মানুষের প্রাচীনতম ধর্মীয় অনুভুতি গুলো প্রথমত উৎপন্ন হয়েছিল একধরনের ভীতি থেকে। প্রথম যে মানব সমাজে অলৌকিকতার ধারনা এসেছিল তা সম্ভবত প্রকৃতিকে বুঝতে অক্ষমতার কারনেই। প্রাচীন সমাজে ধর্মমত গুলো প্রধানত ছিল যাদু নির্ভর। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে না বুঝতে পেরে সেগুলোকেই উপাসনা শুরু করে প্রস্তর যুগের মানুষ। এ উপাসনা কিন্তু সম্পূর্ন পার্থিব কারনেই হত। প্রাথমিক উপাসনা সম্ভবত ছিল ঝড় বন্যা বজ্রপাত হতে বাচার জন্যে। সেজন্যেই আমরা দেখতে পাই প্রতিটি প্রাকৃতিক শক্তিকে উপাসনা করার ব্যাপারটি। সমাজ যখন আরো জটিল এবং কাঠামোবদ্ধ হয়ে এল তখন মানুষের মৌলিক চাহিদার বাইরেও অন্যান্য চাহিদা তৈরী হল। যার ফলে উপাসনার অনুষঙ্গও বাড়লো। শিকারে যাবার আগে শিকারের দেবতার উপাসনা বা মাছ ধরেতে যাবার আগে পানির দেবতার প্রতি উপাসনা সেগুলোই নির্দেশ করে।
প্রকৃতির কাছে উপাসনার সময়ই মানুষ আবিষ্কার করে প্রাচীনতম ধর্মীয় বোধ। পুরস্কার এবং তিরস্কার বা শাস্তি। কয়েকটি ধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্মই দাড়িয়ে আছে পুরস্কার এবং তিরস্কারের এই কাঠামোর উপর। তবে প্রাচীন সমাজে এই পুরস্কার বা তিরস্কারের ব্যাপারগুলো ছিল হাতে হাতে ফল পাবার মত। অর্থাৎ যখন পুরস্কার বা তিরস্কার হিসেবে চলতি জীবনের কোন অনুষঙ্গই উঠে আসত। হয়ত বাচ্চা হওয়ার জন্যে অথবা বেশী ফলনের জন্যে। খরায় ফসল জ্বলে গেলে সেটাকে ইন্টারপ্রেট করা হত দেবতাদের রোষ হিসেবে।
প্রাথমিক ধর্মগুলো তাই প্রকৃতিবাদী ছিল। এবং পুরস্কার বা তিরস্কারও সীমাবদ্ধ ছিল পৃথিবীর জীবনের মাঝেই। এই ব্যাপারগুলো পরিচালনার জন্যে শ্রমবিভাগ ঠিক কখন তৈরী হয়েছিল জানা যায় না। তবে পুরুহিততন্ত্র যে অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান এটা নিশ্চিত হওয়া যায়। পুরোহিতরা তাদের নিয়ন্ত্রন বজায় রাখার জন্যেই ধর্মবোধে নতুন রহস্যের আমদানি করে। তাদের হাতে ধর্মবোধের নিয়ন্ত্রন চলে যাওয়ায় একই সাথে তারা হয়ে উঠে রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। আমরা দেখতে পাই কৃষিভিত্তিক সমাজে গ্রামগুলোতে গ্রাম্যপ্রধান দের সাথেই গুরুত্বের সাথে অবস্থান করতে পুরুহিত দের। প্রাচীন সমাজ গুলোতে গ্রাম্য প্রধান সাধারনত ন্যাচারাল লিডার বা অধিকতর সক্ষম মানুষেরাই হত। কিন্তু ক্ষমতার ভাগাভাগিতে যখন পুরুহিতরা ফ্যাক্টর হয়ে উঠল তখনই বোধহয় মানুষের মাঝে প্রথম “আনডিফাইন্ড” কোয়ালিটির মানুষরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়া শুরু করেছিল। যে ঐতিহ্য আমরা এখনও বহন করে চলেছি।
সমাজের জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের চাহিদা এবং সে অনুসারে না পাওয়ার ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। মানুষ পুজার ফলে প্রতিশ্রুত পুরস্কার না পাওয়ার ক্ষোভ যখন পুরুহিতদের সিংহাসন টালমাটাল করে দিল তখনই সম্ভবত জন্ম নেয় মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ন ধারনা। পুরুহিতরা বুঝতে পেরেছিল নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্যে মানুষকে তৃপ্ত রাখাও জরুরী। যখন পার্থিব চাহিদা পুরনে দেবতারা ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছিল তখন বাধ্য হয়েই পুরুহিত দের খুজতে হয় জনসাধারনকে তৃপ্ত করার নতুন উপায়। মৃত্যুর পরের জীবনের ধারনা জন্মায়। পুরস্কারের সংজ্ঞা তাই পার্থিব থেকে সরে গিয়ে পরলৌকিক হয়ে উঠে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বর্গ নরকের আলাদা সংজ্ঞা তৈরী হয় নি বলেই মনে হয়। মৃত্যুর পরের জীবনটাকে পার্থিব জীবনের আদলেই ডিজাইন করে পুরুহিতরা। সেখানে পুরস্কার আর শাস্তির তালিকা তাই তৈরী হয় পার্থিব ইন্দ্রীয় সুখ এবং কষ্ট কে ঘিরেই। সেখানে আমরা দেখতে পাই ক্ষুধা, পান, নারী সঙ্গের বর্ননা। আর শাস্তি হিসেবেও আগুন কেই বেছে নেয়া হয় যা চিরকাল মানুষের ভয়ের কারন।
