১.
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত গণিতবিদ জি এইচ হার্ডি বিরক্তমুখে তার অফিসে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগে একটি চিঠি এসেছে তাঁর হাতে। শ্রীনিবাস রামানুজন নামে এক ভারতীয় তাঁর মতামত জানতে চেয়ে ১২০ টি গাণিতিক উপপাদ্য পাঠিয়েছে। যার সবগুলোই নাকি সে ‘আবিষ্কার’করেছে! হার্ডি প্রায়ই এরকম উদ্ভট চিঠি পেয়ে থাকেন। এটাও সেরকমই হবে হয়তো। চরম বিতৃষ্ণার সাথে তিনি চিঠিটাতে একনজর চোখ বুলালেন।
বেশিরভাগ উপপাদ্যেরই মাথামুন্ডু স্পষ্ট নয়। বাকিগুলোর ভেতর দুএকটা ইতোমধ্যেই গণিতবিদদের কাছে সুপরিচিত। হার্ডির সন্দেহ হলো, রামানুজন নামের লোকটি অবশ্যই কোনো জালিয়াত হবে। চিঠিটি ঘরের এক কোণায় ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
কিন্তু সারাদিন ওই চিঠি তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখল। ভুলতে পারলেন না। একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, উপপাদ্যগুলো দেখতে আজগুবি মনে হলেও ওর মাঝে মূল্যবান কিছু নেই তো? সন্ধ্যাবেলা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক বিখ্যাত গণিতবিদ জে ই লিটলউডকে সংবাদ পাঠালেন। অজ্ঞাত এক ভারতীয়ের মেধার মূল্যায়ন করার উদ্দেশ্যে দুজনে জহুরির মতো নিরীক্ষা শুরু করলেন।
মাঝরাত নাগাদ তারা জেনে গেলেন শ্রীনিবাস রামানুজন নামের এই ভারতীয় তুখোড় মেধাবী। পরবর্তীতে হার্ডি স্বীকার করেছিলেন, ‘সেই অসাধারণ উপপাদ্যগুলো সত্য না হয়ে কোনো উপায় ছিল না। কারণ, এগুলো উদ্ভাবন করার মতো কল্পনাশক্তি অন্য কারো ছিল না।‘
১৯১৩ সালের এই ঘটনাটি গণিতের ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়। সেসময়ে রামানুজন মাদ্রাজ বন্দরে কেরানির চাকরি করতেন। বছরখানেক পরে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন এবং সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। যদিও ১৯২০ সালেই তার মৃত্যু ঘটে, তার বেশিরভাগ কাজ সময়ের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে ছিল। যার প্রাসঙ্গিকতা সাম্প্রতিককালের গণিতবিদরা বুঝতে শুরু করেছেন। তার গবেষণার ফলাফল কম্পিউটার সায়েন্স ও পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করছে। তার জীবদ্দশায় যেসব সমস্যার অস্তিত্বই ছিল না, সেগুলোর সমাধান আগেভাগে কীভাবে করে গেলেন তা সত্যিই বিস্ময় জাগায়!
