এখন হজ্বের মৌসুম। প্রতিবারের মত এবারও কোটি মানুষ পাপ মোচনের আশায় ছুটে গিয়েছে সৌদি আরব। বাংলাদেশী হজ্বযাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। ফেসবুকেও মাঝে মাঝে পাপমোচনের খুশি দেখছি ইদানিং। মক্কায় গিয়ে গরমের মধ্যেও প্রচণ্ড প্রশান্তি অনুভব করছেন হাজী ভাই বোনেরা,কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন,নামাযে দাঁড়ালে মনে হচ্ছে এর চেয়ে শান্তির কিছু নেই। একটা সময় ছিল মানুষ সারাজীবন পাপ করে শেষ বয়সে হজ্বে যেত তবে গত কয়েক বছর যাবত এই প্রথাটা চেঞ্জ হচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশী হজ্বযাত্রীদের ১৪% ই ৪০ বছরের কমবয়সী। ২০১২ সালের পরিসংখ্যান মতে শুধুমাত্র হব্জ থেকে (উমরাহ্ বাদে) সৌদি সরকারের আয় সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার। আমার মত অনেকেরই হয়ত টাকার হিসাবটা বুঝতে সমস্যা হবে তাই একটু সোজা করে বলি। এই টাকা দিয়ে আমাদের দেশে ৫ টা পদ্মা সেতু তৈরি করেও আরও বিলিয়ন খানেক ডলার থেকে যাবে।
২০১২ সালের কথা।নানী আর খালাকে নিয়ে সিএনজিতে করে ময়মনসিংহ যাচ্ছি। আমার নানী সারা বছর রোগবালাই জমা করে রাখে আমার অপেক্ষায়। আমি দেশে গেলেই নানীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। সময়টা ছিল সম্ভবত স্কুল ছুটির। রাস্তার পাশে অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দেখলাম হাতে বই নিয়ে বুকের সামনে ধরে গুটি গুটি পায়ে দল বেঁধে বাড়ি যাচ্ছে। সেই পাগুলোতে জুতো নেই,থাকলেও ছেঁড়া। অনেকের একমাত্র স্কুল ড্রেসটিও জীর্ণ শীর্ণ,উসকো খুসকো জটা ধরা চুল। চেহারা দেখেই বোঝা যায় পেটে তাদের ক্ষুধা। তারপরও তারা স্কুলে যায়,সুসময়ের স্বপ্ন দেখে। এই দৃশ্যটা আমি অনেকবার দেখেছি এবং প্রতিটিবার অজানা এক ভালো লাগায় পুলকিত হয়েছি আর ভেবেছি ভাগ্যিস প্রাথমিক শিক্ষাটা এখনো অবৈতনিক।
যাই হোক,সিএনজির ড্রাইভার এর মাথায় টুপি,গালে দাড়ি। রোযার মাস বলে হয়তো ড্রাইভারের পাশে যে দুইজন বসে আছে তাদের মাথায়ও টুপি। হঠাৎ ড্রাইভারের পাশের বয়স্ক আঙ্কেল গল্প শুরু করলেন। গ্যাসের দাম থেকে কিভাবে যেন আলাপ সৌদি আরব চলে গেল। শুনলাম আঙ্কেল হজ্বে যাবেন কয়দিন পর। কণ্ঠের উত্তেজনাটা কি আল্লাহ্র ঘরে যাবার নাকি বিদেশ যাবার তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ড্রাইভারের বুক ফেটে কেবল হতাশা বের হচ্ছিল,বারবার আফসোস করে বলছিলেন ভাই আপনি কত ভাগ্যবান,আমারে যে কবে আল্লাহ্ তৌফিক দিবেন। আঙ্কেলও ড্রাইভারকে বুঝ দিচ্ছিলেন আরেকটু কষ্ট করে টাকা পয়সা জমিয়ে একবার চলে যাও,ঐ মহান মাটিতে পা পড়া যে কতোটা ভাগ্যের গেলে বুঝবা। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল এই আলোচনায় অংশ নেবার কিন্তু নানী বারবার আমার হাত চেপে থামতে বলছিল। আমি কি বলতে চাচ্ছি তা নানী ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছিল। এখানে বলে রাখি আমার ধর্মীয় ব্যাপারে অবিশ্বাসের কথা আমার পরিবারের সবাই জানে এবং তারা আমার সাথে কখনো কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি করে না। শুধু রোযার ঈদের দিন সবাই একসাথে খেতে বসলে তারা চারদিক থেকে আমার উপর কথার আক্রমন চালায় এবং আমিও খেতে খেতে সবার যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করি। প্রত্যেকবার বিতর্ক শেষ হয় নানীর কথায় “বাদ দাও তো সবাই,বড় হলে এমনিতেই সব বুঝবে”
২০ মিনিটের যাত্রা পথে ১০ মিনিট ধরে খুরমা খেজুর খাইতে যাবার গল্প শুনতে খুব বিরক্ত লাগছিল। আর সইতে পারলাম না। বললাম আঙ্কেল কবে যাচ্ছেন?কত টাকা লাগলো?উনি ব্যাপক উৎসাহে সবকিছু বোঝাতে লাগলেন। ৪ লাখ টাকা দিতে হয়েছে এজেন্টকে,আরও কিছু টুকটাক খরচ আছে। আমি কিছু বলার আগেই বোঝাতে লাগলেন এই বয়সেই যদি আমি হজ্বে যাই তাহলে সেটা কত ভালো,আমার মত অনেকেই নাকি যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম আঙ্কেল একটু আগে যে বাচ্চাগুলো যাচ্ছিল বই হাতে খেয়াল করেছিলেন? হ্যা সূচক মাথা নাড়লেন তিনি। আবার জিজ্ঞেস করলাম বাচ্চাগুলোর পোশাক,জুতা,চুল এগুলো খেয়াল করেছেন? আপনার এই ৪ লাখ টাকা দিয়ে কতগুলো বাচ্চাকে সাহায্য করা যেত জানেন? এই ৪ লাখ টাকা দিয়ে কতগুলো ড্রপ-আউট বাচ্চাকে স্কুলে ফেরানো যেত জানেন? আপনার এলাকার কত শিশু না খেয়ে ঘুমাতে যায় জানেন? সারাজীবন কষ্ট করে টাকা জমিয়ে সৌদিকে দিয়ে আসার মানে কি,তারা তো এমনিতেই ম্যালা ধনী,দেখেন না কত তেল তাদের?আঙ্কেলের সব উৎসাহ উদ্দীপনা পানি হয়ে গেল,মুখটা কালো করে একটা কথাই বলতে পারলেন,তুমি কি মুসলমান না হিন্দু?