এই প্রকৃতিবাদী ধর্মবোধ থেকে একেশ্বরবাদীতায় উত্তরন হয়েছে কোন দার্শনিক উৎকর্ষের জন্যে নয়। বরং আমরা দেখতে পাই গ্রীক মেধাবীরা বহু ঈশ্বরেই বিশ্বাস করতে। অন্যদিকে একেশ্বর বাদী হিব্রু সভ্যতার(যদিও মোজেস এর সময় বা তার পরবর্তী ডেভিড ,সলোমনের সময় হিব্রু ধর্ম পুরোপুরি একেশ্বর বাদী ছিল না। জিহোভা ছাড়াও আরো কিছু মাইনর দেবতার পুজা হত) কিন্তু সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানের অবদান শূন্যের কোঠায়। একেশ্বর বাদ প্রধানত বিবর্তিত হয়েছে রাজনৈতিক কারনেই। পুরোহিতরা সবসময়ই সম্রাটদের তোষামোদী করত, আবার সম্রাটরাও পুরোহিত দের রয়েসয়ে চলত। সম্রাটের শক্তির প্রমান হিসেবেই পুরোহিতরা ঘোষনা করত কোন দেবতার সুপিরিয়রিটি। একযুগের দেবতা তাই অন্যযুগে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ত। এভাবেই ক্রমাগত রাজনৈতিক শক্তির চালিকা হিসেবে পুরুহিত তন্ত্রই একদেবতার ধারনা নিয়ে আসে।
মানুষের মৌলিক নীতিবোধের সাথে স্বর্গ নরক কতটা কম্পাটিবল তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে নরকের ধারনা আমি কোনভাবেই নৈতিক বলতে পারি না। অনন্ত শাস্তির ধারনা অসুস্থ ধারনা। বারট্রান্ড রাসেল জেসাসের নৈতিক চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কারন তিনি নরকে বিশ্বাস করতেন। আর নৈতিক বিষয়গুলোর বিকাশ এভাবে ভয় বা লোভ থেকে আসুক সেটাকে গ্রহনযোগ্য ভাবা যায় না। লোভ জিনিসটাই একটা কালো অনুভুতি। তাই সুস্থ নৈতিকতা লোভের মাধ্যমে মোটিভেটেড হওয়া উচিত নয়। আর ভয়ও একটি নৈতিকভাবে দুর্বল মোটিভেশন। পুরস্কার বা শাস্তি নয়, মানুষের মনে প্রয়োজন মানবতার মোটিভেশন। আমার সামনে বিপদগ্রস্ত মানুষ থাকলে তাকে আমি সাহায্য করব, এটার মোটিভেশন চিরায়ত মানবতাই হওয়া উচিত।
মানুষের ইতিহাসে অসংখ্য বর্বর অধ্যায় আমরা পার করে এসেছি। রোমান কলিসিয়াম থেকে শুরু করে ক্রুসেড, উইচ হান্ট, ভিন্ন মতালম্বীদের পুড়িয়ে মারা, জোসেফ স্ট্যালিন, এডলফ হিটলার, হেনরী ট্রুম্যান, বেন্জামিন নেতানিয়াহু,জুলফিকার আলী ভুট্টো, গোলাম আজম, জর্জ ডব্লিউ বুশ, সাদ্দাম, বলে শেষ করা যাবে না এত অমানবিকতার ইতিহাস। মানব সমাজের ইতিহাসে আমরা ক্রমাগত উদাহরন তৈরী করেছি নৃশংসতার, রক্তের আর মানবতার বিরোধী যুদ্ধের। কিন্তু তারপরও টিকে আছি আমরা। নতুন শিশুরা আসছে, তারা হাসছে কাদছে। এখনও পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে আনন্দাশ্রু। মানুষ টিকে থাকবে। তবে কোন প্রযুক্তি, মহান জ্ঞান, অসংখ্য ঈশ্বর, স্বর্গ নরকের হাইপোথিসিসের জন্যে নয়, মানুষ টিকে থাকবে মানুষের মনে থাকা নি:শর্ত মানবতার জন্যে। প্রতি যুগেই অন্তত কিছু মানুষ এই নি:শর্ত মানবতাকে রক্ষা করেছে, আগলে রেখেছে। এই যুগেও রাখবে। আর পৃথিবীতে টিকে থাকবে আনন্দাশ্রু।
শক্ত পোষ্ট ... আগে যাই দাঁত মাইজা আসি ... 😀
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥
😀 😀 😀
------------------------------------------------------------------
কামলা খেটে যাই
জন্যঃ মাইজা
পড়ুনঃ মেছ-ওয়াক-থু কইরা
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥
শেষ প্যারাটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে। :thumbup:
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
আগে কি কোথাও পড়েছি? অন্য কোথাও লেখালেখি কর নাকি? কেন জানি মনে হচ্ছে, এর আগেও এটি পড়েছি 😀
তবে ব্যাপার্স্না, সিরিজের অন্য দুই পর্বে বলিনি, এখানে বলছি। তোমার লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। চিন্তার সাবলীল প্রকাশ আকর্ষনীয়।
এরকম দারুণ আরো লেখার প্রত্যাশা রইলো।
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
কাইয়ুমও কি হোসেনের মতো সামুতে ঢু মারো নাকি??
