দুষ্মন্তপুরান (পিজি-১৩)

রাজা দুষ্মন্ত বড়ই চিন্তিত। বিগত দু’দিন যাবৎ শকুন্তলাকে দেখা গিয়াছে মোবাইলে কোন এক অজ্ঞাত ব্যক্তির সাথে ফাইট দিতে। সে ঘন ঘন ছোট বার্তাও পাঠাইতে থাকে। আবার ফিরতি বার্তা পড়িয়া মুচকি মুচকি হাসে। তাহাকে ওই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কথা সুধাইলে সে বলে, তুমার তাতে কি? ইয়েতে চুল্কাচ্ছে?বেটা বুড়া ভাম! আজকাল রিক্সাওলারা পর্যন্ত মোবাইল ইউস করতেসে। আর তুমি একটা আখাইত্তা,নিজের একটা মোবাইল কেনারও মুরোদ নাই,আবার নাম দিসে রাজা,হেঁহ।

রাজা নিজে মোবাইলের ব্যাপারে অতিশয় অজ্ঞ। মোবাইলের ম’ও তিনি বুঝেন না। নিজে মোবাইল ব্যবহারও করেন না। শকুন্তলার কথায় তিনি অতিশয় মর্মাহত হইলেন।তিনি সেনাপতিকে ডাকিয়া বলিলেন, সেনাপতি,অদ্য তুমি আমাকে মোবাইল দীক্ষা দিবে। না দিলে তোমার চাকরি ত যাইবেই,গর্দানও যাইবে। সেনাপতি মনে মনে কহিল,ছোঁহ!সে কি ভাবিয়াছে আমার গর্দান নিলেই আমি মারা পড়িব? ব্যাটা গর্ধবটা তো জানে না,আমার মস্তিষ্ক তো আমার হাঁটুতে। মুখে কহিল,জনাব,মোবাইল দীক্ষা নিতে হইলে আপনাকে সাত সমুদ্দুর তের নদী পারে বঙ্গদেশ নামক এক আশ্চর্য দেশ আছে, সেথায় যাইতে হইবে। রাজা কহিলেন, তবে নামাও জাহাজ।

অতঃপর তাহারা সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হইয়া সে আশ্চর্য দেশের রাজধানীতে পৌছাইলেন।সেখানে গিয়া তাহারা মোবাইল ক্রয় করিবার নিমিত্ত বসুন্ধরা নামক এক বিশাল বিপণীতে গমন করিলেন। হেথায় রঙ বেরঙ্গের হরেক রকম মোবাইল দেখিয়া রাজার তো চক্ষু ছানাবড়া। এক দোকানে গিয়া সুধাইলেন,ভাই,আমরা সাত সমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিয়া বানিজ্য করিতে আসিয়াছি। আপনার দোকানের মোবাইল্গুলা দেখিয়া পুলকিত বোধ করিতেছি। যদি দয়া করিয়া আমদিগকে কিছু নমুনা প্রদর্শন করিতেন…. ।দোকানদার একটি মোবাইল দেখাইয়া কহিল, এইটা হইল গিয়া নকলা এন-৮৫। এইটা দিয়া গান শূনা যায়,ছবি তুলা যায়,আঠার মেগাপিগসেল ক্যামেরা,ফাইল শেয়ারিং করা যায়,ওয়েবসাইটে ঢুকা যায়,টাচ স্ক্রীন,একবারে ১০ জনের লগে ভয়েস চ্যাট করা যায়, টিভি চ্যানেলও আসে পুরা ফকফকা,গান রাখা যায় পুরা বাইশ হাজার। রাজা ভয়ে ভয়ে সুধাইলেন, ভাই, এইটা দিয়া কি কথা বলা যায়? দোকানদার রাজাকে তাহার অগ্নিদৃষ্টি দিয়া ভস্ম করিয়া দিতে চাহিল। রাজা তাড়াতাড়ি পাশের দোকানে আসিয়া পড়িলেন। ওই দোকানদার তাহাকে একটি নোকাই এন-৯৭ সেট গছিয়া দিল। রাজা তাহাকে মূল্য বাবদ পাঁচটি স্বর্নমূদ্রা দিলে সে চটিয়া কহিল, ওই মিয়া, আপ্নের সমেস্যা কি? ট্যাকা দেন নাইলে টেংরি ভাইঙ্গা হাতে ধরায়ে দিমুনে। সেনাপতি পাশেই ছিল। বেগতিক দেখিয়া সে দ্রুত হাজার টাকার দশটি নোট বাহির করিয়া দিল।

