সেইদিন নীলাকে অনেক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।আসলে সেদিন না,হয়ত প্রতিদিন ই।
নীলা, ঢাকা ভার্সিটির একজন নিতান্তই সাধারণ ছাত্রী (পড়াশুনার দিক থেকে নয়) যতদূর ওকে জেনেছিলাম ছোট ছোট বই এর বড় বড় জ্ঞান ওকে কখনই টানত না।তবুও কেন যেন ও অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল।
আর আমি তো আমি ই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অপদার্থের চেয়ে কিঞ্চিৎ খারাপ একজন শিক্ষার্থী ।পড়াশুনা র প্রতি ছোটবেলা থেকেই অনাগ্রহ ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের। তার উপর যোগ হয়েছিল দুর্বোধ্য অ্যানাটমি আর মহাভারত আকারের কিছু বই । পড়ার টেবিল এ বসে মাঝে মাঝেই এইসব বই এর লেখকদের তিরস্কার করতাম ।
আমি ছিলাম একটু অন্যরকমের।গোলাকার পৃথিবীর কোন কিছুই আমাকে তেমন একটা টানত না।মাঝে মাঝে মনে হত আমার জন্য পৃথিবী নয়,পৃথিবী র জন্য আমি নই।এক কথায় আমি ছিলাম বোরিং ।নীলার মত মেয়ে আমার মাঝে কি খুঁজে পেল তা আজও আমার কাছে রহস্য ঠেকে।
নীলা ছিল আমার ঠিক বিপরীত।বয়সের তুলনায় প্রতিভা হয়ত একটু বেশি ই ছিল ওর।লেখালেখির হাত ছিল ওর অসাধারণের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি অসাধারণ ,ঠিক যেন ওর মত।
আমাদের প্রথম দেখা মধুর ক্যান্টিন এ।আমাদের দেখা বললে হয়ত ভুল বলা হবে,ওর দেখা।ও আমাকে দেখছিল,আমি তাকিয়ে ছিলাম।
নীলা আমার সাথে প্রথম কথা বলল এরও বেশ কিছুদিন পর।নীল শাড়ি, একটা ছোট কাল টিপ আর ভেজা চুলে খুব একটা খারাপ লাগছিলনা ওকে ।অনেক কিছু বলবে বলে হয়ত প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। কিছু অগোছালো কথা ছাড়া ওকে আর কিছুই বলতে দেখিলাম না । বিজ্ঞানে ‘ইন্ডাকশন” বলে একটা কথা আছে।আমার মত অপদার্থের সামনে এসে কোন প্রানি ইন্ডাক্টেড হবেনা তাতো আর হয়না। তবে অগোছালো কথাগুলো ও অনেক সুন্দর করে বলেছিল ও(যদিও আমার কোন ক্রেডিট নেই এখানে )।
রাশেদ আমার নেংটা কালের বন্ধু। ভাগ্য বলে আমার সাথে DMC তে আবার দেখা হয়ে যায় ।নীলার ও বন্ধু মানুষ রাশেদ।
একদিন রাশেদকে দেখি আশে পাশে খুব ঘুরঘুর করছে।মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ কাশাকাশিও করছিল।আদৌ তার ঠাণ্ডা লেগেছিল কিনা আমি সন্দিহান ছিলাম। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে তার পুরনো প্যান্ট টার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল।কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি রাশেদ প্রস্থান করেছে।কাগজ টা পরে প্রথমেই একটা ধাক্কা খেলাম।নীলার লেখা ছিল এইটা। গল্পের শুরু এখানেই ডিসেম্বর ২৩,১৯৫১।
নীলার ভালবাসার মাঝে কোন আতিশয্য ছিলনা, বাড়াবাড়ি রকমের কোন খামখেয়ালিপনা ছিলনা।কিন্তু আমি ছিলাম বরাবরের মতই নির্লিপ্ত। বিজ্ঞানীরা যদি একটা গাছের চারা আর আমার মাঝে কোন গবেষণা চালাত, আমি মোটামুটি নিশ্চিত আমার চেয়ে ওই চারাটার আবেগ বেশি ধরা পরত। কিন্তু নীলার জন্য আমার ভিতর একটা স্থান ছিল, এটা আমি বুঝতে পারতাম,কিন্তু বুঝেও না বুঝার ভান করতাম,অনেকটা নিজের সাথে লুকোচুরি খেলার মত। But I loved the way she loved me.
