A ফর্ম আর B ফর্ম, প্রতিটা ক্লাসেই দুটো করে ছিল। “ফর্ম” শব্দটার সাথে পরিচয় কলেজে গিয়ে, তার আগে তো ক-শাখা, খ-শাখা এই টাইপের জিনিষ ছিল। আমাদের ৫৯৯ থেকে ৬২৩ পর্যন্ত A ফর্ম আর ৬২৪ থেকে ৬৪৮ পর্যন্ত B ফর্ম। সবার জন্যই আলাদা ডেস্ক চেয়ার। দারুন ব্যবস্থা, সবকিছু অবাক হয়ে দেখছি, শিখছি আর মনে রাখার চেষ্টা করছি।
প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকার পরে একটু ভয়ে ভয়ে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম, এদিক ওদিক সবাইরে তাকিয়ে দেখি, বেশীর ভাগরেই চিনি না। একটু পরে একজন আপা ক্লাসে ঢুকলো, লাল পাড় দিয়ে সাদা শাড়ি পড়া, বিধবা পোশাক, আপা দারুন সুন্দরী দেখতে। প্রথমেই নিজের পরিচয় দিলেন, “আমার নাম হুসনে আরা, আমাকে তোমরা সবাই ম্যাডাম বলে ডাকবে, আমি তোমাদের ফর্ম মাস্টার”।
সিস্টেমের কারনে আমি B ফর্মে, নিজের ইচ্ছায় না।
সবকিছুই নতুন লাগে, স্কুল হয়ে গেল কলেজ, শাখা হয়ে গেলো ফর্ম, ক্যাপ্টেন হয়ে গেলো ফর্ম লিডার তাও আবার একজন এসিস্টেন্ট সহ। ফর্মের একজন মাস্টারও আছে, উনারে আপা বলা যাবেনা, ম্যাডাম বলতে হবে। সামনের দেওয়ালের কালোটা ব্ল্যাক বোর্ড, পিছনের দেওয়ালের নীলটা ডিসপ্লেবোর্ড। ম্যাডাম যেখানে দাঁড়াইয়া আছে ওইটা ডায়াস, পিছনের খালি ডেস্ক চেয়ার টার নাম ভিজিটর ডেস্ক, ঐখানে বসা নিষেধ। দুইটা দরজা, একটা অভিধান টেবিল, লাইট ফ্যান সুইচের সংখ্যা মনে নাই। একটা সিট প্ল্যানও আছে, আমিতো খালি আবাক আর অবাক।
ম্যাডাম চলে যাওয়ার পরে আমরা সবাই সুড়সুড় করে A ফর্মে ঢুকলাম। আমাদের তো অনেক কিছু আছে, এদের কি আছে দেখা দরকার। আমাদের মতো সবই এক শুধু ম্যাডামের পরিবর্তে একজন স্যার, জনাব আমিরুল ইসলাম, অংক করায়।
১। A ফর্মের ছেলেরা ক্লাসে গভীর মনযোগী, প্রেপে চুপচাপ পড়ালেখা করে। B ফর্মের গুলা ক্লাস টাইমেই ৭/৮ জনে বারান্দায় নীল ডাউন হয়ে থাকে, প্রেপ টাইমে সংখ্যাটা বেড়ে যায়। সব সিনিয়ররা এইটা দেখে খুব মজা পায়।
২। এসিস্টেন্ট ফর্ম লিডার জাহিদুল, প্রেপে যারা শয়তানি করে তাদের নাম্বার বোর্ডে লিখে রাখে, স্যার এসে শাস্তি দেয়, কঠিন দায়িত্ব তার, সে দুষ্টামি করেনা। বোর্ডে নাম্বার লেখতে লেখতে দেখা যায় ২৪ জনের নাম্বারই লিখে ফেলেছে। আর লেখার কিছু নাই তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে পড়ালেখা করার চেস্টা করে। ফর্ম লিডার আস্তে করে উঠে গিয়ে সবার নাম্বার মুছে দিয়ে জাহিদুলের ‘৬৩৬’ নাম্বার লিখে রাখে, সে টের পায় না। তারপর ডিউটি টিচার এসে জাহিদুলরে পাঙ্গা দেয়।
৩। A ফর্মের সবার রেজাল্ট খুব ভালো, B ফর্মের যা তা অবস্থা, আমরা কয়েক জন তো নিয়মিত ফেল করি। ফর্ম মাস্টার ম্যাডাম প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে ঝাড়ি খায়, ক্লাসে এসে আমাদের কান মলা শুরু করে। কয়েক বছর এই অবস্থা চলতেই লাগলো।
৪। চাঁদের যেমন কলঙ্ক থাকে তেমনি A ফর্মেরও একটা কলঙ্ক ছিলো। রেজওয়ানের A ফর্মে ভালো লাগতো না, সে B ফর্মে চলে আসতো, B ফর্ম থেকে একটাকে A ফর্মে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। যা তুই অন্তত মানুষ হ।
