আদিম অরণ্যের কাছাকাছি

উগান্ডার এন্টেবি বিমানবন্দর থেকে লেক ভিক্টোরিয়ার বিস্তীর্ণ জলরাশির উপর দিয়ে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে এল ছোট্ট আন্তনভ বিমানটি। ১০ অক্টোবর ২০০৯ সাল। কঙ্গোর মাটিতে প্রথম পা রাখলাম। আমার কর্মস্থল ইতুরি জেলার বুনিয়া শহরে। শহর বলতে তেমন আর আছেই বা কী! চল্টা ওঠা রানওয়ে সম্বল করে জীর্ণদশার একটি এয়ারপোর্ট। বুড়ো দারাস সাপের মতো প্রশস্ত কাঁচা রাস্তা। একটি কি দু’টি পুরনো বেলজিয়ান ধাঁচের বাংলো। আর রিলিফের নতুন টিনে ছাওয়া অসংখ্য ছাপরার বস্তি। কয়লার বাজার, পুরনো কাপড়ের হাট, কলা-আম-এভকার্ডের পসরা সাজিয়ে বসা মেয়েমানুষ, চায়নিজ মালে সয়লাব ফুটপাথ, ভ্রাম্যমান চটপটির দোকানের মতো খুচরো পেট্রোল বিক্রির অসংখ্য দোকান, হোগলার বেড়া ঘেরা একটি কি দু’টি নামমাত্র পানশালা, মোড়ে মোড়ে সওয়ারির অপেক্ষায় দাঁড়ানো দু-দশটি মোটরসাইকেল আর অসংখ্য হতভাগ্য মানুষ। এই হলো বুনিয়া।
প্রকৃতির দান বুঝি সব দৈন্য ছাপিয়ে যায়। লেক আলবার্ট থেকে উদ্বায়ী জলকণা আকাশের গায়ে চুমু খেয়ে বুনিয়ার বুকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নামে, প্রায় প্রতিদিনই। চারদিকে আরণ্যক প্রাচুর্য আছে। গায়ের দামাল ছেলের মতো অবাধ্য-স্বাধীন-বন্ধনহীন বেড়ে উঠেছে রেইন ফরেষ্ট। এদিকটায় একটু কম, তবে রিমোটে, গভীর এই বন বাতাসকেও আটকে রাখে একদম কঠিন শাসনে।
সবুজের পাহাড়ের পাঁচিল ঘেরা এই ছোট্ট শহরতলীতে একদিনেই ষড়ঋতুর খেলা। এই মেঘ, এই বৃষ্টি। আবার মুহূর্তেই ঝলমলে রোদ। ঝলমলে, কিন্তু প্রখর নয়। এমন রোদ আলতো আদরের পরশ বুলোয় গায়ে। চিত্তকে উৎফুল্ল করে তোলে লহমায়।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার ফুট উঁচুতে আছি, তবু যেন কিছুতেই নিজের মাথা উঁচু হচ্ছিল না, সে বিষয়ের আলোচনা থাক। আমরা বরং কোমল প্রকৃতির আর নির্ভার জলবায়ুর কথা বলে সময় কাটাই। এই অঞ্চলটি বিষুবীয়, তাই জলবায়ু প্রাকৃতিকভাবেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বোশেখের দহন নেই এখানে। রাতের শেষটায় মৃদু শীত, আমাদের শরতের মতো।

আফ্রিকার মানচিত্রের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত ইতুরি অরণ্য—এক বিশাল এলাকা, ঘন, স্যাঁতসেঁতে ও গেঁয়োদর্শন এক অন্ধকারের বিস্তৃতি দিয়ে ঢাকা। এই অরণ্যে আমরা যারা নতুন, যারা এসেছি খোলা প্রান্তরের দেশ থেকে—যেখানে এন্তার সূর্যের আলো ও উষ্ণতা— তারা প্রথম দর্শনে কখনোই এই অন্ধকারকে বুঝতে পারিনি।

অনেকেই যারা ইতুরিতে পরবর্তীতে গিয়েছেন কিংবা সেখানে থেকেছেন, তাদেরও অনুভূতি অনেকটা একই রকম—এক ধরনের চেপে ধরা ভার যেন সবকিছুর মধ্যে। জঙ্গলের গভীরে গেলে বুঝা যায়— স্যাঁতসেঁতে বাতাস, জলভর্তি বিশালাকার গাছ যেগুলো থেকে ক্রমাগত পানি ঝরে পড়ে—কখনোই পুরোপুরি শুকায় না। এই হয়ত রৌদ্রে শুকালো, শুকাতে না শুকাতেই আবার একঘেয়ে ঝঞ্জা এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। এখানের মাটিও আটকে যায় সামান্য বৃষ্টিতেই। তারচেয়েও বড় কথা,  দীর্ঘসময় ধরে এই নির্জন অরণ্যের ভেতর বান্ধবহীন একাকী বাস করলেই শুধু উপলব্ধি করা যায় এই জায়গার নিঃসঙ্গতা ও চিরকালীন দূরত্ব—এক ধরনের প্রাচীন নির্জনতা।

