দাদীর হাত ধরে বসে আছে ওসমান। দাদীর হাতটা কেমন যেন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। উত্তাপ নেই। ওসমানের মুখের চামড়া শুকিয়ে টান ধরেছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি শুকিয়ে কেমন একটা চ্যাট-পেটে অনুভূতি। কপালের কোনার কাটা জায়গাটা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে আপনা আপনি। রক্ত জমে লাল থেকে গাঢ় খয়েরী রঙ নিয়েছে। বাম পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখটাও উল্টে গেছে। তীব্র ব্যথাটা এখন ঝিমিয়ে এসেছে একটু একটু করে। ডান পায়ের স্যান্ডেলটাকে সঙ্গীহীন একাকী বৈরাগী মনে হচ্ছে। দৌড়ানোর সময় কোথায় যে বাম পায়েরটা পড়ে গেল তা আর মনে করতে পারছে না ওসমান। তারপরেই না এক গর্তে পায়ের নখটা উল্টে গেল। এত কিছুর পরেও ফুটপাথে বসে থাকতে থাকতে ক্ষুধা লেগে গেছে তার। এ অবস্থায় দাদীকে খাবারের কথা বলবে কিনা ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু ক্ষুধার চোটে পেটের নাড়িভুঁড়ি কেমন উল্টে আসছে। ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখা চকলেট বারটার কথা মনে হচ্ছে বারবার। আসার সময় পকেটে করে নিয়ে আসলেই হত। নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে বারবার। দাদীকে বলবে কি বলবে না চিন্তা করতে করতেই একটা মাইক্রো বাস এসে থামল ওদের সামনে।
দরজা খুলে তড়িঘড়ি করে কিছু লোক নামল। তারা হাতে করে বাচ্চা একটা ছেলেকে নামাচ্ছে। ছেলেটার হাত ধরে থাকা উসকো-খুসকো লোকটাকে দেখে চেনা মনে হল ওসমানের। কোথায় যেন দেখেছে। হঠাৎ চিনতে পারল সে। আরে, এ যে তাদের স্কুলের জামিলের বাবা। তাহলে ছেলেটা কে? উঠে খুড়িয়ে খুড়িয়ে কাছে গেল সে। ছেলেটার মুখের এক পাশ কাপড়ে ঢাকা। রক্তাক্ত। কেবল মুখের বাকিটুকু দেখা যাচ্ছে। এ যে জামিল। ক্লাসের ত্রাস জামিলকে কেমন অসহায় জড় পদার্থের মত লাগছে। চোখের নিচের কাটা দাগ, রক্তে লাল জামা। অচেতন জামিলকে নিয়ে সবাই ভেতরে চলে গেল। আবার আগের জায়গায় এসে বসে পড়ল ওসমান। হঠাৎ মনে পড়ে গেল স্কুলের কথা, তাদের খেলার মাঠটার কথা, মাঠের পাশের তিনতলার জেরিন আপার কথা। খুব বেশি তো আগের নয়। মাত্র তিন দিন। কিন্তু যেন মনে হচ্ছে কত আগের। অন্য কোন সময়ের। অন্য কোন জগতের।
ওসমানের বয়স সাতের শেষে। আটে পড়বে কিছুদিন পর। বাসা থেকে ছয় রাস্তা পরে ওদের স্কুল। বয়েজ কিন্ডারগার্টেন। একেবারে নার্সারি থেকেই ওখানে পড়েছে ওসমান। তাই স্কুলের সবই চেনা তার। টিফিন টাইমে বন্ধুদের নিয়ে হৈ-হুল্লোড়। ছোটাছুটি, বল খেলা এসব করেই সময় চলে যায় ওদের। ওদের ক্লাসের সব ছেলেকেই ভাল লাগে ওসমানের; শুধু জামিল আর তার সাথের ছেলেগুলো ছাড়া। জামিল পড়াশোনায় বেশ খারাপ। ক্লাস টুতেই আছে তিন বছর। তাই আর সবার চেয়ে একটু বড়। তাই গায়ের জোর খাটিয়ে অন্য ছেলেদের সাথে মারপিট করে সব