চীনের গ্রাম

অচেনা চীনে ১০
গত একশ’ বছরে ব্যপক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে চীন। রাজতন্ত্রের পতন, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, গৃহ যুদ্ধ, সীমান্ত সঙ্ঘাত, সমাজ তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, সংস্কার, বিশ্বায়নের নামে পুঁজিবাদের বিকাশ, সবকিছুই ছুঁয়ে গেছে চীনা সমাজ। প্রভাবিত করেছে জীবন যাত্রা।

গ্রাম

গ্রাম

চীনের গ্রাম

হেংগাং পৌছানোর পর বুঝলাম পরিবর্তনটা সবচেবেশি ঘটেছে গ্রামে। চীনের ১০ লক্ষ গ্রাম গত তিরিশ বছরে পুরোপুরি শহর না হোক অবকাঠামোর দিক দিয়ে আমাদের দেশের গঞ্জ ছাড়িয়ে গেছে। শেংখানে এসে স্পষ্ট হল বিষয়টি। লোংগাং জেলার দক্ষিণ পশ্চিমের একটি গ্রাম শেংখান। আমার হোটেল থেকে প্রায় ৩৫ মিনিটের পথ। হেংগাং বাজার থেকে পশ্চিমে একটি ছোট্ট রাস্তা পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে। আমরা যখন সেই রাস্তায় ঊঠলাম সূর্য তখন প্রায় মাথার উপর। ভেন জিগ্যেস করলো আমি ড্রাগন ফ্রুট খাই কি না। কোন ফলেই আমার আপত্তি নেই শুনে সামনে থেকে হ্যান সাহেব জানালো আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রচুর আশ ফল পাওয়া যায়। হ্যানের কথাটা বুঝলাম ভেনের অনুবাদের পর। গ্রামে আসার কথা শোনার পর থেকে হ্যান বেশ ফুর্তিতে আছে। মাঝে মধ্যেই সে পিছন ফিরে আমাকে কিছু দেখাতে চেষ্টা করছে।আমারও মন্দ লাগছে না। এই অল্প কদিনের সফরে এসে গ্রাম দেখার সুযোগ পাওয়া কম কথা নয়। ভেনের ভাষায়্ গ্রাম সফরটি আমার হাতে কলমে শিক্ষার একটি অংশ। আমরা যে গ্রামে যাচ্ছি পাঁচ বছর আগেও সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না। ২০০৭ সালে এই গ্রামে পুক্সিন কোম্পানির দুটি বায়োডাইজেস্টার বসানো হয়েছিল, রান্নার গ্যাস আর বিজলি বাতির জন্য। বছর তিনেক আগে এই গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। এখন বায়োগ্যাসজাত ইলেক্ট্রিকের খুব একটা দরকার হয় না। কাজে লাগে দৈবাত লোডশেডিং জাতীয় কিছু হলে।

পাহাড়ের চড়াই পেরিয়ে গাছ পালায় ছাওয়া ঘেরা যে জায়গায় আমরা পৌছলাম তাকে ঠিক গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় বলা যায়না। বন ও এখানে ঊদাসী নয়। পাহাড়ের পায়ের কাছে দুই তলা এ বাড়ির দুই দিকে ফলের বাগান। আশ ফল, রাম্বুটান, কমলা, করমচা, পেপে ছাড়া জাম গাছও আছে বাগানে। একদিকে আছে সুইমিং পুল আর সীমের ক্ষেত। বাসার পাশেই একটি টফু (উদ্ভিদজাত পনির জাটীয় খাবার, আজকাল ঢাকায়ও পাওয়া যায়)তৈরির কারখানা। এই কারখানার প্রধান কাচামাল সীম। যথেষ্ট যত্নে গড়ে তোলা একটা ব্যক্তিগত খামার বাড়ি।

ডানের জন হেক্কা

ডানের জন হেক্কা

আমাদেরকে যিনি অভিনন্দন জানালেন তার নাম হেক্কা। বয়স পঞ্চাশ পেরোলেও শরীর শক্ত পোক্ত। ধূসর হাফ প্যান্ট আর হাতা কাটা কালো ফতুয়ায় তাকে মানিয়েছিলও বেশ। আমাদের কে নিয়ে সরাসরি রান্না ঘরে ঢুকলেন। বায়োগ্যাসে রান্না বান্না হয়, বাতি জ্বালানো যায়, এসব দেখানোর কথা ভেন আগেই বলে রেখে ছিল। এই অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে।অবাক হলাম বায়োগ্যাস দিয়ে বাথ রুমের গিজার চালাতে দেখে। এর পর গেলাম বাড়ির পেছন দিকে বায়োডাইজেষ্টার দেখতে। হ্যান সাহেবও এতক্ষণ আমাদের সাথে ছিলো। ডাইজেষ্টারের কাছে এসে কাঊকে কিছু না বলেই ট্রাউজার খুলে ঝাপ দিলো অনতিদূরের সুইমিংপুলে।

দু’টি ১০ মিটার-কিঊব ডাইজেষ্টার এখানে ১০ ঘন ফুট গ্যাস উৎপন্ন করছে প্রতি দিন, কাচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সীমের খোসা আর টফু কারখানার অন্যান্য বর্জ্য। হেক্কা সাহেব এ গ্রামের লোক নন। তার গ্রাম সিচুয়ান প্রদেশে। এই প্রজেক্ট সহ খামারের দেখ ভাল করা তার কাজ।বাড়ি সামলানো, ফল পাকুড় পাড়া, হাস মুরগি দেখা সহ আরও ছোট খাটো কাজ তো আছেই। হেক্কার সে সব করতে ভালোই লাগে।

