২০১০ সালে মেরিনা বে স্যান্ডসের ৫৭ তলার ছাদে নারকেল গাছ দেখে আমাকে চমকে যেতে দেখে আমার মেজবান প্যাসিফিক মেরিনের ক্যাপ্টেন শাখাওয়েত বলেছিলেন, আরও কিছু দিন অপেক্ষা কর, সমুদ্রের দিকে নতুন পার্ক হচ্ছে, সারা বিশ্বের গাছ পালা সেখানে দেখতে পাবে।
২০১৩ সালে গিয়ে শুনলাম, সেই পার্ক ২০১২ সালের জুন মাসে দর্শনার্থিদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। গার্ডেন্স বাই দ্য বে এখন সিঙ্গাপুরবাসীদের নতুন গর্ব।ভাবলাম আর কিছু দেখি না দেখি এই বিস্ময় উদ্যান না দেখে ফিরে যাওয়া যাবেনা।
গার্ডেন্স বাই দ্য বে তে যাবার সহজ উপায় হচ্ছে সার্কেল লাইন এমআরটিতে উঠে বে ফ্রন্টে নেমে যাওয়া। বাস, ট্যাক্সি, নিজের গাড়ি সবকিছুতেই যাওয়া যায়। তবে সে সব রাস্তা আমিই ভালো বুঝিনা। বে ফ্রন্ট ষ্টেশনের এক্সিট B দিয়ে বেরিয়ে লিঙ্ক ওয়ে ধরলেই হবে। বাচ্চা কাচ্চা সাথে থাকলে মিনিট পনরর হাটা পথ।
যারা নিজেদের গাড়িতে যাবেন তাদের জন্যে এত কিছু দরকার নেই। সিঙ্গাপুরে সব গাড়িতেই জিপিএস থাকে। গন্তব্য গার্ডেন্স বাইদ্য বে’র কারপার্ক সেট করলে যন্ত্রই আপনাকে কারপার্ক পর্যন্ত নিয়ে যাবে। গাড়ি পার্কিং করে উপরে এসে টিকিট কেটে ফেলতে পারেন। টিকিট অবশ্য অনলাইনেও কাটা যায়।
সাগর ছাড়া সিঙ্গাপুরের আর কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। তবে সম্ভবত প্রকৃতিকে চ্যলেঞ্জ করার মত সম্পদ তাঁরা গত পঞ্চাশ বছরে জোগাড় করে ফেলেছে। যে বিশাল এলাকা (প্রায় ২৫০ একর) জুড়ে এই কল্পনার জগত তৈরী করা হয়েছে তার পুরোটাই রিক্লেইমড ল্যান্ড ( সমুদ্র মন্থন করে পাওয়া বলা যায় কীনা ভাবছি)। আশির দশকেও এই জায়গা ছিলো পানির তলে। ২০০৫ সালে সিঙ্গাপুর সরকার এখানে গ্রীস্ম মণ্ডলীয় বাগান গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে। প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সাত বছর ধরে তৈরি করে ২০১২ সালে এটি খুলে দেওয়া হয় সাধারণের জন্যে।
——————————————————————————————-
পর্যটকদের তথ্য
এই উদ্যানকে মোটা দাগে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। বহিরাঙ্গনে ভোর পাঁচটা থেকে রাত দু’টো পর্যন্ত খোলা থাকে।এখানে টিকেটের প্রয়োজন নেই।বহিরাঙ্গনের আবার তিনটি ভাগ। বে সেন্ট্রাল, বে ইস্ট আর বে সাউথ। গার্ডেন্স বাই দ্য বে বলতে আসলে বে সাউথকেই বোঝানো হয়। চমৎকার লেক, পায়ে চলা পথ, আর বিশাল তিনটি থিম পার্ক নিয়ে এই উদ্যান গড়ে উঠেছে সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফুল ‘ভ্যান্ডা মিস জোয়াকিম’ অর্কিডের আদলে। আদলে কথাটা এখানে ঠিক নাও হতে পারে বলা যায় অনুপ্রেরণায়। গ্রীণহাউস (কন্সারভেটরি) আর কৃত্রিম লেক গুলো অচ্ছে অর্কিডের মূল, পায়ে চলা পথ, মাঠ হচ্ছে পত্র পল্লব আর থিম পার্ককে তৈরী করা হয়েছে ফুলের নকশায়।
থিম পার্কের তনটি অংশ
