লালসার অপমৃত্যু…

৪. চোখে পানি নিয়ে ডান হাতের দিকে তাকিয়ে আছে শফিক। মোমবাতির উপর হাতটা ধরে আছে মিনিট পাঁচেক। হাতের তালুর সাদা অংশটার একটা পাশ আস্তে আস্তে কাল হয়ে এলো। তাও হাত সরাল না শফিক। দাতে দাঁত চেপে ধরে আছে হাতটা, মোমবাতির লেলিহান শিখার উপরে। মাংস-পোড়া গন্ধ আসছে। তাতেও বিকার নেই শফিকের। অপরাধবোধ, কষ্ট যেন দেহের ব্যথাকেও হার মানাচ্ছে। আর একটু হলেই হয়ত ডান হাতের তালু পুরোটা পুড়ে যেত তার। সালমা ছুটে এলো বলে রক্ষা। সালমার দিকে তাকাল শফিক। এক অব্যক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। নির্বাক। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। কতটা ব্যথায়, কতটা অন্য কারণে, নিজেও টের পেল না। কেউ কোন কথা বলল না। বলার মত কিছু ছিল না বলেই হয়ত। সালমার চোখ বেয়েও পানি পড়া শুরু হল। তাও হাত দিয়ে মুছিয়ে দিল শফিকের অশ্রু। গায়ের ওড়নাটা টেনে হাত বেধে দিল। শফিককে খাটিয়ায় বসিয়ে দিয়ে ছুটল পাশের বাসায়। বরফ, ঠাণ্ডা পানি যা পাওয়া যায়, আনতে। ওড়নাটা খুলে পোড়া হাতের দিকে তাকিয়ে আছে শফিক। আবার অশ্রু। চোখের কোল গলে, পোড়া জায়গাটায় এসে পড়ছে। কলঙ্ক, অপরাধ সব ধুয়ে দিতে চাইছে যেন। এত সহজে কি সব মুছে যায়! যায় না!

১. বছর তিন আগে ঢাকা আসে শফিক। ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে কাজের খোঁজে। বাবা নেই। মা এ বাড়ি, ও বাড়ি কাজ করে সংসার চালান। এভাবে আর কত দিন। শফিক পরিবারের বড়। ওর পরে সালমা, ওর বছর তিনেকের ছোট আর পরের আর একটা বোন, রেনু, বয়সে সালমারও দুবছরের ছোট। গরীব পরিবারে ইন্টারের বেশি পড়তে চাওয়া মানে বিলাসিতা। সে বিলাসিতা করার সাহস, সামর্থ্য শফিকের ছিল না। তাই ঢাকায় এসেছিল চাকরির খোঁজে। ওদের গ্রামের কিছু বড় ভাই কাজ করে গার্মেন্টসে। তাদের কাছেই এসেছিল সে। তাদের সাথে ঘুরে ঘুরে কাজও জুটিয়ে ফেলে শফিক। বনানীতে কাজ। এদিকে থাকার খরচ বেশি। থাকত আব্দুল্লাহপুর বেড়িবাঁধের দিকে। এভাবে ভালই চলছিল শফিকের। বাসায় কিছু পাঠিয়ে, নিজের ভালই চলে যাচ্ছিল। সালমা, রেনুর পড়ার খরচ সেই দিত। ওদের একটা গতি করে নিজে বিয়েথা করে পাকা হবে, এমনি ছিল স্বপ্ন।

ঢাকা বড়ই আজিব শহর। কত রকম মানুষ, কত রকম তামশা। দেখত, আর অবাক হত। এ দুই বছরে অভিজ্ঞতা তো কম হয়েছিল না। দিনদিন একটু বিলাসী হয়ে গিয়েছিল সে। কিনেছিল চোরাই একটা চাইনিজ ফোন। ছবি তোলা যায়, ভিডিও দেখা যায়। আরও কত কি। এলাকার আরেক ছেলে শিখিয়ে দিয়েছিল, কম্পিউটারের দোকান থেকে কিভাবে মেয়েদের পচা পচা ছবি ফোনে নিয়ে নেওয়া যায়। আগে এসব বুঝত না শফিক। গ্রামে থাকতে দুই একটা খারাপ বই পড়ে দেখা হয়েছিল। এর বেশি কিছু না। কিন্তু ঢাকা বড় শহর। কি নেই এখানে। অন্যান্যদের কাছে দেখেছে, মোবাইলে খারাপ খারাপ ভিডিও। দেশী, বিদেশী। সারাদিনের কাজ শেষে বিছানায় শুয়ে দেখতে খারাপ লাগত না। কাজ চলে যায়। এলাকার খলিলের সাথে খারাপ পাড়াটাও চিনে এসেছিল। এখনও যাওয়ার সাহস হয়নি। কেমন ভয় ভয় করে। তবে যাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সে। একা থাকা আর কত দিন। অনেকেই তো যায়। সেও না হয় একটু গেল। তাতে দোষের কি। রোজগার করছে সে। একটু নিজের ভোগে লাগুক। এভাবেই শহুরে হয়ে ওঠে গ্রামের ছেলে শফিক।

