আহার ও বাহারী মানুষ

কিভাবে শুরু করি ঠিক বুঝতে পারছিনা। শুরুটা এরকম।

আমার এবং আমার সহধর্মীর ভাত না খেয়ে একদিন মানে ২৪ ঘন্টা পার করা মুশকিল। গত এক যুগেরও বেশি সময় পশ্চিমা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে পার করলেও ডাল-ভাত না খেয়ে নিজেদের কষ্ট দেয়ার মত পশ্চিমী হতে পারি নি এখনো। বরং যে শহরেই যাই না কেন গুগলে রিভিউ পড়ে সে শহরের বেস্ট ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করে মনের আশা পুরণ করি।

গত বছর নোভা স্কোসিয়া-এ গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে গিয়েছিলাম। বেশ ক’দিন পথে পথে ছিলাম লং ড্রাইভে। এক সময়ে মনে হলো এবার একটু দেশী খাওয়া দরকার। “Minsoo” নামের এশিয়ান-ফিউশন রেস্টুরেন্টএ পৌঁছে গেলাম কোনো এক বেলার খাবার খেতে। সার্ভার এর সাথে দু’একটা কথা বলতে না বলতে তার বলা এবং চলার ধরণ শুনে-দেখে মনে হল উনি বাংলাদেশী। এরপর এপিটাইজার নিয়ে আবার আমাদের টেবিলে আসার পর আমরা তাকে জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না, “Where are you from?” উনি এক সেকেন্ড এদিক ওদিক না করে জবাব দিলেন, “I am prom Kuria“; বুঝলাম, উনি pure নোয়াখালির মানুস অথচ বলছেন কোরিয়ান! নাক-চোখ কোনোটিই ওই দেশীয় নয় অথচ সে কোরিয়ান! আমার নাছোড়বান্দা সহধর্মী আবার প্রশ্ন করলেন,“Are you originally from Korea or you migrated there?”; “No I am originally prom India because I was born in India” উত্তর এলো। খুব অদ্ভুত লাগলো শুনতে। সাধারনত ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানীরা খুব নিষ্ঠা-ভালোবাসার সাথে নিজেদের দেশের পরিচয় দেয় অথচ এই লোকটি অত্যন্ত নির্লজ্জের মত নিজ দেশের পরিচয় লুকিয়ে গেল আমাদের কাছে। আমি ভীষন বিরক্ত হলাম; আমার চেহারা দেখে তা না বোঝার কোনো উপায় নেই। অনেক বিড়বিড় করলাম। “লোকটা কি আমাদেরকে বোকা পেয়েছে? নিজের দেশের পরিচয় লুকায় এমন লোকের দোকানে আমি খাবো না।” আমার স্বামীটি ক্ষেপে গেলেন, ভাবলেন আমি বোধ হয় আসলেই উঠে বের হয়ে যাবো। বোঝাতে শুরু করলেন, “তোমার কি? আমাদের কি?দেশের পরিচয় লুকাক না! বাদ দাও। খেয়ে চলে গেলাম তো ভুলে গেলাম শেষ!” না আমার কাছে এর শেষ নাই। নিজের দেশ নিয়ে আমার কোন লজ্জা নাই। আমি বাংলাদেশের মাটিতে সে দেশের খেয়ে পরে বড় হয়েছি! এতোটা অকৃতজ্ঞ হবার কোনো সুযোগ যেন না আসে কোনোদিন! লোকটার প্রতি আমার অশ্রদ্ধা তৈরী হলো। তাতে অবশ্য তাঁর কিছু যায় আসে না। যাই হোক, সে গরু ভুনা নিয়ে আসলো যা ছিল শেফ’স স্পেশ্যাল; একেবারে দেশী স্টাইলে রান্না করা। খাবার সার্ভ করতে করতে লোকটা জানতে চাইল, “Do you know Chittagong?” আরো মেজাজ খারাপ হলো। শুধু যে সে বাংলাদেশী তাই না, হয়তো সে আমার শহরেরই। রবিন উত্তরে বললো “Yes, my wife is from Chittagong. Are you from Chittagong as well?” সে সত্য বলার সুযোগ পেয়েও আবার মিথ্যা বললো, “No, once I visited one of my priend there” মহা অদ্ভুত! বিল দিয়ে চলে আসবার সময় খাস বাংলায় সে বলল, “ভাল থাকবেন, আবার আসবেন।” তাহলে আমরা ঠিকই ধারণা করেছিলাম, লোকটা বাংলাদেশী। রবিন তাকে বললো, “ওহ! আপনি বাংলা জানেন?” সে আবার শুদ্ধ “বাংলাদেশী বাংলা”য় বললো, “জ্বি একটু একটু।” বদ্ধ উন্মাদ না হলে এত বড় risk কেউ নেয় না। ইন্ডিয়ান পরিচয় দিয়ে আবার বাংলাদেশী কায়দায় বাংলা বলছে আমরা বাঙ্গালী জানার পরও। কতো কিছু যে দেখছি-দেখবো এই ছোট্ট জীবনে!

