কি নিয়ে লিখব, কি নিয়ে লেখা যায়, এই সেই আজেবাজে চিন্তায় দিন পেরিয়ে যায়। রাত্রি ভোর হয়। আবার দিন আসে। দিন যায়। কিন্তু লেখা আর হয় না। অলস সময় আলস্যেই পার হয়ে যায়। তাই এই ছন্নছাড়া লেখার খাতা। যা মনে আসে, যাচ্ছেতাই, সব লিখে ফেলা। মনের অবিন্যস্ত চিন্তাগুলোকে শব্দের আকারে লেখার খাতায় তুলে আনা। যোগসূত্র-হীন সব বিচ্ছিন্ন চিন্তা-রাশি। মনের আনাচে-কানাচে ঘুপটি মেরে থাকা কল্পনারা যদিবা এই সুযোগে বাস্তবের দেখা পায়। কল্পনা থেকে অবয়ব পেয়ে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পায়। তাই বা কম কি। মানুষ তার জীবনে কত চিন্তায় তো করে। আচ্ছা যদি কল্পনাদের জীবন থাকত, যেমন গাছেরও জীবন আছে। আগে যেমন মানুষ ভাবত, গাছের কোন জীবন নেই। আচ্ছা, গাছ কি ব্যথা পায়? গাছেদেরও কি অনুভূতি আছে। তাদের কি পাওয়াতে আনন্দ, না পাওয়াতে বেদনা ভর করে। আমাদের কষ্টগুলো যেমন মাঝেমাঝে অশ্রু হয়ে বের হয়ে আসে, তাদের কষ্ট প্রকাশের কি এমন কোন ব্যবস্থা আছে? তাদের কি কখনও খুব একাকী মনে হয়। না তারা প্রকৃতির অংশ হিসেবে সব সময় কারও না কারও সঙ্গ পায়। গোধূলি বেলায় আমাদের যেমন মনটা কেমন করে ওঠে, যেন মনে হয় এই সময়টাতে প্রিয় কেউ কাছে থাকলে ভাল হত; তাদেরও কি এমন মনে হয়। কিংবা ঘন বরষায় যখন মনের অনুভূতিগুলো বৃষ্টির পানির সাথে দ্রবীভূত হতে শুরু করে, একটু একটু করে, তাদেরও কি এমন হয়। বিজ্ঞান কি এতটা উন্নত হতে পেরেছে, যে গাছের অনুভূতি নিয়ে গবেষণা করবে। গাছের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষবে। কি তার ভাল লাগে, কি খারাপ লাগে, কিসে সে দুঃখ পায়, কিসে তার আনন্দ, তা কি বের করা গেছে।
ফিরে আসি আগের কথায়। যদি কল্পনাদের জীবন থাকত, যদি তাদের আলাদা অস্তিত্ব থাকত, যদি কল্পনাদের অনুভূতি থাকত, যদি অনুভূতিদের কল্পনা করার ক্ষমতা থাকত তবে কেমন হত। তবে কি এত হেলায় আমরা তাদের হারিয়ে যেতে দিতাম। ভাষাহীন, ইন্দ্রিয়হীন কল্পনারা হয়ত মনের আনাচে কানাচে ডুকরে কেঁদে ফেরে। অনেকেই হয়ত আবছা কুয়াশার মতই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। নয়ত শিশির হয়ে ঝরে পড়ে। নিম্ন মাধ্যমিকের জীববিজ্ঞান ব্যবহারিকের একটা স্মৃতি মাঝে মাঝেই আমাকে তাড়িয়ে ফেরে। হারিয়ে যেয়েও হারায় না। বারবার ফিরে ফিরে আসে। আমাকে ভাবায়। আমাকে কাঁদায়। ব্যবহারিকের অন্যতম পরীক্ষা ছিল, কুনোব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র। তো ব্যাঙ মহাশয়দের স্যাভলনে ডুবিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে রাখা হত। তারপর জ্ঞানের নিমিত্তে ছুরি-কাচি-ব্লেড দিয়ে আমরা তার হাড়ির খবর নিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তাম। ব্যাটা