রসুলপুর।
আমরা থাকি জলিল মাঝির পুকুরের পূর্ব পাশটাতে। জানালা দিয়ে তাকালেই স্কুলের বাচ্চাগুলাকে দেখা যায়। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় এটা। পার্থিব জটিল বিষয় এসময় মাথায় ঢুকেনা,স্কুল পালানো আর কিছু আনুষঙ্গিক অগুরুত্বপূর্ণ চিন্তাই এসময়টাতে প্রাধান্য পায় বেশি।
বৃদ্ধাশ্রম। ইংরেজিতে বলে “old home”.আমি এখানে এসেছি কুড়ি বছর হল।কিবরিয়া এসেছে আরও আগে। বজলুর এসেছে গত বছরের মার্চে।আনিসুর আর আমি একসাথেই ঢুকেছি এখানে।জায়গাটা খুব একটা খারাপ না, পিছুটান নেই এখানে।তবে কিবরিয়ার অভিযোগের শেষ নেই,একবার তো সে তল্পিতল্পা সহ চলেই যেতে লেগেছিল।বের হয়ে গিয়েছিলও। আমি আর বজলুর বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাত দেখি কাকভেজা আনিসুর মূর্তির মত দাড়িয়ে আছে।আনিসুরের খুব মন খারাপ হয়েছিল সেবার,ওর পদার্থবিদ্যার দুটো পুরনো বই ভিজে গিয়েছিল।
কিবরিয়া,খুব গম্ভির(আমরা ডাকি বিক্রিয়া বলে)সে ছিল পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। ওর কিন্তু এখানে আসার কথা ছিলনা। কিন্তু সময়ই হয়ত তাকে আমাদের সঙ্গী বানিয়েছে।শুনেছি জীবনে কখনও সুখ পায়নি কিবরিয়া।বিয়ে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক সহপাঠীর সাথে।কোন একদিন সে বাসা থেকে পালিয়ে যায়।অনেক চেষ্টা করেও ওকে খুজে পায়নি কিবরিয়া।
বজলুর,খুব ভাল দাবা খেলে। বৃদ্ধাশ্রমের কেও এখন পর্যন্ত তাকে হারাতে পারেনি(একজন ছাড়া,তার পরিচয় পরে দিচ্ছি)বজলুর ছিল ব্যবসায়ি,পুরান ঢাকায় তার জমপেশ ব্যাবসা ছিল একসময়। ওর বউকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তারপর ছেড়ে দেয় ব্যাবসা। বড়ছেলে আছে বিলেতে।একটা মেয়ে ছিল।পালিয়ে বিয়ে করছে, তারপর থেকে ওর সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই।বজলুর বুঝতে পারেনি জীবনও একটা দাবার বোর্ড, আমরা দাবার গুটি।
আনিসুর,গণিতের শিক্ষক ছিল। এখনও গনিত নিয়েই তার জীবন। গণিতের মানুষগুলো অনেক মজার হয়।
জহির, উঠতি কিশোর। একমাত্র প্রাণী এখানকার যে বৃদ্ধ না হয়েও বৃদ্ধাশ্রমে আছে আমাদের সাথে।জহির ছেলেটাই বজলুর কে দাবাতে হারাতে পেরেছে। তিন চালে খেলা শেষ করাটা আমি ওর কাছ থেকেই শিখেছি।
আমাকে রাতের ট্রেন ধরতে হবে আজকে।আমার মেয়ে আসবে আজকে বিলেত থেকে,বুশরা।জীবনে যদি কোন ভাললাগা থেকে থাকে তাহলে আমার এই মেয়েটার কারণেই। আমার কিন্তু একটা ছেলে আছে।আমার সাথে ওর কথা হয়না ওর মা মারা যাবার পর থেকে। ওর ধারণা আমি ওর মাকে মেরে ফেলেছি।লিলি মারা যাবার পরে ওর বড়ভাই বুশরাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যায়,আমার ধারণা ছিল মেয়েটাকে ছাড়া আমি হয়ত বেঁচে থাকতে পারবনা।
কুড়ি বছর পর আজ দেখতে পাব আমার মেয়েটাকে।এতদিন ছিল বিলেতে,সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে।
অনেক রাত। প্লাটফর্মে আমি আর জহির দাড়িয়ে আছি। আস্তে আস্তে মানুষ চলে যাচ্ছে,জহির ওর তাবিজ হারিয়ে ফেলেছে। এজন্য ওকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। ওর বাবা ওকে ছোটবেলায় এই তাবিজ পরিয়ে দিয়েছিল।ট্রেনের শব্দে স্টেশন টা হঠাত করেই যেন জেগে উঠল। এতক্ষণ কোথায় ছিল ওরা? নাকি আমার আর জহিরের সাথে সবাই লুকোচুরি খেলছে?
