অনেক দিন আগের কথা। ১৯৭৭ সাল। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। আমার পর আরও এক ভাই ও দু’বোন। আমরা সবাই ছোট্ট শিশু তখন। ঈদ এলে আনন্দই ছিল অন্যরকম। বিশেষ করে ঈদের কাপড়। নতুন কাপড় পরার আশা আমাদের সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। পাড়ার সব ছোট ছেলে-মেয়ের জন্য তাদের বাবা-মা রোজার সময়ই নতুন কাপড় কিনে আনতেন। বড়রা আমাদের জন্য কাপড় কিনছেন বা দর্জির কাছে তৈরি করাতে দিচ্ছেন, আর আমাদের মধ্যে আনন্দের নদী বয়ে যাচ্ছে। যে দিন কেনা হচ্ছে বা যে দিন দর্জির কাছে মাপ দিতে যাচ্ছি সেই দিনগুলোই আমাদের কাছে ছিল ঈদের সমান।
আমার বাবা ছিলেন ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক। সে’বছর বাবার অর্থে টান পড়লো। আমার তিন ভাই-বোনকে কাপড় দিতে পারলেন, কিন্তু আমার জন্য নতুন কিছু কেনার অর্থ তার কাছে ছিল না। তিনি আমায় এসে বললেন, ‘আব্বু, তোমার জন্যে তো নতুন কিছু কেনার পয়সা আমার কাছে নেই; তোমার ছোট ভাই-বোনকে দিতে গিয়েই সব শেষ; আমার খুব খারাপ লাগছে; কী করি বুঝতে পারছি না’।
বাবার সেই মুখটি আজও আমার মনে ভাসে। আমি বললাম, ‘কোনও অসুবিধা নেই; আমার যে নতুন স্কুল-ড্রেসটা বানানো হয়েছে আমি সেটাই ঈদের দিন পরবো; ওটাতো এখনো পরিনি।’
বাবা-মাও বিশ্বাস করতে পারেননি আমি একথা বলবো। তাদের সুখী চেহারা আমার ভালো লেগেছিল। আমি স্কুলের ইউনিফর্ম পরেই সেবার ঈদে করেছিলাম।
এ ছিল আমার জীবনের দ্বিতীয় ঘটনা যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের জীবনের অর্থের প্রয়োজনীয়তা। এর আগে বুঝেছিলাম ১৯৭৪ সালে যখন জনপদে খাবারের অভাব। সদ্য-স্বাধীন দেশ চেষ্টা করছে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে। আমাদের স্বাধীনতা যে সব রাষ্ট্র মেনে নিতে পারেনি, তারা খাবার রফতানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশে খাবারের আকাল। মানুষের সব অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছে খাবার কিনতে। অর্থ থাকলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। নেই! তো মানুষ কিনবে কোথা থেকে? আমার বাবা-মাকে দেখতাম তারা রুটি খাচ্ছেন এবং তাদের সন্তানদের জন্য ভাতের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। মা’র কাছে জানতে চেয়েছিলাম এর কারণ। মা বুঝিয়ে বলেছিলেন।
ঈদের জামার ঘটনা শুধু আমার একার গল্প নয়। কোটি মানুষের গল্প। কোটি খানেক মানুষ আমাদের আশেপাশেই খুঁজে পাওয়া যাবে যাদের ছেলেবেলায় কাপড়ের অভাব ছিল। তারা সে অভাব এখন হয়তো কাটিয়ে উঠেছেন, বাংলাদেশ তৈরি পোষাকে বিখ্যাত হয়েছে, বঙ্গবাজারের মতো বাজারের জন্ম হয়েছে, তারপরও কি আমাদের আশেপাশের মানুষের কাপড়ের অভাব মিটেছে? হ্যাঁ, ঈদ এলে আমরা সবাই আমাদের বাসা-বাড়িতে যে মানুষগুলো কাজ করেন, আমাদের অভাবি আত্মীয়, এতিমখানায় যে যার মতো অর্থ ও কাপড় দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু তাতে কি সবার অভাব মেটে? তারপরও কাপড়বিহীন কোটি মানুষ সমাজে রয়ে যায়, আমাদের আশে-পাশেই ঘুরে বেড়ায়।
আমার একটি স্বপ্ন আছে ঈদের কাপড় নিয়ে। সমাজের সামর্থবান মানুষেরা খুব সহজেই পারে সামর্থহীন কাপড়-বিহীন মানুষের জন্য ঈদে নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিতে। বাংলাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক উন্নতি করেছে। অনেক দেশি-বিদেশি কোম্পানি এখন বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। তারাই পারে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে। সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপন দেখে বেশ ভালো লেগেছে। একটি টেলিফোন হ্যান্ডসেট কোম্পানি বলেছে তাদের একটি হ্যান্ডসেট কিনলেই তারা তার মুনাফা থেকে একটি অংশ ব্যয় করবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের কাপড় ও বই-খাতা কিনে দিতে। কয়েক বছর আগেও এমন একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। একটি মোবাইল টেলিফোন কোম্পানি ঈদের সময় একটি পণ্য বাজারে এনে বলেছিল তাদের সেই পণ্য কিনলে সেই রাজস্ব থেকে একটি অংশ দিয়ে কাপড়-বিহীন শিশুদের পাঞ্জাবি কিনে দেবে। দিয়েওছিল।