হোসেন, ভালো লাগছে, সহজ-সরলভাবে সবার বোধগম্য ভাষায় ঈশ্বরচিন্তা নিয়ে ধারাবাহিক লেখা। অব্যাহত রাখো। :thumbup:
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
তাই হয়েছে হয়তো লাবলু ভাই 🙂 বোধহয় ওখানেই দেখেছি।
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
ধন্যবাদ ভাই।
------------------------------------------------------------------
কামলা খেটে যাই
সামুতে লিখছিলাম। ঐখানে পড়ে থাকতে পারেন।
আর প্রশংশা শুইনা :shy: :shy:
------------------------------------------------------------------
কামলা খেটে যাই
একেশ্বরবাদকে আমি অভিহিতি করবো রাজনৈতিক একটি অন্যতম সুচতুর ভন্ডামো হিসেবে। মানেটা অনেকটা এরকম যে, সুপারম্যানবাদকে একটি অদর্শ জীবনব্যাবস্থা বানাতে চাইলে সুপারম্যানকে অদৃশ্য করে দেও। এর ফলে লাভ হচ্ছে হলো-সুপারম্যানের পক্ষে কেউ কোন প্রমান চাইতে আসলে তার চাওয়া হেসেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে।
চমৎকার বলেছো।
এটাই হোক আমাদের সবার কামনা।
মানুষ শিখুক মানুষ কে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে, এটাই আমি চাই।
------------------------------------------------------------------
কামলা খেটে যাই
নিজস্ব চিন্তার প্রকাশ হিসেবে চমৎকার। কিন্তু বৌদ্ধিক স্টাডি হিসেবে আরও রেফারেন্স ভিত্তিক হলে ভালো হতো। বহুত্ববাদ থেকে একেশ্বরবাদ এ রূপান্তরের কোন থিওরি এখন সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সেটা নিশ্চিত না। কোন রেফারেন্স ধরে আগালে মনে হয় আরও ভালো হতো।
কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তোর চিন্তাভাবনাগুলো বেশ ভাল লেগেছে।
একেশ্বরবাদ নিয়ে কিন্তু দর্শনেও কিছু গবেষণা হয়েছে। যেমন স্পিনোজা-র "এথিক্স" বইটা নিয়ে আলোচনা করা যায়। এই বইয়েই মনে হয় প্রথমবারের মত ঈশ্বরের ধারণাটাকে দর্শনবন্দী করার সুসংগঠিত চেষ্টা করা হয়েছিল।
চালিয়ে যা... ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে আমিও কিছু পড়াশোনা করছি। মূলত নৃবিজ্ঞানের মাধ্যমে। মাহমুদ ভাই এ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স এর যোগান দিয়েছিলেন।
দোস্ত এটা গবেষনাধর্মী লেখা না। এটা আমার নিজস্ব বোধ থেকে লেখা। এজন্যেই প্রচুর "হয়ত/সম্ভবত" দেখেতে পাবি। তবে এই দিকে পড়াশুনা বেশী নাই। আমার দার্শনিক দের মধ্যে যাদের লেখা ঘাটাঘাটি করার সুযোগ হয়েছে তারা ঈশ্বর সম্পর্কে দার্শনিক ধারনা নিয়ে তেমন আলোচনা করেন নাই। রাসেল ও বারবার ধর্মের দিকেই চলে গেছেন, ধর্মের বিবর্তনের চেয়ে সম্ভবত মানুষের বৌদ্ধিক উৎকর্ষ, সমাজের প্রেক্ষাপট তার কাছে বেশী আকর্ষনীয় ছিল। যতদুর পড়েছি কার্ল পপারেও একই স্বভাব। তিনিও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে বেশী আগ্রহী ছিলেন। আর ফ্রয়েড তো অন্যজগতের জিনিস।
তবে আমার আগ্রহ আছে। চেষ্টা করব পড়তে।
------------------------------------------------------------------
কামলা খেটে যাই
তোর নিজস্ব চিন্তাভাবনাও কিন্তু খুব ভাল লেগেছে।
:thumbup:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
সহমত।
ধন্যবাদ
------------------------------------------------------------------
কামলা খেটে যাই