মোবাইল কেনা সমাপ্ত করিয়া রাজা ও সেনাপতি চলিয়া আসিলেন পলাশীর প্রান্তরে। সেথায় সেনাপতির এক দুরসম্পর্কের মাস্তুত ভাইএর সাথে তাহারা দেখা করিলেন। রাজা প্রথমে তাহাকে দেখিয়া ভাবিলেন,এ নিশ্চয় কোন সাধু বা সন্ন্যাসী হইবে। তাহার পরনে গেরুয়া বর্নের পোষাক। মুখভর্তি দাড়ি। গলায়,হাতে নানাবিধ তাবিজ কবজ ঝুলিতেছে। পায়ে খড়মসদৃশ জুতা। সে আসিয়া কহিল, ওয়াযযাপ নিগা’জ! আই এম ক্রেম্যাট। সেনাপতি রাজার কানে কানে কহিলেন, কেরামত।

রাজা তাহার নিকট এক মাস যাবত দীক্ষা লইলেন।এর মধ্যে ক্রেম্যাট তাহাকে শিখাইল, কল কেম্নে রিসিভ করিতে হয়,কেম্নে মিসকল মারিতে হয়,কেম্নে পে ফর মি কল করিতে হয়,কেম্নে একটার পর একটা অজ্ঞাত নম্বরে ট্রাই করিতে করিতে সুন্দরী রমনীদের নম্বর খুঁজিয়া বাহির করিতে হয়,কেম্নে সেইসব রমনীদের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টা আজাইরা প্যাঁচাল চালাইয়া যাইতে হয়। তিনি আরো শিখিলেন বিভিন্ন সংক্ষিপ্ত শব্দ,যেমন-বিআরবি,লোল,লিম্যাঁও, সিটিএন,টিজিএম, ডিজিএম, জিএমকে ইত্যাদি। উক্ত সময়ে তিনি খেয়াল করিলেন,ক্রেম্যাট জানি কাহার সাথে অনবরত কথা কইতে থাকে এবং বার্তা আদানপ্রদান করিতে থাকে। তিনি কৌতুহলী হইয়া সুধাইলে সে কহিল,এইটা নান অফ তুমার বিজনেস।ভাগ হিঁয়াসে।
রাজা তাহার কৌ্তুহল নিবারণ করিতে না পারিয়া এক রাতে ক্রেম্যাটের রুমের পাশে ঘাপ্টি মারিয়া গুপ্তচরবৃত্তি করিতে লাগিলেন। তিনি শুনিলেন,সে কহিতেছে, ওহ শেকু ডার্লিং,তুমি হুদাই টেনশন নাও। তুমাকে আমি ভাগায়ে বিয়া করবই। তুমার মত একটা সেক্সি মালকে সামলানো কি ঐ বুড়ার কাজ? অপর প্রান্ত কিছু বলিল। জবাবে ক্রেম্যাট কহিল, আব্বার জিগগায়। পুরা মাকখন প্লান। কিছুক্ষন পর সে আবার কহিল, আব্বে তুমি টেনশন লও কেলা? হাম হে না? পুরা কোপায় ফালা ফালা কইরা দিমু। অতঃপর রাজার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল।তিনি বিড়বিড় করিতে করিতে রুমে আসিয়া বাতি নিভাইয়া শুইয়া পড়িলেন।

রাজার ট্রেনিং শেষ। তিনি এখন মোবাইলে কল রিসিভ করিতে এবং রাজন্যদিগকে কল করিতে পারেন। ক্রেম্যাটকে তিনি তাহার পারিশ্রমিকস্বরূপ একটি সোনার পালতোলা জাহাজ এবং দশ হাজার স্বর্নমুদ্রা দিয়াছেন। ক্রেম্যাট তাহাতে অতিশয় খুশি। সে যাইবারকালে রাজাকে একটি ফ্রি উপদেশ প্রদান করিল, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।

রাজা পুনরায় সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হইয়া শকুন্তলার দেশে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি বাটিতে প্রবেশমাত্র ডাকিলেন,শকুন্তলে,প্রিয়ে,আমি ফিরে এসেছি প্রিয়ে। তোমার জন্য আমি সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হইয়া, প্রবল সমুদ্রের বিকট সব দানবদের সাথে লড়িয়া, মোবাইল দীক্ষা লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি। তুমি কোথায় প্রিয়ে?
কিন্তু তাহার দেখা মিলিল না। শকুন্তলার এক সখা আসিয়া কহিল, সেতো এক সোনার পালতোলা জাহাজে চাপিয়া এক দরবেশের সাথে দূরদেশে যাত্রা করিয়াছে। যাইবার কালে আপনার পোষা ছাগী সুনয়নাকে লইয়া গিয়াছে। তৎমুহূর্তে রাজার নোকাই এন-৯৭ ঝনঝন করিয়া বাজিয়া উঠিল।তিনি দেখিলেন,দুটি বার্তা আসিয়াছে। প্রথমটি আসিয়াছে ক্রেম্যাটের নিকট হইতে। রাজা শশব্যস্ত হইয়া উহা পড়িলেন। উহাতে লেখা-এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। অতঃপর দেখিলেন,অপর বার্তাটি শকুন্তলার নিকট হইতে আসিয়াছে। উহা খুলিয়া পড়িলেন,দুষু ডার্লিং,তুমি আসলে খুব ওল্ড ফ্যাশানড। আমাড় আবাড় ইয়াং এনার্জেটিক বেশি পছন্দ। এনিওয়ে, টিসি। বিটিডব্লিউ, তোমাড় সুনয়নাকে নিয়ে গেলাম। এত্ত কিউট একটা গোট…কোলন পি।
রাজা তাহার বাম বুকে হাত দিয়া ধপ করিয়া বসিয়া পড়িয়া কহিলেন-সুনয়না!!

৮,৮০০ বার দেখা হয়েছে

৭৪ টি মন্তব্য : “দুষ্মন্তপুরান (পিজি-১৩)”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    আজহার
    কী যে মজা করে লিখেছো তুমি নিজেও জানো না।
    দারুণ। পড়া শেষ হবার পরও হাসি থামছে না।

    এতো ভালো লিখে যে ছেলে তার 'জিনের বাদশা' বাদ দিয়ে নিজের নামে লেখা উচিত। 😀


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. সামি হক (৯০-৯৬)

    বিআরবি,লোল,লিম্যাঁও, সিটিএন,টিজিএম, ডিজিএম, জিএমকে >>এগুলার মানে আমারে একটু বুঝায়ে দাও প্রথম তিনটা আর ডিজিএম টার মানে জানি, বাকীগুলার কি? আমি মনে হয় রাজা দুষ্মন্ত হয়ে যাচ্ছি 🙁 ...

    গল্পটা অসাধারণ লাগলো...

    জবাব দিন
  3. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    অসাধারন লাগলো ভাই ...... মাথা থেইকা এই আইডিয়াটা বাইর করলা কেম্নে ????!!!!!!
    পপুলার পাব্লিক ডিমান্ডে ওই শর্টকাট শব্দগুলার মানে বইলা দাও ...... জানা থাকা ভালো ... আর বাচতে হলে তো জানতে হবে ...

    জবাব দিন
  4. মিথুন (2000-2006)

    আযহার ভুলে ঔ বাকি গুলার মানে কইস না রে ভাই।।।।।।।
    তবে আমি এই তরে ক্রেমাত হিসেবে ছিন্তা করতেসি। পিন্টু তরে ভুল designation দিসে।
    ভাই জাহাজের জায়গায় মনে হই রিক্সা হবে ।।। :))

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    দারুন! দারুন!!
    হাসতে হাসতে পুরাই পিরা গেসি।
    ভাই আজহার, সেরকম লেখনী তোমার। সিসিবিতে নিয়মিত এরকম আরো আরো লেখা দেখতে চাই।
    দুর্দান্ত মজা পাইসিরে ভাই 😀


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  6. রিফাত (২০০২-২০০৮)

    ....মুহাম্মদ জাফর ইকবালের...'আধুনিক ঈশপের গল্প' পড়ে ছোটবেলায় একবার মুগ্ধ হয়েছিলাম...আপনার উত্তর-আধুনিক বিদ্যাসাগরের গল্প পড়ে আর একবার মুগ্ধ হলাম... :hatsoff:

    জবাব দিন
  7. এটা কি লিখলা ! হাসতে হাসতে আমি শেষ ! (মোবাইল থেকে বলে সঠিক ইমোটা দিতে পারলাম না,এখানে পিরা গেলাম এর ইমো হবে)তবে প্রিয় মোবাইল হারানোর দুঃখ কি আর এত সহজে ভোলা যায় রে ভাই!

    জবাব দিন
  8. রিজওয়ান (২০০০-২০০৬)

    ক-অ-অ-অ-অ-অ-অ-অ-ঠি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ন লিখিয়াছিস!
    :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss:
    মানিক ত খুফি চমৎকৃত হইয়াছে;
    বাল্যসখা! কি লিখিলে!!!
    পরাণের চিপায় চিপায় আজ এ কিসের হিল্লোল টের পাইতেছি?
    আমার পঙ্খ গজাইলো বলিয়া, আমি উড়াল দিবার চাহি।
    তুমার লেখায় হাস্যরস মাধ্যাকর্ষসহ অন্যান্য জাগতিক আকর্ষণ ছিন্ন করিবে দেখি! শব্দচয়নে এ এক অতিপ্রাকৃতিক দক্ষতা দেখিলাম! লিখিয়া যাও, আমি আরো পড়িবার অপেক্ষায় আছি।
    (উপরে কি আশিকের কমেন্ট দেখলাম নাকি?)

    জবাব দিন
  9. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)
    সেনাপতি মনে মনে কহিল,ছোঁহ!সে কি ভাবিয়াছে আমার গর্দান নিলেই আমি মারা পড়িব? ব্যাটা গর্ধবটা তো জানে না,আমার মস্তিষ্ক তো আমার হাঁটুতে।

    :khekz: :khekz: :khekz: :pira:


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।