কিন্তু এসব অনুভব শুধুমাত্র আমাদের মতো বাইরের লোকদের, আমরা যারা এই অরণ্যের অন্তর্গত নই। কিন্তু আপনি যদি অরণ্যের নিজস্ব লোক হন, তাহলে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। যা অন্যদের কাছে চিরস্থায়ী ও দুঃখজনক অন্ধকার, তা আপনার কাছে হয়ে ওঠে শীতল, প্রশান্ত, ছায়াময় এক জগৎ। যখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাছগুলোর মাথায় সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে—যখন সেগুলো সূর্যকে ঢেকে রাখে। তারপর সবুজ ক্যানোপির ফাঁক গলে আলো-আঁধারির দারুণ এক অভিক্ষেপ তৈরি করে আলতো করে নামে। অথচ এই সূর্যই বাইরের দুনিয়াকে করে তোলে শুকনো, গরম ও ধুলায় ধূসর।

এমনকি এখানে নৈঃশব্দ্যই একটি ভ্রান্ত ধারণা। আপনি যদি কান পেতে শুনতে জানেন, তাহলে অরণ্যও আপনার কাছে পরিপূর্ণ নানা শব্দে—উত্তেজনাময়, রহস্যময়, বেদনাময়, আবার আনন্দদায়কও। হাতির তীক্ষ্ণ গর্জন, চিতাবাঘের গা শিউরানো কাশির শব্দ, এমন কত শত রকম শব্দ —এসবই আপনার হৃদয়কে খানিকটা হলেও কাঁপিয়ে দেয়, মনে করিয়ে দেয় আপনি একটু হলেও ভয় পেয়েছেন, হয়তো তারচেয়েও বেশি।

রাতে, মৌসুমী মধুর সময়ে, গাছের উঁচুতে শোনা যায় এক অদ্ভুত, দীর্ঘ, আত্মাভিমানী কান্নার শব্দ। মনে হয় যেন কো প্রাণী নিঃশ্বাস না নিয়েই অনন্তকাল ধরে কেঁদে চলেছে। অরণ্যের মানুষেরা বলেন, এটা গিরগিটির ডাক—ওরা জানিয়ে দিচ্ছে আশেপাশে মধু আছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলবেন, গিরগিটি এমন কোনো শব্দই করতে পারে না। কিন্তু পৃথিবীর বহুপ্রান্তের অরণ্যের লোকেরাও গিরগিটির এই সঙ্গীত চেনেন।

ভোরবেলায় শোনা যায় পায়রার করুণ আর্তি—একটা কোমল কুহুতান, যেটা উঁচু গ্রামের সুর থেকে অবরোহী হয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে, তারপর নিঃশব্দে মিশে যায় এক ম্লান, দুঃখভরা হাহাকারে।

যে কেউ— যদি কখনো ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টের নিঃসঙ্গ নির্জনতায় কান পেতে বহুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সে এই কথাগুলো বুঝতে পারবে। আমিও তার কিছু কিছু কল্পনায় জেনেছি। জেনেছি আপন মনের গহীন অরণ্যে কান পেতে।

আর জেনেছি, এই ইতুরিতেই আছে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা পিগমি মানুষ। আর আছে বিচিত্র বর্ণের মৌনপ্রিয় ওকাপির দল। শুধু ইতুরিতেই। আহা, কবে হবে দেখা…
পায়ে চোট পেয়ে বিছানায় পড়ে আছি বেশ ক’দিন। ইতুরিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের একটি ব্রিগেড থানা গেড়ে আছে বহুদিন থেকে। তাঁদের চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য জর্ডানের একটি লেভেল ২ হাসপাতাল। সতীর্থরা সেখানেই নিয়ে ফেলেছিল আমাকে। ওদের ভাষা কিছুমাত্র বুঝি না আমি। এক্সরে মতো কিছু একটা করলো, ফর্সামতো ডাক্তার এসে আলোয় ফেলে নেড়ে-চেড়ে সেটা দেখলো। তারপর কিছু বুঝতে না বুঝতেই তড়িৎ গতিতে পা প্লাস্টার করে দিয়ে, ওষুধ লিখে, হাতে ক্রাচ ধরিয়ে দিয়ে ছুটি দিয়ে দিল।