রামানুজনের জীবন চরম নাটকীয়তায় ভরা। তার উত্থান আবারো এটাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রতিভা সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে মাথাচাড়া দিয়েও সমগ্র মানবজাতিকে মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।
২. প্রস্তুতিপর্ব
রামানুজনের জন্ম দক্ষিণ ভারতের কুম্বাকোনামে এক দরিদ্র কিন্তু উঁচু বর্ণের ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার বাবা সামান্য বেতনে এক কাপড় ব্যবসায়ীর হিসাবরক্ষকের চাকরি করতেন। সংসারের চাকা সচল রাখার জন্যে তাদের বাড়িতে অনেক সময় পেয়িং গেস্ট রাখতে হতো।
শৈশব থেকেই গণিতের ব্যাপারে রামানুজনের আগ্রহ পরিবারের সদস্যদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে তারার দূরত্ব ও আকার তাকে কৌতূহলী করে তোলে। কারো সাহায্য ছাড়াই সফলভাবে নিরক্ষরেখার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন। গণিতের বাইরে, ধর্মের প্রতি তাঁর ঝোক ছিল। সংস্কৃত ভাষায় লেখা গ্রন্থ থেকে বিশাল বিশাল অংশ অনায়াসে স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতে পারতেন।
১৫ বছর বয়সে কলেজ লাইব্রেরিতে উচ্চতর গণিতের ওপরে রচিত একটি বই তিনি খুঁজে পান। বইটি তেমন মানসম্মত ছিল না। কিন্তু রামানুজন এটি পাঠ করেই গণিতের প্রেমে পড়ে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গণিত ছিল তাঁর একমাত্র মানসী ও প্রেয়সী। এই সময় থেকেই মূলত নিজের মতো করে তিনি গণিতচর্চা শুরু করেন।
স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেন রামানুজন। বৃত্তি পেয়ে কলেজে পড়তে গেলেন। কিন্তু গণিতের জাদুকরী জগতে এমন আকন্ঠ ডুবে রইলেন যে অন্য কোনো বিষয় পড়ার আর সুযোগই পেলেন না। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। দুবার চেষ্টা করেও কলেজ সমাপনী পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেন না। তার বাবা-মা বেশ হতাশ হয়ে পড়লেন। কারণ, পরিবারের আর্থিক অবস্থা তখন আগের চেয়েও নাজুক হয়ে পড়েছিল। রামানুজন তাদের পীড়াপীড়িতে টিউশনি করতে শুরু করলেন। কিন্তু, শিক্ষক হিসেবেও ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন। গণিতের এত জটিল সব তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতেন যে সাধারণ ছাত্ররা ভড়কে যেত। একে একে সবাই কেটে পড়ল।
বেকারত্বের অনিশ্চয়তা প্রতিনিয়ত চোখ রাঙালেও রামানুজন গণিতচর্চার মাঝে সান্ত্বনা খুঁজে নিলেন। তাঁর পরিমন্ডলের কেউই বুঝত না তিনি কী করছেন। কুম্বাকোনামে সে-আমলে গণিতশাস্ত্রের যেসব বই পাওয়া যেত, ততদিনে রামানুজন সেগুলোর চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো দিন-রাত তিনি কেবল আঁক কষছেন। উপায়ন্তর না দেখে তার বাবা-মা পুত্রের বিয়ের আয়োজন করলেন। যদি সংসারের দিকে মতি ফেরে। ১৯০৯ সালে জানকীমাল নামে ১০ বছরের এক বালিকার সাথে তার বিয়ে হয়। রামানুজন তখন ২৩ বছরের তরুণ। ১১ বছরের বিবাহিত জীবনে তারা মাত্র তিন বছর একত্রে কাটিয়েছেন।
৩. যাত্রা হলো শুরু
চাকরির খোঁজে হন্য হয়ে রামানুজন এবার চমৎকার একটা বুদ্ধি বের করলেন। গণিতের ব্যাপারে যাদের ঝোঁক আছে, বেছে বেছে তাদের কাছে ধর্না দিলেন। তার নোটবুক দেখে গণিতপ্রেমী কালেক্টর রামচন্দ্র রায় (পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির সভাপতি) অভিভূত হয়ে পড়লেন। তরুণ এই গণিতবিদের জন্যে মাসোহারার ব্যবস্থা করলেন। আর্থিক টানাপোড়েনের একটা সুরাহা হলো। রামানুজন কিন্তু মন থেকে এই উঞ্ছবৃত্তি মেনে নিতে পারলেন না। চাকরি খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে, ১৯১২ সালে মাদ্রাজ বন্দর ট্রাস্টে মাসিক ২৫ রুপি বেতনে কেরানি পদে যোগ দিলেন। বেতন যা পেতেন তা দিয়ে অঙ্ক কষার জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজও কেনা যেত না। তাই বন্দরে আসা মালপত্রের প্যাকেট মোড়ানোর কাগজ হিসাব করার জন্যে ব্যবহার করতেন।
দারিদ্র্যের কষাঘাত দৈনন্দিন জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে তুললেও রামানুজনের জীবনে অন্যতম ফলপ্রসূ সময় ছিল এটি। কাজের প্রতি তার অনুরাগ এত তীব্র ছিল যে প্রায়ই নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতেন। খাবারের সময় হলে জানকী ও তার মা তাকে খাইয়ে দিতেন। যেন খেতে খেতেও তিনি কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
এরই মাঝে তার কিছু কিছু লেখা ‘জার্নাল অফ ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি‘-তে ছাপা হয়। মাদ্রাজের গণিত অনুরাগীদেও কাছে ‘রামানুজন‘ তখন পরিচিত নাম। তার সাথে যেই সাক্ষাত করত, সেই মুগ্ধ হয়ে যেত। কিন্তু, তৎকালীন ভারতবর্ষ গণিতচর্চার জন্যে নিতান্তই অজ-পাড়াগাঁ। তার মেধার সঠিক মূল্যায়ন করার মতো বা বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগানোর মতো কেউ সেদেশে ছিল না। ব্রিটেন ছিল সেকালে গণিতচর্চার প্রাণকেন্দ্র। শুভানুধ্যায়ীরা তাই তাকে পরামর্শ দিলেন, ‘তুমি বিলেতে চিঠি লেখো।’
রামানুজন তিন তিনবার বিখ্যাত গণিতবিদদের কাছে চিঠি পাঠালেন। কোনো জবাব যখন এলো না তখন ১৯১৩ সালের ১৬ জানুয়ারী তিনি জি.এইচ.হার্ডিকে চিঠি লিখলেন। এই চিঠি শুধু রামানুজনের জীবনই বদলে দিল না, জন্ম হলো অবিস্মরণীয় এক বুদ্ধিবৃত্তিক যুগলবন্দি।
৪. যেভাবে কেমব্রিজ জয় করলেন
হার্ডি উপলব্ধি করলেন গণিতের জগতে নতুন এক নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। রামানুজনকে কেমব্রিজে এসে গবেষণা করার জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন। রামানুজনের মা এত বাধ সাধলেন। কারণ, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের জন্যে কালাপানি পার হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। জাত যাবে, সেই সাথে সমাজপতিরা তাদের একঘরে করে দিতে পারেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি দু-বছরের জন্যে গবেষণা-বৃত্তি লাভ করাটাও বুমেরাং হয়ে দাঁড়াল। তার মা যুক্তি দিলেন, খাওয়া-পরার কষ্ট তো মিটে গেল। এখন কালাপানি পার হয়ে জাত খোয়ানোর কী দরকার বাপু। তবে ললাটের লিখন খন্ডায় কে! দিনকয়েক পর এক সকালে রামানুজনের মা নিজে থেকেই ঘোষণা করলেন, দেবী গতরাতে স্বয়ং তাকে স্বপ্নে আদেশ দিয়েছেন পুত্রের স্বপ্নপূরণের পথে মাতা যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ান। তাই তিনি তার পুত্রকে বিলেত যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন।
১৯১৪ সালের এপ্রিল মাস। রামানুজন এস পৌঁছলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। হার্ডির সাথে সখ্যতা গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগল না। তবে আচার-বিশ্বাস চলন-বলনে দুজনে দুই মেরুর বাসিন্দা। হার্ডি সুদর্শন, ক্রিকেটপ্রেমী, স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে সংশয়বাদী মানুষ। অন্যদিকে রামানুজন বেশ নাদুসনুদুস, খেলাধুলার ব্যাপারে মোটেই আগ্রহ নেই তার এবং ধর্মনিষ্ঠ এতটাই প্রবল যে সবকিছুর মাঝেই তিনি ভগবানকে খুঁজতেন। একবার বলেছিলেন, ‘‘কোনো সমীকরণ যদি ভগবানের চিন্তা প্রকাশ না করতে পারে, তবে সে সমীকরণের কানাকড়ি মূল্যও নেই।‘‘
গণিতচর্চার ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ পদ্ধতির মাঝেও ছিল বিস্তর ফারাক। রামানুজন স্বজ্ঞার (Intuition) ওপর নির্ভর করে কাজ করতেন। তার এ পদ্ধতি গণিতচর্চার বিদ্যমান কাঠামোর সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মিলল কিনা, তা নিয়ে থোড়াই কেয়ার করতেন। আর যেহেতু স্বশিক্ষিত চিলেন, আধুনিক গণিতশাস্ত্রের অনেক গুরত্বপূর্ণ ক্ষেত্র সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। হার্ডি সযত্নে এগুলোর সাথে এমনভাবে তাকে পরিচিত করলেন যাতে রামানুজনের আত্মবিশ্বাস বা প্রাণশক্তি কোনোটাই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। হার্ডি পরবর্তীতে বলেছিলেন, “আমি ওকাজে সফল হয়েছিলাম। তবে আমার কাছ থেকে সে যতটুকু শিখেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আমি তার কাছ থেকে শিখেছি।”রামানুজনের বিলেতবাসের পাঁচ বছরে তারা দুজনে মিলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কিছু গাণিতিক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।
কেমব্রিজে এসে রামানুজনের মেধার অভাবনীয় স্ফুরণ ঘটতে লাগল। হার্ডির ভাষ্য অনুযায়ী,‘‘প্রতিদিন সে আমাকে প্রায় আধা ডজন নতুন উপপাদ্য দেখাত।”তবে ইংল্যান্ডের রুক্ষ আবহাওয়ায় রামানুজন খাপ খাওয়াতে পারেন নি। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যোগ হয় তার খাদ্যাভ্যাস। রামানুজন ছিলেন নিরামিষভোজী। কী খাচ্ছেন সে ব্যাপারে তাই অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন।এমনকি ওভালটিন-ও খেতেন না। কারণ, ওতে ডিম দেয়া আছে। স্বাভাবিকভাবেই তার দেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা দূর্বল হতে শুরু করল।
৫. অবেলায় নিভল প্রদীপ
১৯১৭ সালে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তাররা আশংকা করলেন এর কারণ হলো দেহে পর্যাপ্ত ভিটামিনের ঘাটতি। দেশে ফিরে গেলে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হতে পারে বলে মত দিলেন তারা। কিন্তু ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরা সম্ভব হলো না। পরবর্তী কয়েক বছর তাকে নিয়মিত হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হলো। শারীরিকভাবে ভেঙে পড়লেও, তার চিন্তাশক্তি সম্পূর্ণ অটুট ছিল । অসুস্থ থাকাকালীন একটি ঘটনা থেকে তা বোঝা যায়।
হার্ডি তার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আলাপ শুরু করলেন যে ট্যাক্সিতে চড়ে এসেছেন তার নাম্বার উল্লেখ করে। তিনি বললেন, “ ট্যাক্সির নাম্বারপ্লেটে লেখা ছিল ১৭২৯। আমার মনে হয়েছে এটা একটা তাৎপর্যহীন নিরস সংখ্যা।”সাথে সাথে আঁতকে উঠলেন রামানুজন। বললেন,‘‘কী বলছ তুমি, হার্ডি! এটা হলো সবচেয়ে ছোট সংখ্যা যাকে দুইভাবে দুটো কিউবের যোগফল হিসেবে প্রকাশ করা যায়।”{১৭২৯= (১২*১২*১২) + (১*১*১) অথবা (৯*৯*৯) + (১০*১০*১০)} এই হলো আমাদের রামানুজন !
অসুস্থতা ছাড়াও আরেকটি বিষয় তাকে হতাশ করে তুলেছিল। তা হলো মাদ্রাজে বসে যা তিনি বের করেছেন, তার অধিকাংশই ইউরোপিয়ান গণিতবিদরা আগেই আবিষ্কার করেছেন। কতই না মূল্যবান সময় অপচিত হয়েছে!
