বাইশে মার্চ রাত আড়াইটায় যখন নীতাদের বাড়ি এলাম, কুয়াশা মাখা জোসনার ঘোলাটে আলোয় পাতাহীন গাছের ছায়ায় বাড়িটাকে গুগলে দেখা ৯৮ একেডিয়া বে’র নেগেটিভ মনে হচ্ছে। শাদা বরফের একটা পাতলা আস্তর গেটের বাইরে সাবানের ফেনার মত ছড়িয়ে আছে। তারমধ্যে বাস্কেট বলের একটি পোষ্ট বাড়ির কাঠের বেড়ার সামনে নিঃসঙ্গ দাঁড়ানো।পেছনে খানিকটা দূরে আরও কয়েকটা গাছের কঙ্কাল। কাঠের সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে ঘরে ঢোকার সময় মনে হল বড়দিয়ার লঞ্চে উঠছি। ছোট বেলায় গ্রামের বাড়ি চর কোটাকোলে যাবার সময় আমরা বড়দিয়া থেকে লঞ্চে উঠতাম। মধুমতির বুক চিরে কিছুদূর গিয়ে সেই লঞ্চ নবগঙ্গায় ঢুকতো।
আমাদের ঘরের প্রায় পুরোটা জুড়ে পেল্লাই এক বিছানা। তার ওপর প্রায় এক ফুট উচু ম্যাট্রেস।সব মিলিয়ে এত উঁচু যে সেখানে ওঠার জন্যে নীতা ছোট্ট দু’টি চৌকি রেখেছে দুই পাশে।একদিকে একটি জানালা স্টিমারের জানালার মত ।আর অন্য তিনটি দেয়াল জুড়ে নানান রকম পদক আর শিল্প কর্মের ছড়াছড়ি। নীতা-শাহিনের দুই ছেলেমেয়ে জোনাহ-শানার শিল্প ও শিল্পের স্বীকৃতি।
এরপর মুখোমুখি সারাহদের ঘর আর নীতাদের বেডরুম। সারাহদের ঘরে একটি দোতলা খাট, বুকশেলফ, পড়ার টেবিল ওয়াল কেবিনেট আর একটি পুঁইশাকের টব। নীতার সাধনায় বৈরি আবহাওয়াকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ওদের গ্রীন হাউসে দিব্য হেসে খেলে বড় হচ্ছে একটি পুঁইশাক আর একটি মরিচের গাছ। তারপর কাঁচের দেয়ালে স্লাইডিং ডোরের ওপারে কাঠের ডেক, তার পরে ছোট্ট একচিলতে মাঠ পেরিয়ে বরফ মাথায় দাঁড়ানো কয়েকটি পাইন গাছ। রাতে ভালো করে দেখা যায়না।
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর জানালার দিকে চোখ পড়তেই আবার ছোট বেলার লঞ্চ যাত্রার স্মৃতিটা মনে পড়ে গেলো। সেই কবে আব্দুল হাই নানা গভীর মমতায় কলাপাতায় মোড়ানো সন্দেশসহ লঞ্চে উঠিয়ে দিয়েছিলেন সেই সব কথা, কারো হাত না ধরে প্রথম একা একা সিঁড়ি বেয়ে দোতলা লঞ্চে উঠতে পারার কথা। হঠাৎ পানির কলকল শব্দ কানে আসতেই বিশাল বটগাছের ছায়ায় আমাদের নবগঙ্গার ঘাট বুকের গহনে ভেসে উঠলো। মনের ভেতরের অসংখ্য জানালা দরজায় কোনটিতে মা’কে দাঁড়ানো দেখলাম, কোনটিতে হাসনু খাঁর কাধে উঠে সাড়ে সাত বছরের আমি আমগাছের ডাল ছুঁচ্ছি, কোনটিতে কাকার সাথে তালের ডোঙ্গায় আমার বিলযাত্রা, এসব দেখতে দেখতে শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে ড্রইং রুমে পৌছে গেলাম। সেখানে মাছহীন একটি একুরিয়ামে অবিরাম জলের কলকলানি আমাকে উইনিপেগে ফিরিয়ে নিয়ে এল।
দু’দিন পর মেসেঞ্জারে বাড়ির ছবি দেখে জুনায়েদ বলল, রাজধানীতে ছিলা ভাল্লাগ্লো না। এহন গঞ্জেত গিয়া উঠছো।
আমি দুর্বল চিত্তের মানুষ।মাত্র দেশ ছেড়েছি, এর মধ্যে জুনায়েদের এই কথা! মনটা খারাপ হয়ে গেল। নীতা – শাহিন অনেক যত্নে আমাদের জন্যে ঘর সাজিয়েছে। আমাদের মন ভালো করার জন্যে নানান আয়োজন করেছে।কিন্তু প্রকৃতির পরে তাদের হাত নেই। প্রথম দিন তুষার পাত দেখতে ভালো লেগেছিলো। লাগাতার কয়েকদিনের তুষার পাত, ঝড়ো বাতাস, কনকনে শীতে মন যখন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তখনই একদিন বলা নেই কওয়া নেই ঝকঝকে রোদে ঝলমলিয়ে উঠলো জমাট বরফ। সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই গাছ পাতায় ভরে যেতে থাকলো। বাইরের লনের বরফ গলা সবুজ ঘাসে হলদে বোতামের মত ফুটে গেল ড্যন্ডিলায়ন।
এরপর বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে !মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে দু’এক পশলা তুষার পাত হয়েছে, তবে ততদিনে সেটি খানিকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে নীতাদের বাড়ির অদ্ভুতুড়ে কারবার। একদিন জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি কয়েক রঙের টিউলিপ চায়ের কাপের মত ফুটে আছে লনের এক কোনে। দু’দিন যেতে না যেতেই তার পাশে উঁকি দিতে শুরু করলো ঘন্টামুখো ড্যাফোডিল। গাছ গুলো কবে লাগানো হলো কখন বড় হলো টেরও পেলাম না।
নীতা বলল, এগুলো লাগিয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। বসন্ত কালে এরা নিজের গরজেই ফোটে। ফুল শুকিয়ে যাবার পর মাটির নিচে টিউব গুলো থেকে যায়। পরের বসন্তের জন্যে।
এই টিউলিপ শেষ না হতেই একদিক ছেয়ে গেলো নীলাম্বরি আইরিশে। ব্যক ইয়ার্ডের অবস্থাও বদলে গেলো খুব দ্রুত। সারাহদের ঘরের ডেকের দিকের বন্ধ দরজা খুলে গেলো। সবুজ ঘাস আর নানান রকম বুনো ফুলে বদলে গেলো চারিপাশ।প্রতিবেশির বাড়ির ফুল ভরা আপেলের ডাল ঝুঁকে এলো এ কাঠের প্রাচীর পেরিয়ে। সেই বাইশে মার্চের বাড়ি আর চেনা যায়না।
রোজার সময় আমরা নতুন বাসায় চলে গেলেও্
নীতা শাহিনদের বাসা হয়ে রইলো আমাদের বেস ক্যাম্প। প্রতিদিনই কাজে অকাজে এবাসায় আসি আর অবাক হই এর পরিবর্তনে। চকচকে পাতার ম্যপল গাছটাকে দেখে মনেই হয়্না, মাত্র মাস তিনেক আগে এটি ছিলো বাজ পড়া গাছের মত, খটখটে শুকনো, কালো আর ন্যাড়া। এদিকে ঘরের মধ্যে থেকে পুঁই এর টব বেরিয়ে ঠাঁই পেয়েছে ডেকে।
আইরিশের সাথে পাল্লা দিতে বেগুনি রঙের চাইভ ঘাড় উঁচুকরে দাঁড়িয়ে গেলো ক’দিন পর। নীতা একদিন পিটুনিয়া আর গাঁদা ফুল লাগিয়ে দিলো আইরিশ আর চাইভের ফাঁকে ফাঁকে। দু’দিন পর মেইল বক্স চেক করতে গিয়ে দেখি সদর দরজার সিঁড়ির কাছে ডালিয়ার মত কিছু ফুল ফুটে আছে। লাল সাদা আর হলুদ তাদের রং। শাদা ফুলে মিষ্টি একটা গন্ধ অন্য দু’টির গন্ধ শাদাটির মত মনকাড়া নয়। নীতা বলল পিউনি। সেই পিউনির এখন যাবার সময় হয়েছে। এরই মধ্যে দেখি আইরিশের জায়গায় হেসে খেলে বাতাসে দুলছে এশিয়াটিক লিলি। এদিকে চন্দ্র মল্লিকায় কুঁড়ি এসেছে চাইভের জায়গায়। এ যেন নিজের ইচ্ছেয় ওদের বাসায় এসে কিছুদিন থেকে যাওয়া।
শুধু প্রকৃতি বা ফুলের জন্যে নয়, বন্ধুদের জন্যেও এই বাসার দ্বার অবারিত। গাছেরা যেমন লতায় পাতায় বেড়ে ওঠে, ডালপালা ছাড়ায় এ বাসায় বন্ধুরাও সেভাবেই কখন আত্মীয়ের মত হয়ে গেছে বলা মুশকিল। বাংলাদেশিদের কাছে তো নয়ই, ইরানের বাহার, ভিয়েতনামের ট্র্যাং, ইন্ডিয়ার সোনাল কিম্বা সামনের বাসার নীল জনসন কারোর কাছেই নীতা-শাহীনের কিচেন অপরিচিত নয়।
নীতাদের এই অদ্ভুত বাড়ির প্রভাবে চাওয়া পাওয়ার অংক না কষে হিংসা বিদ্বেষ ভুলে আমরা ভালোবাসায় বসবাসের স্বপ্ন দেখছি
নীতাদের বাড়ির এই অসাধারণ বর্ণনাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। এমন লেখা পড়লে ভারাক্রান্ত মনও যেন আপনা আপনি ভালো হয়ে যায়।
নীতাদের এই অদ্ভুত বাড়ির প্রভাবে চাওয়া পাওয়ার অংক না কষে হিংসা বিদ্বেষ ভুলে আমরা ভালোবাসায় বসবাসের স্বপ্ন দেখছি - বাড়ির বাইরে তুষারপাত, ভেতরে উষ্ণতা আর ভালবাসা, ভাবতেও ভালো লাগে।
ধন্যবাদ স্যার
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
good story
ধন্যবাদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
ধন্যবাদ