পরপর চারটি ডাইজেস্টার

পরপর চারটি ডাইজেস্টার


আমার ভালো লাগছিল না। গ্রামে এসে মজা পাচ্ছিলাম না। বড় বেশি নির্জন।বাসায়ও হেক্কা ছাড়া আর কারো দেখা পাওয়া গেলনা। বাড়ির প্রাণ তার বাসিন্দা। হেক্কা জানালো এবাড়িতে মালিক, মালকিন ছাড়াও তাদের দুই ছেলে মেয়ে থাকে। তবে বিকালের আগে ফিরবে না কেঊ। বড়রা কাজ থেকে ফিরবে সন্ধ্যার দিকে আর বাচ্চারা ফিরবে স্কুল ছুটির পর। হেক্কার সাথে ফিরে এলাম ড্রয়িং রুমে। খুব সাজানো গোছানো মনে হল না। লাল রঙ্গের এক সেট সোফা, একটি টেলিভিসন আর কিছু সো-পিস ছাড়া উল্লেখ করার মত আর কিছু নেই ঘরে। প্রায় ছ্য় বছর ধরে আছে হেক্কা আ বাড়িতে। মা আর বউ আছে দেশে। হেক্কা চীনের বদলে যাওয়াটা দেখেছে খুব কাছ থেকে। বাবা ছিলেন বর্গা চাষী, দায়্যু জিনের (Great Leap Forward) সময় যৌথ খামার গড়লেন মাও সেতুং। চাষের জমি, রান্নার তৈজস, সব চলে গেল কমিউনের কাছে। এতে অবশ্য অখুশি হয়নি হেক্কার পরিবার। জমি তো ছিলই না, আর তৈজস পত্রের বিনিময়ে যদি পেট ভরে খাওয়া যায় অসুবিধা কি? চেয়ারম্যান আসার আগে তো দু/বেলা পেট ভরে খাওয়াই জুটতো না।

তবে যৌথ খামার শেষ পর্যন্ত টিকলো না। নেতারা হিসেবকসে দেখলেন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি সত্ত্বেও ব্যক্তিগত সমপদের পরিবৃদ্ধি ঘটার সুযোগ না থাকায় গড় উতপাদন কমে যাচ্ছে। মানুষের হাতে ডিস্পোজেবল ইনকাম না থাকায় মানুষ হতদ্যমি হয়ে পড়ছে। মাও এর মৃত্যুর পর তার এক সময়ের ঘনিষ্ট সহযোগী দেং জিয়াউ পিং বেশ কিছু সংস্কার আনলেন চীনা জীবন যাত্রায়। জন কল্যানের যে সব দায়িত্ব রাষ্ট্র কাধে তুলে নিয়েছিল। তার অনেক কিছুই জনতার কাধে ফিরে এল। হেক্কার মা প্রতি মাসে পেনশন পান মাত্র ১০০ ইয়্যুয়ান । এক কেজি গরুর মাংসের দামই ২৫ টাকা। তার মাস চলবে কি করে? এই টাকার জন্যেই ঘর বাড়ি ফেলে তাকে আসতে হয়েছে এতদূর। হেক্কা স্বীকার করে এতে তার আয় বেড়েছে কিন্তু সেই অর্থে স্বাচ্ছন্দ্য কি বেড়েছে? এই টাকার ধান্ধায়ই তো গ্রামের মানুষদের শহরে পড়ে থাকতে হচ্ছে। গ্রাম সুন্দর করবে কে? হেক্কার কথার সাথে সরকারি পরিসঙ্খ্যানের আশ্চর্য মিল। গত ছয় বছরে শহর মুখো মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অনেক বেশি। ২০১২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী চীনের ১৩৫ কোটি মানুষের ৫১.৩৮ শতাংশই এখন শহরে বাস করে।

আমরা যখন হেটে মরছি ঝোপ জঙ্গলে, হেক্কা সাহেব তখন আঁশ ফল খাচ্ছেন

আমরা যখন হেটে মরছি ঝোপ জঙ্গলে, হেক্কা সাহেব তখন আঁশ ফল খাচ্ছেন

রোদ একটু পড়ে এলে আমরা ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করলাম। হেক্কা জোর করে গাড়িতে তুলে দিল এক ঝুড়ি আশ ফল।মাত্র ঘন্টা তিনেকের পরিচয়ে মনে হল সে আমার অনেক দিনের চেনা। বড় ভাইএর মুখটা ভেসে ঊঠলো মনের গহনে। যিনি মুখে তেমন কিছু না বললেও প্রতিবার যশোর থেকে ফেরার সময় গাড়িতে তুলে দেন ঘরে যা থাকে তার প্রায় সবই। মনে হল চীনের অনেক কিছু পরিবর্তিত হলেও মানুষে মানুষে বন্ধন টা এখনও আলগা হয়নি। যাবার পথে ভেন বলল তুমি নুডুলস খাউ তো? আজ আমরা বাইরে খেতে চাইছি, তোমার কোন আপত্তি নেই তো?

ফেসবুক থেকে

১২,৭৩৯ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “চীনের গ্রাম”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    বেশ অনেকদিন পর সিসিবি এসে চীনের গ্রাম দেখছি রোববারের অলস সকালে। কী যে ভালো লাগছে! যেন বা আমি নিজেই ফিরে এসেছি আমার গ্রামের বাড়িটিতে।
    আপনার লেখায় ভ্রমণের টুকিটাকির ভেতরে অর্থনীতি, রাজনীতি থাকে জীবনবোধের সঙ্গে জড়িয়ে। ছুঁয়ে যায় --- ভাবায়

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।