২. এভাবেই পার হয়ে যায় শফিকের ঢাকা বাসের বছর দুই। এর মাঝে সালমাও ইন্টার পাস করে। পড়ালেখায় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ভাল সে। ইচ্ছে, আরও পাস দেবে। ভাইও জানে। তাই ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে আসে সালমাকে। ভাইবোন মিলে দুই রুমের মেস দেখে উঠে পড়ে। বোনকে ভাল কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে শফিক। ঢাকার ছেলেমেয়ের মধ্যে হারিয়ে যায় সালমা। চান্স পায় না প্রথম বারে। হাল ছাড়ে না শফিক। বলে পরের বার চেষ্টা করতে। আপাতত মাস ছয়েকের জন্য খিলক্ষেতের এক গার্মেন্টসে কাজ ধরিয়ে দেয়। দুই ভাইবোন কাজ করে বলে, গ্রামে মায়েরও একটু অভাব কমেছে। রেনুটাও বড় হয়ে গেছে। পরের বার ম্যাট্রিক দেবে। স্বপ্নের জাল বোনে শফিক। সালমাটা বড় পাস দেবে। ভাল দেখে বিয়ে দেবে বোনটার। বড় আদরের বোন তার। কোলে করে মানুষ করেছে কত। রেনুটা ইন্টার পাস করলে মাকে সহ নিয়ে আসবে ঢাকায়। কল্পনায় দিনগুলো বেশ ভাল যায় শফিকের।

মাঝে মাঝে কিছু উটকো সমস্যা হত অবশ্য। সালমা কাজে যাওয়ার সময়, রাতে ফেরার সময় এলাকার কিছু চেংড়া নাকি আজে বাজে কথা বলে। একদিন ডেকে ঝাড়ি দেবে ভেবে রেখেছিল শফিক। এছাড়া গার্মেন্টসে ছোটখাটো কিছু হত মাঝে মাঝে। ছেলেগুলো নাকি কেমন করে তাকায়। সুযোগ পেলে নাকি শরীরে হাত রাখার চেষ্টাও করেছে এক দুবার। সালমার ফ্লোর ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছিল শফিক। খুব লাভ হয়নি অবশ্য। উঠতি বয়সী ছেলে ছোকরারা একটু আধটু নাকি করেই থাকে এসব, তাই বলেছে ফ্লোর ম্যানেজার। সালমাকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছিল সে। বেশি রাত না করতে বলেছিল। যতটুকু ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে পারে, সেভাবে চলতে বলেছিল। দু একদিন কাজ শেষে ফিরে কান্নাকাটিও করেছিল সালমা। বেশি পাত্তা দেয়নি শফিক। ফ্লোর ম্যানেজারের কথাটা বোঝে শফিক। সেও তো সুযোগ পেলে তার গার্মেন্টসের মেয়েদের দেখে। সুযোগ পেলে শরীর একটু ছুঁয়ে দেখে। দু একজন কটমট করে তাকিয়েছে। ঝাড়িও দিয়েছে। শফিক ভাল ছেলে। বেশি কিছু করেনি। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুধু একটু ধাক্কা দেয়, এই আরকি। ওর গার্মেন্টস আর এলাকার বন্ধু কালাম ওকে আরও ভাল উপায় বাতলে দিয়েছে। রাতের বাসে। ভিড়ের মাঝে। একটু অন্ধকারে। অচেনা মেয়েকে। বাস থেকে নামার সময় হাত রেখে টুপ করে নেমে পড়ে। ভিড়ের মাঝে মেয়েও বুঝতে পারে না, কে করেছে। বুঝলেও শফিক নেমে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায়। কাজ শেষে ফেরার পথে বেশ ভাল বিনোদন এটা।