ঈদের সময় এমন উদ্যোগ যদি পঞ্চাশটি কোম্পানি মিলে নিতে পারে তাহলে চিন্তা করুন আমাদের সমাজে কী ঘটতে পারে! প্রায় সবগুলো কোম্পানিই এখন সামাজিক দ্বাবদ্ধতার জন্য অর্থ খরচ করে। দান করার প্রয়োজন নেই; তারা তাদের পণ্যের সাথে, ব্যবসার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তারা এ উদ্যোগ নিতে পারেন। বিমা কোম্পানি নতুন বিমা-পণ্য বাজারে এনে বলতে পারে এ মাসে যত বিমা করা হবে প্রতি বিমা থেকে একটি অংশ দিয়ে তারা শিশুদের জন্য কাপড় কিনবেন। ব্যাঙ্কগুলো বলতে পারে এ মাসে যত এলসি খোলা হবে তা থেকে অর্থ বরাদ্দ করে তারা সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ঈদের কাপড় কিনবেন। এমন অনেক খাত রয়েছে যেমন সিমেন্ট, ওষুধ, খাদ্য, চামড়া, তৈরি পোষাক – আরো অনেক। সবাই মিলে যদি ঈদের কাপড় কিনে সমাজে বিলিয়ে দেয়, তাহলে আর কাপড়ের অভাব থাকার কথা নয়। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের নাম সারা বিশ্বে জ্বলজ্বল করবে।
এই কোম্পানিগুলোই রোজার মাসে তাদের সরকারি-বেসরকারি স্টেক-হোল্ডারদের জন্য অনেক অর্থ খরচ করে ইফতার পার্টির আয়োজন করেন। বড়-বড় পার্টি। স্থান ভাড়া করতেও অনেক অর্থ খরচ হয়। সবাই মিলে কত খরচ করেন তার সঠিক কোনও হিসেব না থাকলেও আন্দাজ করা যায় – অনেক। একবারতো এই স্টেইকহোল্ডারগণ নিজেরাই কোম্পানিগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন যে তারা ইফতার পার্টির জন্য অর্থ খরচ না করে যেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে ঈদের কাপড় কিনে দেয়। চিন্তা করুন কোম্পানিগুলো যদি তাই করে তাহলে কি ঘটতে পারে। সারা দেশে একটি ‘কাপড় আন্দোলন’ শুরু হয়ে যেতে পারে।
আমরা বিশ্বে অনেক আন্দোলন দেখেছি – আইস বাকেট ও রাইস বাকেট আন্দোলন। আমাদের দেশে ‘নতুন কাপড়’ আন্দোলন আমরাই ঘটাতে পারি, কাপড়ের অভাব দূর করে দিতে পারি।
রাজনৈতিক দলগুলো এ কাজ আরো ভালো পারবে। ভাবুনতো একবার – ছাত্রলীগকে যদি রোজার মাস ‘নতুন কাপড়’ আন্দোলন করতে বলা হয় এবং কৌশল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাহলে কী হতে পারে! প্রধানমন্ত্রী যদি একটি ডাক দেন প্রবাসি বাংলাদেশিদের প্রতি, তাহলে কী হতে পারে! বাংলাদেশের সবাই মিলে এক মাস ‘নতুন কাপড়’ আন্দোলন করলে আর কি দেশে কাপড়ের অভাব থাকবে? নতুন কাপড় নেই এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমার এ স্বপ্ন হয়তো স্বপ্নই রয়ে যাবে, তবে প্রকাশ করতে অসুবিধে কি?
http://www.banglatribune.com/columns/opinion/216477/%E2%80%98%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%9C%E2%80%99-%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%A8-%E0%A6%B6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%81-%E0%A6%B9%E0%A7%8B%E0%A6%95
পোষাক হলো নেসেসিটি।
নেসেসিটি পুরনের জন্য আন্দোলন করাটা ঠিক আছে।
কিন্তু মানুষ পোষাক বিহীন আছে, নেসেসিটি পুরন হচ্ছে না, এমন কিন্তু না।
ঈদে বা অন্যসময়ে "নতুন কাপড়" পরাটা নেসেসিটি না। সৌখিনতা।
এধরনের সৌখিনতার জন্য আন্দোলন করার ফল ভাল হয় না।
অর্জনের চেয়ে মিস ইউজ বেশী হয়।
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
পয়েন্ট
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য