গল্পের বইয়ের বাকি গল্প

গল্পের বইয়ের গল্প

মীরপুর থেকে রামপুরাতে এসে আমি প্রথম প্রথম খুবই কষ্টে দিন কাটত, কোন বন্ধু নেই, পরিচিত কেউ নেই। তবে কিছুদিন যেতেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। দুটো সার্কেল গড়ে উঠল, একটা এলাকায় আর একটা স্কুলে। এখানে এসে নতুন জিনিষের সাথে পরিচয় হলো, সেটা হলো কমিকস। চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কি, ফ্যান্টম, হি-ম্যান প্রভৃতি ইন্ডিয়ান কমিকস। এগুলো খুব একটা ভাল লাগে নি আমার, তবে হাতে পেলে পড়া হতো। ভাল লেগে ছিল একটা ফুটবল কমিকস, নামটা ঠিক মনে নেই, একটা কিশোরের তারকা ফুটবলার হয়ে উঠার গল্প, অনেকটা গোল মুভির(ইংলিশ) মতো। ৪ কি ৫ টা পর্ব পেয়েছিলাম তারপরের গুলো অনেক খুজেও আর পাই নি 🙁

গল্পের বই থেকে বেশ কিছুদিন দূরেই ছিলাম, মূলত বই সংগ্রহ করতে পারছিলাম না বলে। হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিত এক উৎস পেয়ে গেলাম। আমাদের পাশের ফ্লাটে একজন মাওলানা আসল, তার দুই ছেলে ছিল আমাদের বয়েসি। ওরা মাদ্রাসায় পড়ত তবে বাসাতেই থাকত। প্রথম কিছুদিন ওদের সাথে আমাদের একটু দূরত্বই ছিল। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সেটা চলে যাওয়ার পর আমি অসাধারন দুজন বন্ধু পেলাম। আর পেলাম সেবার বই এর এক বিশাল ভান্ডার। ওদের মাদ্রাসা ছিল সেবার বই এর ডিপো, সেখান থেকে রেগুলার বই সাপ্লাই দিত ওরা। এরপর থেকে আর গল্পের বইয়ের অভাবে পড়তে হয়নি।

এর পরের বছর শুরু হয়ে গেল কলেজ লাইফ। ক্লাস সেভেন এ কোন বই পড়া হয় নি, তবে ছুটিতে বাসায় গিয়ে প্রথম বারের মত প্রকাশ্যে গল্পের বই পড়তে পারলাম।

ক্লাস এইট থেকে কলেজ লাইব্রেরির বই পড়া শুরু হলো, প্রথম বারের মতো সেবার বাইরের বই পড়া শুরু করলাম। হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন সহ প্রায় সবার বই পড়তে থাকলাম। তবে গল্পের বই এর মাঝে সত্যিকার ভাবেই ডুব দিলাম ক্লাস নাইনে। ইন্টার হাউস ফুটবলে গোল কিপিং করতে গিয়ে ডান হাতের কবজি মচকে গেল। প্লাস্টার লাগিয়ে ১ মাসের মত কাটিয়ে দিলাম হাসপাতালে। আর এই একমাস আমার কাজ ছিল শুধুই গল্পের বই পড়া। হাউস লাইব্রেরিয়ান ছিল আমাদের ক্লাসের, এই একমাসে মোটামুটি হাউস লাইব্রেরি শেষ করে ফেলেছিলাম। এ সময় মূলত সব ধরনের লেখকের বই পড়া হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস টেনে আবারো কবজি মচকালো, এবার অবশ্য অন্য হাতের, আবারো এক মাস হাসপাতাল, আবারো বই পড়া উৎসব 😀

তবে গল্পের বই পড়ার স্বর্নযুগ বলা যায় ক্লাস ইলেভেন। শীর্শেন্দু, সমরেশ, সুনীলের ট্রেডমার্ক বইগুলো এ সময়েই পড়া। সবচেয়ে মজা ছিল দূরবিন, পার্থিব সাইজের বইগুলো পড়া হতো দুই তিনজন একসাথে, দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস না থাকার কারনে আমি পড়তাম আফটার লাঞ্চ আর সুযোগ বুঝে আফটারনুন প্রেপে। নাইট প্রেপে সেটা চলে যেত আরেকজনের হাতে আর রাত ১০টার পর আরেকজন। এক সাথে তিনজনই একই বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতাম। বিভিন্ন ফলইনে ঐ বই নিয়েই কথা হতো। ধ্রুব-কৃষ্ণকান্তের মাঝের দ্বন্দ আমাদেরও দ্বন্দের বিষয় হয়ে উঠত, একা এবং কয়েকজনের সূর্য’র চরিত্রকে একসাথে হিংসা করতাম আর নারী চরিত্র কোনটা সেরা সেটা নিয়ে তর্ক হতো। এইসএসসি’র টেষ্টের আগ পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে।

কলেজ থেকে বের হবার পরে গল্পের বই পড়ার আবার গ্যাপ পড়ে। সেটা আবার শুরু হয় প্রায় দেড় বছর পরে, বিএমএতে থার্ড টার্ম থেকে। বিএমএ লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত গল্পের বই ইস্যু করে পড়তাম, যা আমার বেশিরভাগ কোর্সমেটের জন্য ছিল এক চরম বিস্ময়কর ব্যাপার। ঐ সময়ে পড়া আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই ছিল কাছের মানুষ। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের নাম তখনো শুনিনি, বইটার গেটাপ আর দু’তিন লাইন পড়ে ভাষা পছন্দ হওয়ায় ইস্যু করেছিলাম বইটা। বৃহঃপতি বার বিকালে পড়া শুরু করি, এতটাই ভাল লাগছিল যে ঐ দিন অলমোস্ট সারা রাত পড়ি ( কি কারনে জানি ঐ রাতে সূর্যোদয় ফলিন ছিল না) পরদিন শুক্রবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শহরে না গিয়ে রাত পর্যন্ত পড়ে কাছের মানুষ শেষ করি। ওটা পড়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বিরাট ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম, পরের ছুটিতে এসে ওর যতগুলো সম্ভব বই সংগ্রহ করে পড়ে ফেলি।

বিএমএ থেকে বের হয়ে ইউনিট এ যোগ দিয়েই গল্পের বই পড়ার শেষ, সঙ্গি হলো টিভি, ইন্টারনেট আর ফিফা … প্রায় সাড়ে চার বছর পর যেটা আবার শুরু করলাম গত শনিবারে এখনো চলছে…

আর আমার গল্পের বই পড়া পুরোপুরি রিডিং ফর প্লেজার… পড়তে ভাল লাগলেই পড়ি, লেখকের নাম বা জ্ঞান আহরন এদুটোর কোনটাই মাথায় থাকে না।

* অর্ধেক লিখে রাখায় মনের ভিতরে বেশ ডিস্টার্ব দিচ্ছিল, তাই তাড়াহুড়ো করে বাকিটা বলে ফেললাম, এমনিতেই চরম দৌড়ের উপরে আছি

১,৫৬১ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “গল্পের বইয়ের বাকি গল্প”

  1. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    আর আমার গল্পের বই পড়া পুরোপুরি রিডিং ফর প্লেজার… পড়তে ভাল লাগলেই পড়ি, লেখকের নাম বা জ্ঞান আহরন এদুটোর কোনটাই মাথায় থাকে না।

    আমারো একেবারে একরকম অবস্থা। কলেজে থাকতে সেবা এবং গল্প উপন্যাসের বই তো ছিলোই, নাটকের বই পড়াও বাদ দেই নাই। বুয়েটে এসে ২য় কি ৩য় সেমিস্টারের সময় শরৎসমগ্র পড়েছিলাম। তার পর থেকে বাংলা বই পড়লেই কাহিনীর সাথে সাথে মাথায় ঘুরত, "আচ্ছা, এই বইটা শরৎ লিখলে কিভাবে লিখতো ??" এরপরে যখন দেখলাম মাসুদ রানা পড়ার সময়েও শরৎ লিখলে কি লিখতো চিন্তা করছি, বাংলা বই থেকে থেকে নির্বাসন নিয়ে ইংরেজী ফ্যান্টাসি আর ফিকশন পড়া শুরু করলাম। আইজ্যাক আসিমভের যত বই ছিলো, যা পারসি কিনসি আর যা কিনতে পারিনি সব ডাউনলোড করে পড়সি। ৩০০ বেস্ট ফ্যান্টাসি রাইটার নামে টরেন্ট পেয়েছিলাম, ওইটা ডাউনলোড করে এখন A থেকে পড়া ধরসি। তবে আমাকে মুগ্ধ করেছিলো হ্যারি পটার সিরিজ। ছয় নম্বরটা পড়ার পরে যখন খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম, তখন এক হ্যারি পটার ফোরাম থেকে ফ্যান ফিকশন সাইটের আড্রেস পেলাম। বেশ কিছু ফ্যান ফিকশন পড়েছি যেগুলো, এমনকি, রাউলিং এর ৬ এবং ৭ এর চাইতে ভালো লিখেছে। এখন বাইরে থাকার কারনে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাংলা বই পড়তে পারছিনা। 🙁 🙁

    @কামরল ----- দ্য ভিঞ্চি কোড ভালো লেগে থাকলে, অ্যাঞ্জেলস এন্ড ডেমনস পড়ে দেখো।
    @আহসান ------ কি কি বই মাথায় ঘুরছে ???

    জবাব দিন
  2. মাসুদুর রহমান (৯৬-০২)

    আমি এখন আর বই পরিনা। কারন এখন কোনো বই আমার আর ৩ মাসের আগে শেষ হয়না। আর নভেল পরতে শুরু করলে ১০ মিনি্ট লাগে না। প্রথম কিছু পাতা পরে হলেই শেষের পাতা পরে ফেলি। আসলে আমি এক্সাইট্মেন্ত ধরে রাখতে পারি না।

    জবাব দিন
  3. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)
    ইন্টার হাউস ফুটবলে গোল কিপিং করতে গিয়ে ডান হাতের কবজি মচকে গেল। প্লাস্টার লাগিয়ে ১ মাসের মত কাটিয়ে দিলাম হাসপাতালে।

    ক্লাস টেনে আবারো কবজি মচকালো, এবার অবশ্য অন্য হাতের, আবারো এক মাস হাসপাতাল

    Whats Next..........???? :chup: :chup:

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।