সেই থেকে অফিসে যাওয়া নেই। সারাদিন একটা কামরাতে পড়ে থাকা। কামরা তো নয়, নাট-বোল্ট দিয়ে জুড়ে দেয়া ইস্পাতের ফ্রেমে তৈরি লম্বা কাঠামো। মাঝে মাঝে প্রিফেব্রিকেটেড প্লাস্টিক বোর্ডের পার্টিশন দিয়ে ছোট ছোট কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। ইতালির করিমেক কোম্পানির তৈরি। হোন্ডা কোম্পানির মোটরসাইকেল যেমন আমাদের কাছে ‘হোন্ডা’ নামেই সুপরিচিত হয়েছে, ঠিক তেমনই এই গুচ্ছকক্ষদের লোকমুখে পরিচিত নাম ‘করিমেক’। আফ্রিকার এই দেশগুলোয় জাতিসংঘের ফিল্ড মিশনগুলোতে এটাই সবচেয়ে পোক্ত ব্যবস্থা। যাঁরা আরো রিমোটে থাকেন, ‘কোম্পানি অপারেটিং বেস’গুলোতে, তাঁদের তো দিনের পর দিন কাটাতে হয় জলপাই রং তাবুর ভেতর।
এগুলোরই একটাতে আমি শয্যা পেতেছি। সৌভাগ্যক্রমে ভাগ্যে জুটেছে সবচেয়ে ডান কোণেরটা। বাড়তি পাওনা জানালার পাশে একটি হাস্নুহেনার ঝাড়। আমাদের আগে যারা এখানে ছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে এনে লাগিয়েছিলেন। সংবেদনশীল মানুষ তাঁর প্রিয় জিনিসকে সর্বদাই বুকে করে রাখতে চায়।
ডাক্তারের কড়া নির্দেশ, লিগামেন্ট স্প্রেইন সেরে না ওঠা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে হবে তিন সপ্তাহ, পাক্কা বেড রেস্ট। হাঁটাহাঁটি বন্ধ। শুয়ে-বসে আর কত! হাতের নাগালে আছেই তো সবেধন নীলমণি একটা আইবিএম থিঙ্ক প্যাড আর ভীষণ ধীরগতির ইন্টারনেট। ব্রিগেডের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার কি হালহকিকত, সবিস্তারে খবর নাও। তারপর কী বোর্ডে হাত চালিয়ে ফোর্স হেড কোয়ার্টারের জন্যে অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট বানাও। বানানো হলে ফেলে দাও সেই শম্ভুকের ঘাড়ে, কখন সে টেনে টেনে গন্তব্যে পৌঁছুবে সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমার আছে ডাক্তারের দেয়া ‘সিক ইন কোয়ার্টার’-এর জোর। তাই সে কাজটিও নেই আপাতত। অন্যদিকে হাঁটা বারণ, কায়িক পরিশ্রম নেই, তাই গভীর ঘুমও নেই রাতে।
ইনবক্সে তেমন ইমপর্টেন্ট ইমেইল নেই। সাইন আউট করে বাইরে এসে দেখি, ফিকে হয়ে আসা ছিন্ন সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে যাচ্ছে নিটোল পূর্ণ চাঁদ, জ্যোৎস্নার বেনোজলে ভেসে ভেসে। আজ পুর্ণিমার রাত, সন্ধ্যে থেকেই ছিল মেঘমুক্ত নীল আকাশ, এখন বিচ্ছিন্ন কিছু মেঘ করেছে। চাঁদের ওলান থেকে জ্যোৎস্নার দুধ নেমেছে চৌদিকে। ভেসে যাচ্ছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্থাণু পাহাড়ের পাঁচিল, কালচে রং উপত্যকা, উঁচুনিচু বিস্তীর্ণ প্রান্তর। চারদিক নিঝুম-নিশ্চুপ। থেকে থেকে ভেসে আসে একটি-দু’টি পাখের আওয়াজ।
এমন মায়াবী পরিবেশে নিজেকে রূপকথার সেই জ্যোৎস্নাভূক পাখি বলে মনে হয়। কাছেই উঠোনে একটা ইজিচেয়ার রাখা। ক্রাচে ভর করে সেখানে এসে দেহ মেলে দিই। তারপর কিছুটা জ্যোৎস্না পান করি। জ্যোৎস্না লেগে আছে মোমের মত মেঘের গায়ে। আরো কিছুটা সময় কাটে চন্দ্রাহত হয়ে। বাইরে একটু একটু শীত পড়ছে। এখন মেঘ জমছে দ্রুত। বৃষ্টি হবে নাকি? কালই তো হলো!
ঘরে ফিরি। ভাঙ্গা পা আর অলস দেহ নিয়ে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিই, ওষুধ খেতে হবে। পেইন কিলার আর ঘুমের বড়ি। একটু চোখটা ধরে এসেছিল। বড়ির দয়ায় পাওয়া ঘুমের ঘোর হয়তো। ঝুমবৃষ্টির শব্দে ঘুম কেটে গেলো রাত চারটায়। মায়ের নিজ হাতে বুনে দেয়া একটা কাঁথা নিয়ে এসেছি আমি। বিছানায় পায়ের কাছটায় ভাঁজ করে রাখা থাকে সেটা। ঘুম ঘুম চোখে হাতের আন্দাজ খাঁটিয়ে কাঁথাটাকে গায়ের ওপর টেনে নিই। এবারে খুবই আরাম লাগছে। বুঝতে পারি, ঘুমিয়ে গেলে আরাম চলে যাবে। তাই জেগে থাকবার চেষ্টা করি।
একটু পরেই শুরু হলো বৃষ্টির টাপুর-টুপুর। জাল লাগানো জানালার বাইরে গাছের পাতায় পাতায় শাখায় শাখায় বৃষ্টির গান। সেইসাথে এলোমেলো বাতাসের আনন্দিত দোদুল দোলা। ফোমের আস্তরণ দেয়া করিমেকের প্লাস্টিকের চালে বর্ষণের শব্দ। শজারুর কাঁটার মতো টিনের চালে বাজতে থাকা ঝমঝম শব্দ নয়; হারমোনিয়ামের নিচু রীডে বাঁধা সুর। পুষি বেড়ালের আদর-নরম গায়ের মতো। কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসার কোন মানেই হয় না এখন, তাতে ঘোর কেটে যাবে। তারচে’ বরং মনে মনে লিখি। বৃষ্টি যেন জলসাঘরের নিপুণ নর্তকী। অনেকক্ষণ মন লাগিয়ে তাঁর নিক্কন শুনি। নিজেই নিজেকে মনে মনে কত কথা বলি।
আবার দরজা খুলে ঘরের সিঁড়িতে এসে বসি। বারান্দা নেই, ঘরের চাল একটু সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়া; এটুকু টিনের। বর্ষণে সবকিছু ভিজে যাচ্ছে, শুধু ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো ছাড়া। সবক’টি গাছের শাখা ও পত্রপল্লব সদ্যই যেন স্নান সেরে শুচি হয়েছে। ভিজে যাচ্ছে দূর্বাঘাসে ঢাকা সবুজ লন। একটি রসিক কুনোব্যাঙ লাফাতে লাফাতে এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল।
এখানে না এলে পরিমিত জলসিঞ্চনে রেইন ফরেষ্ট কিভাবে বেড়ে ওঠে সজীব হয়, পুরোপুরি বুঝে ওঠা হতো না আমার। সংবেদনশীল মানুষেরও মন বুঝি এমনই। পরিমিত ভালোবাসায় নতুন করে বিকশিত হয়।
কাল সারারাত যে নকটার্ণ বেজেছিল মনের গভীরে, একটু বেলা করে তার রেশ নিয়ে ঘুম থেকে উঠি। পুবের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি, সূর্য অনেকটাই উঠে গেছে ওপরে। তবুও এখনো তার নরম আলোর রোদ। একটা অপার স্নিগ্ধতা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ক্র্যাচে ভর দিয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াই। টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে নিয়ে প্রক্ষালয়ের দিকে এগিয়ে যাই। সহকর্মীরা সবাই অফিসে চলে গেছে। ক্যাম্প ফাঁকা সুনসান। কেবল থেকে থেকে অনতিদূরের বার্তা-কক্ষ থেকে সিগন্যাল অপারেটরের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, “হ্যালো, এক তিন, হাউ ডু ইউ হিয়ার মি, ওভার?”
যে ক্যাম্পটায় আমরা আছি, তার নাম ক্যাম্প এন্ড্রোমো (Camp Ndromo)। এই নামের উৎপত্তি জানিনা। তবু তার কিছু ইতিহাস জানি। অনেক রক্তের স্বাক্ষর নিয়ে চারদিকে উঁচুনিচু পাহাড়ের পাঁচিল ঘেরা এই নাবাল টিলা দাঁড়িয়ে আছে। ইতুরিতে প্রথম যুদ্ধ বেঁধেছিল ১৯৭২ এ। হেমা আর লেন্দুদের মাঝে। এই যুদ্ধ তীব্র হয়ে ‘সেকেন্ড কঙ্গোলিজ ওয়ার’-এ পরিব্যাপ্ত হয় ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। এখন এর তীব্রতা কমে এসেছে; তবু মাঝে মাঝে ছাড়া ছাড়া সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই হুট করে জ্বলে উঠে বিদ্বেষের বারুদ, মারণাস্ত্রের বিভ্রান্ত গুলি ছোটে এদিকে ওদিকে। সেজন্য এখানের মিশন ‘চ্যাপ্টার সেভেন’ এর আওতায়। শান্তি রক্ষাই শ্রেয়, যদিও শান্তি আরোপ অনুমোদিত। শান্তিরক্ষীদের তাই ব্যক্তিগত কিংবা দলগত আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে অস্ত্র বহন ও ব্যবহারের অধিকার থাকে।
(According to the Charter, UN peace missions rely on Chapter VI mandates for the pacific settlements of disputes. Chapter VI is accorded to assist the conflicting parties by “seeking a solution by negotiation, enquiry, mediation, conciliation, arbitration, judicial settlement, resort to regional agencies or arrangements, or other peaceful means of their own choice”. (Article 33 of Chapter VI) If a conflict cannot be resolved in a peaceful way and the Security Council (SC) determines “the existence of any threat to the peace, breach of the peace or act of aggression”, the UN will rely on Chapter VII “to maintain and restore international peace and security”. Before immediately resorting to the use of armed force, the Organization will attempt to resolve the threat by applying a “complete or partial interruption of economic relations and of rail, sea, air, postal, telegraphic, radio, and other means of communication, and the severance of diplomatic relations”. (Article 41 of Chapter VII) The use of armed force by air, sea or land, demonstrations or blockades are last resort measures. (Article 42) Deployed under Chapter VII, peacekeepers have “the right of individual or collective self defence if an armed attack occurs”.)
যখন কঙ্গোর জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সদস্য নির্বাচিত হলাম, তখন আমি চট্টগ্রামে। জাতিসংঘ মিশনে কাজ করবার এটাই আমার প্রথম সুযোগ ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ২০০২ সালে, সিয়েরালিয়নে। সিয়েরালিয়নের জাতিসংঘ মিশনের লক্ষ্য ছিল ‘শান্তি রক্ষা’ আর এই মিশনের লক্ষ্য ‘শান্তি আরোপ’। এরমধ্যে বহু সময় পেরিয়েছে। বেড়েছে আমার বয়স, পদমর্যাদা ও অভিজ্ঞতা। লক্ষ্য করলাম, যে পদে নিযুক্ত হতে যাচ্ছি, সে পদে কাজের ব্যাপ্তি অনেক বেশি।
কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ফোর্সেস হেড কোয়ার্টারস দেশটির পশ্চিম কোণে রাজধানী কিনশাসায় অবস্থিত। আর আমরা যেখানে আছি, সেটি আফ্রিকার ঠিক হৃদয় বরাবর, ইতুরি প্রদেশের বুনিয়া শহরে। সেখানে এই বাহিনীর একটি ব্রিগেড সদর দপ্তর। বুনিয়া ইতুরি প্রদেশের রাজধানী। অতীতে ইতুরি প্রদেশ ছিল ‘কিবালি-ইতুরি’ নামে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। তারপর সে মর্যাদা হারিয়ে ওরিয়েন্টাল প্রদেশের অন্তর্গত হয়ে পড়ে। আবার ২০০৬ সালে কঙ্গোর ২৬ টি প্রদেশের একটি হয়ে ফিরে পায় হারানো মর্যাদা। সে সূক্ষ্ম রাজনীতির কথা এখনই বলা নিষ্প্রয়োজন। ইতুরি প্রদেশের নামে এই ব্রিগেডের নাম ‘ইতুরি ব্রিগেড’। তবু ব্রিগেডটি পুরনো ওরিয়েন্টাল প্রদেশের পুরো এলাকার শান্তি আরোপের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
ছেলেবেলা থেকে জঙ্গলের ভীতিকর, রোমাঞ্চকর, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা গল্পের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। তবু সহসা অরণ্যে গিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা আর অরণ্যের অংশ হয়ে অরণ্যের ভেতরেই বেড়ে ওঠার মাঝে নিশ্চিত বহু পার্থক্য আছে। জলের মাছ ডাঙ্গায় উঠে এলে কিম্বা ডাঙ্গার মানুষ জলে তলিয়ে গেলে যেমনটি হয়, সহসা অরণ্যে গিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা অনেকটা তেমনই। সেই অভিজ্ঞতার ভেতরে রোমাঞ্চ আছে, ভীতি আছে, আশঙ্কা-আশ্রয়হীনতা আছে, আছে অসহনীয় শূন্যতা। বিস্তৃত, ঘন, স্যাঁতসেঁতে, শ্বাপদ-সংকুল অরণ্য। সেখানে পদে পদে বিপদের হাতছানি।
ধরুন, ইতুরির রেইন ফরেস্টের মাঝখানে আপনি আচমকা গিয়ে পড়লেন সহায়-সম্বল-সংগী বিহীন। ঘন অরণ্যের ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে আটকে আছে সবুজ-স্যাঁতসেঁতে বাতাস। বিশাল বিশাল জানা-অজানা ঘন সন্নিবিষ্ট অসংখ্য বৃক্ষের সমাহার সেখানে। প্রত্যেকটির মাথার ছাতা পরস্পরের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে তৈরি করেছে বিশাল এক ক্যানোপি। সূর্যালোককে আটকে দিয়ে ঘনিয়ে তুলেছে অসহনীয় আদিম অন্ধকার। ক্রমাগত জলধারা নেমে আসছে বৃষ্টিস্নাত গাছগুলির লম্বা শরীর বেয়ে। সেই জল মিশে গিয়ে ভারী মাটিকে করে তুলছে ভীষণ আঠালো, কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল। আপনার পা পিছলে যাচ্ছে সে মাটিতে। এগুতে পারছেন না এক পা-ও। জুতোর সোলে পিচ্ছিল আঠার মতো আটকে আছে, লেপটে আছে সেই মাটি। কী একটা বিচ্ছিরি অবস্থা! তারপর ক্রমশ সন্ধ্যা সমাগত। এরই মধ্যে নীরব শূন্যতায় দাঁড়িয়ে ভারী হয়ে উঠেছেন আপনি। হিংস্র বেবুনের মতো লাফিয়ে নামছে অন্ধকার। আধিভৌতিক লাগছে সবকিছু। পিলে চমকিয়ে দিচ্ছে এদিক-ওদিক থেকে ভেসে আসা নাম না জানা সব পাখের আওয়াজ। এই নিঃসঙ্গতা, এই একাকীত্ব সহ্য করা ভীষণ কঠিন।
অথচ যদি আপনি এই অরণ্যের মাঝেই মোগলির মতো বেড়ে উঠতেন? জলের মাছের মতই অরণ্যের সবুজে আপনার হতো স্বচ্ছন্দ সাঁতার। কেমন নির্ভার হত, কেমন শান্তিময় হতো আপনার জীবন!
কঙ্গোর সাথে আমার প্রথম পরিচিতি বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট হার্জের ‘এডভেঞ্চার অব টিনটিন ইন কঙ্গো’-এর মধ্য দিয়ে। অবশ্য ‘বেলজিয়ান কঙ্গো’ আর কিং লিওপল্ডের হাত ধরে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের ইতিহাস জেনেছি তারও অনেক পরে। যখন জেনেছি, তখন পরিষ্কার হয়ে গেছে ‘এডভেঞ্চার অব টিনটিন ইন কঙ্গো’ প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য। মোক্ষম সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সুচতুর ভাবে শিশুকাল থেকেই আপনার মস্তিষ্ক দখল করে নেবে। আপাত নিষ্পাপ প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে আপনি ভুল বুঝবেন আপনার নিজের মানুষদের। ভাববেন, এঁরা শুধু নিজেদের মধ্যে সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে কলহ-বিবাদে লিপ্ত হয়। সাদা চামড়ার বহিরাগতরা দেবতাতুল্য, তাঁরা নিঃস্বার্থ পরোপকারের তাগিদে নিবেদিত হয়ে মানুষ বাঁচায়।
(Tintin becomes a hero in the village, and a local woman bows down to him, saying, “White man very great! Has good spirits … White mister is big juju man!”)
যাহোক, ক্ষীণ শক্তি সম্বল করে নীতির চ্যালা হয়ে কাজ নেই। মেস ওয়েটার টেবিলে নাস্তা ঢেকে রেখে গেছে। দেরি করে প্রাতঃরাশ। ভাঙ্গা পা টেনে টেনে রুম থেকে আবার বেরুই। আঙ্গিনায় গিয়ে বসি। সামনে বিস্তীর্ণ ফুটবল খেলার মাঠ। শজারুর গায়ের কাঁটার মতো উঁচু উঁচু ঘাসে ঢাকা। এ ঘাস বাড়েও বড় বেশি। এখন এই মাঠ খেলাধুলার পাশাপাশি সৈনিকদের শরীরচর্চা ও প্রশিক্ষণেও ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই এই ঘাসের দস্যিপনা প্রতি হপ্তায় কেটেছেটে ঠিক রাখতে হয়। মাঠের সবুজে আমার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে। সেখানে কাজ করছে দু’জন তারুণ্য ছুঁই ছুঁই লেন্দু কিশোর। কাঁচি হাতে অবিরাম কেটে যাচ্ছে ঘাসের বাড়। চিক চিক করছে ঘামে নেয়ে ওঠা পেশীবহুল সমর্থ শরীর। এবোনি কাঠে খোদাই করা প্রমেথেউস যেন। ক্যাম্প ফাঁকা, ভাবলাম এই সুযোগে একজনকে ডেকে নিয়ে গল্প করি।
ইব্রাহিম সাসা তার নাম। অনেক আনুগত্যের পরীক্ষা দিয়ে তবেই এ ক্যাম্পে কাজ পেয়েছে। এই নিদারুণ মঙ্গার দিনে পেট-চুক্তিতেই রাজি ছিল, কোম্পানি কমান্ডার দয়াশীল হয়ে অল্পকিছু বেতনও দিচ্ছে। মেসের বেঁচে যাওয়া খাবার উপরি। এমনকি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মাস শেষে উদ্বৃত্ত থেকে যাওয়া প্রচুর রেশনের চিলতে খানিকও মিলে যায়। তাতেই তার অনেক হয়ে যায়। ইব্রাহিম সাসার কাছ থেকেই আমি প্রথম অরণ্যের কোলে বেড়ে ওঠা পিগমিদের তার চোখে দেখা জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তব তথ্য পাই।

পায়ের চোট সারতে সারতে পিগমি আর ওকাপি দেখার দিন পিছিয়ে গেল। ভ্রমণ-পিপাসু মন দিনের বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনের গলিপথে ঘুরে ঘুরে সময় পার করে। মাঝে-মধ্যে অফুরন্ত বিশ্রাম যখন অসহ্য মনে হয়, তখন ক্রাচ বগলে দাবিয়ে একটু আধটু হাঁটতে চেষ্টা করি। প্রায়শঃই প্লাষ্টার করা পায়ের জায়গায় জায়গায় চুলকোয়। কিন্তু ইচ্ছে করলেও একটু চুলকিয়ে সুখ নেবার উপায় নেই। দফায় দফায় মেস ওয়েটার রুমেই ট্রে-ভর্তি খাবার দিয়ে যায়। এক দফা না ফুরোতেই আরেক দফা। কোন নিষেধ মানে না। বিরক্ত হলে গাম্ভীর্যের আবরণে আন্তরিকতা লুকিয়ে বলে, “না খাইলে শইল্লে বল পাইবেন কেমতে?” দেহের স্থুলতা বাড়ে, কিন্তু মন তার যথোপযুক্ত রসদ না পেয়ে শীতে ফাটা ঠোঁটের মতো ক্রমশ বিশীর্ণ চৌচির হয়। তবে যত্ন-আর্তি পেয়ে পায়ের চোট ভ্রুতই সেরে ওঠে।

পায়ের চোট সারলো, কিন্তু অরণ্যে যাবার আর যুতসই মওকা মেলে না। কাজের ব্যস্ততা বাড়ে। যুদ্ধবিরতির হালহকিকত পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নতুন দায়িত্ব আসে। ঝুঁকির প্রান্তদেশে অবস্থান নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজে নিজেকে জড়াতে হয়। যে কোন মূল্যে ‘প্রটেকশন অব সিভিলিয়ান’- এই হলো ম্যান্ডেট। আমাদের ব্রিগেড থেকে নতুন নতুন অপারেশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সেখানে ব্রিগেড কমাণ্ডার ও তার স্টাফগণ অহোরাত্র কাজে ডুবে থাকেন। আমি ব্রিগেডের চীফ জি সিক্স। আমার দায়িত্ব প্রতিটি অপারেশনে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অধস্তন সিগন্যাল কোম্পানীর সুচারু কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা। গভীর জংগলে বেতার যোগাযোগ স্থাপন ও নিশ্চিত করা একটি রীতিমত চ্যালেঞ্জিং কাজ। সেইসাথে আছে যুদ্ধরত পক্ষগুলোর ক্রসফায়ারের মাঝে অবস্থানের ঝুঁকি। তাই শুধু মার্কনী কিম্বা স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু হলেই চলে না, পাহাড়ে-জঙ্গলে ফিল্ড ট্রেনিং এক্সারসাইজ করবার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতাও থাকতে হয়। অপারেশন ও লজিস্টিক প্ল্যান দুই-ই যখন প্রায় চুড়ান্ত, মূল টেলিযোগাযোগ পরিকল্পনার পাশাপাশি আমি একাধিক বিকল্প টেলিযোগাযোগের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবি। স্থানীয় নির্ভরশীল উৎসের সন্ধান করি। এনজিও কিংবা অন্যান্য সহযোগী সংস্থার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার খোঁজ-খবর নিই।

একদিন এমনি করেই পরিচয় হয় একজন ডাব্লিউএফপি কর্মীর সাথে। গল্পে গল্পে একদিন সে আমাকে বুনিয়া ছেড়ে পশ্চিমে খানিকটা দূরে একটি রিফিউজি ক্যাম্প দেখাতে নিয়ে যায়। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য! অনাহারী মানুষগুলোর জয়নুলের আঁকা মন্বন্তরের ছবির মতো সে কী জীর্ণ দশা! চামড়া শুকিয়ে গিয়ে মুখবিবরের-পাজরের-জংঘার-পায়ের প্রতিটি হাড়ের গায়ে চেপে বসেছে; এ তো খুব সাধারণ দৃশ্য। বীভৎস যা, তা হলো কারুর আঙ্গুল কাটা, কারুর নাক কাটা, কারুর বা চোখ উপরে ফেলা, কারুর পুরো একটি হাত অথবা একটি পা। বিধাতা যা দিয়েছেন মানুষ তা কেটে নিয়েছে। ভিন্ন বর্ণের ভিনজাতির মানুষ নয়, নিজেদের বর্ণের নিজেদের দেশের মানুষ। রিফিউজি ক্যাম্পের প্রতিটি কান্না হৃদয়ের তন্ত্রীকে ভিন্ন ভিন্ন করুণ সুরে বাজায়। তবুও চালানের পর চালানে অস্ত্র আসে। নির্বোধ মানুষগুলোর হাতে শোভা পায় নতুন নতুন কালাশনিকভ। চেইনে লাগানো বুলেট-কার্তুজ-গুলি বুকের উপরে অলংকারের মতো আড়াআড়ি সাজিয়ে তরুণ যোদ্ধার দল অলীক প্রশান্তি ও আত্মধ্বংসী আত্মম্ভরিতায় ক্রূর থেকে ক্রূরতর হয়ে ওঠে। কালাশনিকভ থেকে ছুটে যাওয়া বুলেটের আওয়াজ তাদের কাছে নিখিলের সকল শব্দের চাইতেও প্রিয় হয়ে ওঠে। বারুদগন্ধী আকাশে চোখ মেলে দেখি, বিষণ্ন পায়রাগুলি উড়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও…
১০
অযাচিতভাবে সুযোগটা চলে এলো। বুনিয়া বিমানবন্দর থেকে একটি রোটারি উইং উড়ে যাবে ইপুলুর উদ্দেশ্যে। রেকি মিশন। খবর পেয়েই দে ছুট! ‘মুভমেন্ট অব পারসোনেল’ সংক্ষেপে ‘এমওপি’ করাতে হবে, ‘প্যাক্স লিষ্টে’ নাম ওঠাতে হবে। ব্রিগেডের চীফ জি ওয়ান এসব নিয়ে মহা ব্যস্ত। বুনিয়া লজিস্টিক বেসের অগাস্টিনের সাথে খাতিরটা এবার কাজে লাগল। ঝটপট এমওপি এপ্রুভ হলো। আমি ব্রিগেডের চীফ জি সিক্স অর্থাৎ চীফ কমিউনিকেশন অফিসার। সুতরাং ব্রিগেড কমাণ্ডারের নির্দেশ মতো চীফ জি ওয়ান আমার নাম প্যাক্স লিষ্টে অন্তর্ভূক্ত করবেনই। তাই নিজে থেকে প্যাক্স লিষ্টে নাম ওঠানো নিয়ে তেমন আর চিন্তা না করলেও চলছে।
১১
দীর্ঘদিন ধরে বুনিয়া বিমান বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ওপর ন্যস্ত। নিজের দেশের এয়ার ক্রাফট ও পাইলটদের দেখে গর্বে বুক ভরে ওঠে আমার। এই যন্ত্রবিহঙ্গ আমাদের দেশের। উড়িয়ে নিয়ে যাবে আমাদের দেশের তরুণ বৈমানিক। কন্ট্রোল টাওয়ার, রানওয়ে, টারমাক, এয়ারফিল্ড সিকিউরিটি, সবখানে আমাদের দেশের দৃপ্ত পদচারণা। এই বিমানেই আমার জায়গা হচ্ছে। যাত্রা শুরুর আধঘন্টা আগে ‘চেক ইন টাইম’। সময়মতো হাজির হলাম। রেকি মিশনের অন্যান্য সদস্যগণও এসে পড়েছেন। কম্ব্যাট ইউনিফর্মে সুসজ্জিত তাঁরা। সংগে আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি। এই মিশনের নেতৃত্ব দেবেন স্বয়ং ইতুরি ব্রিগেড কমান্ডার। তিনিও বাংলাদেশী। একে একে সবাই কপ্টারের পেটে সেঁদিয়ে দিই নিজেদের। এঞ্জিনের শক্তিতে পাখাগুলি ঘুরতে শুরু করে, মাটিতে বাতাসের চাপ বাড়িয়ে সামান্য দোলা দিয়ে শূন্যে ভেসে ওঠে বিশাল যান্ত্রিক পাখি। আমাদের যাত্রা হলো শুরু…
(চলবে)
৩ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।