হাতিরপুলের বায়স্কোপ তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল।নীলা আমাকে বলল সে নাকি আমাকে নিয়ে যাবে বায়স্কোপ দেখতে ।সেটা আমার মোটেই মনে ধরেনি এবং কিভাবে তাকে না বলব সেটা চিন্তা করছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে human mind কাজ করেনা,বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে inverse order.আমি ওকে বললাম ,আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাব।
শুক্রবার।নামাজ পড়তে যাইনি, আমার আসলে দোষ নেই,ঘুমিয়ে ছিলাম।বদমাশ রাশেদ ডেকে দেয়নি ।ফলাফল,ঘুমালাম বিকাল পর্যন্ত ।কিন্তু হঠাত করে মনে পরল যে আমার জন্য নীলা অপেক্ষা করছে টিএসসি তে । সেইদিন নীলাকে অনেক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।আসলে সেদিন না,হয়ত প্রতিদিন ই।
দুঘণ্টা লেইট করলাম।নিজেকে কেন যেন খুব ছোট ও অপরাধী মনে হচ্ছিল।ঘুম থেকে উঠার পরও একঘণ্টা লেইট করেছি,পুরোপুরি ই ইচ্ছাকৃত ।
হাতিরপুল সেদিন অস্বাভাবিক রকমের নিশ্চুপ ছিল। কবির ভাইয়ের বায়স্কোপ টা দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল ।কিন্তু কবির ভাই ছিলনা।বায়স্কোপ এর পাশে বসে ছিল মাঝবয়সী একটা কিশোর। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম কবির ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে ।অপরাধ ছিল উর্দু কে মুন্ডুপাত করছিল কোন এক দর্শকের কাছে এবং এক পশ্চিম পাকিস্তানি চামচা গোছের এক পুলিশের কানে সেটা গিয়েছিল ।নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব খারাপ লাগছিল।মেয়েটাকে দেখি শুধু আমিই কষ্ট দেইনা,ওর চারপাশের জগত টাও দেয়।
নীলা সেদিন লিয়াকত আলী আর আলী জিন্নাহ র মুন্ডুপাত করছিল ।গত ৩-৪ বছর ধরেই এ বিষয়টা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠছে ।আমি বরারবরের মত এখানেও নিরলিপ্ত।বাংলাতেই আমি কথা বল্ব,কার কি??জিন্নাহ সাহেব গলায় পারা দিলেও বাংলাতেই কথা বল্ব,কিন্তু কোনরকম আলোচনা বা আন্দোলন আমার একদম ই ভাল লাগতনা।আমি বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ।
সময় দ্রুত কেটে যেতে লাগল। প্রতিটা দিন আগের দিন থেকে আমাকে বেশি ভালবাসা শুরু করল নীলা। কিন্তু আমার মাঝে কোন ভাবান্তর ছিলনা।
নাজিমুদ্দিন সাহেব ঘোষণা দিলেন উর্দুই নাকি হবে রাষ্ট্রভাষা।কেপে উঠল পূর্ব পাকিস্তান। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে নীলা ছিল একটা পরিচিত মুখ।আমাকেও সে যোগ দিতে বলেছিল ।কিন্তু আমার কাছে এসব কেন যেন ভাল লাগতনা।
৩০ জানুয়ারী একটা সভা ছিল।নীলার এবারকার অনুরধ টা অগ্রাহ্য করতে পারলামনা ।সবার চোখেমুখে সেদিন রীতিমত আগুন দেখলাম। আরও দেখলাম এক ঠাণ্ডা আগুন নীলার আগুন ঝরানো বক্তৃতা ।মেয়েটাকে দেখে ভয় লাগছিল, সমীহ করতে লাগলাম ওকে ।
প্রতিদিন ই একটা না একটা সভা লেগেই থাকত ।কিন্তু নীলা আড়ালে চলে যায়নি। আমাকে আগের মতই অ ভালবাসত ,আগের মত বললে ভুল বলা হবে,আগের থেকে অনেক বেশি।
এর মাঝে একদিনকার ঘটনা। একদিন নীলা একটা সভায় যাচ্ছিল ।তার আগে আরেকটা কথা বলি।রাশেদ এর মামা বিলেত থেকে দেশে ফিরেছে বেশ কিছুদিন হল।একটা কাল গোলাপের গাছ নিয়ে এসেছিল সে। টবের মাঝে একটাই গোলাপ শোভা পাচ্ছিল।রাশেদ সেদিন হলে ছিলনা।ফুলটা ছিড়ে নিজের করে নিতে কেন জানি লজ্জা লাগল না। আমার হাতে তখন কাল গোলাপ টা ছিল। কোন উদ্দেশ্য নয়,এমনি ই ছিল,কতক্ষন আর বেঁচে থাকবে এই জীব টা আল্লাহ ই জানেন।যাই হোক ,নীলা কে দেখে কেন জানি মনে হল এই ফুলটা পেলে মেয়েটা অনেক খুশি হবে।
যা আশা করেছিলাম তার থেকে কয়েক সহস্র গুন বেশি খুশি হল মেয়েটা।
১৪৪ ধারা জারী করাটা ঠিক হলনা।সরকার অনেক বড় ভুল করেছে,আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে ।