৫। কলেজ অথারিটির সহ্যের একটা সীমা আছে, অতিষ্ঠ হয়ে ফর্ম দুটো রিফর্ম করে ফেললেন, সম্ভবত দশম শ্রেণীর সময়। A ফর্মের অর্ধেক পড়ুয়া ছেলেদের B ফর্মে, B ফর্মের অর্ধেক গাধা A ফর্মে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পেল। কিছু ছেলে ‘বাবা’ হারা কিছু ছেলে ‘মা’ হারা হয়ে পাথর হয়ে গেলো। আমার নিজের কোন কোন ক্ষতি হয়নাই।
৭। “সঙ্গ দোষে লোহা ডুবে”, নইলে তো লোহার এমনিতেই ভেসে থাকার কথা। আগে গণ্ডগোল হইত এক ফর্মে, এখন হয় দুই ফর্মে। চরম অবস্থা, ক্যাডেটদের ধরা খাওয়াইতে গিয়া স্যাররা ধরা খাইয়া গেলো। হুসনে আরা ম্যাডাম একা ঝাড়ি খাবে কেন? আমিরুল ইসলাম স্যারও খাওয়া শুরু করলো।
৮। তারপরেও কিভাবে যেন আমাদের SSC র রেজাল্ট ভালোই হয়েছিলো। যে আমি নিয়মিত ফেল্টুস ছিলাম, ফেল করে একটা রেকর্ড করে ফেলতে পারি এইটা নিয়া স্যাররা চিন্তিত ছিল, সেই আমি কিনা…। স্যারদের কথা বাদ, আমি নিজেই হাঁ হয়ে গেছিলাম। বাংলাতে মাত্র ৩ জনে লেটার পাইছিলো, আমি ক্যামনে যেন পাইছিলাম। স্যাররা জামাই আদর শুরু করছিলো।
এস এস সি পরীক্ষার ফর্ম পুরুন করার আগে স্যাররা বার বার বলে দিয়েছিলো কিভাবে কি করতে হবে, নতুন সিস্টেমের আমরাই প্রথম ব্যাচ। আগে পেন্সিল দিয়ে ঘর পূরণ করবে, তারপর সব ভালোমতো চেক করে ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে শেষে কলম দিয়ে ঘর গোল করে পূরণ করে দিতে হবে। জাহিদুল খুবই সিরিয়াস, সব ইন্সট্রাকশনস ঠিক ভাবে মেনে ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়েছিলো। পরের দিন ভিপি স্যার তাকে অফিসে ডেকে পাঠায়, কারন সে কোথাও একটা ভুল করেছে।
আমরা উৎসাহিত হয়ে আছি সে কি ভুল করেছে জানার জন্য। আব্দুল হক পিছনে পিছনে গেছে খোঁজ নেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পরে আব্দুল হক এসে খবর দিলো, জাহিদুল ফর্ম পুরুন করার সময় Male এর পরিবর্তে Female এর ঘর পুরন করে দিয়েছে, ফর্ম বাতিল। এই ছেলেটার জেন্ডার জ্ঞান আসলেই খুব খারাপ ছিল। নিজের জেন্ডারের জায়গায় হুসনে আরা ম্যাডামের জেন্ডার লিখা ফালাইছিলো।
ব্লগে স্বাগতম
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
এই ছেলেটার জেন্ডার জ্ঞান আসলেই খুব খারাপ ছিল। নিজের জেন্ডারের জায়গায় হুসনে আরা ম্যাডামের জেন্ডার লিখা ফালাইছিলো। :khekz: :khekz:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
জমাটি হয়েছে। খুব একচোট হাসলাম। আমরাও হুসনে আরা ম্যাডাম আর আমিরুল ইসলাম স্যারকে পেয়েছিলাম। তিনি জনসমক্ষে আমায় উদ্দেশ্য করে বলতেন, ''মোস্তফা যে এই কাজটা (কাজের বিশদ বর্ণনাসহ) করেছে, আমি কি তা কাউকে বলেছি?'' আর আমার রোল নম্বর সবসময়ই ব্লাক বোর্ডে লেখা থাকতো, কোন ব্যাপার না।
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ
ব্লগে স্বাগতম ভাই।
লেখালেখি জারি থাকুক।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
Saidul কে সাইদুলের অভিনন্দন, ব্লগে স্বাগতম l আমি ফর্ম. A'র, আমাদের সময় জোড় ক্যাডেট নম্বর A. তে যেত
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
:clap: :clap: :clap: :clap:
ব্লগে সুস্বাগতম, ভাইয়া!
প্রথম লেখাতেই মন জয় করে নিয়েছো তুমি বলতেই হবে। বাংলায় লেটার পাওয়ার জন্য কনগ্রাটস! আমি বাংলায় লাড্ডু না পেলেও খুব ভাল যে কিছু পেতাম মনে করতে পারিনা। নিজে নিজে বানিয়ে হৈমন্তীর চরিত্র আঁকতাম; সেটি পড়ে আমি আহা উহু করলেও শাজাহান আলি স্যার সব সময় পছন্দ করতেন না
আমাদের সাথেই থেকো।
অটঃ তোমার নামটি বাংলায় লিখলে ভাল দেখাবে। এডিট করে নিও, প্লিজ।
বছরের পড় বছর পার হয়ে যায় কিন্তু এ ফর্ম আর বি ফর্মের গল্পগুলা কখনও বদলায় না।
খুব জোস হইছে ভাই লেখাটা। ফর্মের সেই সময়গুলা একবারে চোখের সামনে ভেসে উঠল (সম্পাদিত)
:boss: :boss: :boss:
সাইদুল ভাইয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম। 😀 (সম্পাদিত)
সুস্বাগত ।
শুভাগমন আর সুন্দর লেখায় স্মৃতির ঝাঁপিটা উস্কে দিয়ে যাবার জন্য ।
:clap: :clap:
আহ দোস্তো ৬৪২!
অবশেষে তুই এইখানে।
আমি শিওর ইসিএফ এর মতন তুই এখানেও জমায় দিবি।
৬২৮ হবার কারনে আমিও বি ফর্মেই ছিলাম।
হোসনে আরা ম্যাডাম আর আমিরুল ইসলাম স্যার, এই দুজন শিক্ষককে আমাদের ব্যাচের পক্ষে কখনোই ভোলা সম্ভব না।
আমি ছিলাম প্রথমে ম্যাডামের ফর্মে। ম্যাডামের আদরের চোটে আমাদের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। আমরা রেগুলার ফেল করার জন্য ম্যাডামকে প্রন্সিপালের কাছে জবাবদিহী করতে হতো। এখন এটা মনে হলে বেশ কষ্ট লাগে।
কপালে সবার নাকি সুখ সয় না! ক্লাস নাইন কিংবা টেনে একবার রেজাল্ট হলো ১ থেকে ২৫ পজিশন পর্যন্ত সব স্যারের ফর্মের। আর ২৬ থেকে ৫০ পর্যন্ত এই আধামরা টাইপের রেজাল্ট আমাদের বিখ্যাত বি ফর্মের। তখন হলো সিসিআরের ইতিহাসের গন-ফর্ম চেইঞ্জ। সেখানে গিয়ে টের পেলাম, ক্যাডেদের যেমন থাকে হাউজ ফিলিংস, স্যারের তেমনি হলো ফর্ম ফিলিংস। কেন জানি স্যারকে খুবই ভয় পেতাম। তবে মন পড়ে থাকত বি ফর্মে।
যাহোক, দোস্তো ৬৪২, এইখানে ব্লগে আসছিস, ভাল কথা। কিন্তু এইখানে একটু ক্যাডেট কলেজ টাইপের অরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা আছে। দেখা যাউক, প্রিন্সিপাল স্যার সানাউল্লাহ ভাই কিনবা অন্য কোন সিনিয়র কিভাবে তোর অরিয়েন্টেশন করায়। ২০০৯ সালে ডেব্যু ব্লগ লখার পারাক্কালে আমাকে ১০টা :frontroll: দেওয়ানো হইছিল। পারলে তুইও আগেই দিয়ে দে। পরে কার না কার সামনে দিতে হয়, তাও আবার এই বয়সে!
শুভ ব্লগিং দোস্তো।
হাত খুইল্যা লিখ্যা যা।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
ভাই, ক্লাস টুয়েলভে আমার তিন ক্লাসমেট শাপলা সিনেমা হল এ সিনেমা দেখা ফিরছিল রিকশায় করে। মতলব কলেজের কাছাকাছে এসে নেমে তারপর প্রাচীর টপকে ঢুকে পড়বে। পথে আমিরুল স্যার এর সাথে দেখা। উনি শুধু বলেছিলেন, "ধরা পড়লে কি হবে জান? যাও তাড়াতাড়ি"। এই কথা উনি কলেজে কারো সাথে শেয়ার করেন নাই। উনি আসলে একটু রিজারভ থাকতেন বলে আমরা বেশি ভয় পেতাম, মানুষ হিসাবে কিন্তু অনেক ভালো ছিলেন।
=))
বুজতেসি না B ফর্ম কি সব ক্যাডেট কলেজে একি রকম? মজা সব B ফর্মে ।
সিসিবিতে সুস্বাগতম!
জেন্ডার চেঞ্জের কথাটা পড়ে খুব একচোট হাসলাম। খুবই চমৎকার ব্লগ নিঃসন্দেহে!
আমিও ক্লাস সেভেনে ফর্ম বি তেই ছিলাম। কোন সিস্টেমে পড়েছিলাম, তা মনে নেই। তবে স্পষ্টতঃই জোড় বেজোড় হিসেবেও নয়, প্রথম ২৮ শেষ ২৮ হিসেবেও নয়।