মোটাসোটা, না পাতলা চিকন। পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে বোঝার চেষ্টা করতাম বইতে যা আঁকা, তা আসলেই বাস্তব কিনা। কাটাকাটি শেষ হলে হৃদপিণ্ড, যকৃত আরও হাবিজাবি জঞ্জালগুলোকে ফেলে দিয়ে ধুয়ে-মুছে হাসিমাখা মুখ করে অপেক্ষা করতাম, নিজের সুকীর্তি দেখিয়ে গুরুমহাশয়ের বাহবা, সাথে বছর শেষে ফলাফলের ঘরে কিছু অংকের হরফের আশায়। এভাবে বিজ্ঞান শিখতে গিয়ে কত ব্যাঙ, আরশোলা, কেঁচো ভাইয়াদের শরীর নিয়ে কাটাকুটি খেলেছি। কিন্তু একদিন ব্যাঙের হৃদপিণ্ড কেটে বাদ দেয়ার আগে হঠাৎ চোখে পড়ে গেল তার কম্পন। অচেতন শরীরেও রক্ত পাম্প করে চলেছে লাব-ডাব শব্দে। ভাল করে তাকিয়ে দেখলে চোখে পড়ে তার ওঠানামা। হাতের আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলে অনুভব করা যায় তার সংকোচন-প্রসারণ। তার অবিশ্রাম কম্পন যেন আমার হাত বেয়ে আমার শরীরেও শিহরণ জাগায়। জীবনকে যেন আমি এই প্রথম এত কাছ থেকে অনুভব করলাম। একের জীবনের স্পন্দন যেন আমায় আমার জীবন স্পন্দন বুঝিয়ে দিল। এক হাতে অস্ত্র, অন্যহাতে জীবন, স্পন্দন, অলিন্দ-নিলয়-কপাটিকা। ছুরির একটা পোঁচেই শেষ হয়ে যাবে তার ছুটে চলা। লাল রঙের গাড় তরলের ছোট্ট একটা পোটলায় পরিণত হওয়ার অপেক্ষা। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ থেমে যাওয়া। যমদূতের মত হাতে করে আরেকটি জীবন নিয়ে চিন্তামগ্ন আমি।
নিজেকে কেমন যেন যমদূত মনে হয়, মনে হয় ব্যাঙেরও তো জীবন আছে। কেউ যদি এভাবে একহাতে আমার হৃদপিণ্ড নিয়ে বসে থাকত, যার আরেক হাতের ছুরির এক পোঁচে আমার মুক্তি। তবে কেমন হত। কল্পনা যেন বাস্তবের আমার মুখে চপেটাঘাত করে সজোরে। আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। হয়ে পড়ি নির্বাক। অনুভূতিহীন। জড় পদার্থ।
আমাদের কল্পনাগুলোও কি এভাবে তন্দ্রাচ্ছন্ন-ভাবে হারিয়ে যায়। সারাদিন কতই না কল্পনা করি। হঠাৎ এক কল্পনা থেকে অন্য কল্পনা। এভাবে কল্পলোকের এক ডাল থেকে আরেক ডালে ছুটে বেড়ানো। কোন কোন ডালে হয়ত একটু স্থায়িত্ব, বেশিরভাগগুলোতে ক্ষণিকের অবস্থান। হয়ত কল্পনাগুলো কোন স্পষ্ট অবয়ব পাওয়ার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই যমদূতের মত অবসান করে চলেছি এক একটি জীবন। ঘাতক আমি। হন্তারক আমি। শুনছি না কোন কথা। কোন আর্তি। নির্দয়ের মত হত্যা করেই চলছি। পাপবোধ আমাকে ঘিরে ফেলে। আমি আবার ভাবনার জগতে ডুবে যাই। কখনও আবার ঘটে ভাব-মুক্তি। ফিরে আসি বাস্তবে। বাস্তব-কল্পনার মিশেলে বয়ে চলে সময়। একটু একটু করে। কালঘড়ি টিকটিক করে তার চলে যাওয়ার বিরহ গীত রচনা করে। বাস্তব আমাকে টেনে নামিয়ে আনে। ছিন্ন করে আমার চিন্তাসূত্র। আমি আবার হারিয়ে ফেলি আমার কল্পনাদের। হারিয়ে ফেলি বাস্তবতায়।
অনেক দিন লেখালেখি করা হয় না। এমন না অনেক লেখালেখি করি। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষে কাগজ-কলম-পেন্সিল তো এক রকম উঠেই গেছে। তাও মাঝে মাঝে সাধের ডায়েরি আর পেন্সিলটা আহবান করে। আপনজনকে সময় না দেয়ায় মুখ ভার করে টেবিলের উপর পড়ে থাকে। অপরাধবোধ থেকে তাদের কাছে টেনে নেই। আলিঙ্গন করার মানসে জড়িয়ে ধরতে যাই। বাকহীন জড়বস্তুরা তাদের অভিমান ব্যক্ত করে। চেষ্টা করি কিছু লিখতে। তাদেরকে একটু সময় দিতে। কিন্তু আলস্যের অদেখায় পছন্দের শব্দরা ফাঁকি দেয়। আসি আসি করেও কাছে আসে না। ধরা দেয় না। তার জানে তাদের ছাড়া যে আমি অচল। আমাকে বিপদে ফেলে তারাও মজা নেয়। কাছের মানুষকে দুঃখ দিয়ে আমার জীবনে তাদের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করে। শব্দহীন, ভাষাহীন, অভিব্যক্তি-হীন আমি মনের কল্পনাগুলো নিয়ে বসে বসে আবার ভাবি। কিভাবে এই অভিমানীকে মানানো যায়। কিভাবে তার রাগ ভাঙা যায়। বড় স্বার্থপর আমি। নিজের প্রয়োজনে শব্দদের নিয়ে খেলতে ভালবাসি। খেলা ভাঙলে তাদের আবার আস্তা-কুঁড়ে ছুড়ে ফেলি। তারা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। আবার দরকারের সময় কাছে টেনে নেই। এ যেন এক হৃদয়হীন প্রেমিকের গল্প-কথা। ইচ্ছেমত প্রেমিকাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই। দুঃখে কাছে টানা, সুসময়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া। কথার সাথে এ আমার এক অমানবিক আচরণ। তাও কিন্তু আমি আমার প্রেমিকাকে ছাড়ি না। সময়মত-সুযোগমত নিভৃতে তাকে আপন করে নেই। গাড় আলিঙ্গনে তাকে আষ্ঠেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলি। তার ওষ্ঠে আমার ভালবাসার চিহ্ন একে দেই। তার চুলে মুখ ডুবিয়ে সুবাস নেই। আমার মানসজগতের কল্পনারা তার সাথে বন্ধুত্ব করে। তার মাঝে বিলীন হয়ে যায়। কানে-কানে কথা হয়। কথা হয় অধরে-অধরে। এভাবেই চলে আমাদের ভাব বিনিময়। আমাদের মান-অভিমান। হাসি-ঠাট্টা। লুকোচুরি খেলা। হয় একটু ছোঁয়াছুঁয়ি। সে আমায় বাঁধা দেয়। আমি রাগ করি। কপট অভিমান। সে আবার কাছে টানে। আমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করে। আমি কিন্তু খুব সেয়ানা। তার ভালোবাসার সুযোগে তাকে ভাল করে দেখি। কাছে টেনে দেখি। স্পর্শ করে দেখি। গন্ধ নিয়ে দেখি। অনুভব করি তার উত্তাপ, তার শীতলতা। তার নৈকট্য, তার দূরত্ব। আমার স্পর্শে তার কম্পন, তার শিহরণ। অনুভব করি। চেনার চেষ্টা করি তার অচেনা অংশগুলো। ছুঁয়ে দেখতে চাই তার অধরা অঙ্গটুকু। শুনতে চাই তার স্পন্দন। বুঝতে চাই তার অবয়ব। পেতে চাই তাকে পূর্ণরূপে। কারও সাথে ভাগাভাগি করে নয়। এভাবেই চলে আমাদের খুনসুটি। আমাদের ঘর-সংসার। আমার কল্পনারা, আমার প্রেমিকাদের নিয়ে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার।
১৫.০৯.২০১২
চমৎকার ভালবাসার গল্প। অনেক বেশি রক্ত-মাংসের এবং জীবন্ত মনে হয়েছে। সাবজেক্ট পরিবর্তন করলে অবশ্য মিনিংও পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমরা কি ভাববো ওভাবে?. 😛 ..।চালিয়ে যাও। :clap:
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ 🙂 । লেখকের কাজ, বাস্তব-কল্পনার মিশেলে কিছু কথা তুলে ধরা। পাঠক তার স্বাধীন চেতনা দিয়ে তার থেকে যেকোন অর্থ করে নিতে পারে, পারে আপন কল্পনায় নিজের জগত তৈরি করতে। সেখানে লেখকের অনুপ্রবেশ না করাই শ্রেয়... 😛
ভালো লিখেছ। অনেক দিন পর লিখলে বোধ হয়।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 🙂 অলসতায় কিছুই করা হয় না। তাই অনেক দিন পর... 😀
দাদা, তোকে বিয়ের পিড়িতে এবার বসাতেই হবে দেখছি 😛 😛 😛 . ..দাড়া তোর মা- কে সুখবরটা দিচ্ছি... !! 😉
লেখা ভালো হয়েছে...চালিয়ে যা...এভাবেই লিখতে লিখতে বড়ো লেখক হয়ে যাবি... 🙂 একটা লাইনের প্রশংসা না করলেই নই...
"তার অবিশ্রাম কম্পন যেন আমার হাত বেয়ে আমার শরীরেও শিহরণ জাগায়। জীবনকে যেন আমি এই প্রথম এত কাছ থেকে অনুভব করলাম। একের জীবনের স্পন্দন যেন আমায় আমার জীবন স্পন্দন বুঝিয়ে দিল। এক হাতে অস্ত্র, অন্যহাতে জীবন, স্পন্দন, অলিন্দ-নিলয়-কপাটিকা। ছুরির একটা পোঁচেই শেষ হয়ে যাবে তার ছুটে চলা। লাল রঙের গাড় তরলের ছোট্ট একটা পোটলায় পরিণত হওয়ার অপেক্ষা। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ থেমে যাওয়া। যমদূতের মত হাতে করে আরেকটি জীবন নিয়ে চিন্তামগ্ন আমি।"
:clap: :clap: :clap:
যাক এতদিনে বড় বোনের মত একটা কাজ কর... 😛 লেখা ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল... 😀
দারুন লিখেছো :thumbup:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ... 🙂
চমৎকার লেখা ভাই।
আপনার ডায়রি লেখার অভ্যাস চালু রাইখেন। কি বোর্ডে চেপে অনেক কিছুই লেখা যায় না, কোথায় যেন একটা ফাঁকা কিন্তু রয়েই যায়।
ভাল থাকবেন। আপনার সাথে লেকের পাড়ে বিড়ি খাওয়ার সময়টা মিস করি।
দেখা হবে আবার- কোথাও না কোথাও তো অবশ্যই।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, রেজা। 🙂 অভ্যাস রাখার চেষ্টা করব, দেখা যাক।
আর আবার কোথাও হয়ে যাবে দেখা নিশ্চয়, আশা করি। আবার দেয়া যাবে আড্ডা। খুব ভাল কিছু সময় পার করেছি, তোমাদের ওখানে। 🙂
আহেম আহেম............
\"why does the weasel go pop? does it matter?
if life is enjoyable, does it have to make sense?\"
পিচ্চি পোলাপানরাও ডাউট দেয়...সাহস কত... পাঙ্গা না খেয়ে এই অবস্থা... লাগাও দশটা হামাগুড়ি... 😛