রাতে সবাই একসাথে বসে প্ল্যাকার্ড বানাচ্ছে ।আমার কাছে কিছু পোস্টার পেপার নিয়ে আসল নীলা ।রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই- এটা লিখতে হবে।অবাক হয়ে নীলা পুরো ব্যাপারটা দেখছিল (তার আশ্চর্যের কারণ এখনও আমার অজানা)।ও,একটা কথা বলা হয়নি।আমি ছবি খুব একটা খারাপ আঁকাতাম না (নিজের ঢোল নিজে পিটানোর জন্য দুঃখিত ) আর্টপেপার টা খুব একটা ভাল ছিলনা।কিন্তু যাকে আঁকছি তার প্রভাবে সেটাকে অগ্রাহ্য করা যায় ।
ফেব্রুয়ারী ২১,১৯৫২।১০ টার মাঝেই নীলা আমাকে আসতে বলেছিল টিএসসির মোড়ে,কি নাকি করবে সবাই একসাথে । পোট্রেইট টা আমার কাছে ছিল।অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল,কিছু স্কেচিং বাদ ছিল,হলে ফিরে সেটা শেষ করে ফেলেছি (অনেক রাত ধরে করেছি )
যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে।ঘুম থেকে উঠলাম দশটার পরে।সকালটা অন্য দশটা সকালের মত ছিলনা।সবকিছু ছিল ভয়ানক রকমের স্তব্ধ।কিছু কাক অনেকক্ষণ ধরে কা কা করছে ।পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে একটুও ভাল লাগছেনা।
পৃথিবী দুবার ঠাণ্ডা হয়, ঝড়ের আগে ও ঝড়ের পরে।
পোট্রাইট টা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি।রাশেদ এর হাতে গুলি লেগেছে।আমার সাথে মাত্র হলে আসল সে। নীলা নাকি মিছিলে যাবার আগে আমাকে বারবার খুঁজছিল।প্রথমবারের মত অনুভব করলাম আমি আমার জীবন থেকে কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি।
৫০ টা বছর পার হয়ে গিয়েছে। ও,নীলা, তোমাকে তো বলাই হয়নাই ডাক্তারি পড়া আমি শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি । পরের বছর journalism এ ভর্তি হলাম।মাঝে বিলেত গিয়েছিলাম,তোমাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছি। যতটুকু ভেবেছিলাম টা থেকে অনেক বেশি সাড়া পেয়েছি।ইংরেজ রা পাকিদের মত এতটা পিশাচ না।
তোমাকে তোমার প্রাপ্য ভালবাসাটা না দিতে পারার অপরাধবোধ থেকেই হোক কিংবা নিজের নিরুৎসাহের কারণেই হোক নিজের উপর থেকে ব্যাচেলর ট্যাগ টা আর উঠিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি ।
একুশে ফেব্রুয়ারি তে আমি শহীদ মিনারে দুটো মোমবাতি নিয়ে যাই রাতে। একটা ভাষা শহীদ দের জন্য (এর মাঝে নীলাও আছে)আরেকটা শুধুই নীলার জন্য।
শুভ ব্লগিং।
সিনিয়র কি জুনিয়র বুঝতে পারলাম না ভাই, তবে লেখা ভাল ছিল। আরও ভাল লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
তানভীর আহমেদ
ভাইয়া আমি জুনিওর (০৫-১১)ধন্যবাদ ভাইয়া 🙂 🙂
:thumbup:
ধন্যবাদ ভাই 🙂
ব্লগে সাগতম হাসিব, লেখা ভাল লাগলো। নামের শেষে কলেজে অবস্থানকালটা জুড়ে দিও।
এখন কুইক ১০টা ফ্রন্টরোল দিয়ে দাও দেখি :grr:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ধন্যবাদ ভাইয়া, কিন্তু কলেজের অবস্থানকাল প্রোফাইল থেকে চেঞ্জ করতে পারছিনা 🙁 নতুন আসলাম ত,বুঝতে পারছিনা 🙁
ইয়েস,পেরেছি 😀
অসাধারণ ! ভালো লাগলো ! যদিও ক্যাডেট কলেজের কেউ না আমি তাও এই ব্লগের লেখাগুলি ফলো করি। অনেকদিন পরে একটা ভালো লেখা পড়লাম
😛 😛
:clap: :boss:
সুন্দর লেখা,আরও লিখতে থাক আরো সুন্দর করে
ফ্রন্ট্রোল শুরু কর নাই ক্যান?আকাশদা দেখার আগে ২০টা লাগাউ কুইক :grr:
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
দিবস ভাই, লাগিয়েছি ফ্রন্ট্র রোল 😀 😀 এবং সবাইকে ধন্যবাদ
ভাল হয়েছে দোস্ত 🙂 কিপ ইট আপ :thumbup:
ধন্যবাদ বন্ধু B-)
ফেসবুকে আগেই পড়ে ফেলছি। ভালো ছিল।
:clap:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
লেখাটা খুব ভাল লাগলো। ম্যাচিউর আর বলিষ্ঠ প্রকাশ। লেখতে থাকো...
ধন্যবাদ রকিব ভাই এবং শহীদ ভাই 🙂 🙂
শুভ ব্লগিং। এখন কুইক ফন্ট্রল লাগাও ২০ টা।
চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।
😀 😀 😀 😀 দিয়েছি
ভালো হয়েছে...
যেমন আছি, তেমনই ভালো।