সেবার মেইন এ পৌঁছেও আমরা ইন্ডিয়ান খাব বলে যে দোকানে গেলাম তার নাম “Taste of India”; কথার শুরুতে রেস্টুরেন্ট মালিক জেনে নিলেন আমরা দেশী এবং তার ওপর আমরা রয়্যাল ডিসট্রিক্ট-এ বিলং করি। অনেক খাতির করলেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার, অর্ডারের বাইরে খাবার এবং মসলার কম-বেশী যে ভাবে চেয়েছি তৈরী করে দিয়েছেন, “বলেছেন, আপনারা হইলেন আঙ্গো নোয়াখালীর মানুষ (আমার শ্বশুর- বাড়ী), দোকান রাখি কি লাভ যদি নিজেদের দেশী মানুষেরে ঠিকভাবে খাওয়াইতে না ফাইরলাম!”

ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম বোল্ডার, কলোরাডোতে। কয়েকদিন ভিনদেশী খাবার খেয়ে ক্লান্ত হয়ে আবার নিজের দেশী খাবারের শরণাপন্ন হলাম “Curry & Kabob”এ। অনেকক্ষণ হাতে মেন্যু নিয়ে বসে থেকে অর্ডার দিতে দেরি হওয়ায় মালিক নিজে এসে জানতে চাইলেন,“Do you need any help?” তারপর নিয়মমাফিক অর্ডার-অপেক্ষা-খাওয়া সব হলো। চলে আসার সময় মালিক জানতে চাইলেন “Where are you from?”;নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলছিলাম তা খেয়াল করেছিলেন হয়তো আর গায়ের রঙতো আর লুকিয়ে রাখার কিছু নয়। যেই বললাম বাংলাদেশী, সাথে সাথে ভদ্রলোক খুশী হয়ে বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন,”আমিও ঢাকার, এই দেশে প্রায় তেতাল্লিশ বছর ধরে আছি, ছেলে-মেয়েরা যে যার মতো পড়াশুনা করে, বিয়ে-থা করে ব্যস্ত..ইত্যাদি।” নিজের দেশের লোক পেয়ে কথা হলো অনেক। চলে আসার সময় মনে হলো কারো বাড়ী থেকে দাওয়াত খেয়ে বেরিয়ে আসছি, এমন একটা অনুভূতি শুধুমাত্র বাঙ্গালীর অকৃত্রিম আন্তরিকতার কারণেই হয়তো হয়ে থাকে।

বোল্ডারের হাইকিং সেরে ফেরার পথে শেষ বিকেলে রাতের খাবার সারবো বলে আমরা গেলাম পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরী নেপালী রেস্টুরেন্ট,“Kathmandu”তে। খুব যত্ন করে ডাল ভুনা-গোশ তৈরী করে দিল আমাদের পছন্দমতো। মন ভরে খেলাম আমরা। মেয়ের পছন্দের ইন্ডিয়ান ডিশও পেলো। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আবার যখন গেলাম দু-তিনদিন পর,অর্ডারমাফিক সবই এলো চোখের সামনে কিন্তু সবই ঠান্ডা! এই আমাদের বাঙ্গালীর সমস্যা! বানরের মতো। ভালো বলেছো তো গেছো! কোয়ালিটি নিয়ে আর ভাববে না এমনকি সার্ভিসও না! অনেক ডাকাডাকি করেও ওয়েটারের দেখা পেলাম না কারন সে অন্য টেবিলগুলোতে ব্যস্ত। যখন তার দেখা পেলাম, খাবার ঠান্ডা বলার পর কোনো ভ্রূ-ক্ষেপ না করে চলে গেল। মেয়ে বলে ফেললো, “Ma, it is a good lesson for us. We won’t praise in front of the restaurent people, otherwise they won’t care if we go back to the same restaurant for good food” আমি অবাক হলাম না মেয়ের কথায়। শিক্ষা হলো বই কি!

এই গ্রীষ্মের ছুটিতে কুয়েবেক-এ বেড়াতে গেলাম। যথারীতি রসনা বিলাসের উদ্যেশ্যে চলে গেলাম মেডিটেরিনিয়ান রেস্টুরেন্ট-এ; কার্টিয়ার রোডের উপর যেখানে বিভিন্ন দেশের রেস্টুরেন্ট আছে। সাড়ে পাঁচটায় খোলে সব রেস্টুরেন্ট ডিনারের জন্য। আমরা ঘড়ি দেখে ঢুকলাম কিন্তু কেউ এলো না আমাদেরকে বসানোর জন্য। ভাবছিলাম, এটা তো Sit down restaurant কিন্তু ব্যাপারটা কি? কোনো জনমানবহীন অথচ রিভিউতো ছিলো চমৎকার! ভেতর থেকে দৌড়ে এল “আরিয়ানা”র মালিক, অ্যারাবিক এক্সেন্টে ইংরেজীতে বললো, “আমাদের ওয়েটার এখনো কাজে আসে নি, তোমরা তোমাদের পছন্দ মতো টেবিলে বসো প্লিজ।” একটু পর এলো টুপি মাথায় হাসিখুশী ছোটো-খাটো একজন। গ্লাসে পানি ঢেলে মেন্যু দিয়ে চলে গেল। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, বাংলায়, কে কি খাব, কে কার সাথে কোনটা শেয়ার করবো ইত্যাদি। লোকটা ফিরে এলো আর সোজা সিলেটী ভাষায় জানতে চাইল, “আফনারা কুন দেশের? বাংলাদেশী?” ব্যস! আহা কি আনন্দ! খুব সহযোগিতা করলেন ভদ্রলোক। বর্ণনা দিলেন কোনটা কেমন হবে খেতে, উনি কি মসলা দেবেন কোন খাবারে। আমরা জানতে চাইলাম উনিই কি শেফ নাকি। খুব উৎসাহের সাথে বললেন, “জ্বি, আফা, আফনাদের দুয়ায় আমি নয় বচ্ছর এইখানে শেফের কাম করিয়া খাই।” ভদ্রলোক আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে আমাদের অর্ডারের পাশাপাশি শেফ’স complimentary সমুসা পাঠালেন কিচেন থেকে। বুঝলাম আতিথেয়তা আর বাঙ্গালী দুটো ব্যাপারকে আলাদা করা যাবে না। রেস্টুরেন্ট ছিল আফগানী, তাই সে রকম দেশী মসলার প্রাচুর্য্য না থাকলেও ভদ্রলোক নানান কায়দায় আমাদেরকে দেশী স্বাদের খাবার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তা আমরা তার তৈরী করা খাবার খেয়ে বুঝতে পেরেছি। চলে আসবার সময় আমার হাসব্যান্ড সেল্ফি নিতে ভুললেন না! টিপু আহমেদ নামের এই অমায়িক লোকটি আমাদেরকে বিদায় দেয়ার সময় বললেন, “Please আবার আসবেন।” আমরা হয়তো যাব আবারো সেখানে, কখনো যদি কুয়েবেক-এ যাই। তবে বন্ধুদের জন্য পরামর্শ রইলো কুয়েবেক-এ বেড়াতে গেলে এই রেস্টুরেন্ট-এ যাবার। আহার শুধু পাকস্থলীর ব্যাপার নয়, মনেরও আহার হয় বাহারী মনের মানুষের দেখা পেলে।

শাহনাজ রহমান, ২৯শে আগষ্ট ২০১৬, ভার্জিনিয়া।

৩ টি মন্তব্য : “আহার ও বাহারী মানুষ”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    চমৎকার লিখেছেন আপা। দেশের বাইরে কিছুদিন থাকার কারনে এমন অম্লমধুর অভিজ্ঞতা একটু হয়েছে। তবে রিয়েলাইজ করেছি, "সাধারনত" "সার্ভিস" ব্যাপারটা মনে হয় আমাদের মধ্যে নেই।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।