সুবচন নির্বাসনে

১৯৯২ সালে ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার আগে বাবার সাথে বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে একটা নাটক দেখেছিলাম- নাম ছিল “সুবচন নির্বাসনে”। নাটকটিতে তিনটা প্রবাদ বাক্য (সুবচন) মিথ্যা প্রমানিত হয়।

নাটকে একজন স্কুল মাস্টারের তিন ছেলেমেয়ে- বড় ছেলে স্বপন সেকেন্ড ডিভিশনে এমএ পাশ করে একটা অফিসে চাকরির ইন্টারভিউ দেয়, সেখানে তাঁর থার্ড ডিভিশনে পাশ করা এক বন্ধু ঘুষ দিয়ে চাকরিটা বাগিয়ে নেয়। “সততাই সর্বোতকৃষ্ট পন্থা” কথাটা এখানে মিথ্যে হয়ে যাই। ভাইয়ের অবস্থা দেখে মেজ ছেলে তপন, যে লেখাপড়ায় মেধাবী ছিল, সে সন্ত্রাসমুখী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং অনেক টাকা পয়াসার মালিক হয় এবং “লেখা পড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে” প্রবাদকে মিথ্যা প্রমান করে। মাস্টারের ছোট মেয়ে রানু চরিত্রহীন স্বামীর সংসারে টিকতে না পেরে ফিরে আসে বাবার সংসারে। ” সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে” এই কথাটাও দেখা যায় যে সত্যি নয়।

নাটকের শেষে বাবার চরিত্রে অভিনয় করা আব্দুল্লাহ আল মামুন (নাটকটির রচয়িতাও তিনি) তিন ছেলে-মেয়ের সামনে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মেনে নেন যে তাঁর নীতি শিক্ষায় ভুল ছিল এবং এই ভুলের বিচারের ভার দর্শকদের হাতে ছেড়ে দেন।

সেদিনের দর্শক হিসেবে যদি বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেই, তবে দেখি, আজকের বাংলাদেশেও সুবচনগুলো এখনও নির্বাসন থেকে ফিরে আসেনি। বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষিত (গ্রাজুয়েট) বেকারের সংখ্যা সত্তর শতাংশ। সরকারী কর্ম কমিশনের আয়ের সবচাইতে বড় উৎস হল চাকরির ফর্মবিক্রির টাকা। পিয়ন-চাপরাশী-কনস্টেবল পদের জন্য ৫-১০ লাখ টাকা ঘুষ বিনিময় আজ ওপেন সিক্রেট। যেকোন ব্যাবসায় জায়গা মত উপযুক্ত সেলামি না দিলে কাজ পাবার সম্ভাবনা শূন্যের চাইতেও কম। সততার বালাই বা প্রয়োজনীয়তা চাকরি কিংবা ব্যাবসায় একেবারেই প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।

অন্যদিকে একই সময়ে চোখের সামনে মূর্খতার সাথে দূর্বৃত্তায়নের সংমিশ্রন ঘটিয়ে অনেককে দেখেছি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে বাড়ির সামনে গাড়ির পসরা সাজিয়ে বসতে। লেখা পড়ার সাথে যে বাড়ী গাড়ীর কোন সম্পর্ক নেই তা আজ সর্বজন স্বীকৃত। আর ঘোড়া তো কবেই রাস্তা থেকে উঠে গেছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা “কেয়ার বাংলাদেশের” একটা রিপোর্ট পড়ে জানতে পারি বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ নারী কোন না কোন ভাবে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার। সরকারী হিসাব বলছে ৩০ থেকে৫০ শতাংশ। “সুখী সংসার” এর ধারনা বলা যায় বাংলাদেশের জন্য একটা ইউটোপিয়া।

দর্শক হিসেবে বিচারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বেশ নিরালম্ব বোধ করছি। বিচারে দোষ খুজে পাচ্ছি কিন্তু দোষী কে বুঝতে পারছি না। জুরি হিসেবে পাঠক আপনার হাতেই বিচারের ভার ছেড়ে দিচ্ছি। আপনারা কি জানেন দোষী কে?

৩,২৩৪ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “সুবচন নির্বাসনে”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    দোষী কে তা সবাই জানে। কিন্তু সবাই আবার সাংঘাতিক আত্মতুষ্ট আত্মসুখ নিয়ে। তাই আত্মকেন্দ্রিক ও ভিতুর ডিম এই 'সবাই' সহজে কথা বলে না। কিন্তু যখন বলে, তখন বিরাট কিছু একটা অর্জন করাও সম্ভব হয়।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।