১৯১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রয়্যাল সোসাইটি তাকে তাদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করে। তার আগে কেবল একজন ভারতীয় এই বিরল সম্মান লাভ করেছিল। কয়েক মাস পরে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ট্রিনিটি কলেজের ফেলো নির্বাচিত হলেন। ১৯১৯ সালে রুগ্ন কৃশকায় রামানুজন বাড়ির পথে যাত্রা করলেন।
দেশে ফেরার পর মহা সাড়ম্বরে তাকে স্বাগত জানানো হলো। কিন্তু উষ্ণ আবহাওয়া, স্ত্রীর সেবা-শুশ্রুষা-ভালোবাসা কিছুই তার রোগ সারাতে পারল না। তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। তাই যে বিষয়ের ওপর কাজ করছিলেন সে ব্যাপারে হার্ডিকে চিঠির মাধ্যমে নিয়মিত অবহিত করতেন ।
১৯২০ সালের ২৬ এপ্রিল সকালবেলা রামানুজন মৃত্যুবরণ করলেন। র্দুভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, ধর্মীয় আচারমাফিক শেষকৃত্য ছাড়াই দাহ করা হলো এই মহান গণিতবিদের মৃতদেহ। কোনো পুরোহিত ‘জাত খোয়ানো‘ ব্রাহ্মণের সৎকার করতে রাজি হন নি।
৬. গল্পশেষের পরের কথা
তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন নোটবুকে কয়েক হাজার অপ্রকাশিত উপপাদ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত তার চিন্তা-ভাবনা বহু গণিতবিদকে আলোড়িত করেছে। প্রখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান গণিতবিদ জর্জ পোলিয়া হার্ডির কাছ থেকে রামানুজনের নোটবুক ধার নিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর তড়িতাহতের মতো বিধ্বস্ত অবস্থায় নোটবুকখানা ফেরত দিয়ে যান। রামানুজনের উপপাদ্যগুলো এত মোহনীয় ছিল যে পোলিয়া নিজের গবেষণা ফেলে রেখে সেগুলো প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আরো অনেক গণিতবিদ রামানুজনের নোটবুকের সুলুক-সন্ধানে কাটিয়ে দিয়েছেন বছরের পর বছর। যার ফলে গণিতশাস্ত্রের নতুন নতুন প্রশাখার উদ্ভব ঘটেছে।
মৃত্যুর ষাট বছর (অনুবাদক: বর্তমানে তা প্রায় একশ) পরেও রামানুজনের অন্তর্দৃষ্টি একালের জটিল দুর্বোধ্য গাণিতিক সমস্যা সমাধানে নতুন আলোর দিশা দেখায়। যদি একশ বছর পরে জন্মাতেন কী অবিশ্বাস্য উপকারটাই না হতো বিজ্ঞানীদের!
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিত ফ্রিম্যান ডাইসনের একটি কথা দিয়ে শেষ করছি রামানুজনের উপাখ্যান। তিনি বলেছেন,‘‘প্রত্যন্ত জায়গা থেকে পাঠানো চিঠিও আমি গভীর আগ্রহের সাথে পড়ি। হাতের লেখা দুর্বোধ্য হলেও। কে জানে যদি কোনো রামানুজন লিখে থাকে চিঠিটা!‘‘
(রিডার্স ডাইজেস্ট এশিয়ান এডিশনের রজতজয়ন্তী সংখ্যায় প্রকাশিত ‘শ্রীনিবাস রামানুজন: দ্যা ম্যান বিহাইন্ড দ্যা ম্যাথমেটিশিয়ান‘ থেকে অনূদিত)
নাম ও কীর্তি জানা থাকলেও অনেক অজানা সামনে আনার জন্য ধন্যবাদ, কৌশিক।
তানভীর আহমেদ
আর্টিকেলটা পড়ার পর মনে হলো অনুবাদ করলে কেমন হয়! মাদ্রাজি গণিতবিদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত যদি কাউকে অনুপ্রাণিত করে!