সময়। কেউ ওর সাথে পারে না। তাই টিফিন টাইমে ওর টিফিন বক্স কেড়ে নিলে কিছুই বলতে পারে না ওসমান। শুধু মাঝে মাঝে দোয়া করে যেন জামিলের হাত একটা ভেঙে যায়। পা যেন খোঁড়া হয়ে যায়। তবেই হবে ব্যাটার উচিত শিক্ষা। বন্ধুরা মিলে ওর বিরুদ্ধে কতই না প্লান করত। কিভাবে ওকে শায়েস্তা করা যায়। একদিন একজন ওর পায়ের নিচে কলার খোসা ফেলে দেয়া যায় কিনা তাও বলল। কিন্তু কিছুই করতে পারে নি তারা। শুধুই নিষ্ফল আক্রোশে হাত-পা ছুড়েছে। আর ভেবেছে একদিন ওরাও বড় হবে। ওদেরও শক্তি হবে। তখন ওরাও দেখে নেবে জামিলকে।
আজ ওদের এত দিনের দোয়া কাজে লেগেছে দেখেও কেন যে খুশি হতে পারছে না ওসমান। যেই জামিলের মুখে এক ঘুসি দিয়ে সামনের একটা দুটো দাঁত ফেলে দেয়ার জন্য ওদের হাত নিশপিশ করত, আজ জামিলের রক্তাত্ত মুখ দেখে আনন্দের বদলে জমাট কান্না জমে উঠছে ওসমানের ছোট্ট বুকে। স্কুলের আর সবার চেয়ে শত্রু জামিলকেই কেন যেন খুব আপন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, জামিল যদি আর স্কুলে ফিরে যেতে না পারে, তবে যেন স্কুলটাই মাটি হয়ে যাবে। রক্তে রাঙা জামিল কি পারবে আবার দুপায়ে উঠে দাড়াতে। পারবে কি আবার তাদের টিফিন কেড়ে নিতে। শয়তান জামিলটার জন্যই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল ওর। তিন দিনের ছোট সময়টাই বদলে দিয়েছে ক্ষুদ্র ওসমানকে।
ওর বাকি বন্ধুরা কে কোথায় আছে তার কিছুই জানে না ওসমান। জানার সময় হয়নি। রহমানের ময়না পাখিটা কি কথা বলতে শিখেছে। খবর নেওয়া হয়নি। ওদের বাসার কার্নিশে বাসা বাঁধা চড়ুইয়ের বাচ্চারা কি উড়তে শিখেছে, তারও খোঁজ নিতে পারেনি সে। শেষ তিন দিন বাসা থেকেই বের হতে দেয়নি মা। তাই পাশের গলির খেলার মাঠটাতে গিয়ে দেখা করা হয়নি বন্ধুদের সাথে। সকালে আসার সময় মাঠের চারপাশের ধ্বংসস্তূপ থেকে অনেকের নিথর শরীর এনে জমা করতে দেখেছে সে। মাঠের ঘাসগুলো বড় হয়ে সাদাটে ফুল ফুটেছিল। সাদা ফুলগুলো রক্তে, ধুলায় কেমন কালচে দেখাচ্ছিল। মাঠের একপাশে জমা করা সারিবদ্ধ লাশ। সতের পর্যন্ত গুনতে পেরেছে সে। দৌড়াতে গিয়ে হিসেব গুলিয়ে গেল। গোনাটা আর শেষ করতে পারেনি। মাঠের ঘাসগুলোতে, মাটিতে রক্ত থোক থোক জমে গেছে। মাছি আসতে শুরু করেছিল একটা দুটো করে। এই মাঠে আর কোন দিন খেলতে পারবে কি ওসমান। বৃষ্টিতে হয়ত মাটিতে, ঘাসে লেগে থাকা রক্তরা ঢুয়ে যাবে। কিন্তু শিশুমনের মাটিতে, ঘাস ফুলগুলোতে যে রক্ত লেপটে আছে, তা কি কোন দিন মুছে যাবে। যাবে কি তার দাগ। তার চিহ্ন।
জেরিন আপারও কোন হদিশ নেই। গত বৃহস্পতিবার খেলার পরে গিয়েছিল আপার বাসায়। জেরিন আপার কোন ছোট ভাই-বোন নেই। তাই ছোট্টটি থেকেই ওসমানকে খুব আদর করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। সামনে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হচ্ছিল আপার। তার এতসব বুঝত না ওসমান। শুধু তার আদরের চকলেট আপা চলে যাবে দূরে। এই দুঃখ নিয়েই সে অভিমান করেছিল এক সপ্তাহ ধরে। তারপর আপা তাদের বাসায় এসে তার মান ভাঙায়। কোলে করে মোড়ের দোকান থেকে চকলেট কিনে দেয়। তারপরেই কেবল আড়ি ভেঙ্গেছিল ওসমান। তার আদরের আপু গত তিনদিনে একবারও তাকে মনে করেনি। খোঁজও নেয়নি। আজ আসার সময় জেরিন আপাদের বাসার দিকে তাকিয়েছিল ওসমান। বাসার একপাশ ভেঙে পড়েছে। জানালার কাঁচ সব টুকরো টুকরো। আপার বারান্দাটা থেকে ঘরের ভিতরের সবটাই কালো। কাল রাতের আগুনে বোধ হয় পুড়ে গেছে। জেরিন আপা কি সময়মত বের হতে পেরেছিল। কেমন যেন শিউরে ওঠে ওসমান। তার চকলেট আপার কি কিছু হয়েছে। তাকে চকলেট দিয়ে কোলে নিয়ে মান ভাঙানোর মানুষটা কি আর ফিরে আসবে না। গোলাপী টোল পড়া গালটাতে গাল লাগিয়ে কেউ কি আর তাকে আদর করবে না। তিনতলার বারান্দা থেকে হাত নেড়ে ডাক দেবার, ছাদ থেকে কাগজের বানানো প্লেন ছুড়ে দেওয়ার মানুষটাকে কি ফিরে পাবে ওসমান। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। এবার ফিরে এলে আপার সাথে আর কখনও রাগ করবে না। অভিমানে গাল ফুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে রাখবে না সে। চিন্তাগুলো ছোট্ট বুকটার মাঝে কেমন হাহাকার করে ওঠে। দমটা কেমন আটকে আসে ওসমানের। মনের বেদনা চোখের কান্না হতে হতেও হয় না। মনের মাঝেই বয়ে চলে।
বাবা-মা, দাদী আর ছোট্ট বোন জারাকে নিয়ে ওসমানদের ছোট পরিবার। পরিবারের মত দেশটাও ছোট। হাতে গোনা চার-পাঁচটা শহর নিয়ে ওদের দেশ। আগে নাকি অনেক বড় ছিল। সময়ের সাথে সাথে ছোট হয়েছে। অন্যরা নাকি দখল করে নিয়েছে সব। অন্যরা কারা, ব্যাপারটা ওসমানের কাছে খুব পরিষ্কার না। একের দেশ অন্যে কিভাবে দখল করে নেয় ছোট্ট মাথায় এতসব ঢোঁকে না। দেশ দখল করাটা জামিলের টিফিন ছিনিয়ে নেওয়ার মত সহজ কিনা ঠিক বুঝে ওঠে না। ওরা নাকি আলাদা। অন্য ধর্মের। অন্য বর্ণের। ব্যাপারগুলো বুঝতে পারে না ওসমান। ওদের শহর থেকে বের হয়ে পাশের শহরে যেতে যে চেকপোস্ট পড়ে সেখানে দেখেছে সে ওদের। কিন্তু পার্থক্য করতে পারে নি। ওরাও তো মানুষ। ওদের মতই দুটো হাত, দুটো পা। ওদের মতই প্রায় দেখতে। পার্থক্য কেবল গায়ের পোশাকে। ওরা কেমন এক পকেটওয়ালা জামা পড়ে। পায়ে শক্ত জুতো। হাতে অস্ত্র। আর ওসমানরা সাধারণ জামা-কাপড়। শুধু কাপড়ের জন্যই ওরা কি তাদের থেকে আলাদা কিনা, চিন্তা করে বের করতে পারে নি। কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি। এবার বাবাকে প্রশ্ন করে দেখবে, ঠিক করে সে।
আগে দাদী ওদের সাথে থাকত না। অন্য একটা শহরে ছিল ওদের দাদার বাড়ি। দাদা-দাদী আর তাদের পোষা কুকুর টমি থাকত ওখানে। তখন ওদের দেশে আটটা শহর ছিল। তিন বছর আগে এক গণ্ডগোলের সময় শহরটা নাকি দখল করে নেয় ওরা। দাদী পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন। দাদা আর টমি পারেনি। দাদার সাথে দাদাবাড়িটা, শহরটা ওসমানদের কাছ থেকে হারিয়ে যায় তখন। তখন আরও ছোট ছিল ওসমান। সব বুঝে ওঠার মত বয়স তার হয়নি। তখন থেকে ওদের এই ক্ষুদ্র শহরটার অলিগলি, মাঠেই ওর বেড়ে ওঠা। এই মাঠেই বল খেলে, দৌড়াদৌড়ি করে, ছোট্ট আকাশটাতে ঘুড়ি উড়িয়ে কাটে ওর শৈশব। শহরের প্রাচীর তার দুরন্তপনার কাছে হার মানে।
এর মাঝেই ওদের সংসারে আসে জারা। প্রথম প্রথম পছন্দ না করলেও আস্তে আস্তে বোনটাকে ভাল লাগতে শুরু করে ওসমানের। ছোট্ট হাত দিয়ে যখন ওসমানের আঙুল ধরার চেষ্টা করে, মনটা ওর খুশিতে ভরে ওঠে। বোনের হাত নিয়ে, পা নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে সে। ছোট্ট জারার কান্না, হাসি, বসা, দাঁড়ানো, হামাগুড়ি, আধো আধো বুলি সবকিছুই ওসমানের দিনের অনেকক্ষণ কেড়ে নেয়। দেখেও যেন আশ মেটে না। ওর প্রতিটা কাজেই, প্রতিটা মুখভঙ্গিতেই যেন মায়া ঝরে পড়ে। বোনটাকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে। ভালবাসতে শেখে ওসমান।
মাস খানেক ধরেই চারপাশ কেমন যেন অন্যরকম। কেউ না বললেও ওসমান বুঝতে পারে। বাবা মা নিজেরা কথা বলে। স্কুলে মিসরা আর আগের মত আদর দিয়ে পড়ায় না। রাস্তাঘাটে নেই আগের সেই কোলাহল। সহজে কেউ শহরের বাইরে যায় না। সন্ধ্যার পরপরই রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করে। সব দেখে সে বুঝতে পারে দাদাবাড়ির মত এই শহরটাও দখল করে নেবে ওরা। দখল করে নেবে ওদের মাঠ। মোড়ের দোকান। স্কুল, বল, ঘুড়ি, মাথার উপরের ছোট্ট আকাশটা। আর বেশি ভাবতে পারে না সে। দখল করে নিলে তাদের কি হবে, তারা কোথায় যাবে তা বোঝার মত বড় তখনো হয়ে ওঠেনি ওসমান।
গত শুক্রবারেই বাবা হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন বাসায়। মাকে, দাদীকে বললেন ওরা নাকি কি সব কাগজ দিচ্ছে। ওদের চলে যেতে বলা হয়েছে শহর ছেড়ে। তাই নিয়ে চিন্তিত সবাই। এতসব বোঝে নি সে। তাই জারাকে নিয়ে মেতে উঠেছে খেলায়। ছোট্ট জারাও ভাইয়ের কোলে শুয়ে হাসি, কান্না, বিচিত্র সব অঙ্গভঙ্গি করে ভাইকে রেখেছে ব্যতিব্যস্ত।
শনিবার রাতেই শুরু হয় গণ্ডগোল। বোনটাকে নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়েছিল ওসমান, বাবা-মা, দাদী সবাই। বিকট বিকট সব শব্দ। শব্দের সাথে চারপাশ আলোকিত, বাসাবাড়ি কেপে উঠছিল থরথর করে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি ভেঙে পড়ে। পাশাপাশি বাতাসে শিষ কেটে বেরিয়ে যাওয়া গুলির শব্দ। জারা প্রথমে কেঁদে উঠেছিল। কিছুক্ষণ কেঁদে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গলা দিয়ে হেঁচকির মত আওয়াজ বাদে আর কোন আওয়াজ নেই। চারপাশে কেবল বোমার শব্দ থেমে থেমে। বোমার শব্দের পরে দূর থেকে ভেসে আসছিল কাদের যেন আত্ম-চিৎকার। কার গলা বুঝে ওঠেনি ওসমান। এভাবেই রাতটা পার করেছিল ওরা। সকালে বাবা বেড়িয়ে দেখে এসেছে। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে এসেছেন তিনি। কোনমতে রবিবার রাতটা পার করলেই পালিয়ে যাবে ওরা। এভাবেই আসে আরেকটি ভয়াল অপেক্ষার রাত। আবার সবাই আশ্রয় নেই খাটের নিচে। জারাটা কেমন যেন কাঁদতে ভুলে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। হাসেও না, কাঁদেও না।
এরাতের বোমার আওয়াজ গুলো আরও কাছে মনে হয় ওসমানের। একেবারে বুকে যেয়ে আঘাত করে। মাঝরাতে চলে যায় কারেন্ট। শেষরাতের দিকে বোমা একটা এসে পড়ে ওদের বাসার সামনে। ছাদের একটা অংশ খসে পড়ে। খাটের নিচে থাকায় সরাসরি মাথায় এসে পড়ে না। চাপা পড়ে ওরা। কপালের কাছে ব্যথা টের পায় ওসমান। সাথে হাতে আর পায়ে। টানা হ্যাচড়া করে বাবা প্রথম বেরিয়ে আসেন। আস্তে আস্তে বের করেন বাকিদের। সবারই হালকা পাতলা ব্যথা লেগেছে। এখান ওখান থেকে রক্ত ঝরছে। কেবল জারা বাদে। মা ওকে বুকে আগলে রেখেছিলেন বলে জারার গায়ে আঁচড়টাও লাগে নি। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছিল তখন। অমানিশা কেটে ভোরের আলো দেখা যাচ্ছিল। হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, আগে থেকে গোছানো ব্যাগগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা। আরেকটা গোলা এসে পড়লে রক্ষা নেই। আর কোন আঘাত সহ্য করার মত শক্তি নেই বিল্ডিংটার। আশেপাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সবাই ধুপধাপ করে নেমে আসছে। কারেন্টও নেই। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার মাঝেই বাবার হাত ধরে নামতে থাকে ওসমান। ওদের পিছনে দাদী। তার পিছনে মা আর মায়ের কোলে জারা। আশেপাশে উপর তলার লোকারাও আছে। কে কে অন্ধকারে চেনা যায় না। একজন বোধহয় অন্ধকারে পা বেঁধে পড়ে গেল। দু-একজন মাড়িয়ে চলে গেল। স্বাভাবিক চিন্তা চেতনার ক্ষমতা আর কারো নেই। সবাই চলছে নেশার ঘোরে। জীবনের নেশা। বাচার নেশা।
আবার সাইরেনের আওয়াজ ভেসে এলো। আবার উড়ে আসছে প্লেন। সবার নামার গতি বেড়ে গেল। কাছেই কোথাও বোমা পড়ল। কেপে উঠল সবাই। শেষের তলায় চলে এসেছে ওসমানরা। দরজা দিয়ে বাইরের আলো আসছে। ওসমানের মনে হচ্ছিল অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে পারলেই বেঁচে যাবে ওরা। এসময়েই বোমা এসে পড়ল ওদের বিল্ডিংটার একপাশে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পড়ে গেল সবাই। উপর থেকে ভেঙে পড়তে শুরু করল অংশ অংশ। যে যেভাবে পারে উঠে দাঁড়িয়ে পৌছাতে চায় আলোর কাছে। স্বাধীনতার কাছে। বাবাকে নিয়ে ওসমান গাড়ি বারান্দায় চলে আসে। উপর থেকে ইট, রড, বড় বড় চাই পড়তে থাকে আশেপাশে। গাড়ি বারান্দা পার হয়ে আলোতে এসে দাঁড়ায় ওসমান। হঠাৎ পিছনেই চিৎকার শুনতে পায়। চিৎকারটা ওর চেনা। মায়ের চিৎকার। উপর থেকে খুলে পড়া একটা অংশ এসে পড়েছে মায়ের উপর। মায়ের কোলে থাকা জারার উপর। ব্যথায়, শঙ্কায় কেঁদে ওঠেন মা। দাদীরও পায়ে লেগেছে। ওসমান আর ওর বাবা দৌড়ে যায়। ইট, সিমেন্টের দেয়ালের একটা অংশ এসে পড়েছে জারাদের উপর। হাচড়-পাচড় করে টেনে বের করা হয় জারাকে, মাকে। মায়ের লেগেছে মাথায়, ঘাড়ে, রক্তে চুল মুখের সাথে লেপটে আছে। ছোট্ট জারা ধুলায়, রক্তে মাখামাখি। চেহারা চেনা যায় না। কথা বলছে না। জারাকে কোলে তুলে নেন বাবা। ওসমানের মাও অচেতন হয়ে পড়ছিলেন। দাদী এসে ধরল ওসমানের হাত। কি থেকে কি হয়ে গেল। ওসমানের কান্না আসছিল না। যেন কাঁদতে ভুলে গেছে যে। দাদী কেঁদে উঠল।
বাবা চারপাশ দেখে একটা গাড়ি খোঁজার চেষ্টা শুরু করলেন। ওদের বিল্ডিংটা ইট-লোহার কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে আছে। ধোঁয়া উঠছে উপরের দিকে।। আগুন জ্বলছে। ওসমানের চোখ জ্বালা করছে। কপালের কাটা থেকে রক্ত এসে চোখে ঢুকছে। হাত দিয়ে চোখ মোছার চেষ্টা করে ও। বাবা ওকে ডাক দেন। ওর হাতে জারাকে তুলে দিয়ে মাকে কোলে তুলে নেন। আবার শুরু হয় ওদের দৌড়াদৌড়ি। ভোরের ম্লান আলো, ধোঁয়া, আগুন, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলে ওরা। পাশের গলিতে এসে পড়ে। জেরিন আপাদের বাসাটা দেখতে পায় সে। তাদেরই মত অবস্থা। সামনের মাঠে অনেক লোক। বিভিন্ন বাসার ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষজনকে বের করে আনার চেষ্টা চলছে। নিথর দেহগুলোকে মাঠের এক পাশে রাখা হচ্ছে। বাচ্চা, বুড়ো, ছেলে-মেয়ে, বড়-ছোট। গোনার চেষ্টা করে ওসমান। দৌড়াতে গিয়ে বারবার গুনতে ভুল করে ও। সতেরোর পরে আর এগোতে পারে না। চারপাশে মানুষের চিৎকার, থেমে থেমে জ্বলা আগুন, কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাওয়া কালো ধোঁয়া। সে যেন এক নরক যজ্ঞ। দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শোনে ওসমান। আলো আধারীর ধোঁয়াশার মাঝে সামনে এসে পড়ে। বাবা চিৎকার করে থামান। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে ওরা। বেরিয়ে আসে ধ্বংসস্তূপ থেকে।
ঘণ্টা দুই হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে বসে আছে ওসমান দাদীর হাত ধরে। বাবা গেছেন ভিতরে মা আর জারাকে নিয়ে। অল্প আঘাত বলে দাদী আর ওসমান বাইরে। ভেতরে তাদের জায়গা নেই। এর মাঝেই জামিলকে নিয়ে এলো তার বাবা। আরও এলো চেনা অচেনা অনেকে। সবারই অবস্থা ওদের মত। রক্ত, ধুলায় মাখামাখি। সবার গায়ের জামা কাপড়ই রক্তাক্ত। নিজের রক্ত না অন্যের আলাদা করা যায় না। সবই লাল। শুকিয়ে কালচে।
ওসমান হঠাৎ নিজের নাম শুনে তাকায় পিছনে। বাবা আসছে। একহাতে মাকে জড়িয়ে, অন্য হাতে কাপড়ে প্যাঁচানো কি একটা। দৌড়ে গেল ওসমান। বুঝেও যেন বুঝতে চাচ্ছে না সে। তিনদিনেই অনেক যেন বয়স বেড়ে গেছে ওর। সব বুঝতে পারে এখন সে। কাপড়ে প্যাঁচানো ওটা জারা। তার আদরের ছোট বোন। ছোট্ট আঙুল। ছোট্ট হাত। ছোট্ট পা। ছোট্ট মুখ। লাল টুকটুকে গাল। তুলতুলে নরম শরীর। আর মুখের সামনের দিকে দুটো আধো দুধ দাঁত। ফুটফুটে পুতুলটা। তার আদর। তার ভালবাসা।