ট্রেনে আমাদের সামনে এক চোর বসেছে।আজকে সে চুরি করেনি,কারণ আজকে নাকি সে বাবা হয়েছে।ওর সবুজ রঙের শার্টটা থেকে খুব গন্ধ আসছে,অনেকদিনের পুরানো।মনে হয় এটাও কোথা থেকে চুরি করেছে।
কলাবাগানে কবিরের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি। দারোয়ান ঢুকতে দিচ্ছেনা,ভেতর থেকে নাকি মানা আছে।আমি আর জহির সামনের একটা চায়ের দোকানে বসলাম।কিছুক্ষণ পর দারোয়ান বের হয়ে এল।আমাদের দেখে মনে হয় ওর সমবেদনা হয়েছে।ওর নাম মনসুর, বাড়ি জামালপুর। আজকে ওর নাকি ঘুম পাচ্ছে,কেন পাচ্ছে এটা বুঝতে পারছেনা,সারাদিন ই তো ঘুমিয়েছে।আমাদের সাথে কথা বলে হয়ত জেগে থাকার চেষ্টা করছে।
বুশরা এখন আমার সামনে। দেশে আসার কোথা ছিলনা ওর।কিন্তু আসতে হল।বিয়ে হয়েছিল ওর,আলিফের সাথে।আমার বন্ধুর ছেলে।বাবার কোন গুণ ছেলের ভিতর নেই।তবে শুনেছি বুশরা নাকি বেশ সুখেই ছিল।মেয়ে হয়ত ওর মায়ের মতই ছিল, সংসারী। আমার ডান হাতে বুশরার ছোটকালের একটা জামা।ওর মা মারা যাবার কিহুদিন পর ওর জন্য কিনে নিয়ে এসেছিলাম। ওকে আর দেওয়া হয়ে উঠেনি।এসে দেখি সাদী(আমার ছেলে) বারান্দায় বসে পেপার পড়ছে। আমার ঘরে তালা ঝুলানো। এই ঘরেই আমার বুকে ঘুমাত বুশরা। বুশরাকে কবিরের কাছে দিয়ে দিয়েছে সে।
বাসা থেকে বের হয়ে আসি আমি।সেই যে বের হলাম,আর কখনও যাওয়া হয়নি।
রাত ঠিক তিনটায় বুশরা আসল।আমার সামনে শুয়ে আছে।মায়ের সাথে কোথায় যেন অদ্ভুত মিল অর।জানিনা ওর কি হয়েছিল।আমাকে জানানো হয়েছে ও নাকি আত্মহত্যা করেছে।
হাতে অনেক কাজ।ওকে দাফন করতে হবে।জহিরের চোখের কোণে সোডিয়াম আলোয় ভেজা খানিক পানি দেখা যাচ্ছে।বৃষ্টি হচ্ছে,অবিরাম বৃষ্টি।
রমজান আলীর ভ্যানে আমরা। গন্তব্য আজিমপুর।রমজান আলী অনর্গল কথা বলছে।বাসা থেকে ঝগড়া করে বের হয়ে এসেছে।ওর বউ ওকে পুরান ঢাকার বিরানী নিয়ে যেতে বলেছিল।ভুলে গিয়েছিল রমজান আলী।সেখান থেকে ঝগড়ার সূত্রপাত।
দাফন করার জন্য টাকা লাগে।আমার কাছে টাকা নেই,যা ছিল হারিয়ে ফেলেছি।চায়ের দোকান থেকে হয়ত কেউ পকেট মেরে দিয়েছে।
আমি,জহির আর রমজান আলী কবর খুঁড়ছি। দশটা কবর খুরতে হবে।বিনিময়ে আমার বুশরাকে দাফন করা হবে।দাফনের জন্য বাইরে অনেকগুলো লাশ অপেক্ষা করছে।একদিনে কত মানুষ মারা যায় সেটা জানতে পারলে খুব ভাল হত।
আমি বুশরার কবর খুঁড়ছি। বয়স হয়েছে,শক্তি নেই, সামর্থ্যও নেই;কিন্তু ইচ্ছা আছে,মায়াবোধ আছে।রমজান আলী তিনটা কবর খুঁড়ে ফেলেছে।রমজান আলী আমার কাছের কেউ নয়,আজ রাতেই ওর সাথে পরিচয়।রাত অনেক গভীর হয়ে আসছে, গোরস্থানের বাতাস মনে হয় একটু ভারি।অনেকেই হয়ত আর্তনাদ করছে,কিন্তু তাদের আওয়াজ কেউ শুনতে পারেনা,কেউ শুনার চেষ্টাও করেনা।
বুশরাকে দাফন করা হল।জহির ও রমজান আলী নির্বাক দাড়িয়ে আছে।দুজনের কেউ ই হয়ত ভাবতে পারেনি বুশরার সাথে দাফন হবে ওর বাবাও।
রমজান আলী কাঁদছে।আমরা মানুষ,আমাদের কষ্ট হয়।তাই হয়ত আমরা কাঁদি।
রাতের ট্রেনে আজ ফিরে যাবে জহির।বউয়ের জন্য পুরান ঢাকা থেকে বিরানী কিনে নিয়ে গিয়েছে রমজান আলী। ওর বউ আজ অনেক খুশি।
১ম :tuski: :tuski:
People sleep peaceably in their beds at night only because rough men stand ready to do violence on their behalf.
এই শিরোনামে হুমায়ূন আহমেদের একটা বই আছে।
গল্পটা একটু খাপছাড়া মনে হলো, পড়তে গিয়ে বারবার কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। 🙁
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
নামকরণ টা ভাইয়া হুমায়ূন আহমেদের বই থেকেই করেছি