মেয়েটি হৃদয়বতী ছিল না (চার পর্বের ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-এক )

অফিসের কাজে শাহবাগে আসতে হয়েছিল।
কাজ শেষে কি মনে করে বই মেলার ভিড়ে নিজেকে হারাতে ইচ্ছে হল রেজার। তাই বাংলা একাডেমীর ভিতরে এখন সে। কত মানুষ। নানা রঙের মানুষ। উচ্ছল প্রানবন্ত এক একজনের আনন্দিত মুখগুলোকে দেখছে। নিজেও ভালোলাগার আবেশে ভেসে যাচ্ছে।
কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা হল।
এরা নবীন লেখক। এদের সবার বই বের হয়েছে। ওদের থেকে একটি করে বই কিনলো। খুশী মনেই। বন্ধুরা অনেক খুশী হল। ওদের চেহারায় উপচে পড়া আনন্দকে নিজের আনন্দ মনে হল রেজার। সবসময়ে এমনই ভেবে এসেছে সে।
আচ্ছা, অন্যরাও কি এমনটি ভাবে?
রেজাকে নিয়ে?

বাংলা একাডেমী থেকে বের হয়ে সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গনে একটু ঢু মারতে গেলো। এখানেও অনেক ভিড়। দেশের এই ‘আতংকের’ পরিবেশে এমন আনন্দময় একটি ভিড় রেজাকে অনেক ভালোলাগায় বিবশ করে তোলে।
মেয়েদের সকলে ফুলে আচ্ছাদিত। চকিতে মনে পড়ে যায় ‘আজ তো বসন্তের প্রথম দিন’। তার ওপর আজ শুক্রবার। কিন্তু এই বন্ধের দিনেও রেজাকে কাজ করতে হচ্ছে।
সেও তো কণাকে নিয়ে এই মেলায় আসতে পারত!
একটা গভীর ক্ষুদ্র শ্বাস বের হতে হতেও কেন জানি বের হল না। মাঝপথেই ওটা আটকে গেল।
আজকাল রেজার সাথে এমনই হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস গুলোও কেন জানি বের হবার সঠিক রাস্তা খুঁজে পায় না।

তবে যে হারে মানুষ এসেছে মেলায়, সবার হাতে সেই তুলনায় বই খুব কমই দেখল সে। সবাই স্টলে ঘুরে ঘুরে বই দেখছে… সাথের প্রিয়জনকে নিয়ে সেলফি তুলছে… সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আপলোড করছে… ভাবগম্ভীর কিংবা চটুল আলোচনায় নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখছে। কিন্তু বই কিনছে না। আর কিনলেও এর সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। আসার সময়ে শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় থেকে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে রেজার। এক একজন ফুলের মাল কিনছে ৫০০ কিংবা হাজার টাকা দিয়ে। কিন্তু একশ’ কিংবা আরো কিছু বেশী দিয়ে বই কিনতে তাদের অনীহা।

আর ভালো লাগল না ওর। মাঠের ভিতর দিয়ে শর্টকাট পথ ধরে বাস ধরার জন্য শাহবাগ মোড়ের দিকে আগালো। কয়েককজনকে গোল হয়ে কল্কিতে গাঁজা টানতে দেখল। একপলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। আজকাল এসব কোনো ব্যাপারই না। সবারই ব্যক্তি স্বাধীনতা খুব প্রখর।

কণা কি করছে এখন?
আজ থেকে পনের বছর আগে এমন এক দিনে তাদের প্রথম দেখা। পরিচয়… ভালোলাগা… এরপর ভালোবাসা-প্রণয়।
ভালোবাসা! আসলেই কি ভালোবাসা ছিল?
নিজের দিকে তাকালো রেজা। কি ভাবছে এসব। ভালোবাসা ছিল মানে? ভালোবেসেই তো কণাকে সে বিয়ে করেছিল। আর কণাও কি কম ভালোবেসেছিল! ভালোবাসা গুলো বসন্তের মাতাল হাওয়ায় চড়ে কখনো কাছে কখনো দূরে দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এই গতিকে রোধ করার জন্য কণার অভিভাবকদের তরফ থেকে কত বাঁধাই না এসেছিল।

‘এই ছেলে তোর যোগ্য না’
‘এখন বুঝতে পারছিস না, এক সময় বুঝবি’

সেই সময় কি এসেছে? আর এলেও কণা কি বুঝেছে?
জীবন যাপনের এই কঠিন সময়গুলোতে কণার উপলব্ধি রেজার হৃদায়াকাশে খুব কঠিন ভাবে ধরা দেয়। ভালোলাগাগুলো আজকাল দুজনের কাছে থাকার সময়গুলোতে কেমন নির্জীব মনে হয়।
কাছেই বা কতটুকু সময় থাকা হয়। যে টুকু সময়ও বা পাওয়া যায়, ইটপাথরের নগরজীবনের স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়াগুলোর হিসাব মেলাতেই ‘ফুড়ুৎ’ করে উড়ে যায়।
ফুড়ুৎ!
এই শব্দটা মনে হতেই কেন জানি হেসে ফেলে রেজা। একটু জোরেই বোধহয় হেসে ফেলল। ওকে পাশ কাটানো এক জোড়া ছেলেমেয়ে অবাক হয়ে ওকে দেখল। পরক্ষণে নিজেরাও হেসে নিজের মনে চলে গেলো। ওরা এখন পথে নেমেছে। পথ চলাতেই ওদের আনন্দ। এই আনন্দময় পথে একজন রেজার নিজের মনে হেসে ফেলার মুহুর্তটিও ওদের কাছে আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে।
এমন আনন্দময় সময় তো রেজা এবং কণাও একসময় পার করেছে!
সবই তাহলে সময়ের প্রয়োজন। সময়ের খেলা।

বাসে উঠতে গিয়ে প্রচন্ড হিমশিম খেতে হল। কোনমতে উঠে ভিড়ে চিরে-চ্যাপ্টা হওয়া অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভাবছে অফিসে ফিরে যাবে, নাকি বাসায়। কোনটা বেশী জরুরী?
আজকাল রেজা ভেবে উঠতে পারে না কোনটা বেশী জরুরী।

কণা বাসা থেকে বের হবার সময়ে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিল। বাস থেকে নেমে আগে সেগুলোকে নিতে হবে। ছেলে আরাফাত একটা গেমসের সিডি আনতে বলেছে। ওটাও নিতে হবে। আর মেয়ে? সে আজকাল তেমন বায়না ধরে না। একটু কি বড় হয়ে গেছে সে? একটু বেশী ই? আজকাল বোধহয় বুঝতে শিখেছে… অনুভূতিতে বোধগুলো কি ওকে নাড়া দিয়ে যায়? না হলে বাবার কাছে কিছুই চায় না কেন সে?
জানে বাবা দিতে পারবে না বলে? একটা দামী মোবাইল সেট চেয়েছিল। রেজা দিতে পারেনি। আসলে হিসাবের বাইরে খরচ করার মত সামর্থ এতগুলো বছর পার করে দিয়েও রেজার হয়ে উঠেনি। তাই বলে এভাবে কিছুই চাইবে না সে!!
কণার সাথে থেকে থেকে মেয়েও কি…

বাইরের রোদ্রোজ্জল আকাশ তার উজ্জ্বলতা নিমিষে হারিয়ে ফেললো বসন্তের প্রথম দিনে।এমনটি ই মনে হল রেজার। বুকের গভীর থেকে কেমন ভারী অনুভূতি চাপ চাপ কোষ্টকে টেনে আনতে চাইছে। কি করবে রেজা? ওগুলোর আসার অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে বেদনায় বিদীর্ণ হবে? নাকি জোর করে হাসিমুখ নিয়ে নিজেকে একজন সুখী মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে?