মার মাথায়ও ব্যান্ডেজ করা। হাটতে পারছেন না। আঘাতে, শোকে মরার মত প্রায়। জারাকে কোলে তুলে নেয় ওসমান। কাপড় সরিয়ে তার মুখ দেখার ইচ্ছা করে তার। কাপড় সরাতেই গুলিয়ে ওঠে ওসমানের ভেতরটা। মুখ থেকে অস্ফুট একটা বেদনার ধ্বনি বের হয়ে আসে। আঘাতে, রক্তে ক্ষত বিক্ষত বোনটার মুখ। চেনা যায় না। কেবল খোলা মুখের সামনের পাটিতে দুটো ছোট্ট দুধদাঁত জানান দেয়। এই তার আদরের ছোট বোন, জারা। মা আবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। দাদীকে নিয়ে আবার ফুটপাথে এসে বসে ওসমান। নিথর বোনটাকে বুকে জড়িয়ে রাখে। বাবা মাকে নিয়ে আবার হাসপাতালে ছোটেন।
ব্যথা, চিৎকার, আর্তনাদ, কোলাহল, মানুষের ছোটাছুটি, প্রিয়জন হারানোর কান্না, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, কালোধোয়ার কুণ্ডলী, সব কিছু ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পড়ে ওসমানের গায়ে। শুষ্ক চোখ বেয়ে আবার বেরিয়ে আসে জল। চোখের পানিতে আলোরা প্রতিফলিত হয়। চিকচিক করে। ছোটাছুটিতে কপালের কাটা জায়গাটা থেকে আবার রক্ত বেরিয়ে আসে। চোখের পাশ দিয়ে এসে কান্নার সাথে মিশে যায়। গাল বেয়ে গড়িয়ে মুখের কাছে নামে। ঠোটের কোনায় এসে জমে। জিহ্বা বের করে ছুঁয়ে দেখে ওসমান। স্বাদ বোঝে না। কান্না ভেজা রক্তের স্বাদ অনুভব করার সামর্থ্য ওর তখনও হয়ে ওঠে নি।
২৩.১১.২০১২
একটানে পড়ে শেষ করলাম। শেষের দিকে কষ্ট হচ্ছিল। চখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
তোমার সেরা পোস্ট।
পেপারে, টিভিতে, ছবিতে আগে দেখেছি অনেক। কিন্তু ভিডিওটা দেখার পর নিজেকে ওখানে কল্পনা করলাম। মনের আয়নার দেখা জীবনটাকেই তুলে আনার চেষ্টা করেছি মাত্র। ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল। 🙂
খুব ভাল লেখা সন্ধি। মানুষ নিজেকেই মারছে দশদিক। একদিন শুধু হয়ত গুলি-গোলা-কামান-ছোরাই পড়ে থাকবে পৃথিবীতে মরচে পড়ে যাবার জন্য। মানুষকে বাঁচানোর জন্য আর কেউ নেই আজ দশদিকে। আবার মানুষকে বাঁচাতে পারে একমাত্র মানুষই।
সুমাদ্রী ভাই, মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। মাঝে মাঝে এমনি মনে হয়। এমন এক সময় আসবে, কেবল মানুষ মারার মারনাস্ত্র থাকবে পড়ে। মেরে ফেলার মত মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। 🙁
খুব টাচি একটা লেখা। অনেক গুলো চরিত্র এসেছে তাই প্রথমে বুঝতে একটু সমস্যা হয়েছে। কিন্তু শেষ করেছো বেশ ভালোভাবে।
একটা ছোট ছেলের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন চরিত্রগুলোই আনার চেষ্টা করেছি মাত্র। গল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে সবার প্রতি হয়তবা সুবিচার করা হয় নি। তারপরেও ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল... 🙂