চারিদিকে কেউ নেই। বাতাসের মন মাতাল। সবুজ পাতায় ভালোলাগার ভ্রমরগুঞ্জন। দূরে মিশে যাওয়া মেঠো পথটি বামে যেখানে বাঁক নিয়েছে, একটা বাঁশঝাড় ওখানে। যত্ন করে ছাটা। বুঝাই যায়। ছনে ছাওয়া একটা গ্রাম্য চায়ের দোকান। এই ভরদুপুর বেলায় দোকান বন্ধ। এখন পাতাঝরার দিন। ঝরছে.. অবিরাম।
লম্বা বেঞ্চটাতে বসে আছে মেয়েটি। পাতায় পাতায় সবুজে ছায়া যুবতীর শরীর বেয়ে যৌবন উপচে পড়ছে যেন!
দূর থেকে মোড় ঘুরবার সময়ে চোখে এমনই লাগলো। পায়ে পায়ে পথ ফুরালো। কাছে এসে পাশ কাটানোর সময়ে বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ! পা থমকে গেল। তাকিয়ে কোথাও ফুল দেখতে পেলাম না। এক নারী। সবুজ ফুল। দৃষ্টির কোমলতা এনে ফুটে আছে। বাতাসে শিউলির ভেসে ভেসে যাওয়া। তাকাতেই লজ্জাবতীর নুয়ে পড়া অভিবাদনেই কি কেঁপে উঠে চোখের তারা? আমাকে ও কি একটু কাঁপায়?
অল্প কথায় পরিচয় জানতে চায় এক গাঁয়ের মেয়ে। জানাই। পাশে বসি বেঞ্চে। বড্ড সাবলীল তার আচরণ। কেন জানি দেখতে ইচ্ছে করে। দেখি ও। একটু একটু করে। সে বুঝে। অনুভব করে কি? আমার ভাবনা।
গাঁয়ের মেয়েরা কি পথিকের মন পড়তে পারে? শহরের মেয়েরা শুনেছি পড়ায় দক্ষ। সে তুলনায় গাঁয়ের মেয়ের দৌড় কতদূর?
দুজনে যখন একই পথে চলা শুরু করি, আমি তার থেকে একটু এগিয়ে। তবুও পাশাপাশি। ওদের বাড়ির দিকেই আমার গন্তব্য। তাই কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে এলো। ভদ্রতা? সে তো মানুষের কাজ। শহুরে ধারায় নাগরিক ভদ্রতা!
মেয়েটি স্বাস্থ্যবতী। হৃদয়বতী ও কি? ভেবেই একটু হাসি। একটু বুঝি জোর প্রকাশ ছিল তাতে। সে তাকায়। আমাকে দেখে একপলক। কেন হাসছি জানতে চায়। হাঁটে সামনে তাকিয়ে। গতি কমে না চলার। দুজনেরই। বলি-
‘ তুমি হৃদয়বতী কিনা ভাবছিলাম।’
এবারে আমার দিকে একটু ফিরে তাকায় যুবতী। জিজ্ঞেস করে,
– আমার খালি পা দেখেই কি তুমি বললেন? নাকি গাঁয়ের মেয়ে আমি, তাই?
থেমে যাই। চারিদিকে ধুলা উড়ছে। বাতাস আরো ধেয়ে আসছে। উড়ছে মেয়েটির চুল। চোখ ঢেকে যাচ্ছে। তার ভেতরে চোখের কালো আগুন। তাকিয়ে আমার দিকে। কানে ঘাসের ফুল। দুল হয়ে ঝুলছে। নাকেও সবুজ নথ হয়েছে ঘাস ফুল। আলতায় রাংগা খালি পা। বড্ড সুন্দর! একটা সাপ উপর থেকে নেমে এলো ভীষণ বেগে। মেয়ের ওড়না বাতাসের পাক খেয়ে চিকন রশি। সৌন্দর্য এতক্ষণ অবগুন্ঠনে ঢেকে ছিল। মুক্ত হতেই অহংকারি হতে চাইলো। দুর্বিনীত উদ্যত প্রখরতায় নিজের উপস্থিতি দম্ভে ঘোষণা করতে চাইলো। আমি অনুভবটুকু হজম করে সাপের কামড়ে বার বার মরে যেতে থাকলাম।
সে বুঝলো বোধহয়। কিছু একটা ভাবলো। শেষে বলল,
– খালি পায়ে যে মেয়েরা হাঁটে, তারা কেমন হয় আপনি জানেন? আপনাদের শহরের বাবুরা তাদের অন্য নামে ডাকে। জানেন কি ?