১। ফ্লাওয়ার ডোম
২। ক্লাউড ফরেস্ট
৩। সুপার ট্রি
থিম পার্ক বন্ধ হয়ে যায় রাত ৯ টায়। রাত আটটার পর টিকেট বিক্রি বন্ধ, আর থিম পার্কে প্রবেশের শেষ সময় রাত সাড়ে আটটা।
বিদেশীদের জন্যে টিকেট ২৮ ডলার, শিশুরা(বারোবছর পর্যন্ত) ঢুকতে পারে বারো ডলারে।
——————————————————————————————
২৮ টাকা (২৮ সিঙ্গাপুর ডলার) দিয়ে ফ্লাঊয়ার ডোমে ঢুকে পড়ে মনে হলো, আমি ভুল করে কোন আঁকা ছবির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। গার্ডেন্স বাইদ্য বে’র দুটি গ্রীণ হাউসের নিচেরটি ফ্লাওয়ার ডোম। কোন পিলার ছাড়া এত বড় কাঁচের ঘর পৃথিবীতে আর নেই।
প্রায় আড়াই একরের এই কাঁচঘরে ঠাই পেয়েছে পৃথিবীর নানান অঞ্চলের গাছপালা। ৩৮ মিটার উঁচু এই ঘরের তাপমাত্রা সবসময় ২৩ থেকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে রাখা হয়। বিভিন্ন রকম গ্রীষ্মমন্ডলীয় উদ্ভিদের বাস এখানে।ফুল, ফলের সাথে মরিচ, বাঁধা কপি, আসমানীদের ভেন্না গাছের পর্যন্ত ঠাঁই হয়েছে কাঁচঘরে।
বিশাল বিশাল কিছু গাছের বন্দী দশা দেখে, পুরো ব্যাপারটিকেই সত্যিকারের প্রকৃতি প্রেমিকদের কাছে প্রকৃতিকে পোষ মানানোর প্রচেষ্টা মনে হতে পারে। ফ্লাওয়ার ডোমে মোট সাতটি বাগান। ছোট্ট মরিচ গাছ থেকে বিশাল বাওবাব গাছ সবই দিব্যি হেসে খেলে দর্শণ দিয়ে যাচ্ছে। বিশাল আকারের বাওবাবগুলির জন্ম কিন্তু এখানে হয়নি। দৈত্যাকার গাছগুলিকে বৃক্ষাবস্থায় (এই শব্দটি কী সঠিক?) জাহাজে চড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে আফ্রিকা থেকে।
ফ্লাওয়ার ডোম ঘোরা হলে গেলাম ক্লাউড ফরেস্টে। ঢোকার মুখেই কৃত্রিম জল প্রপাত। ফ্লাওয়ার ডোমের চেয়ে ১৪ মিটার উঁচু এই নকল পাহাড়ে উঠতে হ্য় এলিভেটরে। ঘোরান সিঁড়িও আছে কাঁচের পাহাড়ে।
এটি তৈরি করা হয়েছে গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকার ১০০০ থেকে ৩০০০ মিটার উঁচু পাহাড়ের আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে। হাজার রকম লতা, গুল্ম অর্কিডের আবাস ক্লাউড ফরেস্ট। সিঙ্গাপুরের এই উদ্যানে টেকনোলজি আর প্রকৃতির অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে। ফটোভোল্টিক সেল, সূর্যালোক, তাপ আর বৃষ্টির পানির স্মমিলন ঘটিয়ে তাপমাত্রা আর আলো আঁধারির নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।ক্লাউড ফরেস্ট থেকে নেম আসার সময় মাঝ রাস্তায় লস্ট ওয়ার্ল্ড গ্যালারি। এই গ্যালারিটিকে বলা যায় ক্রিস্টালের তৈরি।
একেবারে নীচ তলায় আগামী পৃথিবীর থ্রি ডি প্রেজেন্টেশন দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। একেতো তাপ মাত্রা মাত্র পাচঁ ডিগ্রী, তারপর পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয় ধরানো সব কথা বার্তা। বের হবার সময় আমার ছোট কণ্যা মুখ কালো করে বলল, বাবা পেঙ্গুইন একটাও থাকবে না?