৩. কাজ শেষে ফিরছিল শফিক। সাথে কালাম। কানে কানে কালকে নতুন লোড করা বিদেশি ভিডিও নিয়ে কথা হচ্ছিল ওদের। চুপি চুপি হাসছিল রগরগে রসিকতায়। সন্ধ্যার এসময়টা বেশ ভাল ওদের জন্য। অন্ধকার, অফিস ফেরত মানুষের ভিড়। প্রতিদিন নামার সময় বেছে নেয় কাউকে, দুজন মিলে। কালামের পছন্দ শরীরের উপরের দিক। শফিকের নিচের পিছনদিক। দুজন একসাথে দুই দিকে হাত দিলে মেয়েও বোঝে না কোনটাকে ধরবে। এর মাঝে ওরা নেমে যায়। নির্ভেজাল প্লান। দূর থেকে দেখে রাখে দুটোকে। অন্ধকারে খুব ভাল দেখা যাচ্ছে না। দেখে কি হবে। তাদের কাজ হলেই হল। কাল আবার শুক্রবার। তাই আজকে বেশ খোশ মেজাজে শফিকরা। সামনের দুটো মেয়ের মাঝে একটা আবার আজমপুরে নেমে পড়ে। ওরা নামবে আব্দুল্লাহপুর। কাছে এসে দাঁড়ায়। সপ্তাহ শেষের ভিড় প্রচণ্ড। তারপর গাজীপুরের বলাকা বাস। ভর্তি মানুষ জন। ওদের জন্য ভালই। কাজ শেষে চুপ করে নেমে যেতে পারবে। দুজনে ঠেলতে ঠেলতে কাছে এসে দাঁড়ায় মেয়েটার। পুরনো খেলোয়াড় ওরা। কালাম পাশাপাশি, শফিক পিছনের দিকে। শফিক ইশারা দিলেই হাত দিয়ে চাপ দিয়েই কেটে পড়বে দুজন। অনেক বার করেছে ওরা। দেখেছেও অনেককে করতে। ইশারা দেয় শফিক। দু দিক থেকে দুজনের হাত এগিয়ে যায় মেয়েটার দিকে, আবছা অন্ধকারে। বুকে চাপ দেয় কালাম, শফিক পিছনে। কালাম চাপ দিয়েই মিশে যায়। শফিক একটু দেরি করে ফেলে। মেয়েটা দ্রুত ঘুরে ধরে ফেলে শফিকের হাত। শফিক হাত গলে পালাতে চায়। শক্ত করে ধরা হাতটা শিথিল হয়ে আসে। চমকে মেয়েটার দিকে তাকায় শফিক। আবছা আলোতেও চিনতে পারে। চেনা দৃষ্টি, চেনা মুখ। কোলে করে বড় করা বোনটাকে চিনতে আলোর দরকার হয় না।

৩০.০৩.২০১৪

১,৬৭৪ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “লালসার অপমৃত্যু…”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এই সব পুরুষেরা যখন রাস্তায় নামে তখন মাথায় থাকে না যে তাদের মা, বোনদেরও রাস্তায় অন্য পুরুষের মুখোমুখি হতে হয়। তবে নিজের মা, বোন তথা পুরো নারী সমাজকে তারা কতটুকু সম্মানের চোখে দেখে সেটাই বা কে জানে!


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      যতদিন যাচ্ছে ,ব্যাপারগুলো যেন আরও খারাপ দিকে গড়াচ্ছে... আগে আমি দেখতাম, ভাবতাম ঘটনাগুলো বেশিরভাগ মধ্যবয়স্ক পুরুষরাই ঘটায়... কিন্তু এখন উঠতি বয়সি ছেলেরাও এই অজানা ভাল লাগার খেলায় নেমে পড়েছে... প্রযুক্তির যুগে, মোবাইল-ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এর একটা বড় কারণ বলে মনে করি... স্কুল জীবনে বা কলেজ জীবনে খারাপ ছবি বা বই, এগুলো কিন্তু এত সহজলভ্য ছিল না... আর এখনকার ছোট ছোট ছেলেরা সহজেই এগুলো পেয়ে যায় হাতের মুঠোয়... যা দেখে, তাই শেখে... তারও আগ্রহ জন্মায় এই অনুভূতিগুলোর প্রতি... ফলাফল তো আজ সবার সামনেই... 🙁

      জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    শফিক একটু করে ফেলে। মেয়েটা দ্রুত ঘুরে ধরে ফেলে শফিকের হাত।

    এখানে শফিক একটু দেরি করে ফেলে হবে মনে হয়।
    লেখা ভাল হয়েছে। (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    আপাতত মাস ছয়েকের জন্য খিলক্ষেতের এক গার্মেন্টসে কাজ ধরিয়ে দেয়।

    গল্প হলেও ভালো লাগলো।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    সালমাকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছিল সে।

    হিজাব হইলো মুক্তির উপায়।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    কোলে করে বড় করা বোনটাকে চিনতে আলোর দরকার হয় না।

    :thumbup:

    মিডল ইস্টের একটা কাহিনী পড়েছিলাম একবার।
    তখন সুমন হিট বাংলাদেশে।
    দেশি হোমমেড ভিডিওর ব্যাপক চাহিদা তখন বিশ্বব্যাপী।
    তো এইরকম এক ভিডিও গেছে মিডল ইষ্টে। বন্ধু বান্ধবেরা দেখতে বসছে।
    হঠাৎ করে একজন দেখে ছবির নায়িকা তার বোন।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।