আমাকে নিরুত্তর দেখে সে হাসে। ওর হাসি, ভাংগা কাচের শ্রুতিমধুরতায় আমাকে আরো উষ্ণ করে। বোধের অতল থেকে পাপ গুলো বের হয়ে আসতে থাকে। আমাকে ঘিরে ধরার আগেই খালি পায়ের মেয়েটি আমাকেই হেলিয়ে দেয়,
– অচেনা নারী হৃদয়বতী কি না, ভাবাটা আপনার অশোভনীয় মনে হল না?
আমি এবারো উত্তর না দিয়ে হেঁটে চলি। সে ও। পাশাপাশি। আমার ভিতরের সাপগুলি কার্বলিক এসিডের ঘ্রাণে নিস্তেজ হয়েছে যেন! মেয়েটির কথা, না কি সে নিজেই পুরোটা ‘এন্টি ভেনম’ টাইপ হয়ে আমাকে স্থির করালো- জানি না।
ওকে এবার আবার দেখলাম। সে ও আমার দেখাটা দেখল। নিজেকে দেখতে দিলো। তবে দেখালো না। তার চোখের কালো আগুন এবার বেশ নরম। আগের বারের মত প্রখর না।
ওর শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোবাসার ঘ্রাণ। ওর বুক থেকে ভালোবাসা বের হচ্ছে। হৃদয় ছুঁয়ে গেলো আমার!
ওদের বাড়ির সামনে এসে থামলাম দুজনে। ভেতর বাড়ির পথ দেখিয়ে সে পথের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। পথ আগলে? আমি তার দিকে পিঠ ফিরাতেই ডেকে বললো,
– এই যে শুনুন!
আমি ফিরলাম। তার দুটি ঠোঁট কাছে-দূরে অনুভবে কয়েকবার এক হতে দেখলাম। শুনলাম সে বলছে,
– আপনি কি হৃদয়বান?
এবার আমি পথ পেলাম কথা ফিরিয়ে দেবার-
‘ এটা জানতে চাওয়া শোভন হবে কি?’
সে হেসে জবাব দেয়,
– হ্যা! হবে। … এখন আমরা পরিচিত।
সেই ছিল আমাদের প্রথম পরিচয়। সময়ের বুকে কত অসময় গড়িয়েছে। সুসময় পালিয়েছে পথের মোড়ে মোড়ে আমায় একা রেখে। কিন্তু এখনো সে সাথে রয়েছে। অন্যদের মতো ছেড়ে যায় নাই।
এখনো সে পথ না আগলিয়ে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে জানতে চায়,
– তুমি কি এখনো হৃদয়বান?
হৃদয় সকলের আছে। মানুষ হবে হয়ত তাতে। হৃদয়বান হবে কী?
ভালোবাসা নাকি উড়ে উড়ে বেড়ায়, হৃদয়বানদের আকাশের নীলে। যেখানে হৃদয়বতীরা তাদের দু:খগুলিকে ধুয়ে ধুয়ে সুখ বানায়।।
পড়ে ভাল লাগল।
ভালো লাগার সুন্দর অনুভূতি জেনে আমারও ভালো লাগল।
ধন্যবাদ।
নিজের মনের আনন্দে লিখালিখি করি।
:thumbup:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আপনার লিখা অনেক ভালো লাগলো