আমি বললাম তোমাকে কে বলল?
সে বলল, তুমি শোননি? প্রেজেন্টশনের শেষের দিকে ছিলো, যদি প্ল্যান্ট আর ফরেস্ট ডেস্ট্রয় করা বন্ধ না করা হয় তাহলে নেক্সট ফিফটি ইয়ার্সে পেঙ্গুইন পাখিগুলো শেষ হয়ে যাবে।
ভাবলাম ছোট্ট মেয়েটির এই ভয় তাড়াবো কী করে?
পুনশচঃ
ক্লাউড মাউন্টেন থেকে বের হতে হতে রাত ৯ টা বেজে গিয়েছিলো। সুপারট্রিতে ওঠা হয়নি। সুপারট্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ১৬০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতার মেটালিক কাঠামোর উপর নির্মিত শুণ্যের উদ্যান। প্রতিটি ট্রি তৈরি করা হয়েছে সত্যিকার গাছের কথা মনে করে। এই গাছের একটি কাজ হচ্ছে, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে চ্যানেলের মাধ্যমে মাটিতে পৌছে দিয়ে সেচের কাজ করা। এলিভেটরে চড়ে সুপারট্রিতে উঠতে হয়। পাশা পাশি এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়া যায় ব্রিজের উপর দিয়ে। শ’তাধিক ফুট উচ্চতায় এই যাওয়া আসা কে বলে স্কাই ওয়াক।
চমৎকার নিখরচায় ভ্রমন হয়ে গেল। চোখ জুড়ানো ছবি গুলি উপরি পাওনা। ক্যক্টাস পাম গাছ এসব কাচের ঘরে রাখা কেন বুঝলাম না, সিঙ্গাপরা তো গরম দেশই।
আমিই কৗ এত বুঝি!
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
মাহবুবের মতই বলা যায়। একরকমের ভ্রমন তো হলোই বটে আবার ফিজিকাল ভ্রমনের ক্ষুধাও তৈরী হলো।
বিশেষ করে স্কাই ওয়াকের জন্য তো খুবই বেশী ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছে, যা বুঝতে পারছি...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
আগেরবার স্কাই ওয়াক হয়নি, সামনের মাসে আবার যাচ্ছি, এবার করবো
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
আমিও আপনার কাছাকাছি সময়ে গেছি। বড়ই কড়া শৃঙ্খলার দেশ রে বাবা। সবসময় তটস্থ থেকেছি। পৃথু যেমন রুষার কাছে তটস্থ হয়ে থাকতো 'ঘাস্টলি' স্বভাবের জন্য। চারদিকের এমন পরিপাটি করে ছেঁটে রাখা বাধ্য পরিবেশের মাঝে নিজেকে কেমন জানি অপাংতেয় মনে হয়েছে। ভেবেছি, এই বুঝি পুলিশে এসে ধরে নিয়ে যাবে, পায়ের বুড়ো নখে মাটি লেগে থাকার অপরাধে। আকাশ দিয়ে হেঁটেছি। ভেবেছি, এই তবে, 'আকাশের ওপারে আকাশ'। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাচের খাঁচায় ঢুকিনি। ওর চাইতে আমার ভুবনডাঙ্গার মাঠ ঢের ভালো। কাচের ঘরের একটি বিষয় আমার ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে, পুরো ঘরটাই যেন এক সতর্ক বার্তা। যদি তুমি এখন থেকেই যত্ন না নাও, তবে অবাধে বেড়ে ওঠা বন্ধনহীন বিপুলা প্রকৃতিকেও একদিন এমন মোহন মিউজিয়ামে এসেই ঠাঁই করে নিতে হবে।
আপনার লেখা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, কেমন হতো অই কাচের ঘরের ভেতর বিভূতি কিম্বা জীবন বাবুকে ছেড়ে দিলে?
এম আর টিতে এক সিনিয়র সিটিজেনের সাথে কথা হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'কি করে সময় কাটাও?' বিরস মুখ করে বলেছিল, সারাদিন শূয়ে-বসে দিন কাটে, সন্ধ্যে হলে ঘুমে ঢলে পড়বার আগ পর্যন্ত মদ গিলে। বিস্মিত হবার মতো, আনন্দিত হবার মতো কিছু নেই তাঁর জীবনে। চারদিকের অনেক বিস্ময়ের, অনেক শোভিত বিন্যাসের মাঝে তাঁর প্রবেশাধিকার আটকে দিয়েছে অপ্রতুল বৃদ্ধ ভাতা।
লেখা কিন্তু চমৎকার হয়েছে। বিশেষ করে ভালো লেগেছে এই জেনে যে, শিশুরা কিন্তু প্রকৃত বিপদটা ঠিক ঠিক বুঝে ফেলে। হয়ত মুক্তমনে ভাবতে পারে বলেই।
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ
সিঙ্গাপুর আমার কাছেও বড় বিভ্রমের জায়গা। এই যে আঁকা ছবির মধ্যে ঢুকে পড়ার কথা বলেছি সে, ওই অনুভব থেকেই। ছবির মানুষ, প্রকৃতি সবই তো ফ্রেম বদ্ধ। তবে প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করার এই স্পর্ধাকে অভিনন্দন জানাই
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
পাসপোর্ট ভিসার কম্ম কাবার ।
ঘুরে বেড়াচ্ছি বেশ একের পর এক দেশ ।
আমাদের খোলা ময়দান, আর তাদের এমন হাজার কোটি টাকার বাগান।
কি করে যে ওরা বানায় এসব !
তবে এই এক কাঁচের ঘরে জগতের সব পদ গাছ মেলাবার মতো স্পর্ধা,
আর সেই সাথে অর্ধশত বছর পরের যা ছবি আঁকা - সত্যি অভাবনীয় ।
তার ওপর সবচেয়ে বড় কথা আপনার নয়নাভিরাম কথার মালায় জিপিএস এর চেয়ে সহজবোধ্য নির্দেশনায় অত সহজেই যেভাবে ঘুরিয়ে আনছে দুনিয়াদারি ...
অনন্য ভ্রমণ ! অনন্য !
অনেক ধন্যবাদ লুৎফুল
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
গ্রন্থাকারে পাব না?
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
মোস্তাফিজ এখনও চিন্তা করে দেখিনি।ভালো থেকো
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
ভাইয়া,
আপনার প্রাণবন্ত বর্ণনা আর ছবিগুলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
সিঙ্গাপিরী গার্ডেন দেখতে মন চায়...।।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
ধন্যবাদ । মাহমুদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
চমৎকার ভ্রমণ কাহিনী! সিঙ্গাপুরে গত ১৫ বছরে যাওয়া হয়নি, তার আগে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। ভাবছি, না জানি কত না বিস্ময় সেখানে অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে। কাঁচের ঘরে আবদ্ধ প্রকৃ্তিকে কতটা উৎফুল্ল দেখতে পাবো, কে জানে!
থীম পার্কের থীমগুলো বেশ চিত্তাকর্ষক। বর্ণনার গুনে লেখাটি অনবদ্য হয়েছে।
ঘুরে আসেন স্যার মোটে ঘন্টা চারেকের তো ফ্লাইট
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
আহ ! একদম মনের মতন একটা ছবিব্লগ। ভ্রমণ ব্লগ গুলো আমার ফেভারিট ক্যাটাগরিতে পরে।
খুব ভালো লাগলো !
ধন্যবাদ নাফিস
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান