“তিনি একজন কবি যিনি দার্শনিক তত্ত্বের চেয়ে বরং মৃত্যুর কাছাকাছি, বুদ্ধির চেয়ে বরং দুঃখের যন্ত্রণার কাছাকাছি, কালির চাইতে বরং রক্তের কাছাকাছি” — পাবলো নেরুদা সম্পর্কে এমনটিই বলেছিলেন ফেদেরিকো গার্থিয়া লোর্কা।
১৯৭১ সালে নোবেল বিজয়ী নেরুদাকে “আচ্ছন্ন করে তাঁর জন্মভূমি— অত্যাচারিত দিগ্বিজয়ীদের দ্বারা যে ভূমি ধর্ষিত হয়েছে বারংবার। নিজেকে তিনি নির্বাসিত করেছেন, অসংখ্যবার নির্যাতিত হয়েছেন, কিন্তু কখনো থামেন নি। অত্যাচারিতের সহযাত্রী তো সারা পৃথিবী জুড়েই। তাদেরই তিনি খুঁজেছেন এবং শেষে ধর্ষিত মানব মর্যাদার কবি হয়ে দাঁড়িয়েছেন”। তাই তো তাঁর কবিতা পাঠে আমাদের রক্তে যুগপৎ খেলে যায় প্রেম ও বিপ্লব।
নেরুদাকে প্রথম দেখি কলেজের পাঠাগারের একেবারে দোরগোড়ায় রাখা স্বচ্ছ কাঁচের পাল্লা লাগানো সেই আলমারিটিতে। ‘নতুন আগমন’-এর রাজটীকা ললাটে এঁটে গর্বিত দাঁড়িয়ে থাকা আলমারিটির বুকের পাঁজরে শোভা পেত রুপোলী ইলিশের মতো ঝকঝকে প্রচ্ছদ মোড়ানো সদ্য প্রকাশিত ও সুনির্বাচিত বইয়ের ঝাঁক। আলোর প্রতিসরণের অব্যর্থ নিয়ম মেনে সবুজ প্রিজমের বর্ণিল আত্মার মতো বিকিরিত হতো তার বুকভরা মণি-রত্নের অহংকার। তালাবন্ধ ছিল সেটি, তাই যক্ষের ধনের আপন সহোদরের মতই তাঁর ছিল কার্পণ্যের কুপমণ্ডুকতা। সেই স্পর্ধার বদ্ধদ্বার আমি খুলতে পেরেছিলাম। আর আলোয় আলোয় যেন ভেসে এসেছিল এক অপার আনন্দলোক। বাসর রাতের রোমাঞ্চিত প্রেমিকের মতোই কম্পিত হাতে আমি অবগুণ্ঠন খুলেছিলাম একটি আত্মজৈবনিকের।
অকাল প্রয়াত সাংবাদিক মোজাম্মেল হকের অসমাপ্ত অনুবাদ কর্মে, কিম্বা ভবানীপ্রসাদ দত্ত অনূদিত তাঁর ‘অনুস্মৃতি’-তে, অথবা ‘প্রাকৃতজন’-এ আনন্দময়ী মজুমদারের লেখা তিন অথবা চারটি কিস্তিতে, নেরুদার স্মৃতিকথার এইসব খণ্ড খণ্ড পাঠ আমাকে প্রতিকুল জীবনের আপোষহীন সংগ্রামী পাঠ বুঝতে শিখিয়েছিল। বুঝতে শিখিয়েছিল, নিরন্তর অনিশ্চয়তা ও শ্বাপদ-সঙ্কুল প্রতিবেশের মাঝে দমবন্ধ বসবাস করেও কবিতার রক্তমাখা ফুলেল সৌরভকে কিভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায় বৈপ্লবিক অন্বেষণে নিবেদিত জীবনের পরতে পরতে।
‘স্বীকার করি, বেঁচে আছি’- আহা, কি এক আর্ত উচ্চারণ! তবুও বিপর্যস্ত গোলাপ বাগানে, রক্তাক্ত বেলাভূমিতে, প্রেতের নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন সৈকতে এ এক কান্তা মুক্তকেশীর আগমনী গান। কোন এক বাদামী বিকেলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে প্রথম ওঁর কবিতা পড়বার সুযোগ হলো। রংপুরের লাইব্রেরী পাড়ায় ইষ্ট বেঙ্গল লাইব্রেরীর সত্ত্বাধিকারীর পাশে বসে। “পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ” ও “পাবলো নেরুদার আরো কবিতা” এই ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুদিত গ্রন্থ দু’টির নাম।
ইংরেজিতে নেরুদাকে পড়লাম আরো অনেক পড়ে। ওঁর একটি এন্থোলজী হাতে এসেছিল ২০০০ সালে, সম্ভবত: এপ্রিল কিম্বা মে মাসে। শিহরিত করবার মতো ছিল বইটির নাম “ফুল ওম্যান, ফ্রেশলি অ্যাপল, হট মুন : সিলেক্টেড পোয়েমস অব পাবলো নেরুদা”। ধীরে ধীরে ওঁর কবিতাকে ছুঁই। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি আরক্তিম আপেল, সোমত্ত নারী আর জ্বলন্ত চাঁদকে। দেখি কেমন বিমুগ্ধ আত্মমগ্নতায় শব্দের পর শব্দ সাজাচ্ছেন তিনি। জীবন্ত, স্পন্দিত, আরক্তিম সব শব্দ। ছলকে যাচ্ছে নরম নদীর নারীর মতো, ডানা ঝাপ্টিয়ে উড়ে যাচ্ছে দুরন্ত টিয়ের ডানায় লেগে থাকা থোকা থোকা সবুজ দিনের মতো, ভিজে যাচ্ছে সোমত্ত নারীর ঊরুসন্ধির সিঁথি বেয়ে নেমে আসা গ্লেসিয়ারের বরফ গলা জলধারার মতো।
ফেব্রুয়ারি ২০০৫ এ হায়াত মামুদের সম্পানদায় বেরুলো ‘শ্রেষ্ঠ পাবলো নেরুদা’। প্রচ্ছদে ধরা নেরুদার প্রস্তরীভূত আবক্ষ মূর্তি। সংকলিত কবিতায়, প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়, আত্মজৈবনিক রচনায়, সাক্ষাতকারে, নেরুদাকে নিয়ে বিদগ্ধ-মনন প্রবন্ধে, কিম্বা পরিশিষ্টতে সেঁটে দেয়া আরো চার বিবিধ লেখাতে নেরুদার একটি সামগ্রিক পরিচয় ফোটাতে চাইলেন তিনি। নেরুদাকে ‘অতিপ্রজ’ না বলে অভিসিক্ত করতে চাইলেন ‘ইচ্ছাপ্রজ’ অভিধায়।
ইতিমধ্যে বাংলা ভাষাতেও নেরুদা বহু প্রকাশিত হয়েছেন। আমাদের হাতের কাছে লভ্য হয়েছে তাঁর ইংরেজি অনুবাদ — আন্তঃজালে কিংবা ছাপার অক্ষরে। সময়ের স্রোতে সাম্পান ভাসাতে ভাসাতে আমরা এগিয়ে গেছি আধুনিক প্রপঞ্চের খরস্রোতা নদীটির ঘূর্ণাবর্ত দিয়ে। নিকটবর্তী হয়েছি অধুনান্তিক কালের। তবুও আমাদের অতীত থেকে আলো নিতে হয় ভবিষ্যতের পথ চলবার জন্যে।
তাঁর কবিতায় অনুভব করেছি, এক অনন্য জটিল স্যুরিয়ালিজমের প্রবাহ । অবিরল জলভ্রমনে আমাদের এই বোধ স্থির হয়েছে যে তিনি এক মহান কবি, ক্রমাগত নির্মোকের পর নির্মোক সরিয়ে শব্দের অপরূপ রূপ উন্মোচনে তিনি লাতিন আমেরিকার বর্ণিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতির মতোই সাবলীল ও সিদ্ধহস্ত। কখনো তাঁর শব্দের মিলিত ঝংকার সুউচ্চ আন্দেজের মতোই শক্তিধর আবার কখনো তারা চিলের (চিলির) জলে ধোয়া সৈকতের মতোই সৌকর্যে আধুনিক ও মুগ্ধকর।
অক্টোবর ১৯৭৩ এ ‘পাবলো নেরুদার কবিতা’ নামে একটি ক্ষীণাঙ্গিনী বই প্রকাশিত হয়েছিল প্রকাশ ভবন ঢাকা থেকে। সেখানে মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে পাবলো নেরুদার পনেরটি কবিতা জায়গা পেয়েছিল। বইটি ক্ষীণাঙ্গিনী হলেও দারুণ ছিল অনুবাদগুলো। পুরনো বই ঘাঁটতে গিয়ে সেটি আমি খুঁজে পেয়েছি। সেই কবিতাগুলো থেকে প্রেরণা ও সাহস নিয়েই নেরুদার অনুবাদে হাত দেয়ার ধৃষ্টতা। তাই অক্ষমতা ক্ষমার্হ।
জীবন ও সময় পাবলো নেরুদাকে অনেক অবিস্মরণীয় বিস্ময়কর মুহূর্তের মুখোমুখি করেছে। তাই তাঁর মতো প্রতিভাধর মানুষের এমন বড় মাপের কবি না হয়ে কি কোন উপায় ছিল? পাঠক, কোন মূল্যেই একটি কবিতা তাঁর বিশাল রচনা সম্ভারের প্রতিনিধিত্ব করে না, এ আমাদের জানা কথা। তবুও আসুন, আমরা নেড়ে চেড়ে দেখি আরক্তিম আপেল, সোমত্ত নারী আর জ্বলন্ত চাঁদকে। অথবা আমরাও জ্বলতে থাকি এক মোহন আগুনে।
(ইংরেজী অনুবাদ)
Carnal apple, Woman filled, burning moon,
dark smell of seaweed, crush of mud and light,
What secret knowledge is clasped between your pillars?
What primal night does Man touch with his senses?
Ay, Love is a journey through waters and stars,
through suffocating air, sharp tempests of grain:
Love is a war of lightning,
and two bodies ruined by a single sweetness.
Kiss by kiss I cover your tiny infinity,
your margins, your rivers, your diminutive villages,
and a genital fire, transformed by delight,
slips through the narrow channels of blood
to precipitate a nocturnal carnation,
to be, and be nothing but light in the dark.
এবারে আমার করা বাংলা অনুবাদ। আমি জানি যে আমি ইংরেজি অনুবাদটির কাছাকাছিও যেতে পারি নি। একটি তৃণ কতটুকু সবুজ বিলাতে পারে তা তো সে জানে। তার কি সাধ্য থাকে সবুজে সবুজে অশ্বত্থের মতো দিগন্ত ছাপিয়ে দেবার? শুনেছি হিস্পানি ভাষায় নেরুদা নাকি রক্তচক্ষু তারার মতো জ্বলজ্বলে।
আরক্তিম আপেল, সোমত্ত নারী, জ্বলন্ত চাঁদ,
সামুদ্রিক শৈবালের প্রগাঢ় গন্ধ, পিষ্ট কাদা ও চূর্ণ আলো,
কি গোপন প্রজ্ঞান লেপ্টে আছে তোমার সুকোমল দুই থামের মাঝে ?
কোন আদিম রাত্রির স্পর্শ পায় পুরুষ-চেতন ?
আহা, প্রেম সে এক মোহন ভ্রমণ জল আর তারার ভেতর,
দমবন্ধ বাতাসের ভেতর, শস্যকণার তীক্ষ্ণ ঝটিতি ঝড়ের ভেতর :
ভালবাসা হলো আলো জ্বালাবার যুদ্ধ,
আর এক মাধুরীতে মিশে গিয়ে দুটি দেহের ধ্বংস হয়ে যাবার খেলা।
চুমোয় চুমোয় আমি ছুঁয়ে যাই তোমার ছোট্ট অতল,
তোমার দেহপ্রান্ত, তোমার নদী, তোমার ছোট্ট গ্রাম,
আর আনন্দে রূপান্তরিত একটি যোনির আগুন,
সুগন্ধি এক নিশি উৎসবে অধঃক্ষিপ্ত হবার নেশায়
রক্তের সুচিক্কণ স্রোতধারায় পিছলে পিছলে যায়
আর অন্ধকারে শুধুই আলো হতে চায়।
অনেক দিন পর সিসিবিতে এলেন মোস্তফা ভাই। সুস্বাগতম। দারুণ এই লেখাটি পোস্ট করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল