কল আসল নাকি এলার্ম বাজল।
ঘুমটা ভাঙ্গার পর এই প্রশ্নটাই প্রথমে মাথায় এলো।
এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙার রেকর্ড খুবই কম। অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে গেছে এর মধ্যে। একবার ফোন অনেক দূরে রেখেছিলাম। হয়ত এলার্ম বন্ধ করার জন্য বিছানা থেকে উঠা লাগবে। এতেও যদি একটু ঘুমটা ভাঙ্গে। কিন্তু বিধিবাম! সাউন্ডই শুনতে পেলামনা। অন্যান্য দিনের চেয়েও দেরীতে উঠতে হয়েছে সেদিন।
আরেকবার ফোনটাকে সাউন্ডবক্সের সাথে কানেক্ট করে ঘুমালাম। ভাবলাম- এইবার ঠেকায় কে? খুব নিশ্চিন্তে ঘুম দিতে গেলাম। ঘুমের মধ্যে মনে হয় ভাবাও শুরু করলাম কীভাবে এলার্মের সাউন্ডে আমার ঘুম ভাঙবে। ঘুমটা এসেও গেছে। তখনই পুরো বাড়ি কাপিয়ে শব্দ হল। তাড়াহুড়ো করে উঠে গেলাম। বাইরে দেখি গাঢ় অন্ধকার। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি এক ফ্রেন্ডের ফোন। সাউন্ড বক্সের প্লাগটা খুলে ফোন রিসিভ করলাম। অপরপ্রান্ত থেকে আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করল- দোস্ত ভাল হেডফোন কই পাওয়া যাবে? একটা হেডফোন কিনব। আমি মাথার উপরে ঘড়িটার দিকে তাকালাম। দেখি রাত ৩টা বাজে। বন্ধুটাকে যে গালি দিব, তার ইচ্ছাশক্তিও হারিয়ে ফেললাম। শুধু এইটুকুই বললাম- রাত তিনটা বাজে। তার উত্তর- তাইলে সকালে ফোন দিবনে।
সেদিনের পর ওই পদ্ধতি আর রিপিট করিনাই। বন্ধুটার ব্যপারে আর কিছু বললাম না। পৃথিবীতে কিছু মানুষকে আল্লাহ পাঠান মানুষকে বিরক্ত করার জন্য। এই বন্ধুটা তাদের দলভুক্ত। সেদিন রাতে সে যা করেছিল- এটা নতুন কিছু ছিলনা। এর আগেও এরকম কাজ সে করেছে। একবার বাসে করে যাচ্ছিলাম। ফোন বেজে উঠল। দাঁড়িয়ে আছি- তাই ধরলাম না। আবার ও ফোন। এবার তাকিয়ে দেখি ওই ফ্রেন্ডের নাম্বার। ভাবলাম একটু পর নেমেই ফোন দিব। তাই ধরলাম না। কিন্তু আবারও ফোন এল। এভাবে তিন চারবার ফোন আসার পর আমি ভাবলাম জরুরী কল হয়ত। ধরে দেখি। ফোন ধরেই জিজ্ঞেস করলাম- কী হইছে, কোন important কিছু? বন্ধুর উত্তর- দোস্ত হেডফোন কিনছিলাম তো, তাই কল দিয়ে দেখলাম যে হেডফোন কাজ করে কিনা। আমি থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম।
চোখ খুলতে ইচ্ছা করছেনা। মনে হচ্ছে ঘুম ভালমতন হয়নাই। আরেকটু ঘুমানো দরকার মনে হয়। কিন্তু শব্দটা কিসের তা বুঝতে পারছিনা। গতকাল রাতে কেন যেন মনে হল, রাতে ঘুমানোর সময় এলার্ম শুনে ঘুম না ভাঙ্গলেও মাঝে মাঝে রিংটোনের সাউন্ডে ঠিকই ঘুম ভাঙ্গে। তাই রিংটোনকেই এলার্ম টোন হিসেবে সেট করলাম। এখানেই সমস্যার শুরু। এখন ধরতে পারছিনা এটা কিসের সাউন্ড। যদি কল আসে ভুলেও সুন্দর ঘুমটা ভেঙ্গে তা ধরা যাবেনা। অনেক সুন্দর একটা ঘুম হচ্ছে। একটা কল ধরে তা ভাঙ্গা অন্যায়। কিন্তু যদি এলার্ম হয়, তাহলে ঘুম থেকে উঠতে হবে। জরুরী একটা কাজ আছে। ১০টার মধ্যে একটা জায়গায় থাকতে হবে। নতুবা অনেক বড় বড় মহাকাব্য অশুদ্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। ভুলেও সেটা হতে দেয়া যাবেনা। ওই মহাকাব্যের লেখকরা ক্ষেপে যেতে পারেন। পরে কী না কী করে বসেন। দেখা যাবে রাস্তার পাশে না খেয়ে অনশন ধর্মঘট ডেকে বসবেন। পরে তাদের অনশন ভাঙ্গাতে জুস কিনে নিয়ে যেয়ে তাদের খাওইয়াতে হবে আর পা ধরে মাফ চাইতে হবে। ওই যন্ত্রণার পথে যাওয়া যাবেনা।
ভালই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পরে গেলাম। কোনভাবেই চোখ খোলা যাচ্ছেনা। শরীর বোঝাতে চাচ্ছে যে আমার ঘুম অনেক প্রয়োজন। যে শব্দ হচ্ছে তা এলার্ম না রিংটোন- এত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন নয়। ওইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সুন্দর একটা ঘুম দেয়াই আমার কাজ। কল আসলে যে কল দিয়েছেন সে ভাববে আমি ঘুমাচ্ছি। আর এলার্ম হলে তা নিজ দায়িত্বে বন্ধ হয়ে যাবে। এ নিয়ে এতো ভাবার কিছু নেই। শরীরই আমাকে নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে সময়মত জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু শরীরকে বিশ্বাস করা যে অনেক কঠিন। এর আগেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে আমাকে জাগিয়ে তুলেনি।
আচ্ছা, আমি মরে যাইনি তো। চোখ খুলতে পারছিনা যে। নাকি চোখ খুলেছি কিন্তু কিছু দেখতে পারছিনা। পার্থিব জগতে কী হচ্ছে সব টের পাচ্ছি- কিন্তু আমি নিজেই সেই জগতে নেই। আমি কালের গহবরে হারিয়ে যাচ্ছি- আস্তে আস্তে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ বাকি ছিল। কিছু মানুষকে কিছু কথা বলার ছিল- যা তাদের অবশ্যই অবশ্যই বলে যেতে হত। মানুষগুলোর জন্য সে কথাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। সকালে যে কাজটা ছিল- ওইটাও অনেক important ছিল। এখন কী হবে? এভাবে চলে যেতে চাইনি আমি। একটা শান্তির পরশ নিয়ে যেতে চেয়েছি। যেন যাবার আগে মনে না হয়, কিছু ফেলে রেখে গেছি।
অনেক কষ্টে চোখটা খুললাম। নাহ, মরিনি। এখনো বেচে আছি। আশেপাশের আলোর সাথে চোখ অভ্যস্ত হতে পারেনি। তাই কিছু দেখতে পারছিনা। ডান হাতটা দিয়ে বালিশের কাছে হাতড়ে ফোনটাকে খুজে বের করতে চাইলাম। হাতের ধাক্কায় ফোনটা নিচে পড়ে গেল। নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, No, not again!