সারা পৃথিবীর উত্তোলনযোগ্য পেট্রোলের ২৫% আছে সৌদি আরবে। মাত্র ৮ মাসে পেট্রোল থেকে আয় ১৩০ বিলিয়ন ডলার। তাদের মাথাপিছু আয় আমাদের ২০ গুণ।তারা যে খুব খাঁটি মুসলমান তাও কিন্তু বলা যাবে না। এমনকি সৌদি সরকার এইবারের হজ্বযাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েছে G4Sকে যারা কিনা ফিলিস্তিনি মুসলমানদের উপর অত্যাচারের কারনে সারা পৃথিবীতে সমালোচিত। অন্যদিকে আফ্রিকার মুসলমান দেশগুলোতে দুইদিন পরপর দুর্ভিক্ষ লাগে,পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব ১০টি দেশের তালিকায় ছয়টি দেশেই মুসলমান জনসংখ্যার আধিক্য। পৃথিবীর মোট উদ্বাস্তুর ৭০% হলো মুসলমান।
জানি অনেকে বলবেন যাকাতের কথা। নিয়মিত যাকাত দিলে কেউ গরীব থাকবেনা হ্যান-ত্যান। ইসলামে জাকাত দেয়ার কথা বলা আছে,তারপরও গরীব মুসলমান কিভাবে থাকে? বাংলাদেশে হাজার হাজার পথশিশু দুইবেলা ঠিকমত খেতে পায়না,কয়েকদিন আগে পড়লাম ক্ষুধার জ্বালায় ওরা নাকি পলিথিনে “পেসটিং(এক ধরনের নেশা)” খায়। আবার এই বাংলাদেশ থেকেই প্রতিবছর লাখের উপর মানুষ হজ্ব বা উমরাহ্ করতে যায়। যাকাত বা ইনকাম ট্যাক্স দেয়না এমনও হাজার হাজার মানুষ যে হজ্বে যায় এতে কোন সন্দেহ নাই। এখন আমি বলি মানুষ কেন যাকাতের চেয়ে হজ্বে যেতে আগ্রহী। যাকাত দিয়ে তো আর নামের আগে “হাজী” টাইটেল লাগানো যায়না। এই টাইটেলের তো আবার বিশাল মূল্য আমাদের দেশে। একবার “হাজী” হইতে পারলেই বিশাল সম্মান,আগের আমলনামা একদম সাদা ফকফকা।
আল্লাহ্র ৯৯টি নামের একটি হলো আল হাকাম বা বিচারক।এখন কথা হইলো এ কেমন বিচার?যার আছে তারে আরও দেয়ার মানে কি?আল্লাহ্র আরেকটা নাম হলো আল আলিম বা সর্বজ্ঞ। তাইলে তো উনি এইটাও জানতেন যে সব তেলের খনি সৌদি আরবের নিচে,উনি তো জানতেন যে এই তেল বেচেই সৌদের বংশধরেরা অনেক বছর খাইতে পারবে,উনি তো এইটাও জানতেন যে লাইবেরিয়া বা সোমালিয়ার মুসলমানরা না খেয়ে মারা যাবে, উনি তো জানতেন যে মক্কার লোকেরা ধনী মুসলমানদের কাছে রাত প্রতি ৬০০০ ডলারে হোটেল ব্যাবসা করবে। তাহলে এইটা কেমন ধরনের ইনসাফ,কেমন ধরনের আদালত?হজ্বের সিস্টেমটা অন্য কোন গরীব দেশে না দিয়া কেন সৌদি আরবেই দেয়া লাগলো?অন্ততপক্ষে সম্পদের একটা সুষম বণ্টনতো হইত নাকি?
তোমার লীলা বোঝা নাকি ভার,লীলা বোঝাবুঝির কিছুতো নাই এখানে। হয় পুরোটাই আনফেয়ার/পক্ষপাতদুষ্ট নয়তো তুমি জানতাইনা যে সৌদির বাইরেও দেশ আছে।
(লেখাটি আমার ফেসবুক ওয়াল থেকে ঈষৎ পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত আকারে দেয়া হলো)