ধন্যবাদ ভাইয়া পড়ার জন্যে ! 🙂
এমন মনে হওয়াটাকে অগুন্তি সাধুবাদ।
খুব প্রাঞ্জল অনুবাদ হয়েছে কৌশিক। তোমাকে দ্বারা ভাল অনুবাদ হবে। আরো অনেক এরকম লেখা চাই।
উৎসাহিত হলাম 😀
ইশ, অবেলায় চলে যায় এমন প্রতিভারা।
রূপকথার মতো লাগে শুনতে।
ভাইয়া, কখন যে কার বেলা হয়!
কিটস মারা গিয়েছিল ২৬ বছর বয়সে। সুকান্ত ২১ বছরে।
এই অল্পসময়েও এমন কাজ করে ফেলল যে অমর হয়ে গেল।
খুব সুন্দর অনুবাদ হয়েছে, কৌশিক! অধিকাংশ তথ্য আগে জানা থাকলেও তোমার লেখার গুণে পড়তে চমৎকার লাগলো।
রামানুজনের কথা বিশেষ করে মনে থাকার কারণ হচ্ছে ভার্সিটি থাকতে আমরা চার বন্ধু মিলে যখন প্রথম বাংলা উইকিতে কন্ট্রিবিউট করা শুরু করি তখন আমার বন্ধু মহিব রামানুজনকে নিয়ে লিখে একটা উইকি পদক পেয়েছিলো। সেটা দেখে আমরা সবাইই খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম। তোমার লেখা পড়ে সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
উইকি পেজটা তো বেশ সমৃদ্ধ! রামানুজনের সম্পর্কে নতুন সব তথ্য জানা গেল।
ধন্যবাদ জিহাদ ভাই শেয়ার করার জন্যে এবং সময় করে এই লেখাটি পড়ার জন্যে। 🙂
বাহ, জানা কাহিনী হলেও এমন ঝরঝরে ভাষায় জানতাম না। :thumbup: :thumbup: :thumbup:
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
অনুবাদ করার Temptetaion টা সামলাতে পারি নাই। 😛
ধন্যবাদ, ইশহাদ ভাই!
আরও Temptetaion আসুক 😀
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
তোমাকে ধন্যবাদ। পড়ে ঋদ্ধ হলাম । (সম্পাদিত)
আপনার অনূদিত ছোটগল্পের একটি সংকলন দ্রুত প্রকাশ করেন, লুৎফুল ভাই। প্লিজ।
আমার ধারনা, এটা সিসিবির অনেকেরই মনের ইচ্ছা। 😀
ইচ্ছে আছে স্থির। মধ্যপ্রাচ্যের এক গুচ্ছ ছোটোগল্পের অনুবাদ এক বই আর মৌলিক ছোটোগল্পের এক বই।
তবে তার আগে অন্য দুটো বই তালিকায় আগিয়ে আছে।
একটার কয়েকটা এখানে দিয়েছিলাম "প্রেম প্রণয় যদাপি দীপ্য বহমান | জীবন ঋতি নিয়ত ঋদ্ধিমান" শিরোনামে রম্য গদ্য।
আর অন্যটা অনেক দিন ধরে দেবো দিচ্ছি করছিলাম এ ব্লগে ওটা কাহিনীকাব্য "নাগর"। দেবো দেখি ক'টা আজ-কালই।
তোমার মন্তব্যে ত্বরান্বিত হলো মনে হয় ...
রামানুজন এর কীর্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম। চমৎকারভাবে তা তুলে ধরার জন্য তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ।
'অবাক বিস্ময়' কথাটি রামানুজনের মতো মানুষদের ক্ষেত্রেই যথার্থ।
সময় করে পাঠ করা ও উৎসাহ জোগানোর জন্যে আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।