বিকেলে হাঁটতে বেরুলে প্রতিবেশী মিজ বারবারার সাথে আমার দেখা হয় মাঝেমাঝে। সত্যি কথা বলতে কি মধ্য পঞ্চাশের বারবারা বাগান করতে ভালবাসেন এইটুকু ইনফরমেশন ছাড়া তার সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না। টল এন্ড স্লেন্ডার বারবারার এক মাথা সাদা কালো চুল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি তার লেগেই আছে। দেখা হলে হাত নাড়ি দু’জনেই, আরো একটু সময় হলে হয়তো জানতে চাই কুশল। সামার এলে হয়ত বারবারা জানতে চান আমার কাছে বাড়তি দুটো চারটে শশার চারা আছে কিনা অথবা তার দুটো টমেটোর চারা পরে রয়েছে আমি চাইলে তিনি দিতে পারেন। আমরা গল্প করি কাইয়েন পেপারের আগুন ঝাল নিয়ে অথবা তিনি দেখান তার নতুন বার্ড বাথটা। কথা বলতে এই টুকুনই।
হাড় কাঁপানো শীতের শেষে বসন্ত এসে গেছে আমাদের শহরে। টিউলিপ, রোডোডেন্ড্রন, আর ড্যাফোডিলের শোভায় চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। রংবাহারী আজ্যালিয়া ফুটতে শুরু করেছে চারদিক আলো করে। ন্যাড়া সব গাছে গাছে নতুন কচি পাতা। ঘরের বাইরে গেলেই চোখে পরে ট্রিলিয়াম আর প্রিমরোজ। রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ গোলাপী আর সাদায় মোড়া ডগউডের নিচ দিয়ে ড্রাইভ করবার সময়ে মনেহয়, বেঁচে থাকবার মত আনন্দ আর হয়না!
অনেকদিন বারবারার দেখা পাইনি। উইকেন্ডে চমৎকার আবহাওয়া ছিল আমাদের এখানে। আগের দু’দিনের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে গাছের সব পাতা। রুমঝুম এপ্রিল শাওয়ার বুঝি একেই বলে! রবিবারের বিকেলে কন্যা মুভি দেখছে বন্ধুর সাথে। এই অবসরে পার্পল রঙ্গা ডাম্বেল হাতে বেরিয়ে পরি একা একা। একটু দূরে যেতেই দেখি বারবারার বাড়ির আঙিনায় লাল-গোলাপী রঙ্গা আজ্যালিয়া ফুটে রয়েছে। জল ফুরিয়ে যাওয়া বার্ড বাথে একটা ব্রাউন থ্র্যাসার বসে আছে। একটু ভাল করে তাকাতেই বুঝতে পারি ডেকের কোণে বারবারা বসে আছেন, হাতে একখানা টল গ্লাসে লাল মেরুনের পানীয়।
আমাকে দেখে হাত নাড়েন বারবারা। ওর মুখে ম্লান একটা হাসি, কোন যাদু মন্ত্রে ওর ঢেউ খেলানো চুল গুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে হঠাৎ। ক্লিন শেভড মাথা। ক্যান্সার নয়তো? আমার বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে যায় অজানা আশঙ্কায়!
এগিয়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরি তাকে। বারবারার গল্প শুনি ডাম্বেল পাশে রেখে। স্টেজ থ্রি ব্রেস্ট ক্যান্সার কি করে তার জীবন বদলে দিল সেই গল্প। ডাবল মাস্টেক্টমি শেষে এখন অনেকটাই সুস্থ তিনি। কিমো শুরু হয়েছে আবারো। দেখি হ্যালোপিনিওর চারা গুলো পরে রয়েছে ডেকের কোণে! আমি ওর হাত জড়িয়ে বসে চুপচাপ তাকে কথা বলতে দেই!
গ্রোসারী থেকে স্ট্রবেরী, কিউই, লাল আঙুর আর ক্যান্টালোপ এনেছিলাম আগেরদিন। বাড়ি ফিরে ফল গুলো ধুয়ে মুছে কেটেকুটে একটা প্ল্যাটার বানাই। এদিকে ওদিকে দুটো চারটে ফেরেরো রসার সাজিয়ে দেই প্ল্যাটারে। ইউটিউব দেখে কালাকান্দ বানিয়েছিলাম তারার জন্য, সেগুলো বের করে কাপ কেকের রংবাহারী কাগজে মুড়ে নিই। আমার যাদুর বাক্সে ‘গেট ওয়েল সুন’ কার্ড না পেলেও ‘লাভ ইউ’ লেখা একখানা কার্ডে নীল কালিতে লিখি, বাটারফ্লাই কিসেস এন্ড কাডলি বাম্বেল বী হাগস, মিজ বারবারা! গেট ওয়েল সুন!
আমার অতি সামান্য খাবার হাতে বারবারা প্রায় সজল হয়ে ওঠেন। প্রথমবারের মত ওর লিভিং রুমে বসে চায়ের কাপে গল্প করি দু’জন মিলে। আমার ঘর গেরস্থালীর খোঁজ পরে প্রথম বারের মত। আমি বাংলাদেশের মানুষ শুনে হাত জড়িয়ে খুব মৃদু স্বরে বললেন, ছোট্ট বাংলাদেশের অনেক বড় মানুষ তুমি!
'ছোট্ট বাংলাদেশের অনেক বড় মানুষ তুমি!'
ক্যাডেট রশীদ ২৪তম,প ক ক
🙂 🙂 🙂 🙂
"ছোট্ট বাংলাদেশের অনেক বড় মানুষ তুমি!" বাংলাদেশটা ছোট্ট হতে পারে কিন্তু ওখানকার মানুষের মন যে আসলেই অনেক অনেক বড়, আর শুধুই কি দেশ/ দেশের নাম দিয়ে সেই দেশের মানুষ চেনা যায়?
আমেরিকায় আসার পর প্রথম প্রথম মনে হত এখানকার মানুষ মনে হয় একটু জাতি-বিদ্বেষী অন্তত দক্ষিনের লোকজনের নামে প্রায়ই এই অভিযোগ পাওয়া যায়, কিন্তু নেসভিলে মধ্যরাতে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে এমন অবস্থায় খাঁদের মধ্যে আমার গাড়ি পরে যাওয়ার যখন ২ জন এশিয়ান আমাকে সাহায্য করতে অপরাগতা জানিয়েছিল, তখন স্যুট টাই পরা সাদা চামড়ার আমেকিকান ই ল্যান্ডরোভার থেকে নেমে আমাকে বৃষ্টিতে ভিজে, কাদায় গড়াগড়ি করে সাহায্য করেছিল।
যাইহোক বরাবরের মত একই মন্তব্য সাবিনা আপুর লেখা নিয়ে গোগ্রাসে গিলে ফেলার মত এক নিঃশ্বাসে পড়া শেষ করে ফেললাম। অভিনন্দন রইল আপু, পরের লেখা পড়ার জন্য অপেক্ষায় রইলাম 🙂
🙂 🙂
গেলবার দেশ থেকে ফেরার পথে এয়ারপোর্টে এসে শুনি আমরা নাকি ওভার স্টে করেছি দেশে। জরিমানা হয়ে গেলো। প্রায় পনেরোশ টাকা দিতে হবে আমাদের মা-মেয়েকে। আমার ফ্যামিলির লোকজন ততোক্ষণে চলে গেছেন এয়ারপোর্টের বাইরে। আমার কাছে একটা টাকা নেই তখন, ডলার ভাঙিয়ে নিতে গেলেও খানিক সময় লাগবে। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের শেষ ঘোষণাও শেষ। আমরা প্লেন মিস করছি অবধারিত ভাবেই। এমন সময়ে এমিরেটসের একজন এগিয়ে এসে কোন কথা না বলে কাউন্টারে টাকা দিলেন পকেট থেকে এবং ছুটতে ছুটতে এলেন আমাদের সাথে বিমান অবধি। অপরিচিত মানুষটির মহানুভবতার কথা আমি ভুলতে পারিনা, আফজাল!
খুব সুন্দর লাগলো। বাস্তবিক জীবন সত্যিই অন্য রকম। মানুষ মানুষের ভালোবাসা না পেলেও প্রকৃতি তা পোষিয়ে দেয়।
ভালো থেকো।
🙂 🙂
ধন্যবাদ, ভাইয়া!
তোমার লেখা পড়ে অকারনেই চোখে জল আসলো ... আমরা বড়ই আবেগপ্রবন প্রানী ।
বারবারার জন্য ভালোবাসা রইল।
নিজে কানা পথ চেনে না
পরকে ডাকে বার বার
🙂 🙂
অনেক ধন্যবাদ, অরূপ দা! তোমার জন্যও অনেক ভালবাসা রইল!
আপু তোমার লিখা পড়ে মাঝে মাঝে মনে হয় সুনীলের কোন বই শুরু করেছি কারন প্রকৃতি এত সুন্দর বর্ণনা তুমি দাও। তোমার বড় লিখা চাই। বারবারার জন্য ছোট্ট দেশের ছোট্ট মানুষের দোয়া রইল। উনার সুস্থতা কামনা করি। :clap: :clap:
🙂 🙂 🙂 🙂
ছোট্ট দেশের ছোট্ট একজন মানুষ আমি, জিয়া! বুকের ভেতরে বিশাল আকাশ নিয়ে ঘুরে বেড়াই আমরা অনেকেই। বারবারা বড় মনের মানুষ তাই আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন।
অনেক বড় মানুষ তুমি 🙂
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
😛 😛 😛 😛
গত লেখা পড়ে খাবারের লোভে পড়েছিলাম, এইবার পড়লাম প্রকৃতির। একটু গুছায়ে নিয়ে উঠতে পারলেই আমেরিকার ইস্ট কোস্টটা ঘুরে ফেলব। ভালো থাকবেন আপা 🙂
🙂 🙂 🙂 🙂
তোমার জন্য আমাদের আটলান্টার বসন্তের ছবি সংযুক্ত করলাম, তৌৌফিক! বেড়িয়ে যেও আমাদের এদিকে!
//cadetcollegeblog.com/wp-content/uploads/2015/04/spring.jpg
চোখ জুড়ানো বসন্তের ছবি। মুগ্ধ হ'লাম।
চলতি পথের গল্প শুনে প্রাণ ভরে গেলো।
"ছোট্ট বাংলাদেশের অনেক বড় মানুষ তুমি!" - শুনে বুক ফুলে গেলো গর্বে।
"বুকের ভেতরে বিশাল আকাশ নিয়ে ঘুরে বেড়াই আমরা অনেকেই" - কি সুন্দর করে বলে ফেললে এ কথাগুলো, তাই তো! কিন্তু আগে তো এমন করে ভাবনাটা মাথায় আসেনি!
বারবারার জন্য শুভকামনা রইলো। তার আশু রোগমুক্তি কামনা করি।
অণু ব্লগঃ কিন্তু অপূর্ব সুন্দর!
🙂 🙂
আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি তারা এক একজন দেশের এম্বাসেডর বৈ অন্য কিছু নই, ভাইয়া! তের নদীর এপারে এই দেশের মানুষগুলো আমাদের প্রতি যে ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দেখান তার জন্য কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। আমার ফেলে আসা ছোট্ট ব-দ্বীপে কত যে সোনার মানুষ আছেন চারপাশে আমরা ক'জনের খোঁজ রাখি?
গেলবার দেশে যাবার পর অন-লাইনে পরিচয় হয়েছে এমন অনেক নতুন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছিল ঢাকায়। প্রায় সবাই কোন না কোন ক্যাডেট কলেজের। অসাধারণ মানুষগুলো কী যে মমতা আর ভালবাসায় সিক্ত করেছিল আমাদের!
বারবারার প্রতিবেশী 'মিজ' বাংলাদেশ, তোমাকে এক আকাশ অভিনন্দন!
আমাদের চারপাশে মিঃ বাংলাদেশও কত যে আছেন আমি জানি, নূপুর!
"ছোট্ট বাংলাদেশের অনেক বড় মানুষ তুমি!" - আমারো না চোখ ভিজে গেল।
"বেঁচে থাকবার মত আনন্দ আর হয়না!" - আসলেই...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
:hatsoff: :hatsoff:
পড়তে পড়তে চোখ ভিজে গেল। আবার পড়লাম। বার বার পড়া যায়
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
:hatsoff: :hatsoff:
সুনীলের "ছবির দেশে, কবিতার দেশে " পড়ছি গতকাল থেকে।
আলাদা করতে পারলাম না সেই বই আর এই ব্লগ কে ! অসাধারণ লাগলো। আপা, আপনি চাইলে কিন্তু অনু ব্লগ এর গন্ডি থেকে বের হয়ে আরো বড় পরিসরে একটা সিরিজ চালু করতে পারেন এরকম লেখা গুলো নিয়ে। এরপর সেই সিরিজ থেকে আরো বড় কিছু। হয়তোবা। (সম্পাদিত)
🙂 🙂
'ছবির দেশে, কবিতার দেশে'র উল্লেখে খুব জড়সড় হয়ে আছি, নাফিস! ধন্যবাদ পড়বার জন্য! লেখালেখির ক্ষেত্রে বলতে পারি আমি 'উঠলো বাই তো কটক যাই' টাইপ লেখক! যে কোনদিন সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে পারি আবারো!
The last line is simply the heart of the whole write up "ছোট্ট বাংলাদেশের অনেক বড় মানুষ তুমি!" :clap:
সাহেদ (৬০৫) ১২ তম ব্যাচ পিসিসি
:hatsoff: :hatsoff:
লেখাটা একদম হৃদয় ছুঁয়ে গেল আপু :hatsoff:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
🙂 🙂
আকাশের হৃদয় ছোঁয়া সহজ কথা নয়গো জানি!
Madam Sabina, indeed this is a well written essay. Again, you instinctively capture the imagination by not using pale colors of pastel, but by a stark differences of bold colors and contrasts. In the same sentence I see you talk about the coldness of winter and the cusp of a new spring. The bright flowers contrasted with the empty trees. You talk about the refreshing April showers. To me it signifies birth and joy or a new beginning.
And then there is Ms. Barbara, stricken with cancer, surviving and not thriving like the flowers outside. She does not have hair, much like the empty trees. Your fruit platter, sprung from the womb of Mother Earth will replenish Ms. Barbara’s body, ravaged from cancer and chemo.
But more importantly, your essay brings out the harmony to the heartbeat of a tiny nation, Bangladesh. And I believe Ms. Barbara was able to hear that heartbeat like one hears a beautiful song.
Get well Ms. Barbara. Get well soon. It’s not what you have done. It’s what you have overcome. Many hearts from a little nation are also hoping you will recover. And their hope is the heartbeat of their soul.
Atlanta, Georgia, USA
"And I believe Ms. Barbara was able to hear that heartbeat like one hears a beautiful song." - Very poetic indeed. Liked these words.
বারবারার বেদনা আমি বুঝতে পারছি।সঠিক সময়ে সঠিক মানুষজন পাওয়াটাও বিরাট ভাগে্যর ব্যাপার।একা একা ক্যানসারের সংগে যুদ্ধ করে যাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার।ওর জন্য আমার অনেক শুভ কামনা রইল।