আজ সকালে কণা বলতে পারত,’ আজ না গেলে কি হয় না? আজ চলো বসন্তের প্রথম দিনে সবাই মিলে বের হই।’ কিন্তু সে কি করল? বাজারের একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে নির্বিকার রইলো। কেন এমন করল?
আজকাল এমনই সে।
‘তুমি ও কেন বলতে পারলে না চলো ঘুরে আসি?’
‘তোমার কেন মনে হল না আজ পহেলা ফাল্গুন?’
নিজের কাছ থেকে এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর রেজাকে আরো ম্রিয়মান করে তোলে। আজকাল নিজের কাছের মানুষদের কাছ থেকে এরকম প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত হতে হতে এক বিষাক্ত বলয়ে নিজেকে আবদ্ধ দেখতে পায়। সেখান থেকে বের হবার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত রেজা নিজের কাছ থেকেও আচমকা এমন সব প্রশ্নে দিক হারিয়ে ফেলে। তখন কেমন নির্বোধ হয়ে যায়।

পরিচিত জনদের কাছ থেকে আজকাল দূরে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। সেদিন এক খালাতো ভাই যে আর্মিতে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে আছে। ওর সাথে দেখা। নিজের বিলাসবহুল গাড়ি থামিয়ে হেঁটে চলা রেজার সাথে কথা বলে। কথায় কথায় রেজা এখনো ওর পুরণ চাকুরিতে আছে জেনে দুঃখ প্রকাশ করে। কি লাভ এই ভাবে জীবনকে শেষ করে দেবার ইত্যকার কথা বার্তার এক পর্যায়ে বলে,’আমি রিটায়ার করলে প্রায় এক কোটি টাকা পাবো। তুমি কি পাবে?’
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয়?
হলেও রেজার জানা থাকে না। সে হাসে। স্রাগ করে নিজের পথে চলে যায়।
আজকাল সবকিছুকে হেসে উড়িয়ে দেয়ার এক অদ্ভুদ প্রবণতা রেজার মাঝে প্রকট হয়েছে।
কণা এটাই মানতে পারে না।

রেজা যে শিল্পের সাথে নিজেকে জড়িয়েছে, তার মালিক ওর উপর দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করে যাচ্ছেন। বিনিময়ে রেজাকে যে স্যালারি দিচ্ছেন, তাতে করে কণা এবং ছেলে মেয়ে ক্রমশঃ ওর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু রেজার বস ওকে ভালোবাসেন অত্যধিক। কিন্তু শুধু ভালোবাসায় কি হয়?

আবারো নিজের দিকে তাকায় রেজা। ‘শুধু ভালোবাসায় কি হয়’ কথাটি অন্য এক অর্থ নিয়ে হাজির হয় বাসভর্তি মানুষের ভিড়ে একজন বাবার কাছে। একজন স্বামীর কাছে। রেজা নিজেও তো ওর বসের মত কেবলি ভালোবাসা দিয়ে ওর প্রিয় তিনজনকে কাছে পেতে চায়। কিন্তু শুধু ভালোবাসা দিয়ে আজকাল কি জীবন চলে?
তবে কেন কণাকে ভুল বোঝা? ছেলের বায়না মেয়ের চাহিদা এসব কিছুকে অতিরিক্ত বিলাস কেন মনে হওয়া?

একজন সাদামাটা সৎ জীবন যাপন করছে সে। দুই রুমের ছোট্ট বাসাটায় ভেবেছিল স্বর্গ নেমে আসবে ওর এই স্বাভাবিক জীবনযাপনের স্টাইলে। কণা কি অনেক অপেক্ষা করে নাই? এখনও কি সে করছে না?
তবে কি জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজেকে আমূল বদলে দিলে ভালো হবে? নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবে? নিজের কাছে অনেক নিচুতে নেমে যাওয়া একজন বাবার চেহারা দেখতে কেমন হবে? সেটা কি এখন আয়নায় ওর চেহারার থেকে খারাপ হবে?

জীবন এক একজনকে এক একভাবে যাপন করতে শিখায়। রেজা এভাবে শিখেছে। এর থেকে উত্তরণের পথ ওর জানা নেই। এভাবেই চলবে ওর জীবন।
বাস থেকে নেমে মাথা নিচু করে সামনে হেঁটে চলে সে… আর ভাবে।
কণা ওকে জীবনের মানে শিখিয়েছিল। ভালোলাগায় ভালোবাসায় প্রতিটি মুহুর্ত পাতাঝরার দিনের মৃদুমন্দ বাতাসের বৈতালিক প্রবাহে আবিষ্ট করে তুলেছিল। অনেক বড় ঘরের আদরের মেয়ে হয়েও পরিবারের অমতে ওকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল। কত আশ্বাস… ‘আমার কোনো সমস্যা হবে না… তুমি যেভাবেই রাখবে আমি আনন্দে থাকবো… তোমার সঙ্গ ছাড়া আর কিছুই চাই না আমি…’
তখন কণার জীবনে রেজা ছিল ‘তুমিময়’।
এরপর যখন আমরা হয়ে গেল, কিভাবে জীবন ‘আমিময়’ হয়ে যায়? হৃদয়ের এমন পরিবর্তন কেন হয়? হৃদয়গুলো কি সব সময়ের আবর্তনে পরিবর্তনশীল? জীবন কি শেষ হয়ে গেল? আরো একটু অপেক্ষা করলে কি হয়? সুদিন আসতে কি দেরী হয়?

জীবনের শুরুর দিকের ‘কণা’ নামের যে মেয়েটি রেজাকে ভালোবেসেছিল- ওয়াদা করেছিল সব সময় একই ভাবে থাকবার… আজ সেই মেয়েটি এতোটা তীব্র ভাবে ‘রিয়্যাক্ট’ করবে… হৃদয়ের ওপর থেকে পলেস্তারার মত আস্তরণ সরিয়ে আসল রূপ দেখাবে- রেজা কি কখনো ভেবেছিল!
নিজের হৃদয়ে ওর প্রতি এখনো প্রচণ্ড ভালোবাসা সেই আগের মতই তীব্র ভেবে আনন্দ পায়। পরক্ষণে এক অজানা ব্যথায় অনুভূতির বাইরে গিয়ে দেখতে পায় কণাকে। এবং নিজেকেও।
রেজা হৃদয়বান বলেই ওর ভালোবাসা আজও অটুট রয়েছে।
কিন্তু কণা হৃদয়বতী ছিল না। সে ওকে ভালোবেসেছিল ঠিকই। কিন্তু শীতের অতিথি পাখির মত ছিল সেই অনুভূতি… ওর উপলব্ধিটুকু। যা সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে এসেছে।

‘ ভালোবাসা একটি রাবার ব্যান্ডের মত, যার দুপাশ দুজন ধরে থাকে। যদি কেউ একজন একপাশ ছেড়ে দেয়, তবে অপরজন আঘাত পায়। যাকে আপনি কখনো ভালোবেসেছেন তাকে আঘাত দেয়া আর নিজের সাথে প্রতারনা করা সমান।’ হুমায়ূন আহমেদ এর এই কথাগুলো আজ কেন জানি রেজার মনে হয়। আজ কণা ওর পাশ থেকে সেই ব্যান্ডটি ছেড়ে দিয়েছে। ব্যথা লাগার কথা।
কিন্তু রেজা কোনো ব্যথাই অনুভব করছে না।
একজন হৃদয়বান পুরুষ বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে ওর ভালবাসার মানুষদের দিকে এগিয়ে যায়। এখন আর মাথা নিচু করা নয়। সার্থক ভালোবাসা কখনো কারো মাথা হেঁট হতে দেয় না।।

(ক্রমশঃ)

২ টি মন্তব্য : “মেয়েটি হৃদয়বতী ছিল না (চার পর্বের ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-এক )”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    "একজন হৃদয়বান পুরুষ বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে ওর ভালবাসার মানুষদের দিকে এগিয়ে যায়। এখন আর মাথা নিচু করা নয়। সার্থক ভালোবাসা কখনো কারো মাথা হেঁট হতে দেয় না"
    হুমমমমমমমমম.........
    সেটা বোঝে কজন?????


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।