্থা করে দেয়া। ব্যক্তিগতভাবে তাদের টেবিলগুলিতে আমি আমার নিজ হাতে তৈরি বীন-স্যালাড পরিবেশনের প্ল্যান করি। তাই জুমাতুল বিদার নামায শেষে চটজলদি বাড়ী ফেরার তাগিদ। আমি সাধারণত শুক্রবারে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করে থাকি আর জুমার নামাযের জন্য দেড় ঘণ্টার একটা ‘আউট অব অফিস’ নোটিশ দিয়ে রাখি। সেই জন্য নামায শেষে এমনিতেই তাড়া থাকে কাজে ফেরার, আজ কাজের শেষে বীন-স্যালাড তৈরির জন্য ডবল তাড়া। এতসব তাড়াহুড়ার মাঝে যখন গাড়ীতে ষ্টার্ট দিব তখন আমার স্ত্রী আমার হাতে একজোড়া রিডিং গ্লাস দিয়ে বলল – “আসার সময় রাস্তায় পেলাম। এই ভীড় ঠেলে এখন আর ‘লষ্ট এন্ড ফাউন্ড’-এ জমা দিতে পারলাম না। বিকেলে দিব।” কালো ফ্রেমের ‘রে-বান’ ব্র্যান্ডের দামী সেই চশমা জোড়া। আমি চোখে দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ‘তারা তিনজন’ নাটকের ডায়ালগের মতন করে বললাম – “যাক জিনিষটা ভালো পাওয়া গেছে।” আমার এই জাতীয় রসিকতার সাথে আমার স্ত্রী বহুল পরিচিত, তাই সে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চশমা জোড়া তার হাতব্যাগে চালান করে দিল।
বাসায় ফিরে আবার অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু পাঁচটা বাজার সাথে সাথেই লেগে গেলাম বীন-স্যালাড তৈরি করতে। পিঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, টমেটো, শশা, কাঁচা আপেল সব কুঁচি কুঁচি করে কেটে বিভিন্ন প্রকারের বীন এর সাথে মিশিয়ে তৈরি করি এই স্যালাড। তারপর ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা আর কফি নিয়ে আমরা রওনা দিলাম আবু হুরাইরার উদ্দেশ্যে। সেখানে অনেক কাজ পড়ে আছে। মসজিদে পৌঁছেই লেগে গেলাম পার্কিং লটে টেবিল লাগানোর তদারকিতে। ইতিমধ্য দলে দলে মুসল্লীদের আগমন শুরু হয়ে গেছে। সেই মুসল্লীদের মাঝে বেশ কিছু পরিচিত মুখের দেখা পেয়ে তাদেরকে নিয়ে গেলাম নির্দিষ্ট করা টেবিলগুলির কাছে। এই ভীড়ের ভেতর ক্যাডেট কলেজের এক জুনিয়র ছেলেকে পেয়ে তার সাথে কুশল বিনিময় করছিলাম পার্কিং লটের আরেক প্রান্তে – আমার গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ মাঝ বয়সী সোমালী এক ভদ্রলোক গাড়ী থামালেন আমার গাড়ীর ঠিক পিছনে। তারপর গাড়ী থেকে নেমে আমার গাড়ীর সামনে এসে মাটিতে কি যেন খুঁজতে শুরু করলেন। জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর পেলাম সে আজ জুমার নামাযের পর থেকে তার রিডিং গ্লাস জোড়া খুঁজে পাচ্ছে না। সে এখানে গাড়ী পার্ক করেছিল জুমার সময়, তার ধারণা চশমা জোড়া সে এখানেই ফেলে গেছে। তাই ‘লষ্ট এন্ড ফাউন্ড’-এ খোঁজ নেয়ার আগে এখানে একটু চেক করে নিচ্ছে। কালো ফ্রেমের ‘রে-বান’ ব্র্যান্ডের চশমা কিনা জিজ্ঞেস করতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আমিও পেয়ে গেলাম আমার স্ত্রীর কুড়িয়ে পাওয়া চশমার মালিককে। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম আমার স্ত্রী তোমার চশমা জোড়া জুমার শেষে কুড়িয়ে পেয়েছে। এখনও বোধকরি সেটা তার ব্যাগে আছে – ‘লষ্ট এন্ড ফাউন্ড’-এ জমা দেয়ার কথা অবশ্য। এবার তার বিস্মিত হবার পালা। কারণ সে চশমা খুঁজতে এসে আমাকে খুঁজে পেয়েছে যার স্ত্রী কিনা চশমা জোড়া কুড়িয়ে পেয়েছে প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক আগে। আর আমি বিস্মিত দুটো কারণে – এক, আমি ঠিক সেই জায়গায় গাড়ী পার্ক করেছি যেখানে চশমা জোড়া কুড়িয়ে পেয়েছিল আমার স্ত্রী। দুই, আমি ঠিক সেই মুহুর্তেই আমার গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি যখন চশমা খুঁজতে চশমার মালিক এসে উপস্থিত।
ফোন করতেই আমার স্ত্রী জানালো সে এখন সেই চশমা জোড়া ‘লষ্ট এন্ড ফাউন্ড’-এ জমা দেয়ার জন্য যাচ্ছে। মালিককে খুঁজে পাওয়া গেছে জানাতেই সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল। সোমালী ভদ্রলোককে জানালাম যে আমার স্ত্রী চশমা নিয়ে আসছে। অপেক্ষার সময়টাকে কিছুটা প্রাণবন্ত করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম সে কতদিন ধরে কানাডাতে আছে। সে জানালো যে সে ১৯৮৯ সালে এদেশে এসেছে যখন সোমালীদের জন্য ভিসা লাগত না। সেই সময়ে আমি তখন বেইজিং-এর একটি ইউনিভার্সিটিতে ফরেন স্টুডেন্ট হিসেবে কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি। সতীর্থ হিসেবে অনেক সোমালী স্টুডেন্টদের পেয়েছিলাম তখন। তাদের ভেতর বেশ কয়েকজনের সাথে আমার সখ্যতাও ছিল বেশ গভীর। সেই সময়ে দেখেছি অনেক সোমালী স্টুডেন্টদের লেখাপড়ার মাঝপথেই কানাডাতে পাড়ি জমাতে। ভাগ্যক্রমে আমিও যে একদিন কানাডাতে পাড়ি জমাবো তখন সেটা ছিল আমার দূরতম কল্পনারও অতীত। ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী চশমা নিয়ে হাজির। আমরা আমাদের বিস্ময়ের কথা শেয়ার করে আরো একবার বিস্মিত হলাম এই কারণে যে আজকের দিনটি একই সাথে জুমাতুল বিদা এবং শবে কদর। এই তাৎপর্যপূর্ণ দিনে আমরা সবাই এই চশমা ঘটনার নাটকীয় পরিসমাপ্তি অনুধাবন করে চমৎকৃত হলাম আর সেই সাথে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম। তারপর আমি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ইফতারির জন্য আগত লোকজনের আপ্যায়নে।
ভালো হইছে!!
ভালো লেখা ভাই। আলহামদুলিল্লাহ